....

‘মানুষ হিসেবে একজন লেখক কখনোই চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গিতে আবদ্ধ থাকতে পারেন না’ : কবি সাজ্জাদ সাঈফের সাক্ষাৎকার

কবি সাজ্জাদ সাঈফ। জন্মস্থান- যাত্রাবাড়ি, ঢাকা, ১৯৮৪

এসএসসি ও এইচএসসি ঢাকায় এবং শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ, বগুড়াতে। চিকিৎসা বিদ্যায় গ্রাজুয়েশন, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পাবলিক হেলথ বিভাগে পোস্ট গ্রাজুয়েশন(থিসিস পার্ট অন অ্যাডিকশন সাইকোসিস এন্ড ইটস ডিজিজ প্রোসেস ইভ্যালুয়েশন ইন এসপেক্ট অফ মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রোভাইডার সেন্টারস ইন বগুড়া সদর এরিয়া)।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা(২০১৭), মায়ার মলাট(২০১৯), ভাষার সি-বিচে(২০১৯, ভারত) ।

সা ক্ষা  কা 


প্রশ্ন।। ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন? মানে ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় কী লিখেছেন, তা নয়; বরং মনের ভেতরে সুপ্ত বাসনা ছিলো কি কোনো কিছু হবার জন্য?

- ছোটবেলা বলতে চাকুরিজীবি মা ও স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি বাবার অনুপস্থিতিতে পড়ালেখায় কিঞ্চিৎ ফাকি দিয়ে রোদ্র-বৃষ্টিতে ক্রিকেট/ফুটবল নিয়ে মেতে থাকাকালে নান্দনিক খেলোয়াড় হতে চাইতাম, আর তারও আগে পিঠাপিঠি কাজিনদের সাথে বাড়ির সবচেয়ে উচু বেডকে মঞ্চ বানিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করার সময় মনে হতো একজন নাট্যকার হবো, এই তো।

প্রশ্ন।। একজন  লেখকের  ভেতরের ‘মানুষসত্তা’কে  কীভাবে  ব্যাখ্যা  করেন?

- একজন লেখকের ভেতরের মানুষসত্তা কোনোভাবেই তাঁর বাইরের মানুষসত্তা হতে পৃথক তা মনে করি না, মানুষ হিসেবে একজন লেখক কখনোই চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গিতে আবদ্ধ থাকতে পারেননা এইটাই বাস্তবতা, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপামর মানুষের ভিতর হতে ভাবনা-বোধের দিক থেকে লেখকেরা কতখানি মানবিকতায় এগিয়ে ছিলেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জহির রায়হানের কথাসাহিত্য ও সিনেমা, মুনীর চৌধুরির নাটক, নির্মলেন্দু গুণের 'হুলিয়া' ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রশ্ন।। জন্ম-মৃত্যুর  মাঝখানের  জীবন  সম্পর্কে  আপনার  অনুভূতি  কী?

-জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানের জীবনকে নানাজনে নানা উপায়ে ব্যক্ত করেছেন, আমি জানি এইটা একটা জার্নি মানে ভ্রমণকাল। বাউল বা অস্তিত্ববাদের ঘরানায় কোথাও 'ভ্রম' বলা হয়ে থাকতে পারে। এইটা এমন প্রশ্ন যা নিজেই নিজের উত্তর ক্যারি করতেছে, যার যার প্রেক্ষিতে সেই সেই উত্তর মনে করি, উত্তরটাও এক ধরণের অন্বেষণের ইঙ্গিত বহন করে যে অন্বেষণ সচেতন মানুষকে আমৃত্যু তাড়িয়ে বেড়ায় -

যেমন...

'সত্যি, ভ্রম নাকি ভ্রমণ

এই জন্মযাত্রা আমাদের?'

-(যাপন/ কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা)

প্রশ্ন।। লেখার ক্ষেত্রে আপনার কোনও প্রেরণার জায়গা আছে কি?

- লেখার ক্ষেত্রে কোনো প্রেরণার অভিক্ষেপে আমার আস্থা নেই, একে আমি তাড়না জ্ঞান করি।

প্রশ্ন।। বর্তমানে  বাংলা  সাহিত্যের  আলোচনা-সমালোচনা  চর্চা  কতটা  গঠনমূলক হচ্ছে?

-বর্তমানে বাংলা সাহিত্য যে শাখায় পিছিয়ে পড়েছে সেই শাখাটার নামই 'আলোচনা-সমালোচনা সাহিত্য', বাংলা সাহিত্য এখন স্মরণকালের সবচেয়ে বড় একটা পরিসরে ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো কর্পোরেট পরিসর, তবে সেই তুলনায় পাঠ-গভীরতা, পাঠ-বিশ্লেষণ, প্রতিক্রিয়াচর্চা দূর্বলতর বিধায় আলোচনা-সমালোচনা প্রায়শই গন্ডিবদ্ধতায় খেই হারাচ্ছে।

প্রশ্ন।। ‘কবিতায় ছন্দ’ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?

-ছন্দ, কবিতার গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। আঙ্গিক প্রচলিত ছন্দে বা গদ্যঢঙে হলেও কবিতায়

ছন্দের প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ উপস্থিতি থেকেই যায় কেননা উচ্চারণ একটা অবশ্যম্ভাবি আয়োজন যেখানে গদ্যে লিখলেও কবিতার সাবলীল শব্দসজ্জার একটা গুরুত্ব থাকেই এবং পাঠকমাত্রই সেই সাবলীলতাকে স্বাগত জানায় যা শ্রুতি ও বাকযন্ত্রকে আয়েশ দেয়। মোট কথা ছন্দ বিষয়ে অতিশয়োক্তি বা বিদ্বেষ কোনোটাই নাই আমার, একইভাবে গদ্য আকারে লিখিত কবিতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। 

প্রশ্ন।। ছোটবেলায় কি লেখালিখি করতেন?

- 'ছোটবেলা' অভিধাটি এখানে আরেকটু পরিস্কার করা যেত বৈকি, ছোটবেলা তো ইনফ্যান্টাইল-চাইল্ডহুড-অ্যাডলোসেন্স বয়সের যে কোনোটাই হতে পারে। যা হোক, ছোটবেলা যদি শৈশবকে ধরেন তো বলতে পারি তখন ছবি আঁকতাম খুব, কমিক্সের বই ছিলো নিত্যসাথী, লেখালেখির মধ্যে শুরুটা ছিলো 'মঞ্চনাটকের সংলাপ' লেখা দিয়ে, তারপর পাঠের বৈচিত্র্যে যখন 'বিষাদ সিন্ধু, বাঘের ওপরে টাগ, শার্লক হোমস, হাঙ্গর নদী গ্রেনেড, কাকাবাবু সিরিজ, লালসালু, পথের পাঁচালি' বুঝে না বুঝে পড়তে শুরু করি (বাড়িতে বাবা, নানাভাই ও খালামনিদের পাঠাভ্যাসহেতু) তখন ক্লাস ফাইভ, কবিতা লেখার শুরু। কবিতাই অদ্যাবধি যদিও উপন্যাস লেখার বৃথা চেষ্টার দলিল ডায়েরিগুলি মিসিং প্রায় পনেরো বছর হলো, কবিতাকেই ঘুরেফিরে ডেকেছি খাতায়-মনিটরে...

প্রশ্ন।। লিখতে কেমন লাগে?

-এই প্রশ্নের সোজা উত্তর হলো লিখতে ভালো লাগে বিধায় জীবন নিয়ে বিবিধ জুয়া খেলতেও দ্বিধা করিনি আমি, জানতাম আগুনে হাত দিলেও এর অভিজ্ঞতা আমার লেখায় হেল্পফুল হবে। এভাবেই একদিন পিতামাতার অবাধ্য হয়ে সার্বক্ষণিক লেখালিখিতে মনোযোগ দিই, এইটা গ্লানিময়, মোট কথা আমি যখনই যা করেছি অবচেতনে লেখালিখির একটা স্টিমুলেশন বরাবরই ছিলো!

প্রশ্ন।। আপনি কী ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন?

- মেডিকেল টেক্সট বুকের বাইরে আউটবুক হিসেবে আমার প্রথম পছন্দ ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস, এর পাশাপাশি কবিতার বই এবং কিংবদন্তীদের বায়োগ্রাফি। এছাড়াও চিত্রকলা বিষয়ক বইয়ের প্রতি বোধ করি তীব্র একটা টান।

প্রশ্ন।। এখন কোন বইটা পড়ছেন?

-এখন পড়ছি শ্রী গৌরাঙ্গগোপাল সেনগুপ্ত রচিত ও সংকলিত মির্জা গালিবের জীবনী ও নির্বাচিত কবিতার বই 'মির্জা গালিব'।

প্রশ্ন।। আপনি বারবার পড়েন, এমন কবির নাম জানতে চাই।

- এই প্রশ্নের উত্তরটি আমার দিক থেকে মাল্টিপল, যেমন ওয়াল্ট হুইটম্যান, যেমন নাজিম হিকমত, অমিয় চক্রবর্তী, উৎপলকুমার বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আল-মাহমুদ, আবুল হাসান, সিকদার আমিনুল হক, ভাস্কর চক্রবর্তী, শামীম কবির, মজনু শাহ, মাসুদ খান...

প্রশ্ন।। বর্তমান  সময়ের  কবিতার  বিরুদ্ধে  জনবিচ্ছিন্নতা  ও দুর্বোধ্যতার  অভিযোগ  বিষয়ে  কিছু  বলেন। কবি  কি পাঠকের  রুচির  সাথে  আপোষ করে  কবিতা  লেখা উচিত?

- এই অভিযোগটাকে আমি আক্ষেপ হিসেবে দেখি কেননা রাজা রাজরার সময়কাল বাদ দিলে বাংলা কবিতার পাঠক বরাবরই কম ছিলো, আর এই কম থাকাটাকে জনবিচ্ছিন্নতা বলে মানতে নারাজ আমি। আর দুর্বোধ্যতাও প্রাচীন অভিযোগ মানে নতুন কিছু নয়, কবি সবশেষে তাঁর সমাজেরই একজন এবং তাই কবিকে নানানভাবে চলমান সমাজবাস্তবতার সাথে কানেক্টেড থাকতেই হয়। পাঠকের রুচি গড়ে দেয়ার আবশ্যক দায়িত্ব কবির নয়, পাঠককেও পাঠে রুচিশীলতার উন্নয়নে সচেতন হতে হয়, সমকালীনও হতে হয়। অতঃপর এখানে আপোষের কিছু নেই, আছে কবি ও পাঠকের ভিতর আন্তঃসম্পর্কের উপযোগিতা। এক্ষেত্রে কবির জন্য নিজের লেখনীর ভাষাপ্রক্রিয়া স্থির করতে যে শ্রম ও সাধনা আবশ্যক, একইভাবে পাঠককেও সেই পাঠ-শ্রমে জারিত হতে হয় এবং অবশ্যই তা পাঠকভেদে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে। মোদ্দাকথা হলো কবিতাশিল্পের ক্রম পরিবর্তন বিষয়ে সচেতন পাঠকই কবিতার প্রকৃত পাঠক। এবং কবিকেও জনসংশ্লিষ্ট বা লিপ্ত থাকতে হয় যাপনে।

প্রশ্ন।। লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে  অন্তর্জালকে  কীভাবে দেখছেন?

- মাধ্যমের ভিন্নতা সময়ের অবদান, আন্তর্জাল বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম।

প্রশ্ন।। আপনার কি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে?

- হ্যাঁ আছে, শ্রেণীসাম্যের রাজনীতিতেই আমার আস্থা বরাবর। সম্প্রতি প্রয়াত কমরেড মুজাফফর আহমেদ ছিলেন আমার বংশানুক্রমিক আদিনিবাস এলাহাবাদের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক পরিমন্ডলেই শ্রেণীসাম্যের রাজনীতির দীক্ষা পেয়েছি আমি, আমার রাজনৈতিক গুরু আমার প্রয়াত দাদাজান যিনি একইসাথে কমরেড মুজাফফর আহমেদের রাজনৈতিক সহচর। এক কথায় মানবিকতার পক্ষেই আমার সমস্ত রাজনৈতিক অবস্থান। পেশাজীবনে স্বাধীনতা ও অসাম্প্রদায়িকতার স্বপক্ষে 'স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ' আমার প্লাটফর্ম। 

প্রশ্ন।। আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন, না কি বারবার সংশোধন করেন?

- সাধারণত এক বসায় লিখে অভ্যস্ত আমি, তবে কবিতাভেদে পরিমার্জনও করে থাকি।

প্রশ্ন।। আপনার প্রেমের কবিতাগুলো কি কল্পনাসৃষ্ট না কি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ?

- 'প্রেমের কবিতা' 'দ্রোহের কবিতা' এই রকম সাবটাইপে কবিতার ক্যাটাগরাইজেশনে আমি অভ্যস্ত নই, কবিতাই স্বয়ং প্রেম-দ্রোহ-অনুভূতি... সব। আর আলাদা করে বললে প্রেমের কবিতা বা যে কোনো কবিতায় আমি কল্পনাকে খুব বেশি স্পেস দিতে নারাজ, উপরন্তু অভিজ্ঞতাই আমার প্রথম সম্বল, তারপর ভোকাবিউলারি, তারপর ইমাজিনেশন... এই তো!

প্রশ্ন।। আপনি দিনের কোন সময়টাতে লিখতে পছন্দ করেন? কোনো রুটিন আছে কি এ ব্যাপারে?

- আমি পেশাজীবনের সাথে সমন্বয় করে সাধারণত রাতেই লিখতে পছন্দ করি, সুনসান রাত্রে, নির্জনতা সাধারণত মস্তিষ্কের মেমরি সেলে স্টোরড লেখালিখিসংক্রান্ত ডাটাগুলিকে পিক আপ করতে সাহায্য করে নিখুঁতভাবে। এইটা আসলে সময়-ক্ষণের সাথে কবিমস্তিষ্কের এক ধরণের বোঝাপড়া, অন্যভাবে বলা যায় যে স্মৃতিদের যথাযথ বোঝাপড়া একজন লেখকের লেখন-প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এইটা কমন আইডিয়া। এর ব্যাতিক্রম নাই তাও নয়। সন্ধ্যা/সকাল দশটায়ও লেখা সাবলীলভাবে হতে পারে। পুরো বিষয়টায় লেখকের স্ট্রাটেজি, পার্সেপশন আর মেমোরিলব্ধ ডাটার মধ্যস্থতা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অন্য কোনো সময় এ নিয়ে আরো বিস্তারিত  বলার ইচ্ছে থাকলো।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ দিব্যক অনলাইনকে, সুচারু করেই কাজটি করতে গিয়ে আসা নানান বাধা বিপত্তিও টলাতে পারেনি প্রগতিকেন্দ্রিক অনলাইন পোর্টালটিকে... ভালোবাসা

    উত্তরমুছুন

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।