....

সজীব খন্দকার এর একগুচ্ছ কবিতা




আমার পুরনো সাইকেল

বেঁচে থাকার শেষ ইচ্ছেটুকু নিয়া যখনি ঘুমুতে যাবো-
মাসিক বেতন পাওয়া মুয়াজ্জিনের নদীর মতন কুলকুল সুর কানের ভেতর দিয়া অন্তরে যায়।
আমার তখন মরবার মন চায়,
আমার তখন মরবার মন চায়।
আমারে দেয় নাই কিছু কেউ কোনোদিন,
আমিও দেইনি কিছু কোনো মানুষেরে...
কিছুই পারিনি দিতে।
আমার অবুঝ শৈশব ভাঙ্গা এক সাইকেলে চড়ে ঘন্টা বাজাতে বাজাতে চলে যায় মধুপুর গ্রামে।
ও গাঁয়ে একটা দুপুরের দীঘি ছিলো,
টলমল জল,
আর ছিলো বেগুনের নুয়ে পরা ক্ষেত।
সে গাঁয়ের পূঁজো বাড়ি ধুপের গন্ধময়।
ছোট এক আমগাছে পাখির বাসা,
নীল রঙ ডিম,
স্কুল ছুটি হলে বিষন্ন বিকেল-
ওই তো ঘন্টা বাজিয়ে চলে যায় আমার পুরনো সাইকেল।



আমার প্রেমিকাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে এক নপুংসক

আমার প্রেমিকাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে এক নপুংসক;
‌দেখে আমি মুখ ফিরিয়ে চলে আসি।
‌এ শহর ব্যাস্ত এখনো
‌মডেলের ফাঁস হওয়া নগ্ন ছবি, মন্ত্রী মহোদয়ের বেফাস মাতলামি, নেতাদের হঠাৎ বিদায় আমাকে আহত করেনা।
‌দুই মুঠো ফুল হাতে যেই শিশু মানুষের বাজারে নেমেছে,
‌অবাধ্য যেই ছেলেটা গাঁজা আর গিটারের সুরে নিজেকে মাতিয়ে রেখেছে,
‌কুকুর আর কাকের পেটে বেশ্যার বার্ষিক গর্ভপাত- যেই রক্ত আর কোমল মাংসগুলি ঈশ্বরকে অনবরত অভিশাপ দেয়, গালি দেয়-
‌সমস্ত ঢাকা জুড়ে তার ভয়ানক উল্লাস
তবু আমি মানুষের, তবু আমি পাখিদের হৃদয়ের গোপন ধ্বনি শুনি
দেখি এক মহান সাম্রাজ্য এভাবেই সমুদ্রে ভেসে যায়।
‌আমার প্রেমিকাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে এক নপুংশক;
দেখে আমি মুখ ফিরিয়ে চলে আসি।
এ শহর ব্যাস্ত এখনো
ঝলমলে মদের দোকান, ফুটপাতে খদ্দেরের আনাগোনা, আলোকিত স্টেজ বিশাল কনসার্ট,
হলি ডে সন্ধ্যা নামে কেরানীর শাড়ি পড়া বউ,
সাম্যবাদের মুখোশ পরা কিছু নারী আর বাউন্ডুলে যুবকের চায়ের কাপ, চারিদিকে সিগারেটের বিষন্ন ধোঁয়া।
যে শহর ব্যাস্ত এখনো আমি তার বুকের ভেতর অখন্ড অবসর নিয়ে ঠোটে সিগারেট চেপে দেখি-
আমার প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরে এক নপুংসক।
তারাও ব্যাস্ত ভীষণ
এ শহর ব্যাস্ত এখন।



পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে আসামের নির্ঘুম পাহাড়গুলো

আর আমার কেউ নেই।
যারা থাকবে বলে কথা দিয়েছিলো তারা সমুদ্রের ওপাড়ের নক্ষত্রের মতন ঝরে যাচ্ছে প্রত্যহ।
আমি যেই আদর্শে বিশ্বাসী অমন আদর্শিক কোনো নেতা নেই যার পিছনে দাঁড়িয়ে শ্লোগানে প্রকম্পিত করতে পারি রাজপথ, আকাশ এবং ক্যাম্পাসের ক্লাসমুখো শিক্ষার্থীর হৃদস্পন্দন।
কোনো কবি নেই যার কবিতা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে,
কোনো শিল্পী নেই যার শিল্পের কাছে আমি চিরকাল নত হয়ে থাকার প্রত্যাশা করবো।
এমনকি কোনো নারী নেই যার আকাঙ্খায় আমি আহত হবো, কবিতা লিখবো এবং বিশ্বাসের চূড়ান্ত দেয়াল নির্মান করে তাকে প্রতিহত করবো সকল অশুভ থেকে।
একদা আমি যেই পূজারিণীগণকে শুদ্ধতার শুভ্র মহলে আবিষ্কার করেছিলাম তারা আজ গোপন বেশ্যালয়ে নিশ্চিত ঘুম দিয়ে জেগে উঠে সকালের সূর্যের সাথে।
যাদের দখলে ফুটপাত এবং কনডমের বাজারজাতকরণের দায়িত্ব তেমন একজন মানুষের কাছ থেকে পণ্যের মত কিছু রক্ত ক্রয় করি, কিছু খুন আর একান্ত কিছু দুঃশাসন।
উদ্যানের গ্রিলগুলোয় মরচে ধরেনি বলে আমাকে ভীষণ বন্দি মনে হয়।
আমি এই বন্দিত্বের অবসান ঘটাতে নির্বাসন চেয়েছিলাম - নিজের পোষা কুকুরের কামড়ে নিহত একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।
তিনি আমার আবেদনের পক্ষে কিছুই করে যেতে পারেননি- অবশ্য করার কথাও ছিলো না।
আমি তার মৃত্যুতে শোকাভিভূত এবং সেই বার্তা তার স্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে গিয়েছি বার বার কেননা ওই বৃদ্ধ ভুরিওয়ালা মন্ত্রির অল্প বয়েসী স্ত্রীর মেদুল কোমরের দিকে তাকালে আমি বন্দিত্ব এবং নির্বাসনের কথা ভুলে যাই।
উপকুলে ভয়াবহ ঝড় হলো যদিও ওই ঝড়ের সাথে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই তবু একদিন বুঝতে পেরেছি আমার এমন ভাঙ্গনের খেলা প্রয়োজন ছিলো বলে শহরমুখি জীবনে বার বার আঘাত হেনেছে।
একজন সাংবাদিক এসে বউটির মুখের সামনে মাইক্রোপিস নিয়ে দাঁড়ালো আর পেছনে ক্যামেরা, লাইট ইত্যাদি
সম্ভবত এমন ভয়াবহ দুর্দশার কথা জাতির কাছে সরাসরি পৌছে দেবার কথা কিন্তু অদ্ভুতভাবে নাকে নোলক পড়া, গালে কাটা দাগ, রোদে পোড়া শ্যামা বউটি হেসে উঠলো 'আমার নাগর গেলো, আবার নগর হলো ভরা আশ্বিনে..''
আমি ওই বউটারে পাই নাই কোনোদিন।
অন্তরের ভিতরে যেমন জ্বালা করে বৃষ্টি হলেই অমন জ্বালায় আমারে যেই নারী- চেয়ে দেখি তার স্তন খুলে পরে কুকুর আর শেয়ালের মুখের উপর,
তার চোখ দেখি গলে যায় শুয়ো পোকার জমজমাট স্তুপের ভেতর।
এখন আর আমার কেউ নাই বলে দুঃখ হয় না, আহত হই না পরাজিতের মতন অথবা আমার ব্যার্থতায় আব্বার হতাশার মতন।
বহুদুর হতে আমার গ্রামের উপর দিয়ে আসামের মেঘ উড়ে যায়,
আমার চাচারা তাদের স্ত্রী এবং সন্তান নিয়ে ওই রাষ্ট্রহীন মেঘের মত কাঁটাতার পেরোতে গিয়ে সপরিবারেই নিহত হয়েছিলো সীমান্তরক্ষীর গুলিতে কোনো এক শ্রাবন মাসে।
আমাদের নদীটায় যেদিন সকাল বেলা লাশগুলো ভেসে এলো আমি কারো কান্না দেখি নি।
আমার চাচারা জানতো না মানুষ তো মেঘ নয়, মেঘের মতন অমন করে উড়ে বেড়া যায় নাকি?
তবু তারা মেঘ হয়ে এখনো আমাদের গ্রামের দক্ষিন আকাশে উড়তে থাকে- পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে আসামের নির্ঘুম পাহাড়গুলো।



আমি একা আর কোথাও যাবো না

তোমাদের উঠোন জুড়ে বৃষ্টি নামে, তোমরা আনন্দ উল্লাসে ভেজো, হৈ হুল্লোর করো;
আমি ঘরের ভেতর একলা শুইয়া থাকি -শুনিনা কোথায় জলের পতন হয়, কোন দিকে বইতে থাকে।
বুঝিনা কখন আকাশ ডাকে, কখন কে কান্না করে!
আমি জলের শব্দ পাই না, কারো কান্নার শব্দ পাই না।
কালা আর বধির হইয়া এই দরজা, জানালাহীন ঘরের ভেতর শুইয়া থাকি একা।
উত্তরে যাই না, দক্ষিনে যাই না -পুব আর পশ্চিমে বহু মানুষের আনাগোনা।
জানি ওইখানে কাছের মানুষটারে বৃষ্টির শব্দ পেলেই চুমু খায় আমার প্রেমিকা;
তখন তার চুল ভিজে দু একটা লেপ্টে থাকে গালে আর কাঁধে।
বৃষ্টির অল্প কয়টা ফোঁটা তার নাকে আর গলায় কেমন যেন চাইয়া থাকার মত জ্বলে।
দরজা, জানালাহীন এই ঘরে ছোট খাটো ফুটো দিয়ে গাঁজার গন্ধ আসে, প্রেতের ছাঁয়ার মতন হাতে গোনা দুইটা আলোক রশ্মি বিকেলে আমার চোখের উপর ঘুমাইতে আসে।
আমি ঘরে শুইয়া থাকি,
মনে হয় ওইদিকে বৃষ্টি নামে, আকাশে ছাই রঙ, মেঘ গুর গুর করে ডাকে;
এইসব কিছুই দেখিনা, কিছুই শুনিনা আমি।
তোমাদের সব আছে তোমরা সমুদ্রে যাও,
বৃষ্টিতে ভেঁজো আর এক সাথে গান গাও,
শুধু আমি একা আর কোথাও যাবো না।
কোথাও যাবো না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ