....

‘নজরুল পরবর্তী সময় থেকেই কবিতা জনবিচ্ছিন্ন’ : কবি শামশাম তাজিলের সাক্ষাৎকার

[ কবি শামশাম তাজিলের জন্ম ১৯৮৪ সালের পহেলা মার্চ, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাংলাদেশ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। 
প্রকাশিত বই : ‘আদম পাহাড়’, ‘আলিফ এক মূর্খের ফিকির’। 
সম্পাদনা : ‘তিতাসনামা’ (লিটল ম্যাগাজিন) অনিয়মিতভাবে এখন পর্যন্ত ২৩টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘শ্রয়ণ’ (লিটল ম্যাগাজিন) যার একটাই সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। 
আগামী একুশে বইমেলায় কবিতার বই প্রকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।
কবির একটি সাক্ষাৎকার নেবার উদ্দেশ্যে আমরা তাঁকে ই-মেইলে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম। ২৯ আগস্ট ২০১৯ তারিখে তিনি যে উত্তরমালা পাঠিয়েছে, তা হুবহু প্রকাশ করা হলো। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। -সম্পাদক। ]

সা ক্ষা  কা 


প্রশ্ন
ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন? মানে ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় কী লিখেছেন, তা নয়; বরং মনের ভেতরে সুপ্ত বাসনা ছিলো কি কোনও কিছু হবার জন্য?

শামশাম তাজিল
শৈশবে মাছ ধরতাম খুব। মাছ পছন্দও করতাম অনেক। ধীবর হতে ইচ্ছা হতো। কিছুটা বড় হবার পর ক্রিকেট আমাকে পেয়ে বসে। নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকতাম। ক্রিকেটার হতেও ইচ্ছা হতো। ক্লাস এইটে উঠার পর প্রথম কবিতার মত কিছু একটা লেখতে সমর্থ হই। তখন থেকে কবিই হতে চেয়েছি।

প্রশ্ন
একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষসত্তা’কে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?

শামশাম তাজিল
লেখকের আলাদা কোনো মানুষসত্তা আছে বলে মনে করি না। লেখক আর দশ মানুষের মতোই। খায়, দায়, ঘুমায়। সঙ্গম করে। লোভ, লাভ, কামনা বাসনার বশবর্তী হয়। 
তবে এইটাও মনে করি, তারা অনেকটাই অভিমানী হয়। হয়তো আর দশজনের চেয়ে বেশি সংবেদনশীলও। সংবেদনশীলতা লেখকের অন্যতম গুন। মানুষসত্তাকে লেখকের থেকে আলাদা করে দেখি না। লেখকসত্তাও মানুষসত্তারই বিকশিত, পরিনত একটা রূপ।

প্রশ্ন
জন্ম-মৃত্যুর  মাঝখানের জীবন সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?

শামশাম তাজিল
জীবন যাপনের। যাপনের ভেতর দিয়েই একে উপলব্ধি করতে হয়। জন্ম এবং মৃত্যু কোনটারই অভিজ্ঞতা মূলত মানুষের থাকে না। দুইটা ঘটনার স্বাক্ষী আমরা। দর্শক। বেঁচে থাকা নিয়ে বলি, বেঁচে থাকা সুন্দর। দুঃখ, কষ্ট, ভালোলাগা এইসব নিয়েই বাঁচতে হয়। জীবন অন্যের সাথে -- প্রকৃতির সবকিছুর সাথেই -- সম্পর্কিত। এই সম্পর্কটা উপলব্ধি করতে পারলে জীবন সুন্দর। বেঁচে থাকা সুন্দর। পরিবারের জন্য দায়িত্ব পালন করা জীবনকে পূর্ণতা দেয়। আর মানুষের জন্য কাজ করতে পারলে জীবন বিকশিত হয়। অনুভূতি এই : আমাদের কাজ করতে হবে প্রচুর। জীবনকে যাপনের জন্যই কাজ করতে হবে। আলস্য যাপনের জন্যও। 

প্রশ্ন
লেখার ক্ষেত্রে আপনার কোনও প্রেরণার জায়গা আছে কি?

শামশাম তাজিল
লেখতে ইচ্ছা হয়। এই ইচ্ছাটাই প্রেরণা। কখনো কখনো ইচ্ছা করে না। তখন লেখতে পারি না। কেন ইচ্ছা হয়, আর কেন হয় না -- তার কারণ উদঘাটন করতে যাইনি কখনও। 

প্রশ্ন
বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনা চর্চা কতটা গঠনমূলক হচ্ছে?

শামশাম তাজিল
আলোচনা-সমালোচনা গঠনমূলক হচ্ছে কি না তার আগে বলতে চাই, সমালোচনা কখনো গঠনমূলক হয় না!
তবে ব্যক্তিআক্রমণ করে তো আর সমালোচনা হয় না। আমাদের এখানকার বেশিরভাগ আলোচনা হলো বন্ধুকৃত্য সম্পাদন। আর সমালোচনা করা হয় কাউকে খারিজ করার বাসনা থেকে। যার কোনটাই গঠণমূলক নয়। অবশ্য গঠণমূলকতার নির্দিষ্ট মানদণ্ডও নাই।
কেন নাই, সে আলোচনা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। আপাতত সেদিকে যাচ্ছি না। তবে কথা দিচ্ছি, আলোচনা-সমালোচনা শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লেখবো।

প্রশ্ন
‘কবিতায় ছন্দ’ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?

শামশাম তাজিল
ছন্দ জরুরী। আমাদের বাক্য উচ্চারণে অলিখিত, গোপন একটা ছন্দ আছে। প্রকৃতির সব কিছুতেই। ছন্দ স্বাভাবিক। কবিতায়-ছন্দ ব্যাপারটা শুধু মাত্রা গুনার ব্যাপার নয়। 
কবিতার অন্তর্নিহিত ছন্দটা ধরতে পারলে আর মাত্রা গুনে গুনে কিছু লেখতে হয় না। 
আবার ছন্দ ছাড়াও কবিতা হয়। 
যাদের জীবন সাচ্ছন্দ্যময় তারা বোধ করি ছন্দের প্রতি দূর্বল। উল্টোও হতে পারে। জীবনে ছন্দ ছিল না বলেই হয়তো নজরুল ছন্দের বাইরে কোনো কবিতাই লিখেন নাই!
ছন্দ কবিতার জন্য প্রয়োজনীয়। তবে কানে বেজে উঠলে তখন সেটা আর ছন্দ থাকে না। কোলাহল হয়ে উঠে। কবিতার ছন্দ হোক আমাদের রক্তপ্রবাহের মতো। ছন্দময়। কিন্তু কোলাহল মুক্ত এবং সুন্দর, সুস্থ জীবনের জন্য আবশ্যিক। 

প্রশ্ন
ছোটবেলায় কি লেখালিখি করতেন?

শামশাম তাজিল
ক্লাস এইট থেকে লেখালেখির শুরু। 

প্রশ্ন
লিখতে কেমন লাগে?

শামশাম তাজিল
লেখা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। একটা অসুখের মত। লিখে অসুখ থেকে সেরে উঠতে চাই আবারও অসুখে পড়ার বাসনা নিয়েই।

কবি শামশাম তাজিলের দু’টি কবিতার বই।

প্রশ্ন
আপনি কী ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন?

শামশাম তাজিল
কবিতা, প্রবন্ধ, ইতিহাস, বিজ্ঞানের বইপত্র পড়তে পছন্দ করি। 

প্রশ্ন
এখন কোন বইটা পড়ছেন?

শামশাম তাজিল
একসাথে একাধিক বই পড়ি। অনেক দেরিতে হলেও ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের ‘শাপমোচন’ পড়তে শুরু করেছি। আর মিন্নাত আলীর ‘আমি দালাল বলছি’।

প্রশ্ন
আপনি বারবার পড়েন, এমন কবির নাম জানতে চাই।

শামশাম তাজিল
বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, শঙ্খ ঘোষ, আল মাহমুদ। তাদের লেখা ক্লান্ত করে না। জীবনানন্দও পড়ি। তবুও এখন মনে হয় তিনি কিছুটা ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছেন! আর আশির দশক থেকে এখনকার কবি যারা তাদেরই বেশি পড়া হয়। 

প্রশ্ন
বর্তমান  সময়ের কবিতার বিরুদ্ধে  জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার  অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলেন। কবি কি পাঠকের  রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিত?

শামশাম তাজিল
কবিতা যখন সঙ্গীত থেকে আলাদা হয়েছে তখন থেকেই তা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নজরুল পরবর্তী সময় থেকেই কবিতা জনবিচ্ছিন্ন। অবশ্য কবিতা কোনোকালেই খুব জনপ্রিয় কিছু ছিল না। জীবন যেমন জটিলতা লাভ করেছে, কবিতাও তার সাথে পাল্টে যাচ্ছে। কবিতা পড়ার জন্য পাঠক কেন, মাঝে মাঝে মনে হয় কবিদেরই প্রস্তুতি নাই। কবিতার বড় সুবিধাজনক দিক হলো তাকে নিজের মত অর্থ দেয়া যায়। যে কবিতা যত অর্থদ্যোতনা সৃষ্টি করতে সক্ষম সেই কবিতা ততো সফল হয়ে উঠে। 

প্রশ্ন
লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে অন্তর্জালকে কীভাবে দেখছেন?

শামশাম তাজিল
অন্তর্জাল খুব ভালো এবং কার্যকরী মাধ্যম। বিজ্ঞানের পরিবর্তনই তো কবিতাকে গাওয়ার হাত থেকে লিখিত রূপ দিয়েছিল কাগজ আবিষ্কারের পর। অন্তর্জালের বড় সুবিধা হলো লেখককে কারো দারস্থ থাকতে হচ্ছে না। অসুবিধা হচ্ছে সম্পাদনাহীন লেখা যেনতেন ভাবে প্রকাশ হচ্ছে। 

প্রশ্ন
আপনার কি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে?

শামশাম তাজিল
বিশেষ ধরনের রাজনীতিক বিশ্বাস কথাটা স্পষ্ট ধরতে পারিনি। 
আর রাজনীতি বিশ্বাস নয়। রাজনীতি হলো বিজ্ঞান। সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিজ্ঞান। 
এক সময় সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। এখন এক ধরণের বানপ্রস্থ অবস্থায় আছি রাজনীতিক দিক দিয়ে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে যে জুলুম অত্যাচার চলছে,মানুষের অধিকার হরণ চলছে,যে গুম হত্যা চলছে, যে দূর্নীতি সন্ত্রাস চলছে আমি এর বিরুদ্ধে। রাজনীতিক চিন্তায় নানা পরিবর্তন এলেও কখনো জুলুমকারীর পক্ষাবলম্বী হইনি। আমি সব সময় মজলুমের পক্ষে। 

প্রশ্ন
আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন, না কি বারবার সংশোধন করেন?

শামশাম তাজিল
কিছু কবিতা এক বসায় লেখা হয়ে যায়। কিছু কবিতা সংশোধন দাবি করে। তবে সংশোধন প্রায়ই কবিতার মৃত্যু ঘটায়!

প্রশ্ন
লিটল ম্যাগাজিনগুলি সাহিত্য বিকাশে কী গুরুত্ব বহন করে?

শামশাম তাজিল
সাহিত্যের বিকাশ যা ঘটাবার তা লেখক ঘটান।
তবে লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যের প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। লেখককে লেখার জায়গা করে দেয়। লিটল ম্যাগাজিন লেখকের জন্য ধাত্রীর ভূমিকা পালন করে।

প্রশ্ন
আপনি দিনের কোন সময়টাতে লিখতে পছন্দ করেন? কোনো রুটিন আছে কি এ ব্যাপারে?

শামশাম তাজিল
আমার লেখার নির্দিষ্ট সময় নাই। জীবিকার টানে যে দিকে ছুটতে হয় সেদিকে ছুটি। লেখার কোনো রুটিন নাই। 
অবশ্য মোবাইল ফোন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। আমাদের ছুটার সাথে সেও সঙ্গী। মোবাইলের নোটপ্যাড এখন লেখার জায়গা হয়ে উঠেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ