সচেতনতা হচ্ছে যুগপত অনুভব ও প্রজ্ঞার সমানুপাতিক সংমিশ্রণ। মনুষ্যত্বের এই এক প্রধান নির্দেশক, যার মাধ্যমে মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে নিজেকে পৃথক করেছে। সচেতনতাই মনুষ্যত্ব, কারণ মানুষের জীবন কখনই সহজ সরল সমান্তরাল, নির্দিষ্ট, মসৃণ নয়। তার চলার পথ সব সময় এলোমেলো, অমসৃণ, বন্ধুর। তাকে যে কোন মুহূর্তে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, গাছ-পাথর অর্থাৎ বিভিন্ন বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হতে পারে। এটাই মানুষের ভবিতব্য। এই যে মানুষের অনির্দিষ্ট, অনিশ্চিত ও বন্ধুর পথে হাঁটাচলা এ তার শ্বাশ্বত অবস্থান। মানুষ যন্ত্র নয় যে, তার চলার পথ সুমসৃণ পিচঢালা হতে হবে, কিংবা হতে হবে সমান্তরাল রেল। যন্ত্র বা যান্ত্রিকতা স্বপথ থেকে বিচ্যুত হলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, কিন্তু মানুষ হয় না। কারণ সে নিজেই নিজেকে প্রতিকুল পরিবেশ থেকে উদ্ধার করে সহনশীল পরিবেশে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। আর তাতে তার প্রধান সহায়ক তার সচেতনতাবোধ । তাই সচেতনতা ও মনুষ্যত্ব সমান মানদন্ডে প্রশংসিত।
পশুর জীবনে এত ঝামেলা নেই। বিভিন্ন পরিবর্তিত পর্যায়কে পর্যবেক্ষণের শ্রান্তি নেই । তার সামনে খাদ্যসদৃশ যা উপস্থিত হয় তাই তার খাদ্য; শত্রুসদৃশ যে উপস্থিত হয় সেই তার শত্রু। অখাদ্যকে খাদ্য বা শত্রুকে বন্ধু বানাবার মত কোন প্রেরণা, প্রচেষ্টা বা তাড়না তার মধ্যে নেই। প্রকৃতিতে সে যে অবয়বে, অবস্থানে উপস্থিত হয়েছে তাতেই সে সন্তুষ্ট। মনুষ্যত্ব এমন অমানবিক উপলব্ধিকে স্বীকার করে না। কিন্তু আজ একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে বসে থেকে মনে হচেছ ‘আমি হয়তো মানুষ নই।’ নির্মলেন্দু গুণ আক্ষেপ করে বলেছিলেন তিনি হয়তো মানুষ নন, কারণ সাপ দেখলে এগিয়ে যান, অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরেন। আমিও তাই বলছি।
আমাদের চারপাশের অবয়বিক মানুষগুলো সবাই যেন অন্তরে রূপান্তরিত হয়েছে সাপ, বাঘ, সিংহ, হায়েনা, শিয়াল সদৃশ কোন মানবেতর হিংস্র প্রাণীতে। আমরা সবাই আজ সহিংস ও আক্রমনাত্মক। কেউ কাউকে বিশ্বাস করি না, ভালবাসি না। এর মূল কারণ আমাদের চিন্তা-চেতনা, মগজ-মনন এর দরিদ্রতা। স্বাধীনতার পর এত বছর পার হয়ে গেছে আজও দেশের বেশীরভাগ জনগণ বাস করে দরিদ্র সীমার অনেক নিচে, এখনও এদেশে সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে সযত্নে লালন করে অধিকাংশ জনগোষ্ঠী। যারা শিক্ষিত বলে সরকারী নথিভূক্ত হয়েছে বা নিজেকে দাবী করে তাদের মধ্যে প্রচন্ডরকম অভাব রয়েছে মনস্বীতার। তারা কেউ চিন্তা করতে জানে না। তারা মনে করে জাতির এই দরিদ্রতা, দ্বীনতা, মূর্খতা, হিংস্রতা, পিছিয়ে থাকা, কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কারপ্রবণতা সব কিছুই প্রকৃতি নির্দিষ্ট। মানুষ পারে না একে বদলাতে। আর এখানেই তারা পরিচয় দেয় তাদের সংকীর্ণতা, হীনমন্যতা ও জ্ঞানপাপের।
প্রাণ মাত্রই পরিবর্তনশীল। জীব ও উদ্ভিদের প্রাণ আছে দৈহিক দিক থেকে আর সমাজের প্রাণ আছে সাংস্কৃতিক দিক থেকে। গাছ-পালা, পশু-পাখি, মানুষ-সমাজ সবকিছুই বদলায়। সময়ের সাথে সাথে নিজ রূপ পাল্টায়। নিজের অবস্থানের, অবয়বের, পরিবেশের, সৌন্দর্যের, চিন্তার, মননের পরিবর্তন ঘটায়। শুধু পরিবর্তন ঘটেনা বস্তুর ও আমাদের মুরুব্বীদের চেতনার। পাথর, টেবিল, চেয়ার, কাগজ, ঘর, পাহাড় - এগুলো কোনকিছুই নিজে থেকে নিজেকে পাল্টাতে পারেনা। অন্য কেউ এসে বলপ্রয়োগে, তাপ প্রয়োগে, চাপপ্রয়োগে তাদের অবস্থানগত, অবয়বগত, রূপগত, মূলগত পরিবর্তন না ঘটালে তারা নিজেদের পূর্বিক অবস্থানে অপরিবর্তিত থাকে; থেকে যায়। কারণ এরা কেউ বেঁচে নেই, সবাই জড় পদার্থ। এই অবস্থা আমাদের মুরুব্বীদের। সমাজের মুরুব্বীদের চেতনাকে আমার মৃত বলতে ইচ্ছে করে। আরও ইচ্ছে করে এটা বলতে যে মুরুব্বীদের মগজ শুকিয়ে জড় পদার্থে পরিণত হয়েছে। তারা না পারছেন বহির্জগতকে দেখতে, না পারছেন নতুন কিছু শুনতে, বুঝতে, চিন্তা করতে ও গ্রহণ করতে। মহাকালিক শৈবাল জড়ো হয়েছে তাদের মগজের ভাঁজে ভাঁজে; স্থবির, মুক্ হয়েছে সবাই। “বর্তমানে আমার যে অবস্থান তা মানসম্মত নয়; আন্তর্জাতিক মানদন্ডে এটা মানবিক নয়, আমার এই অবস্থান পাল্টানো দরকার নইলে মনুষ্যত্বের পতাকা বাহক হতে পারবো না, আর Global Village এর বাসিন্দা হওয়া তো দূরের কথা”- এই সহজ সত্যটা বোঝার মত, বহন করার মত বুদ্ধিবৃত্তিক সৌকর্য ও ক্ষমতা তাদের নেই। অথচ এরাই আবার নিন্দা, আক্রমণ ও ব্যবহার করে তারুণ্যকে। যে তারুণ্যের জীবনের পাথেয় হচ্ছে সততা, ন্যায়নিষ্ঠতা, সৌন্দর্যবোধ ও মানবতা, সর্বোপরি ভালবাসা। যে তারুণ্যের দিকে চোখ তুলে তাকাবার মত যোগ্যতা আমাদের মুরুব্বীদের নেই (তারা সবাই মিথ্যাচার, বিশ্বাসহীনতা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ভন্ডামো অর্থাৎ সার্বিক স্ববিরোধীতায় আকন্ঠ ডুবে আছেন) সেই তারুণ্যকে তারা চোখ রাঙান। তারুণ্যকে করে রাখতে চান বাস্তববিমুখ। তাদের স্থবির মগজপ্রসূত ন্যায়নীতিকে বহন করাতে চান তারুণ্যকে দিয়ে। তারা মনে করেন এই সহিংসতার মাধ্যমেই অজ্ঞতা ও চিন্তাহীনতা, সংস্কারপূর্ণ কুসংস্কার অর্থাৎ সর্বোপরি একটি ভাববাদী শাসন টিকিয়ে রাখা যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এ লক্ষ্যে এই প্রথাদাসরা হরণ করেন স্বপ্ন। সমাজ ও তারুণ্যে প্রতিষ্ঠিত সমস্ত স্বপ্নকে তারা নিন্দা করেন নির্দ্বিধায়। প্রত্যাশা করেন ভাববাদী দাসত্ব। ফলে বেড়ে যায় হতাশার তান্ডবলীলা। যা আমরা এখন প্রতিদিন ভোগ করছি।
সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন -
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
তাঁর দর্শন এখনও মিথ্যে হয়ে যায়নি। বরং ক্ষুব্ধতা আরও বেড়েছে। Chris De Burg এর ভাষায় বলা যায় -
We said nothing would make us change in any way,Since yesterday-were just the same,Since yesterday-nothing has changedSince yesterday-were just the sameBut I can feel there's a new kind of hunger insideTo be satisfied.
আজ দেশে স্বপ্নের দূর্ভিক্ষ লেগেছে। কবিরা কবিতা লেখার স্বপ্ন দেখে না; তরুণরা বেঁচে থাকার, ভালবাসার, এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখেন না; চাষী স্বপ্ন দেখেন না সংবৎসরের সমৃদ্ধির; শিক্ষক স্বপ্ন দেখেন না মানবাদর্শের; বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানীরা দেখেন না সৃষ্টিশীলতার স্বপ্ন। এ ব্যাধি ছড়িয়ে গেছে সমাজের সবখানে। এক অনন্ত স্বপ্নহীনতার মাঝখানে আমরা নিয়ত বসবাস করছি। ফলে মনুষ্যস্তর থেকে আমাদের অবনতি ঘটছে। আমরা ক্রমান্বয়ে পরিণত হচ্ছে মানবেতর কোন প্রাণীতে, কারণ পশুরও নিয়ত বসবাস স্বপ্নহীন এক ধূসর পৃথিবীতে। যা আজ আমাদের জাতীয় আচরণ। সারা বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নীল আগামীকালের দিকে, আমরা সেখানে পিছিয়ে যাচ্ছি মোহান্ধ অতীতে। অশরীরীর মত আমরা পিছন দিকে পিছিয়ে যাচ্ছি এক পা, দু’পা করে।
মানুষের, সমাজের, জীবনের ইতিহাসে পিছিয়ে যাওয়াকে কখনই সমর্থন করা হয়নি, এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে তার দর্শনগত উপলব্ধি। ‘গতিতে জীবন মম, স্থিতিতে মরণ’। এগিয়ে যাওয়া, ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে প্রাণের চিরন্তন দাবী, আচরণ। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ‘যে প্রেম সম্মুখে চলিতে, চালাতে নাহি জানে’ তা প্রেম নয়। আসলেই তাই; সিঁড়ি ভেঙ্গে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া, ক্রমাগত উপরে উঠা, বন্ধুর পথকে পিছনে রেখে সামনের দিকে তাকানো, বিবর্ধিত হওয়া এবং বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবর্তন এতেই মানুষের মনুষ্যত্ব, এখানেই মানুষ রচনা করে ইতিহাস, সাহিত্য, রচিত হয় আদর্শ- এটাই স্বাভাবিক। এটাই বাস্তব, বাস্তবতা।
বাঙালি জীবনে দেখা যায় এর বিরুদ্ধাচরণ। প্রাকৃতিক সমর্থনকে এড়িয়ে বাঙালি রচনা করে বাস্তববিমুখ এক ভাবাদর্শ। অশরীরীর মত মাটির দু’আঙ্গুল উপরে ভেসে থেকে ভাবাদর্শের মাধ্যমে বাহিত হতে চায় পিছন দিকে। যেন বাঙালি মানুষ নয়, অশরীরী, অলৌকিক কোন মিথ্যে সত্ত্বা মাত্র।
বাঙালির গর্ব রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘সত্য যে কঠিন, সেই কঠিনেরে ভালবাসিলাম, সে কখনও করে না বঞ্চনা’। বাঙালি কিন্তু তার প্রাণপুরুষের এ কথাকে মানে না, বিশ্বাসও করে না, যেমন বিশ্বাস করে না নিজেকেও। সত্য এবং বাস্তবতাকে সে প্রচন্ড ভয় করে। তাই তার আশ্রয় হচ্ছে কল্পনাপ্রবণ এক স্থবিরতা। বাস্তবতা ও সত্যতা থেকে যার অবস্থান অনেক দূরে। তাই বোধহয় হুমায়ুন আজাদ বলেছেন-
বাঙালি একশত ভাগ সৎ হবে, এমন আশা করা অন্যায়। পঞ্চাশ ভাগ সৎ হলেই বাঙালিকে পুরস্কার দেয়া উচিত।
রবীন্দ্রনাথও বুঝতে পেরেছিলেন বাঙালির অন্তরস্থ এই মৌলিক সত্যটি। তাই ক্ষোভে, দুঃখে উচ্চারণ করেছিলেন-
...রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি।
রবিঠাকুরের এই অমোঘ উপলব্ধির পর কেটে গেছে অনেক সময়।
আজ এই পরিবর্তিত প্রতিবেশে একবিংশ শতাব্দীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি ‘বাঙালি কি মানুষ হতে পেরেছে? আমি কি মানুষ?’ মনুষ্যত্বের সঠিক সংজ্ঞা কি?
2 মন্তব্যসমূহ
এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম৷ বেশ গতিশীল লেখা৷ তবে শেষে যে প্রশ্ন করেছেন তা আমারও - বাঙালি কি মানুষ হতে পেরেছে? তারা কি মনুষ্যত্যের সংজ্ঞা বোঝে? ধন্যবাদ লেখককে এমন দার্শনিক চিন্তার লেখা উপহার দেবার জন্য৷ এ ধরণের লেখা এযুগে বিরল৷
উত্তরমুছুনচিন্তার ভালো রসদ যুগিয়েছন এই প্রবন্ধের মাধ্যমে।
উত্তরমুছুনআমাদের চিন্তার মুক্তি হয়নি,বাঙালির চিন্তার মুক্তি হওয়া দরকার। চমৎকারলিখেছে।
অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।