মেঘগুলো জল হলো না
দুপুরের বেলা বিকেলের কোলে ঢলে পড়ছে। এখনো মাঠ জুড়ে আগুন জ্বলা চৈত্ররোদ। তাই ক্ষেতে নামার আগে খেজুর তলায় একটু জিরিয়ে নিচ্ছে সানু। খন্ড খন্ড চৈত্রমেঘ মাঠ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘ-রোদ আলো-ছায়ায় প্রেম-প্রেম খেলছে অপূর্ব শোভায়। সেদিকে খেয়াল নেই সানুর, দৃষ্টি ক্ষেতের উপর। চার চারটি পেট ভর করে আছে তার উপর। এই পেটের জ্বালায়ই তো বড় মেয়ে ছায়াকে ঢাকায় দিয়েছে বড় সাহেবদের বাসায়। ‘কেডা জানে কি কাজ করায় এইডু ম্যাইয়ারে দিয়্যা। কইছিল তো খালি একটা ছোডো পোলা আছে হেরে রাখব আর খাইবো-দাইবো। আল্লাই জানে, কিদ্দা কি হরে?’ মেয়ের কথা মনে পড়ায় বুকের বাম পাশটায় মায়া ব্যথার মোচোর অনুভব করল সানু। সে উঠে দাঁড়াল। কাঁধের গামছাটা নামিয়ে কোমরে বাধল শক্ত করে। সানুর মনটা ভালো যাচ্ছে না। কী এক অজানা বিষণ্ণতায় চেপে আছে তার মন। মেঘগুলোও ঘুরে ফিরে জমছে চারপাশে। তাই আর দেরি না করে মাঠে নেমে পড়ল।
চৈত্রের মাঝামাঝি বুনা না বোনলে ধানের ফলন ভালো হয় না। এই এক খন্ড জমি তার। অবহেলা চলবে না। মনের রঙে গা ভাসাবার জো নেই। যা করার আল্লাহ্ করুক। সবই নিয়তির খেলা! নাইলে নদীই বা কেন এমন আগ্রাসী হবে। তার এমন অবস্থাই বা কেন হবে! যা ও আবার দু 'খন্ড ছিল, এক খন্ড গেল আবার বউয়ের পিছে।
নিয়তি! সবই নিয়তি!
নিয়তি তাকে সুন্দরী বউ দিয়েছে, কিন্তু সে সুন্দরের ভিতর আবার দুঃখও ভরে রেখেছে। দিন যত যাচ্ছে দুঃখের পোড়নও তত বাড়ছে। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ মরল বিধবা মা। সেই থেকে একুলে ওকুলে সানু ছাড়া আর কোন বংশধর নেই সানুর। যাইহোক বউয়ের আদর-সোহাগে মায়ের শোকের মাতাম প্রায়ই ভুলেছে। কিন্তু ন'মাসের মাথায় আবার খাইল কুমিরকামর। তখন বউ তার ছ'মাসের পোয়াতি। সানুর মগজে বয়ে যাচ্ছিল নতুনের সুখবাতাস। বউয়ের বাড়তি খাবারের জন্য টানা এ বাড়ি ও বাড়ি কামলা খাটতো। খালে-বিলে হাওড়ে-বাওড়ে সকালে-সন্ধ্যায় যেদিন যখন সময় পেত তখন মাছ ধরতো। শিং, মাগুর মাছের জন্য কত জায়গায় যে কতবার জাল ফেলেছে, পৌষের শীতে গলা সমান পানিতে নেমে জালের ভিতর মাছ খুঁজেছে। কত যে শিংমাছের ঘা খেয়েছে তার হিসাব নেই! বিষে তার হাত খয়েরি হয়ে যেত কিন্তু তেমন অনুভূতি হত না। মগজে তার নতুনের হাওয়া, ঘরে নতুন প্রাণের স্পন্দন। শিং মাছ চাই-ই চাই। শিং মাছ শরীরে রক্ত বাড়ায়।
পোড়ার কপালে পোড়নই বুঝি সুখ। তাই সানুর সুখবাতাস ঝড় হয়ে উঠল এক সন্ধ্যায়। বাড়ি ফিরে দেখে বউ তার রক্তে ভেসে যাচ্ছে। সানু কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কি করবে সে! ভিমড়ী খেয়ে পড়ার অবস্থা। বউ'র কাছে আগায়, দেখে জ্ঞান নেই তার কিন্তু রক্ত ভেঙে চলছে। সানু বউ'র থুতনিতে হাত দেয়। দেখে দাঁত খিলমারা। সে দৌড়ে ঘরের বাইরে এসে ডাক ছাড়ে-
‘হাইজ্জা চাচি... ও হাইজ্জা চাচি ... শিগ্গির এমনে অ্যাও। মোর কপাল পুইড়ড়া যাইতেছে।’
মিলনের মা (হাইজ্জা চাচি) সানুর ঘরে এসে বলল - ‘ওরে পোড়া কপাইল্লা, তুই বউডারে বাঁচা। শিগ্গির সদর হাসপাতালে লইয়া যা।’
সানু কোন চিন্তা ভাবনা না করে ভ্যানে করে তখনই হাসপাতালে নিয়া গেছিল। কাজ-কাম করে যা জমাইছিলো তা এক রাতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। বউ তখনো উঠে বসতেও পারে না। শুধু মিনমিনইয়া একবার একটু চায় তারপর আবার কয়েক ঘন্টার জন্য চোখ বোঝে। বউ’র মুখের দিকে চাইলে মায়া বাড়ে সানুর। চোখে জল আসে।
না; সানু যে করেই হোক টাকা জোগাড় করবে। চিকিৎসা করাইতে হবেই।
হাসপাতাল থেকে নেমে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। ছফা চাচার কাছে যাবে সে। এই বিপদের সময় সেই টাকা দেবে। অন্যরা বলবে নানান কথা।
‘হায়রে! মানুষ’ - বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে সানু।
ভাদ্র মাসে ভুই রোপোনের সময়ে অনেকে এসে সানুর পায় পরে প্রায় । তখন কত কদর তার!
সানু ছফা চাচার বড়ি পৌঁছে। বাড়িতেই ছিলেন তিনি। পুকুরের ঘাটলায় বসে ছিলেন। সানুকে দেখে প্রশ্ন সূচক চোখে তাকালো। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করার আগে সানুই বলল - ‘চাচা ; বিপদে পইড়া আইছি। বউডারে হাসপাতাল রাইখ্যা আইছি।’
‘কি অইছে বউ’র?’ -নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল ছফা।
সানু বিস্তারিত বলল। তারপর একটু থেমে বলল - ‘চাচা ; ডাক্তার কইছে রক্ত দেওয়া লাগবে। অপারেশনও নাকি করতে অইবে। এহন টাহা-পয়সা তো আর আতে নাই। কিছু টাহা দেওন লাগবে।’
‘কত লাগবে?’
‘ডাক্তার কইছে আজার পঁচিশ লাগবে।’
‘এতো টাহা শোধ করবা কিরোহম?’
‘চাচা, জাগা-জমি তো আছে কতডু।’
কতক্ষণ ঝিমধরে বসে থাকে ছফা। তারপর ঘরের ভিতরে যায় এবং টাকা নিয়ে আসে। সেই থেকে এক খন্ড জমি হাত ছাড়া হয় সানুর। বিনিময়ে বউ তাকে উপহার দেয় ছ 'মাসের অপূর্ণ মৃত ছেলে। তারপর থেকে বউ’র ছেলে হয় নি। তৃতীয় মেয়ে হওয়ার পর সানু আর একটা বিয়ে করতে চেয়ে ছিলো কিন্তু বউয়ের মুখের দিকে চেয়ে দ্বন্দে পরে যায়। তারপর এক দিন বাজারে বসে চা খাওয়ার সময় কয়েক জন শিক্ষিত লোক গল্প করছিল সে সময় তারা বলাবলি করছিল সন্তান ছেলেমেয়ে হওয়ার জন্য পুরুষ দায়ী। তখনই মাথা থেকে আর এক বিয়ের ভূত পালাইছে।
এক ঘোরের মধ্যে এসব ভাবতে ভাবতে সানু জমির বুকে হাত চালাচ্ছিল। ঘোর ভাঙ্গতে পিছু চেয়ে দেখে এতক্ষণে হাত দশেকের মতো জমির বোন বাছা হয়েছে।দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে সানু - ‘এহণ এসব ভাইব্যা আর কি লাভ!’
জোরে হাত চালাচ্ছে সানু সন্ধ্যার মধ্যে বোন বাছা শেষ করতে হবে। মেঘগুলোও ঘন হচ্ছে বেশ। তাই ঝুরঝুরা কোমল মাটির দিকেই তার গভীর মনযোগ। চারপাশের কোলাহল মোটেও টানছে না তাকে। এক নাগারে হাত চালিয়ে চলছে। বাতাসের গাড়ি করে সহস্র তরঙ্গ চলে যাচ্ছে তার দুই কানের পাশ দিয়ে। কতশত ভাষা নিয়ে চলছে সে তরঙ্গ। এবার সানুর জন্যও আসলো গাড়ি -
‘আব্বা ...আব্বা ...আব্বাগো...
হুনছেন ...ও আব্বা ...হুনছেন ..আব্বা ... রে...’
সানু মাথা জাগিয়ে কান খাড়া করে। এতো তার মেজ মেয়ে মায়ার গলা। সানু উঠে দাঁড়ায়। চোখ বাড়ায় বাড়ির দিকে। দেখছে মায়া ক্ষেতের আইল দিয়ে দৌঁড়ে আসছে। সানু সামনের দিকে আগাচ্ছে। মায়াও আরো জোরে জোরে দৌঁড়ে আসছে সানুর কাছে।
‘আব্বা ...আব্বা ...ঢাকা-ইদ্যা খবর আইছে ছায়াবুর অসুখ। আপনের যাওন লাগবে।’
সানুর মুখে কথা সরছে না। চারপাশের মেঘগুলো অন্ধকার হয়ে শব্দে-শব্দে ভেঙে পড়ছে তার দু'চোখের উপর। কি হয়েছে মায়ার? কিভাবে যাবে? হাতে তো টাকা-পয়সা তেমন কিছু নাই। এসব ভাবতে ভাবতে সানু বাড়ি পৌঁছে। বিস্তারিত শুনে তার মাথা একেবারেই ঘুরে যায়। সানু এবারও ছফা চাচার কাছে যায়। সানু কিছু টাকা ধার চায়। ছফা এমনিতেই খুব দরদি লোক, তার উপরে আবার সানু। এর আগের বার কোন ঘুরাঘুরি না করে কথা মতো দলিল দিয়ে দিছে। তাই সানুর প্রতি দরদ ও বিশ্বাস একটু অন্য রকম। তবুও এবার একটু সমস্যার কথা বলে ছফা।
‘কি সমস্যা চাচা?’ - জিজ্ঞেস করে সানু।
'টাকা কিছু আছে; তয় বীজ ধান নাই। ধান কিনতে অইবে।’
‘সমেস্যা নাই। মোর যা আছে হেইগুলা নিয়া হালাইয়েন।’
আর কথা না বাড়িয়ে ঘরের ভিতর থেকে টাকা এনে সানুর হাতে দেয়। ‘যাই, একটু খেয়াল রাইখ্যেন বাড়ির দিকে।’ আবদারের সুরে বলে দ্রুত হেটে বাড়ি চলে যায় সানু। সন্ধ্যার লঞ্চ ধরতে হবে তাকে।
স্ত্রী ঝিনু আর কোলের মেয়ে নিয়ে সন্ধ্যায় লঞ্চে ওঠে সানু। মায়াকে রেখে যায় মিলনের মা’র কাছে। বাড়ি থেকে রওয়না হওয়ার সময় আলোর বাড়ি থেকে আলোর ঠিকানা নিয়ে আসে। আলোই ছায়াকে এনে কাজে দিয়েছে।
লঞ্চের এক কোনায় চাদর বিছিয়ে বসে আছে সানু আর ঝিনু। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কারো মুখে কোন কথা সরছে না। ঝিনু মনে মনে ঢাকা মেডিকেল কেমন হবে তা ভাবার চেষ্টা করতেছে কিন্তু চোখে বরাবর ভেসে উঠছে সদর হাসপাতালের ছবি।
পানির বুক চিরে চিরে লঞ্চ ঢাকার নৌবন্দরে পৌঁছল। লঞ্চ থেকে নেমে আলোর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সানু। কিছুক্ষণের মধ্যে আলো এসে তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসল। মেডিকেলে এসে সানুর চোখ পুড়ে কাঠ হল। ঝিনুর চোখ দিয়ে দরদর করে জল ঝরছে। বিলাপ করবে কি না বুঝে ওঠতে পারছে না। ছায়া মিনমিন করে একটু তাকাচ্ছে। নাকের গর্তে খাদ্যনল। হাতে শিরায় স্যালাইন চলছে। শরীরে মাংস বলতে তেমন কিছু নেই। চামড়া দিয়ে হাড়গুলো মোড়ানো। অনেকটা হাতে আঁকা ভূতের ছবি যেন। শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় ব্যান্ডেজও আছে।
সানু ঝিনু দুজনই ছায়ার মুখের উপর তাকিয়ে আছে। কি করবে বা করতে হবে বুঝে ওঠতে পারছে না। মৃত নয় মৃতের মতো সন্তান চোখের সামনে নিয়ে বসে থাকা দারুণ কঠিন। এই নির্মম নিষ্ঠুরতা প্রকাশের কোন ভাষা নেই। শুধু সহ্য করতে হয়।
ছায়ার অস্ফুট ঠোঁট কিছুক্ষণ পরপর কাঁপছে। সেই ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে ঝিনু। নির্বাক ছায়ার ঠোঁট সানুর কানে যেন বলছে - ‘আব্বা মুই কি খুব বেশি খাইতাম? ক্যা মোরে এইহানে দিলেন?’
সানুর মগজে তাড়া বাড়ছে। ছায়ার ঠোঁটও আরো কাঁপছে। চোখের পিটপিটানিও বাড়ছে, সাথে ঘন শ্বাস। সানু আর স্থির থাকতে পারছে না। ‘মা, ছায়া ...ছায়া ...এই ছায়া ...’
ছায়া স্থির চোখে তাকিয়ে আছে তার মা-বাবার দিকে আর যেন ঠোঁট নেড়ে বলছে -'আব্বা মুই কি খুব বেশি খাইতাম? ক্যা দিছিলেন এইহানে?'
0 মন্তব্যসমূহ
অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।