....

সীমা শামীমা এর গল্প : ভোরের অতিথি



অই ননী, ওট! ওট!
অই ননী! ননী ওট!
আহ!  রামা, চুপ কর! আরিট্টু গুমাইলই।বলেই ননী গায়ে জড়ানো ছেঁড়া মলিন কাঁটাটাকে আরো ভালো করে জড়িয়ে আয়েশ করে চোখ বুজে রইল।
আরে না! ওট! বাত অইছে, গরম গরম খাইয়া ল!
 না আমি আট্টু গুমামু।
এবার চেঁচিয়ে উঠল শিবু জেডু।
এঁ যেন, শশুরবাড়ি শীতের দাওয়াত খাইতে আইছে? ওড তাড়াতাড়ি।
জেডু, আইজ তো মেলা কাল পড়ছে, আইজ থাউক, পানি তো বরফের লাহান কাল অইয়া রইছে,
চুপ কর, উট, গরম ভাতের লগে বেশি কইরা সউরষার তেল খাইয়া ল।অই রামা অরে মাছের মাতাডা দিয়া বাত দে, বেশি কইরা জিওল মাছের তরকারি দে। জগা মনা আর রামা তোরাও খাইয়া ল।আইজ জাল অনেক খানি গুঁজা দিতে অইবো। মহাজন তাড়া দিতাছে। তাছাড়া চাউল ডাউলওতো ফুরাইয়া আইল।

শিবু জেঠা হলেন দলের কর্তা। রামা ননী মনা আর জগা এই পাঁচজেলের দলটি আজ প্রায় মাস হয়ে এল এই দীঘিতে খেও ফেলছে।দীঘি টি যেমন বড় গভীরও বেশ। খেও প্রায় শেষের দিকে।আজ শিবু জেঠুও বুঝতাছে কাল কারে কয়, তথাপি উপায় নাই। জাল এগিয়ে নিতে হবে। ননীর কাজ হল জলে ডুব দিয়ে জাল গুঁজে গুঁজে এগিয়ে নেয়া। সাথে রামা মনা আর যগা পানিতে নেমে দু'পাশ থেকে জাল এগিয়ে নিবে। 

তারা সবাই গরম গরম ভাত খেল।সবাই আচ্ছামত তেল মালিশ করে নিল হাতে পায়ে শরীরে।অতপর মাঝখানে একটি মাটির পাত্রে শুকনা ডাল,পাতা আর তোষ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে খুব আয়েশ করে তামাক খেল। তামাকের সাথে শরীর গরম রাখবার ঔষধ (গঞ্জিকা,শিবু জেঠু এই বিশেষ সময়ের জন্য অতি সামান্য যোগার করে রেখেছে)খেল।

ননী, আর দেরী করিসনা, এইবার হরিবোল বলে নাম দেখি, তাড়া দিলেন শিবু জেঠু।
আইচ্ছা জেডু, বলেই সবাই হরিবোল বলে নেমে গেল। এই প্রচণ্ড শীতরাতে তাদের আর কোন চাওয়া নেই, বিছানা পেতে আয়েশ করে ঘুমনোও নেই, আর নেই  স্ত্রীর কাছে কোন একান্ত আবদার। রামা আর মনা ত্রিশের কোঠায়, বিয়ে করেছে, সংসারও হয়েছে। ননীর বয়স পঁতাল্লিশ হলেও এখনো তারমতো করে ডুবে থাকতে পারে না রামা, মনাও। তাই তারা থাকে জালের দুইপাশে, দীঘির পার ঘেঁষে। 

ননী অনেক ক্ষণ ডুবে ডুবে  জাল বেশ অনেকখানি এগিয়ে নিয়েছে। দুইপাশ থেকে মনা আর রামাও বেশ টেন নিয়েছে।জগা মাঝখানে টানছে।শিবু জেডু নৌকা দিয়ে লেবেল ঠিক করে দিচ্ছে। শিবু জেঠু পানিতে নামে না, তার কাজটা নৌকায় বসেই করে। 
ননী এবার যেন ইকটু ক্লান্ত।ননীর বয়স হয়েছ।এখন আগের মত আর দম পায় না, বলও পায় না, তবু তাকেই এই কাজ করতে হয় কেননা তার মত আর কেউ পারে না।
জেডু, এবার ইকটু  জিরিয়ে নেই। আরে না ! শরীল হিম অইয় যাইবো,তারপর আর ডুব দিতে পারবি না। 
তাড়াতাড়ি গুঁজা দিয়া ওইট্যা আয়।
দুপাশ থেকে রামা আর মনাও তাড়া দিল, ননী তাড়াতড়ি শেষ করে দে, জলে আর থাকতে পরছিনা।
আইচ্ছা তোরা টান দে। বলে ননী আবার ডুব দিল।

অনেকক্ষণ  পার হল ননী  উঠে আসছে না।শিবু জেঠু চিন্তিত।জগা ? ননী আর ওডে নাই?
নাগো জেডু। 
আইচ্ছা তুই কাম কর।
আবার খানেক ক্ষণ পর, বেশ উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে জগা ননী ওডে নাই? 
না জেডু, অহনো ত উটল না।
জেডু, ননী ত কহনো এতক্ষণ থাকে না ডুব দিয়া, আইজ যা কাল পরছে! নিচের পানি তো মনেঅয় বরফ অইয়া রইছে। ননী আবার জইম্মা রইলনা তো ?
দেকতো জগা ডুব দিয়া, আমার মনে যে কু ডাক দিতাছে! ঠাকুর! তুমি দেইখো ননীরে, রক্ষা কইরো বলেই জেঠু দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকালো। ঠাকুর বোধহয় এই কালে শীতঘুম দিচ্ছে, তার কানে এই দুর্বল, বয়স্ক, মলিন বুড়োর প্রার্থনা পৌঁছালো না!

জগা ডুব দিয়ে ভাল করে খুঁজলো। ননীকে পেলো না। আবার ডুব দিল।
কিরে জগা ননীরে পাছনাই? জেঠুর কণ্ঠে ভয় আর উদ্বেগ দুটোই যেনো ফুটে উঠল।
না জেডু, দারে কাছে তো নাই।
এবার জেঠু খুব অস্থির হয়ে গেল। জোরে হাঁকাল অই রামা মনা তোরা জাল গুঁজা দিয়া শিগগীর আয়।ননী অহনো ওডে নাই, অরে খোঁজন লাগবো।

সবাই মিলে অনেক ক্ষন খুঁজে ননী কে পেল অদূরে পরিত্যাক্ত এক ঝাটায় (দীঘিতে ফেলা গাছের ডাল যা মাছের আশ্রয়স্থল বানাতে দেয়া হয়) আটকে আছে।  নৌকায় তুলে তাড়াতাড়ি শরীর মুছিয়ে দিয়ে হাতে, পায়ে ভাল করে তেল মালিশ করল সবাই, পেট থেকে পানিও বের করল তবু ননীর কোন নড়াচড়া নেই।নাকের কাছে কান নিয়ে দেখল, না নিঃশ্বাস ও নেই। এবার জেঠু যেনো বিচলিত হয়ে গেল অই রামা মনা!  অহন কী করুম,  কী জবাব দিমু অর বাড়িতে?  হায়! হায়! এই কী হইল? অই ননী? ননী রে? ওট বাবা!  হায়! হায়! আমি ননীরে মাইরা ফালাইলাম!
রামা আর মনা জেডুরে সান্ত্বনা দিচ্ছে, জেডু, থামো, তুমি কিচ্ছু করো নাই, মনেরে শক্ত করো। 
অই মনা? অহন কী করুম ক, আমি তো কিছুই ভাইবা পাইতাছি না! অরে কি বাড়িত লইয়া যামু? 
না জেডু , অরে হাসপাতাল লইয়া লও।
ঠিকাছ, তোরা অরে লইয়া হাসপাতাল যা আমি মহাজনরে লইয়া অর বাড়িতে যাইতাছি!

সেদিন ভোর হল অনেক দেরীতে। শৈত্যপ্রবাহের সাথে ঝরছে কুয়াশা।ভারী হয়ে আছে আকাশ, থমথম করছে সারাপাড়া। ননীর স্ত্রী সন্তানদের কান্নায় কাঁদছে যেনো গাছের পাতাও। সকাল এলো সাথে এল ননীর শব যাত্রী। আঙিনা ভরে গেল অতিথি দিয়ে।

সম্পদ বলতে ননীর অবশিষ্ট রইল স্ত্রী, তিন পুত্র ও এক কন্যা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. ভইনে, এ যে জীবন থেকে নেয়া যারে গল্প বইলা চালাইয়া দিতেছেন।
    দারুন সাবলীল আর নিখুত বর্ণনা। ভাল্লাগছে।

    উত্তরমুছুন

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।