মৃদুল মাহবুব। কবি। জন্ম: ৯ অক্টোবর, ১৯৮৪। কবিতার বই: জল প্রিজমের গান (২০১০), কাছিমের গ্রাম (২০১৫), উনমানুষের ভাষা (২০১৭)।
প্রকাশিতব্য বই: কবিতা বিষয়ক গদ্যের বই প্রকাশিত হবে ২০১৯ এ। দর্শনের সমকালীন ব্যবহারের উপর অতাত্ত্বিক আলোচনা মূলক একটা বই লেখা আগাচ্ছে। ২০২০ এর বইমেলায় প্রকাশিত হবে।
কবির একটি সাক্ষাৎকার নেবার উদ্দেশ্যে আমরা তাঁকে ই-মেইলে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তারিখে তিনি যে উত্তরমালা পাঠিয়েছে, তা হুবহু প্রকাশ করা হলো। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। -সম্পাদক। ]
‘সাহিত্য দুর্বোধ্য ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এগুলো অপাঠকদের অভিযোগ, যারা দুনিয়ার কোন শিল্প-সাহিত্যের খোঁজ রাখে না’
—————————————————কবি মৃদুল মাহবুব
সা ক্ষা ৎ কা র
❑❑
প্রশ্ন
ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন? মানে ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় কী লিখেছেন, তা নয়; বরং মনের ভেতরে সুপ্ত বাসনা ছিলো কি কোনো কিছু হবার জন্য?
মৃদুল মাহবুব
এই ‘হতে চাওয়ার’ নানা পর্যায় আছে মনে হয়। বয়স, সময়, সামাজিক বাস্তবতা ও চলমান ট্রেণ্ড, অর্থ-রাজনৈতিক কারণে তা নানা ভাবে বদলায়। সেই হিসাবে শিশুকালে একটা নিম্নমধ্যবৃত্ত ঘরের সব সন্তানদের একই রকম চাওয়া থাকে। মধ্যবৃত্ত ও উচ্চবৃত্তের সন্তানদের শিশুকালের চাওয়ার মধ্যে পার্থক্য থাকে দেখবেন। ফলে, নিম্নমধ্যবৃত্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে শিশুকালে কখনো কটকটি বা হাওয়াই মিঠাই বা আচার বা সিঙ্গারা বিক্রেতা হতে চেয়েছি যেহেতু এই সমস্ত চাইলেই পাওয়া যেতো না। এই ইচ্ছা পূরণের পারিবারিক সক্ষমতা সর্বদা ছিলো না সেই সময়। স্কুলে এইট বা নাইনে থাকাকালে বাংলাদেশ যখন আইসিসি ওর্য়াল্ড কাপ জিতলো তখন ক্রিকেটের ট্রেণ্ড। ক্রিকেটার হওয়ার কসরৎ করেছি বেশ কয়েক বছর। এবং বুঝতে পেরেছি ও আমি হতে পারবো না। কলেজে বা ইউনিভার্সিটির পুরাটা গিয়েছে কবি বা লেখক হয়ে ওঠার স্বপ্নে। আমি এই সময়ে লেখকইবা হয়ে উঠতে চাইলাম কেন? আমি ভাবি। নিজেকে সাইকোঅ্যানালিনিস করে দেখতে চাই এখনো মাঝে মাঝে। আমার যে কোন সামাজিক আচরণের কোর ভ্যালুগুলো কী কী? এই অ্যানালাইসিসের গুরুত্ব আছে। আমার সময়ের শিল্প সাহিত্যেও উদ্দেশ্যটা বোঝার যায় অনেকটা নিজেকে দিয়ে। আমি স্কুল পার করেছি ২০০০ সালে। কলেজ ইউনির্ভাসিটি ২০০১ থেকে ২০০৭ বা ০৮ এর মধ্যে। এই সময়কালে দেখেছি একজন লেখক বা বিশেষত কবিরা সমাজিক ভাবে খুবই সিগনিফিকেন্ট, প্রিভিলেজড ও অতি সুবিধাবাদি। লেখক এক আপোষহীন সত্ত্বা, সংগ্রামী, অমোচনীয় ইত্যাদি যে প্রত্যয় আছে তা নির্জ্জলা মিথ্যা। লেখক এখানে একটা সামাজিক সুবিধা আদায়ের চর্চা। আপনি হয়তো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখক হতে চান। কিন্তু লেখকত্বের উপর মহত্ব আরোপন উদ্দেশ্যমূলক। এটা বোঝা যায় না। দুনিয়ায় এমন অনেক আচরণ আমরা করি, অনেক কিছু সিলেক্ট করি যা আদতে খুব ভালো মনে হলেও তার গভীরতায় রয়েছে ক্ষত। দুনিয়ায় অনেক আচরণ আছে যা আমরা না জেনেই করি। সেই অনুন্নত, লিমিটেড মিডিয়ার যুগে আপনার ঘরে লেখক নামে যারা পৌঁছতো তারা সকলেই সামাজিকভাবে প্রিভিলেজড, পাণ্ডা। রাষ্ট্র ও ক্ষমতায় তাদের ভূমিকা আছে। একজন ভালো ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার থেকে দৃশ্যমাল সাফল্য ও গুরুত্ব একজন লেখকের বেশি। মানুষ তো বিশেষ হয়ে উঠতে চায় তার সামাজিক অবস্থান বদলের জন্য। সেই হিসাবে ঝিনাইদহের মত মফস্বলে বসে বাংলা ভাষার লেখক হয়ে ওঠা খুবই লাভজনক একটা স্যোসাল স্ট্যাটাস। আমি লেখকত্ব ব্যাপারটা না বুঝেই লেখক হতে চেয়েছি। তার প্রচ্ছন্ন কারণ এগুলো থাকতে পারে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, গবেষক হওয়া থেকে কবি কোন ছোট ব্যাপার না। এবং আমাদের লেখকরা লেখক হয়ে ওঠার প্রেরণাটাকে অস্বীকার করে নিজেদের উপর মহত্ব আরোপ করে। ‘স্ট্যাণ্ডার্ড লেখক’ ধারাণা ও ‘বাস্তব লেখক’ ব্যক্তিত্বেও মধ্যে পার্থক্য আছে। ফলে, লক্ষ্য করলে দেখে থাকবেন, ছোটবেলায় লেখক হয়ে ওঠার অপ্রকাশিত কারণটাই লেখকরা পরবর্তী লেখক জীবনে বহন করে চলে। নানা রকম আপোষ, তোষামোদ, অর্জনের ভেতর দিয়ে অনেক লেখককে জীবন বাহিত করতে হয়। এই সমস্তের কারণ হয়তো সেই শৈশবের লেখক নামক নায়কেরা যারা নিজেদের কবরের এপিটাফে লিখি গিয়েছে ব্যক্তির সাফল্যের জয়গান। ফলে, আমরা অনেকেই তেমনই লেখক হতে চাই যারা প্রিভিলেজড, ক্ষমতা-কাঠামোর সেবক। একইভাবে বিপ্লবী লেখকরা খুব বেশি বিপ্লবী না, ক্ষমতাকে ক্রিটিক্যালি দেখে না। তারা প্রতিবিপ্লবী, তোষামোদী লেখকদের মতই। মানে তারাও আত্মউন্নয়নের জন্য সমাজিক বিপ্লবটা দাবি করে। সেই দাবিতে তারা জনস্বার্থের ভেইলটা আরোপন করে ক্ষমতা বিরোধী পক্ষের প্রিভিলেজড অংশে থাকতে চায়। ফলে, গোলআলু লেখক ও প্রতিবিপ্লবীর ভান ধরা লেখক দুই নানা চর্চাও ভেতর দিয়ে হয়ে উঠতে হয়। আহমদ ছফা থেকে শুরু করে আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক দিয়ে এই কালের ফরহাদ মজহার বা সলিমুল্লাহ খান যাকেই আপনি দেখেন না কেন তারা সমাজে প্রিভিলেজড, বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবী। সমাজের বিরাট কোন ভ্যালুকে তারা ততটা পুস করেছে যতটা নিজেদের আগ্রবর্তী করতে পেরেছে। ফলে, এই কালে লেখকের এইম ইন লাইফ হলো আলাদা পার্সন হয়ে ওঠা স্যোসাইটিতে।
ফলে, হয়ে ওঠার, হতে চাওয়াটা আামদের নানা রকম অভাববোধ থেকে জাগ্রত। আমরা যে সময়ে লিখতে এসেছি তার আগে পরে উচ্চবৃত্তের ঘর থেকে লেখক শিল্পীরা আসে নাই। সমাজে কী উচ্চবৃত্ত ছিলো না তখন। ছিলো তো বেটেই। নিম্নবৃত্ত আর মধ্যবৃত্ত আত্মউন্নয়নের জন্য সাহিত্য করতে আসছে। দখল নিতে আসছে ক্ষমতা ও রাষ্ট্র। ফলে, লেখালেখির লক্ষ্য বা এইম এতো হালকা কিছু না সমাজে। খুব সিরিয়াস বিষয়। দুর্বলের সবলায়ন। তবে সময়ে এসে জীবনের অর্থময়তা, ফুলফিলমেন্টের ধারণায় এসে পর্যবসিত হয় এই সমস্ত অভাববোধ আক্রান্ত হয়ে উঠতে চাওয়া।
আমার লেখক বা কবি হয়ে ওঠার বাসনা আর তেমন একটা নাই। লেখালেখি একটা যাপন এখন। জীবন অনেক বেশি এইমলেস, নিস্তরঙ্গ যেহেতু আমি জানি লেখালেখি দিয়ে যাকে ঠিক অর্জন বোঝানো হয় আমি তার ভেতরে অনুপ্রবেশ করতে পারি নাই। শিল্প সাহিত্যের কাঠামো কেন্দ্রের বাইরে বসে শিল্প, সাহিত্য ও ক্রিটিকের গুরুত্ব তৈরির করার প্রয়াস নিয়ে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছি।
প্রশ্ন
একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষসত্তা’কে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
মৃদুল মাহবুব
যে কোন মানুষের ভেতরই ‘মানুষ সত্ত্বা’ থাকে। যে খুনি তার ইন্টেনশনকে আপনি খারাপ বলতে পারবেন না। জীবন রক্ষার জন্য সে হয়তো খুন করে। জীবন রক্ষা খারাপ কিছু না। তার পদ্ধতিটা হয়তো খারাপ। তার ভেতরও আপনি মোরালিটি খুঁজে পাবেন। দুনিয়ায় রিফুজি একটা বিরাট সমস্যা। তাদের কোন দেশ নাই। কোন রাষ্ট্রই তাদের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত না। কেন? মায়ানমারের রোহিঙ্গাদের দায়-দায়িত্ব মায়ানমার যেমন নিতে প্রস্তুত না, বাংলাদেশও প্রস্তুত না। কিন্তু তারা দুনিয়ায় জন্মগ্রহন করা মানুষ। তাদেরকে আপনি তাড়িয়ে দিচ্ছেন। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে মানুষের জীবন নিয়ে পুসব্যাক পুসব্যাক খেলা চলছে। আপনি ধীরে ধীরে পরিণত মানুষকে নানা নির্যাতনের ভেতর দিয়ে শেষ করে দিতে চাচ্ছেন। এই যে কেউ কারো দায়িত্ব নিচ্ছে রাজনীতি, সার্বভৌমত্ব আর উন্নয়নের নামে তাকে আপনি অর্থনীতির ভাষায় ডেভেলপমেন্টের ইনটেনশন দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ডাটা পাবেন। কিন্তু এই স্ট্র্যাটিকটিক্সের সাথে মোরালিটি যুক্ত না হলে তার কোন মানবিক মূল্য নাই। মানুষ সত্ত্বা যাকে বলছেন তার কোন মূল্য থাকে না। এখন যাকে মানুষত্যহীন খনি বলে নির্ণয় করেছেন তিনি একটু মোরাল হয়ে ভাবতে পারেন অন্তত যাকে হত্যা করছি তাকে তিলে তিলে নরক যন্ত্রণা দিয়ে না-মেরে একবারে মাথার খুলি বারাবর গুলি করে মেরে ফেলি। খুনির এই মানুষসত্ত্বাকে আপনি কী হিসাবে দেখবেন? এটাও তো তার একটা মোরাল অবস্থান। খুনি তো আমাদের রাজনীতিবিদদের চেয়ে ভালো। কাশ্মির বা আসামের এনআরসির শুদ্ধ লিস্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বহুলোক উদ্বাস্তু হয়ে যাবে। জীবিত অবস্থায় তারা নরক যন্ত্রনা দেখে যাবে। এখন এই রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার লেজিটেমিসি কারা দেয়। প্রথমত, জনগণ। দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পীরা। গণতান্ত্রিক সৈরতন্ত্রকে আমরাই লেজিটেমেটেড করেছি। আপনি আমাদের লেখক শিল্পীদের দিকে তাকান না কেন? এই প্রিভিলেজড অধিকাংশ শিল্পীরাই পরোক্ষভাবে ফ্যাসিজমকে নৈতিক শক্তি দেয় সারা দুনিয়ায়। বাহু ও বন্দুক বলের সাথে সাথে জ্ঞান দ্বারা সেই ক্ষমতার বৈধতা লাগে, প্রযুক্তির নজরদারি লাগে। ছাড়া কোন ভাবেই ক্ষমতা চলতে পারে না। এর উদাহরণ নাই। ফ্যাসিবাদি দেশের শাসন ব্যবস্থা সমুন্নত রাখার জন্য সেদেশের শুধু প্রসাশন, পুলিশ, আর্মি, ব্যবসায়ী আর মিডিয়ার একক দোষ না। এই দোষের সমান ভাগিদার ঐ সময়ের লেখক, কবি সাহিত্যিকদের নিতে হবে। ১৯৭১ সালে দেখবেন অগণিত লেখক ছিলো যারা ফ্যাসিবাদি পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর থেকেছে। ত্রিশ লক্ষ লোক যে মারা গেল তার দায় ঐ সমস্ত লেখকদের নিতে হয় নাই। গণহত্যার দায় তারা এড়াতে পারে। হিটলারের ফ্যাসিবাদি মতাদর্শ সমর্থন করার লেখকেরও অভাব ছিলো না। সমাজতন্ত্রের নামে হত্যাকে জায়েজ করা লেখক অনেক আছে। স্বাধীনতাবাদ, গণতন্ত্র, উন্নয়নের নামে মানব ও প্রকৃতি নির্মূলের সাফাই গাওয়া লেখকও আপনি পাবেন। বেশির ভাগ লেখকই আদর্শ আর প্রোপাগাণ্ডা প্রচারের মুখপাত্র। লেখকরা মূলত সমাজের চিন্তারই প্রতিনিধি। যে যখন চলমান ‘মানুষ সত্ত্বা’ ধারণ করে তখন মনে হয় সে আসলে ক্ষমতা নামক রাক্ষসটার জন্য নতুন যুদ্ধেও রণসঙ্গীত রচনা করছে। লেখকের ‘মানুষ সত্ত্বা’ খুব ভয়াবহ, সৈনিকের ট্রেনিং দেওয়া ভাষার অন্ত্রে হাজাওে হাজার প্রাণ নাই হয়ে যেতে পারে। রাষ্ট্র আর ক্ষমতার লোকই লেখক। রাষ্ট্রে ও ক্ষমতায় তার ভূমিকা আছে। সমাজের যেকোন চিন্তার ভাষা দেয় লেখকরা। একজন লেখক হলো ওয়ান ম্যান আর্মি। তার চিন্তা সংগঠিত সেনাবাহিনী থেকেও বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কম কোন অর্থেই না। এই সমস্ত হিসাবে লেখকের মানুষ সত্ত্বা থাকা লাগে কিনা জানি না। তবে তার সত্য দেখার চোখ থাকা লাগে, যতই অজনপ্রিয় কথা হোক না কেন তাকে তা ভাষায় রূপ দেওয়ার সাহস ও ভাষিক দক্ষতা থাকা লাগে। স্যোসাইটিতে নতুন ভ্যালুর জন্ম দেয় বড় লেখকরা। ‘মানুষ সত্ত্ব’ নামক হালকা আদর্শবাদ না থাকাই ভালো লেখকের যেহেতু তাকে মানুষের নতুন সংজ্ঞা ও অর্থ প্রদান করতে হয় সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে।
প্রশ্ন
জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানের জীবন সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?
মৃদুল মাহবুব
মৃত্যু নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নাই। আমি দীর্ঘ জীবন চাই লেখালেখিতে সচল রাখার জন্য। ফলে, মৃত্যু হলো দুনিয়া চরম সত্য যা জীবনকে মিথ্যা করে দেয়। ফলে, মৃত্যু বিষয়ক কিছু দেখলেই আমি এড়িয়ে চলি। মৃত্যুকে মহিমান্বিত করার চল অতি পুরানা। সক্রেটিকে তার বন্ধুরা মৃত্যুর হাত থেকে ফেরাতে পারেন নাই। এমন আরো আরো মহিমান্বিত মৃত্যু আছে বোধ হয়। তবে এই কালে মহিমান্বিত মত্যু খুব রাজনৈতিক ব্যাপার। মৃত্যুর দিয়ে আন্দোলন হয়, যুদ্ধ হয়, ব্যবসা হয়, নতুন নতুন গবেষণা হয়, রাষ্ট্রের সীমানার পরিবর্তন হয়, অর্থনীতির পরিমাপ হয়, উন্নয়নের সূচক হয়, ফ্যাসিবাদের প্রাবাল্য বোঝা যায়। ফলে, মৃত্যু যতনা মেটাফিজিক্যাল দার্শসিক ব্যাপার তার থেকে একটা জ্যান্ত ব্যবহারিক বিষয়। গণিতের মত কাঠকোঠ্যা সূত্রবদ্ধ বিষয়। আপার কবর আজিমপুর কবরস্থানে, নাকি মিরপুর বুদ্ধিজীবী ককরস্থানে, নাকি বনানী, নাকি লাশ যাবে কি যাবে না শহীদ মিনার বা বাংলা একাডেমি, রাষ্ট্রীয় শোক, সম্মান কত কী বৈষয়িক বিষয় যে মৃত্যুর মত অপার্থিক একটা বিষয়ের সাথে জড়িত। স্পিরিচ্যুয়ালিটি বা সুফিবাদ ব্যবসায়ীরা বলবে, মৃত্যু হলো দেহের রূপান্তর, নতুন দশা লাভ ইত্যাদি ইত্যাদি। খুবই অরাজনৈতিক অর্থহীন ব্যাপর মনে হয়। মৃত্যু এতো হালকা কিছু না। জীবিত মানুষ থেকে মৃত মানুষের প্রভাব সমাজের উপর বেশি। ফলে, জীবন থেকে মৃত্যু মনে হয় বেশি সিগনিফিকেন্ট করো কারো জন্য। এটাই মনে হয় জাগতিক মোটাফেরে মৃত্য পরবর্তী জীবন, হিসাব নিকাশ, পাপ পুণ্যের খসরা।
জীবন মনে হয় একটা রেসপন্সিবিলিটি। কিছু একটা করার ভেতর দিয়ে তাকে ফুলফিল করতে হয়। মৃত ঝিনুকের শূন্য খোসল তা না। সেই খোলসের শূণ্যতায় নানা কিছু দিয়ে পূর্ণ করতে হয়। নানা লোক নানাভাবে এটা পরিপূর্ণ করে। জীবনের গহ্বরগুলো শুধু অর্থময় অবস্তু বা অবস্তু দিয়েই যে পরিপূর্ণ করতে হবে তা কিন্তু না। ব্যক্তির জীবন যখন সমাজের সাথে যুক্ত হয় তখন নানা রকম লক্ষ্য তৈরি করি আমরা সমাজের তরফে বসবাস করার জন্য। এখন জীবনের দায়িত্ববোধকে আপনি লক্ষ্য বলবেন না নিশ্চয়ই। জীবন কোন আনন্দপূর্ণ ঘটনা না। জীবন আসলে সাফারিং। ওয়াটার ওয়াটার এভরি হোয়্যার, নট অ্য সিংগ্রেল ড্রপ টু ডিঙ্ক। নানা দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে তাকে অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়। সাফারিং হলো মানুষের কোর অবস্থান। আপনি কোন কিছু অর্জন করতে চান আপনাকে সাফারিঙের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। পাঠ করা, সাধনা করা, রক্ষা করা, বেঁচে থাকা সব কিছুর জন্য আপনাকে ফাইট দিতে হবে। সাফারিঙের ভেতর দিয়েই আপনাকে প্রকৃতির বিরুদ্ধে সৃষ্টি করতে হবে। সকল প্রকার মানবিক সৃষ্টি অপ্রাকৃতিক। শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য থেকে শুরু করে দালান, রাস্তাঘাট যাই সৃষ্টি বা তৈরি করেন না কেন তা প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে আপনাকে করতে হবে। কবিতা, শিল্প, সাহিত্য একটা অপ্রাকৃতিক ঘটনা। এগুলো প্রকৃতিতে নাই। আপনি এগুলোর উৎপাদক ও ভোক্তা। ফলে, প্রকৃতির বাইরে গিয়ে যাই ডিল করতে চান না কেন, ক্রিয়েটিভ যাই সৃষ্টি করতে চান না কেন তা আপনাকে সাফারিং দিবে। এই সাফানিং এর ভেতর দিয়ে আপনি একটা মানসিক গন্তব্যে পৌঁচ্ছাবেন। সমগ্র মানব জাতির যাত্র হলো দুঃখের ভেতর দিয়ে যাত্র। জীবনের এই দুঃখবোধকে মেনে নিতে হবে। বারবার দুঃখ ফিরে ফিরে আসবে। বিচলিত হওয়া কিছু নাই। হতাশ হওয়ারও কিছু নাই। মানুষের জীবন ধারণটা যেহেতু অপ্রাকৃতিক পদ্ধতি নির্ভর সেহেতু প্রতিবেশের সাথে সাথে দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। ট্যাডিশনাল দুঃখ বলতে যা বোঝায়, এটা সেই প্যাঁচ প্যাঁচে দুঃখ না। এটা হলো দার্শনিক দুঃখ জীবনের। জীবন একটা রেসপন্সিবিলিটি। চেষ্টার ভেতর দিয়ে, আত্ম ও অপরকে উপলব্ধির ভেতর দিয়ে আগাতে হবে। আনন্দবাদীদের মত দার্শনিক হতাশাময় জীবন আর কারো নাই। আনন্দবাদী, নৈরাজ্যবাদী, উত্তরাধুনিক হওয়া মানে জীবনকে অর্থহীন করে তোলা। জীবনের শূন্য খোলে ক্ষুদ্র বালুর অর্থ আরোপ করতেই হবে যাতে মুক্ত জন্ম নেয় একদিন। জীবন খুব অর্থময়, পরিপূর্ণ একটা সত্তা।
প্রশ্ন
লেখার ক্ষেত্রে আপনার কোনও প্রেরণার জায়গা আছে কি?
মৃদুল মাহবুব
লেখা এক সময় লেখকের অভ্যাসে পরিণত হয়। সমাজ, সময়, সমগ্র ব্রাহ্মাণ্ড ও মানব প্রজাতির সাথে তার যে সংযোগ, সংকেত, নেটওয়ার্ক তা তাকে লেখার জন্য উদ্বুদ্ব করবে। লিখতে পারা লেখকের অবচেতনের অভ্যাস। হাঁটাতে পারা বা সাইকেল চালানোর মত তা রপ্ত করতে হয়। অভ্যাসকে অনুপ্রেরণা বলা যাবে না। লেখা ও চিন্তা করতে পারাটাকে বারবার চর্চার ভেতর দিয়ে অভ্যাসে নিয়ে আসতে পারতে হয়। যে লেখকরা অনুপ্রেরণা থেকে লেখে সে আসলে নবীশ ড্রাইভার। নবীশ ড্রাইভার সামনে পথচারী পড়লে ব্রেকের বদলে এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে দিতে পারে যেহেতু ঐ নুতন পরিবেশেন সাথে সে অভ্যস্থ না। অনুপ্রেরণা আক্রান্ত লেখকদের লিখতে পারাটার সাথে চিন্তার সংযোগ নাই। তারা পরিস্থিতি বুঝে অ্যাক্ট করে। চিন্তাতো মানুষ দেহ দিয়ে করে। তাদের নিজ দেহের উপর নিয়ন্ত্রন থাকে না। দমের সাধনাটা নাই। সেই রকম আমি আকাশ দেখলাম, অনুপ্রাণিত হলাম লিখলাম, আমি আগুন দেখলাম, অনুপ্রাণিত হলাম, লিখলাম, আমি সামাজিক ঘটানা দেখলাম, অনুপ্রাণিত হলাম লিখলাম, আমি অ্যাফটার দ্য সেক্স অনুপ্রাণিত হলাম, লিখলাম- এভাবে খুব নিম্ন চিন্তার লেখকরা লেখে। আপনি নানা ঘটনা হতে সংকেত পেতে পারেন, তা দ্বার আপনার চিন্তা স্টিম্যুলেটেড হতে পারে, আপনার মগজের সাথে বাইরের প্রকৃতি ও ঘটনার সংযোগ ঘটতে পারে, আপনি চিন্তা করবেন, তারপর আপনি লিখবেন। ব্যাপারটা অনুপ্রেরণার মত হালকা বিষয় না। আমার কাছে চিন্তার প্রকাশিত রূপ হলো 'লেখা'।
প্রশ্ন
বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনা চর্চা কতটা গঠনমূলক হচ্ছে?
মৃদুল মাহবুব
সমালোচনা দিয়ে সাহিত্যে কিছু হয় না। সমালোচনা নামে যা দেখেন তা দিয়ে সাহিত্যের কোন পরিবর্তন, পরিমার্জনের উদাহরণ থাকলে আমাকে বরং জানাবেন। সমালোচনা সাহিত্যের ফুটা পয়সা দাম নাই আমার কাছে। ধরেন, আপনি কবিতা লেখেন, আমি খুব সুন্দর সুন্দর সহজ কঠিন বাক্যেও মিশ্রনে বললাম আপনার কবিতা কিছু হয় না। আবার উল্টাটাও বলতে পারি, আপনি জীবনানন্দের পরবর্তীতে সবচেয়ে বড় কবি। দুই পক্ষেই প্রবল যুক্তি দেওয়া যাবে। কিন্তু, প্রকৃত প্রস্তাবে এইসব সমালোচনা ও আলোচনায় আপনার কবিতা যা তাই থাকবে। কারো শিল্প সাহিত্যেরই কোন পরিবর্তন হবে না। সাহিত্যে সমালোচনার অত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নাই। এখন অপরের সমালোচনা ও আলোচনা পড়ে যারা নিজের শিল্প, সাহিত্যের ডিকশন তৈরি করবে তাদের মত দুর্বলচিত্তের লোকরা আর যাই হোক কবি, শিল্পী সাহিত্যিক হবে না। আর্ট হলো আর্টিস্টের ডিকলারেশন। তিনি বলবেন, দেখ, দিস ইজ মাই আর্ট। দ্যাটস অল। আপনি মেনে নিতে বাধ্য হবেন আলোচনা সমালোচনার উর্ধ্বে।
আর একটা জিনিস লক্ষ্য করার মত, দেখবেন ভালো সাহিত্য সমালোচকরা শিল্পমৌলবি। তারা শিল্পের মাপ দেয় অতীত প্রতিষ্ঠিত শিল্পের মাপে। তাদের গজ ফিতার একটা মাপ আছে। ফলে, এই সমস্ত মুখস্থবিদ ছাগলদের কাছে আপনি গঠনমূলক সাহিত্য আলোচনা আশা করেন? কোন মানে হয় না। সাহিত্য সামালোচকদের শিল্পী হওয়ার নজির থাকলেও তা বিরল। সাহিত্য সমালোচনা দিয়ে সাহিত্যের কোন উপকার নাই। বরং মাঝে মাঝে ক্ষতি আছে। তারা এমন সব পুরানা জিনিস মার্ক করে যার ফলে নতুন শিল্পকে সমাজে স্থান পেতে সময় লাগে। এই ছাগলগুলো নতুন কিছু দেখলে ম্যা ম্যা করবে যে এই কবিতা উৎপলের প্রভাবে প্রভাবিত বা এই উপন্যাসে মার্কেজের ছায়া আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সাহিত্য আলোচনা হলো পিওর ছাগলামিপূর্ণ মানবিক আচরণ।
কবি মৃদুল মাহবুবের কবিতার বই : কাছিমের গ্রাম, উনমানুষের ভাষা। |
প্রশ্ন
‘কবিতায় ছন্দ’ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?
মৃদুল মাহবুব
বাংলা কবিতার প্রধান দুইটা কুসংস্কার হলো ছন্দ আর ভাষা। কবিতা করতে আসলেই শিল্পমৌলবিরা বলবে ছন্দ ছাড়া কবিতা হয় না। আর একটা কথা বলবে কবিতায় নিজস্ব ভাষা অর্জন করতে হবে। কেন? প্রশ্ন করেছেন একবারও? কবিতাকে ভাষা আর ছন্দের মত অলংকারের মধ্যে আটকে দিয়েছে এরা। ফলে, বাংলা কবিতার যে যৌগিকতা সেখানে নতুন সংযোগ কম। মানে ছন্দে লেখাটা অবধারিত না। লেখক হিসাবে নতুন ভাষা আবিস্কারও আপনার কাজ না। আপনি ছন্দে লিখতে চাইলে লিখতে পারেন। না চাইলে নাই। কবিতা আসলে অন্যত্র। কবিতা থাকে মানুষের চিন্তার ভেতর। চিন্তাকে পরিবর্তন করলে পারলে ভাষা আপনি বদলায়। ছন্দ বা অছন্দের উপর দিয়ে তা ছাপিয়ে ওঠে। কবিতার ভাষা ও ছন্দ হলো সেকেন্ডারি বিষয়। তাকে প্রাইমারি করে তুলেছি আমরা। আমরা লিরিক শোনার কালে আর বসবাস করি না।
ভাষাই সাহিত্য নয়। চিন্তা আলাদা হলে ভাষা আপনি বদলে যায়। কিন্তু কবিদের ভিন্ন হওয়ার জন্য ভাষা বদলের যে সংগ্রাম তা শিল্পের মূল ফোকাস থেকে লেখককে সরিয়ে নেয়। শিল্পের কাজ শুধু নিজেরে এক্সপ্রেশন করা নয়, চিন্তার ভাঙনও তার কর্তব্য। ভাষা কাজ হলো শিল্পের প্রকাশে সাহায্য করা মাত্র। বাকি কাজ আরো গভীরে।
এই সময়ে অনেক বেশি ভালো কবিতার দরকার নেই। অনেক ভালো ভালো কবিতা প্রান্তরে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে। পাঠকের যে রুচি তাতে এগুলো গুড এনাফ। তারা তাদের এক জীবনে এই সমস্ত শিল্পিত ভালো ভালো কবিতা পড়ে কাটাতে পারবে। যেমন ধরেন জীবনানন্দ বা উৎপলের মতো ভালো কবিতা পড়তে পড়তে যে শিল্পের চাহিদা পাঠক ও কবিতা চিন্তকদের তৈরি হয়েছে তা দিয়েই অন্তত আরো একশ বছর কাটানো যাবে নতুন কবিতা না লিখেই। নতুনের নামে পুরাতনের উৎপাদন অব্যাহত আছেই তো। এই সমস্ত ভালোর প্রেক্ষিতে বহু খারাপ কিছু ভালো হয়ে উঠতে পারছে না এই চিরাচরিত পাঠকদের চিন্তার শিশুত্বের কারণে। এটা কোনো সমস্যা না। আমার হিসাবে জগতে অনেক ভালো কবিতা তৈরি হয়েছে। এবং এমন ভালো ভালো কবিতার তেমন আর দরকার নেই। এমন ভালোর মতো দেখতে-শুনতে-পড়তে কবিতার যুগ শেষ। বাঙালি কবিজাতি কবিতায় যত ভালো, চিন্তায় ততটাই খারাপ। কবিতায় চিন্তা অন্তর্হিত কত দিন! আগামী দিনে যা শিল্প ছাড়া কিছু দেয় না তা টেকার সম্ভাবনা কম। এই সময়ের নতুন মানুষ ফালতু ফালতু শিল্প আর পড়বে না। যার কোনো উপযোগ নেই তার পেছনে সময় ব্যয়ের মতো সম্পদ ও সময় মানুষের হাতে কমেছে এই আধুনিক সমাজব্যবস্থায়। সমাজে কবিতা দিয়ে চিন্তার নতুন ভ্যালু অ্যাডিশন লাগবে। ফলে সমকালের লতানো, পাতানো, টেকনিকনির্ভর কম অনুভূতিশীল কবিতা ও কবির কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না।
আমাদের সমাজের ভ্যালু সিস্টেমটাকে টেনে লম্বা করুন, ছিঁড়ুন কবিতায়। এই সমাজ অবেগী শিল্পঘেঁষা। কিছু আঁচড় কবি হিসেবে রাখুন। বুড়া কবি যদি বলে আপনার কবিতা ভালো, তবে এখনই লেখা বন্ধ করে ভাবতে বসুন। এবং নিশ্চিত ধরে নিন ভবিষ্যতে আপনার কবিতা অপ্রয়োজনীয় লেখাপত্র হিসেবে গার্বেজ হতে চলেছে।
ভাষা আবিষ্কার থেকে নিজের চিন্তার অনুসন্ধান করুন।
প্রাইমারি বিষয় ঠিক হলে, সেকেন্ডারি বিষয়গুলো আপনি ঠিক হয়ে যাবে।
প্রশ্ন
ছোটবেলায় কি লেখালিখি করতেন?
মৃদুল মাহবুব
আমার বয়স বারো তেরো যখন তখন থেকেই লিখি। কবিতা লিখতে চাইতাম।
প্রশ্ন
লিখতে কেমন লাগে?
মৃদুল মাহবুব
দম নিতে যেমন লাগে। পার্থক্য শুধু লেখাটা ইট ভাঙার মত পরিশ্রমের কাজ, দম নেওয়াটা স্বতঃস্ফূর্ত। বেঁচে থাকার জন্য দুটোর স্বাদ একই।
প্রশ্ন
আপনি কী ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন?
মৃদুল মাহবুব
সাহিত্য রিলেটেড যেকোন কিছুতেই আগ্রহ আছে। তবে, সাহিত্য পড়ার ক্ষেত্রে খুবই সিলেকটেড। কী পড়বো আর কী পড়বে না মেনে চলি। জীবন ধারণের পর পড়া ও লেখার সময় খুবই সীমিত। দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি বিষয়ে আগ্রহ আছে। কবিতা লেখার ইন্সেপাইরেশন আমি কবিতার বাইরে থেকে নিতে চাই। কবিতা পড়ে সেই একই কবিতা রিপ্রোডাকশনের কোন দরকার নাই। ফলে, কবিতার বাইরে বসে কবিতা লেখা দরকার। মাঝে মাঝে খুবই কন্সেপচ্যুয়াল একটা ভাবান আসে। জীবনে একদমই কবিতা না পড়ে কবিতা লিখলে কবিতা কেমন হতে পারতো। কবিতায় কোন ওরিয়েন্টেশনই নাই। কিন্তু সেই লোকটি কবিতা লিখছে। তার কবিতা কেমন হতে পারে? আমার তো মনে হয়, সে এমন কিছু একটা লিখতো যা খুবই ভিন্ন কিছু হতো। তবে, আর্টের নূন্যতম ওরিয়েন্টেশন ছাড়া মনে হয় আর্ট করা যায় না। কেননা, আর্ট, সাহিত্য এগুলো হলো মানবিক ধারণা। ধারাবাহিকতা ছাড়া এ রস উপলব্ধি সম্ভব না। তবে আমার কন্সেপচ্যুয়াল চিন্তার ব্যবহারিক একটা দিক আছে। তা হলো, আর্টের যে ধারণা তার ডিলার্নিং। মানে, চলমানতার বোধ থেকে বের হওয়ার জন্য, নতুন কিছু করার জন্য পুরানা শিল্পের শিক্ষাটাকে অস্বীকার করে নতুন সংজ্ঞা আরোপ করতে হয়। আর্ট তো লেখক বা শিল্পীর ডিকলারেশন। দ্যাট ইজ মাই আর্ট। তুমি না মানলে দূরে যাও। এইভাবেই আর্টকে নতুনভাবে দেখার দৃষ্টি তৈরি করে আর্টিস্ট।
কী ধরণের বই পড়েন বা কারা আপনার প্রিয় লেখক, কাদের লেখা বারবার উল্টে দেখেন এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এই দেশে বলা খুব মুশকিলও মূর্খ আলোচকদের জন্য। ধরেন আমি বললাম, উৎপলকুমার বসু আমার খুব প্রিয়। তারা আমার কবিতায় উৎপলের প্রভাব খুঁজে বের করবে। ধরেন আমি গল্পকার, মুরাকামি আমার প্রিয়, তারা এসে বলবে তার গল্পের বিন্যাস মুরাকামির মত। ধরেন আমি বললাম, জিজেককে আমার অতি পছন্দ, তারা বলবে নিজের চিন্তা বলে কিছু নাই, সকলই জিজেকের অনুকরণ। আপনি চারটা বইয়ের ছবি আপ দিলেন ফেসবুকে। একটা ছিলো হয়তো এডওয়ার্ড সাঈদের তারা এসে বলবে আপনার প্রস্তাবনা আর সাঈদের প্রস্তাবণা এক। আপনার কিছু নাই। আপনি চারটা বইয়ের রেফারেন্স দিলেন। তারা এসে বলবে, এই কালের নবীন সলিমুল্লাহ। আপনি কী করবেন এখন?
ফলে, পড়ালেখা লুকিয়ে করা ভালো। আলোচকদের জীবন কঠিন হয়ে পড়ুক। তবে এতে, সমাজের ক্ষতি হয়। পড়ুয়াদের মধ্যে ইন্টার্যাকশনটা জরুরী। কে, কী পড়ছে তা জানলে ভালো। নতুন নতুন টুলস পাওয়া যায়। সবার সব পড়ার দরকার নাই। ভালো পাঠকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসটা নিয়ে নিতে পারবেন। এর পর যদি আপনার জন্য অতি প্রয়োজন হয় বিষয়টি তখন না হয় পুরোটা পড়ে দেখলেন। পড়াতো খুব ব্যয়বহুল একটা ব্যাপর। ফলে, নানা ঘরাণার ভালো পাঠকরা তাদের পাঠ অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে ভালো সমাজ গঠিত হতে পারে। কিন্তু, ছাগল ও কমবুঝদার সমালোচকগুলো আপনার জীবন অতীষ্ট করে তুলবে। লেখকদের ব্যক্তিগত লেখাপত্রে কালিমা লেপনের জন্য এরা সাহিত্য পড়ে মূলত।
প্রশ্ন
এখন কোন বইটা পড়ছেন?
মৃদুল মাহবুব
একসাথে কয়েকটা বই, ওয়েব, ব্লগ পড়ি, ইউটিউবে বক্তৃতা শুনি আমি। ওয়েবে যখন যে বিষয় মাথায় আসে সার্চ করে দেখি। আমি যা পড়ছি বা দেখছি তা নিয়ে অন্যান্যরা কে কী বললো তা-ও দেখার চেষ্টা করি নানা উৎস থেকে। বলার মত, একটা বই গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছি মনোবিজ্ঞানী, অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়া ড্যানিয়েল কানেম্যানের 'থিঙ্কিঙ ফাস্ট অ্যান্ড স্লো'। আমরা কীভাবে ভাবি, আচরণ ও বিচার করি তা বোঝার জন্য খুই গুরুত্বপূর্ণ একটা বই।
প্রশ্ন
আপনি বারবার পড়েন, এমন কবির নাম জানতে চাই।
মৃদুল মাহবুব
শুধু মাত্র কবিতাই বারবার পড়া হয়। বাকি পড়ালেখা দুইবার বা বারবার পড়ার সুযোগ নাই। আমি বই পড়ার সময় রেফারেন্স রাখি। ফলে, কোন বই দ্বিতীয়বার খুলে দেখার প্রয়োজন হলে আমার নিজের লেখা রেফারেন্সগুলো থেকেই ইনফর্মেশন নিয়ে নিই।
বারবার পড়া কবিতা অসংখ্য। যে কারো কবিতা ভালো লাগলে তা নানাভাবে বারবার পড়ি। কবি থেকে ভালো কবিতার উপর গুরুত্ব দিয়ে কবিতা পড়ি। কে কেমন, কোন মতাদর্শের, আমার বন্ধু, না কি অপরিচিত এই হিসাবে কবিতা পড়া হয় না।
প্রশ্ন
বর্তমান সময়ের কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলেন। কবি কি পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিত?
মৃদুল মাহবুব
কবিতা জনসংযুক্ত ও সহজবোধ্য কবে ছিলো? শিল্প, সাহিত্য ধর্ম না যে সবাইকে একই রকম রিচ্যুয়াল পালন করতে হবে। সাহিত্য বিজ্ঞান না যে এক যোগ এক দুই হতে হবে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডজুড়ে। সাহিত্য ইতিহাস না যে তাতে সত্যেও ভেক ধারণ করতে হবে, সাহিত্য দর্শন না যে তাকে মানুষের আচরণের যুক্তি লিখতে হবে, সাহিত্য মনোবিজ্ঞানও না যে গভীর কোন মানবিক উৎকর্ষতার দায় নিয়ে তাকে আগাতে হবে, সাহিত্য উন্নয়ন অর্থনীতির পাতা না যে তা সূচক দিয়ে সমাজ পরিমাপ করবে। সাহিত্য আসলে সাহিত্যই। তার নিজের মত তার চেহারা আছে। অপরাপর মানবিক জ্ঞানের ব্যাপারগুলো যেমন মাপা যায় না, সাহিত্যের প্রজ্ঞাটাকেও আপনি মাপতে পারবেন না। সাহিত্য পরিমাপের কিছু নাই। এর মানে এই নয় সাহিত্য অব্যহারিক একটা বিষয়। সাহিত্য দুর্বোধ্য ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে এগুলো অপাঠকদের অভিযোগ, যারা দুনিয়ার কোন শিল্প-সাহিত্যের খোঁজ রাখে না। আমি তো রেগুলার সাহিত্য পড়ি নানা রকমের। আমি তো বিচ্ছিন্ন বোধ করি না। দুর্বোধ্যও লাগে না। এখন, যা সাহিত্য না তকে উদাহরণ হিসাবে দাঁড় করালে কিছু বলার নাই। বিমূর্ততা একটা রাজনৈতিক ব্যাপার। বিমূর্ততা শেষ পর্যন্ত মূর্তই হতে চায়। এখন বিমূর্ততার রাজনীতি, ইতিহাস, মানবিক আবেদন না জেনে তাকে দুর্বোধ্য বলে দিলে ধরতে হবে যিনি এই সব বলছেন তার শিল্প সাহিত্যে ওরিয়েন্টেশন নাই। আমরা এই সমস্ত আবাল পাঠকদের জন্য কি বলে দিবো আজকালকার সাহিত্য দুর্বোধ্য, জনবিচ্ছিন্ন। বইয়ের দোকানে, অনলাইনে, পরিসংখ্যানে দেখি তো পাঠক বেড়েছে। দুনিয়ায় মানুষের পঠন পাঠন বেড়েছে। যাদের হাতে ডাটা নাই তারা বলবে দিনকে দিন পাঠক কমে যাচ্ছে। এইসব ভিত্তিহীন কথা। তো ক্রমবর্ধমান পাঠক নিশ্চয়ই শুধু ক্ল্যাসিক পড়ছে না। তারা সমকালিন শিল্প সাহিত্যটাই পড়ছে। তারা যদি কিছু না-ই বুঝতো তবে কী শুধু কাগজে ছাপা কালো অক্ষর দেখার জন্য বই কিনছে, পড়ছে? আমার অজার্ভেশন হলো, যত দিন যাচ্ছে ভাষা তত সোজা হচ্ছে। মানুষ প্রতিটা শব্দের নিজস্ব মানে শিখতে পেরেছে নিজের মত। মানুষের বোধ বুদ্ধি বেড়েছে। ফলে, সে অনেক কিছুর ইন্টারপ্রিটেশন করতে পারে। ফলে, দিনকে দিন লেখা সহজ হচ্ছে। দুর্বোধ্য শিল্প সাহিত্য দুনিয়ার কমে যাচ্ছে। বিশ্ব সাহিত্যের দিকে তাকান। দুনিয়ায় আর ইউলিসিস লেখা হবে না। আপনি অতি তরল ভাষার অসম্ভব বিরল সাহিত্য পারেন। মুরাকামি এই সরল বিরলতার উদাহরণ। সাহিত্য যতদিন যাবে মানুষের কাছে তত সহজ হবে।
সাহিত্য হলো মানুষের ইন্সটিংথ, অনুভূতির চূড়ান্ত লিখিত নিদর্শন। মেটাফরিক্যালি সাহিত্য একটা অমর ধারণা। শিল্পের অর্থ উৎপাদন প্রক্রিয়ার শেষ নেই। কোনো একটা টেক্সট যদি দুনিয়া থেকে বিলীন না হয়ে যায় তবে তা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ উৎপাদন করবে। টেক্সটের আয়ু তত দিন যত দিন এটার অস্তিত্ব থাকে সমাজে। এটাই সাহিত্যের ইউনিকনেস অন্য যেকোনো জ্ঞানকা- থেকে। যেমন ‘ঈদিপাস’ বা ‘হ্যামলেট’ বা ‘রক্তকরবী’ কোনো দিন পুরনো হবে না। যুগের পর যুগ সমান্যতম শব্দ বাক্যের পরিবর্তন ছাড়াই সে বেঁচে থাকে। ব্যাবহারিক শিল্পের গুণ হলো যেকোনো সময়েই সে নিজেকে ডিকোড করতে পারে সংক্রিয়ভাবে। সাহিত্য ব্যাপারটা দর্শনের মতো গ্রহণ-বর্জনের ভেতর দিয়ে যায় না। সমস্ত দর্শনকে নিজের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে এগোতে হয়। প্লেটো বা অ্যারিস্টটল আপনি এখন জ্ঞানের ইতিহাস হিসেবে পাঠ করেন, জ্ঞানের চাহিদা হিসেবে না। আধুনিকতম দর্শনের উৎসমূল গ্রিকো-রোমান দার্শনিকরা হলেও তাদের বহু চিন্তাই বাতিল এখন। অথচ সাহিত্য বাতিল হয় না, লক্ষ করুন। আপনি এখনো ঈনিড বা ইনফার্নো পড়েন। তার অর্থ উৎপাদন সক্ষমতা বদলেছে সময়ে সময়ে, তবে তা থেমে নেই। মেটাফরিক্যালি শিল্পমাধ্যম হিসেবে সাহিত্য মূলত অমরত্বের খেলা।
দর্শনের ক্ষয় আছে, শিল্প অক্ষয়।এই অর্থেই কবিতা কবিতাই। পদার্থবিজ্ঞানের মতই আলাদা ডিসিপ্লিন হলো কবিতা।
প্রশ্ন
লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে অন্তর্জালকে কীভাবে দেখছেন?
মৃদুল মাহবুব
মানুষ এক সময় পাথরে লিখতো। এসময় কাঁচা মাটির উপর লিখে আগুনো পুড়িয়ে তা মন্দিরের গায়ে লাগিয়ে সংরক্ষণ করতো। চামড়ায়ও লিখতো। প্যাপিরাস পাতায় লিখতো। কাগজ আবিস্কার হওয়ার পর কাগজে লিখলো। সবই লেখা সংরক্ষণের প্রযুক্তি। গুটেনবার্গের প্রিন্ট মেশিন আবিস্কারের পর আমরা বইয়ে লেখা সংরক্ষণ শুরু করলাম। জ্ঞানের রিপ্রোডাকশন দ্রুত হলো। এরপর কম্পিউটার এলে আমরা সফট লেখাপত্র সংরক্ষণ করা হলো। ওয়েব আবিস্কারের পর আমরা ওয়েবে গেলাম লিখতে। আরো দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছানো গেলে। ফলে, ওয়েব লেখাকে লেখা প্রকাশ থেকে লেখা সংরক্ষণের উপায় বলা বেশি যুক্তিযুক্ত। যত দিন গিয়েছে মানুষ আসলে গতির সাধনা করেছে। যত পারো দ্রুত করো সব। চাকা থেকে বর্তমান দুনিয়ার অপটিক্যাল ফাইবার সবই মানুষের গতির সাধনার ফলাফল। মানুষ আসলে গতি চায়। সেই হিসাবে ওয়েব হলো আধুনিকতম লেখার সংরক্ষণ ও মানুষের কাছে পৌঁচ্ছানোর সর্বোচ্চ পন্থা। আগামীতে মানুষ হয়তো আকাশের দিকে লেখা পাঠিয়ে দিবে, তা ব্রহ্মাণ্ডে সংরক্ষিত হয়ে থাকবে। শুধু মানুষ না অ্যালিয়েনরাও তা পড়তে পারবে। ফলে, লেখা, চিন্তা দুনিয়ার হাওয়ামন্ডল ভেদ করে সামগ্রিকতায় ছড়িয়ে পড়বে। এটাই তো মানুষের গন্তব্য। সেই হিসাবে ওয়েব খুবই কার্যকারী পদ্ধতি। ওয়েব ভিত্তিক সাহিত্যের চল হওয়ার ফলে, সাহিত্যের দলবাজির মৃত্যু হয়েছে। শিল্প, সাহিত্য কারো কুক্ষিগত মালামাল না। আপনি নিজেই নিজের লেখার প্রকাশক। নো সেন্সরশিপ। আপনার জন্য বিরাট একটা পাঠক বসে আছে। মেইন মিডিয়া আপনাকে অগ্রাহ্য করলেও আপনি পাঠকের কাছে পৌঁচ্ছে যেতে পারছেন। দেখুন হুমায়ূন আহমেদ কাগজ আর বিটিভির উৎপাদন। সমগ্র সাহিত্য সমাজ তার পেছনে ছিলো। কিন্তু এই কারের সাদাত হোসেনকে কোন মেইস স্ট্রিম মিডিয়া কিন্তু স্থান দেয় নাই। তিনি কিন্তু বই বিক্রি হওয়া লেখক হয়ে উঠতে পেরেছেন মেইন মিডিয়ার কোন সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া। এটা ওয়েব বিপ্লব। মেইন মিডিয়া মূমুর্ষ। ফলে, ওয়েব একটা বিরাট ঘটনা সাহিত্যের জন্য।
প্রশ্ন
আপনার কি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে?
মৃদুল মাহবুব
যে লেখকের রাজনৈতিক সচেতনতা নেই সে আবার কীসের লেখক? লেখক তো মানুষের জীবনটাকেই নতুন দৃষ্টি দান করে। চারপাশের নতুন অর্থ দেয় সে। ফলে, রাজনৈতিক জানাবোঝা ছাড়া সেটা সেটা লেখা তো আর সম্ভব না। মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী। সেই মানুষের আচরণও তা দ্বারা প্রভাবিত। ফলে, রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টও লেখকের জন্য।
বহুদিনের একটা চল আছে, লেখক মানেই বাম মতাদর্শের হতে হবে। আমাদের অধিকাংশ লেখকদের বামের রাজনীতির প্রতি একটা ঝোক আছে। এর কোন মানে হয় না। অতি আদর্শবাদী লোক দিয়ে বড় কিছু হয় না। আদর্শ খুব খারাপ বিষয়। প্রকৃত সত্যকে দেখতে দেয় না। মূলত বাম ও ডান রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। আদর্শের নামে মানুষকে শাসন ও শোষণের মানবিকযন্ত্রমন্ত্র। আবার দুই মতই মানুষের জন্য কল্যানকর হয়ে উঠতে পারে। দুনিয়ায় ক্ষমতা এখনো মানব তথা প্রকৃতিমুখী হয়ে উঠে নাই। ধরেন, আপনাকে ক্ষমতা দেওয়া হলো মানুষকে শাসন করার। আপনি পারবেন না। কেন পারবেন না? কেননা, ক্ষমতার যে স্ট্রাকচার নানা মতাদর্শের আলোকে গড়ে উঠেছে তা কল্যান থেকে শাসন করতে চায়। বাম ও ডান অর্থনীতি দুইয়েরই রাষ্ট্রের উন্নয়নের সূচক আছে। এই দুই উন্নয়ন সূচকের কোনটাতেই আমার বিশ্বাস নাই। গণতন্ত্রকামী, স্বাধীনতাবাদী আমেরিকা, ইউরোপ, ভারত এর বিপরীতে হিটলার, স্ট্যালিন যাকেই আপনি দেখেন না তাদের প্রত্যেকের উন্নয়নের ধাপ্পাবাজির গল্প আছে। যা যত না মানুষের উপকারের জন্য তা থেকে বেশি তাদের মতাদর্শকে সাপোর্ট করে এগুলো। পশ্চিম বাংলায় তো অনেক দিন বাম। তারা হিসাব মত বাংলাদেশকে পানি দিতে চায় না কেন? বামপন্থাও পুঁজি ও ক্ষমতার অনুগামী। পুঁজিবাদও প্রয়োজনে সমাজতন্ত্রী। মতাদর্শ হলো দুনিয়ার শাসকের মুখোশ।
এই মুখোশ উন্মোচন না করে যদি লেখক আদর্শে নিজেকে বলি দান করে তবে আর কী হলো? এই রকম রাজনৈতিক মতাদর্শ দুনিয়ার ক্ষতি করে। হিটলারের সময়ে তার অনেক লেখক ছিলো যারা মনে করতেন হিটলার যা করছেন তা ঠিকই করছেন। তারা সত্য দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ছিলো মতাদর্শ দ্বারা অবসেসড থাকার কারণে। তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো হিটলার যা করছেন ভালো জন্য করছেন। সত্যি তারা তা-ই বিশ্বাস করতো। অনেক লেখক আছে যারা বিশ্বাস করে গণতন্ত্র মানুষের মুক্তি দিবে। আসলেই কী তাই!
লেখকের জন্য মতাদর্শ খুব খারাপ। সে ক্ষমতাকে গাইড করবে। নতুন নতুন লুপহোল গুলো খুঁজে বের করবে সে। মানুষকে রাজনীতিকে দেখার কৌশলগুলো দেখাবে। জনগণ কী করবে তা তার বিষয়। সমাধানের বটিকা হাতে যে লেখক পাঠকের কাছে যায় আসলে তার আস্থা নাই নিজের পাঠকের উপর।
প্রথমত মানুষকে সকল রকম আদর্শ থেকে মুক্ত করতে হবে।
প্রশ্ন
আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন, না কি বারবার সংশোধন করেন?
মৃদুল মাহবুব
নানা কবিতা বা গদ্য নানাভাবে লেখা। কখনো একবারে, কখনো ধীরে ধীরে অনেকগুলো সিটিং এর ভেতর দিয়ে।
প্রশ্ন
আপনার প্রেমের কবিতাগুলো কি কল্পনাসৃষ্ট না কি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ?
মৃদুল মাহবুব
শিল্প বা সাহিত্য হলো বিয়ালিটির ডিস্টরট্রেড ফর্ম। বাস্তবতাকে ভাঙচুর করে শিল্প গড়ে ওঠে। এখন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকুক বা না-থাকুক, তা যথন সাহিত্যে প্রকাশিত হয় তা তখন আর ব্যক্তির অভিজ্ঞতার মত থাকে না। তা ভিন্ন কিছু হয়ে ওঠে। আরো সুক্ষ্ণভাবে বললে, দৃশ্যমান ঘটনা যখন ব্যক্তি দেখার পর অপরের কাছে বর্ণনা করে ভাষা দিয়ে দেখবেন ঘটনা কিছুটা বদলে গিয়েছে। দৃশ্য বার মুখে বর্ণনার মধ্যে তফাত আছে। দৃশ্য যখন ক্যামেরায় বন্ধি হবে তখনও তা বদলে যাবে। ঘটানা যখন লিখিত রূপ লাভ করবে তখনও তা বদলে যাবে। ধরেন একটা ঘটনার আপনি সামনা সামনি দেখেছেন। সেই ঘটনা যখন কোন সাংবাদিক কোথাও লিখবে, দেখবেন দৃশ্য লিখিত ফর্ম নেওয়ার কারণে কেমন বদলে গিয়েছে। ফলে, মানুষের সরাসরি অভিজ্ঞতা যখন শিল্পে ভর করে তখন তা আর বাস্তবতা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকে না।
আপনি আমার কোন প্রেমের কবিতার কথা ইন্ডিগেট করছেন তা জানালে আলোচনায় সুবিধা হয়। আপনি আমার লেখা কবিতা বা গদ্য কতটা পড়েছেন আমি জানি না।
প্রশ্ন
আপনি দিনের কোন সময়টাতে লিখতে পছন্দ করেন? কোনো রুটিন আছে কি এ ব্যাপারে?
মৃদুল মাহবুব
কোন রুটিন নাই। তবে রুটিনের মধ্যে লিখতে পারলে ভালো হতো।
1 মন্তব্যসমূহ
সাবলীল আলোচনা। পড়ে মজা পাওয়া গেল।
উত্তরমুছুনঅস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।