....

‘কবি তা-ই লিখবে যা সে বিশ্বাস করে’ : কবি সোয়েব মাহমুদের সাক্ষাৎকার

কবি সোয়েব মাহমুদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৪ সালের ২৩ নভেম্বর,  গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ায়। জন্মের পরপরই মোহম্মদপুর নুরজাহান রোড চলে আসেন। এখন মোহাম্মাদিয়া হাউজিং সোসাইটিতে চারবছর যাবত। 
     একাডেমিক পড়াশুনা বিষয়ে জানতে চাইলে কবি দিব্যককে বলেন, ‘১৯৯১ সাল থেকে ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাইস্কুল, এরপর আদমজী ক্যান্টঃ কলেজ, এরপর দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর কলেজ অফ ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, সাইপ্রাস। এরপর... এরপর নাইবা জানলেন হা হা হা, রহস্য থাকা ভালো।’
     এখন অব্দি তাঁর পাঁচটি কবিতার বই ও একটি সম্পাদিত কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। আমরা ই-মেইলের মাধ্যমে ৩১ আগস্ট ২০১৯ তারিখে তাঁকে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম, তিনি যে উত্তর আমাদের পাঠিয়েছেন, আমরা তা হুবহু প্রকাশ করলাম। -সম্পাদক

সা ক্ষা  কা 
❑❑


প্রশ্ন
ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন? মানে ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় কী লিখেছেন, তা নয়; বরং মনের ভেতরে সুপ্ত বাসনা ছিলো কি কোনো কিছু হবার জন্য?

সোয়েব মাহমুদ
আসলে প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ আমার সাক্ষাৎকার সেটা যে মাধ্যমেই হউক তা নেয়ার জন্য। দিব্যক পাঠকের কাছাকাছি পৌঁছে যাক শীঘ্রই।  

আসলে মাই এইম ইন লাইফ - রচনাটা আমার কাছে একটা রচনাই মাত্র, যেখানে ১৫ নম্বর নির্ধারিত থাকতো, আমি সবসময় যদি কোন অপশন না থাকতো তবে ৮৫ নম্বরের উত্তর করে বেরিয়ে যেতাম, my aim life তাই আমার কাছে একটা রচনামাত্র যা আমি লিখিনি কোথাও  

প্রশ্ন
একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষসত্তা’কে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?

সোয়েব মাহমুদ
আসলে কবি- কবি বা মানুষ যখন একটা লাইন লিখে ফেলেন কবিতায়, ঠিক তখন থেকে তার কোন দ্বৈত-সত্তা থাকতে পারে না। তাই হাসি আমি খুব জোরে প্রচন্ড স্বরে যখন কেউ বলেন ব্যাক্তি হুমায়ুন আর লেখক হুমায়ুন আলাদা স্বত্তা, ব্যাক্তি আল মাহমুদ আর কবি আল মাহমুদ এক করবেন না। এসব বাক্য স্রেফ হিপোক্রেট মানুষ, হিপোক্রেসি যাদের অস্ত্র তারাই বলেন কী না! কারন যদি আমি লেখক আর মানুষ আলাদা স্বত্তা করে ফেলি তাহলে'তো আমার তীব্র ঘৃণা থেকে গোলাম আযম বেঁচে যান, কারণ উনি তো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চারজন সংগঠকের একজন। ধর্ষক কেবলই ধর্ষক যদি সে আর্কিমিডিস, শেক্সপিয়র, কাফকা, বোদলেয়ার, যে-ই হউক না কেনো? কবি'র কোন আলাদা স্বত্তা নেই, থাকতে পারে না। আশা করি বোঝাতে সক্ষম আমি।

প্রশ্ন
জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানের জীবন সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?

সোয়েব মাহমুদ
আমি তো জন্মাই নি এখনও, হ্যাঁ তবে মৃত্যুটা বারবার টের পেয়েছি। আসলে ২৯ বার আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ এ জীবন যখন, তখন একজন রাকিবুল হায়দার আমাকে কবিতায় এনে বলেন- এখন মারা যান। তারপর থেকে কবিতা লিখছি, কবিতায় মারা যাচ্ছি বারংবার প্রতি লাইনে, প্রতিবাক্যে। সহজভাবে বলতে গেলে আমি অন্ধকার ভালোবাসি, আলো মানে প্রপঞ্চকর মায়া। জন্ম তাই মায়ের জরায়ুর অন্ধকারে, একটি কবিতা লিখতে পারলেই হবে যে মৃত্যু তাও মূলত অন্ধকারই। 
এর মাঝের জীবন যা টেনে নিয়ে যাচ্ছি, মুছে পদচারণ করতে করতে- তা মূলত কবিতার। 

প্রশ্ন
লেখার ক্ষেত্রে আপনার কোনও প্রেরণার জায়গা আছে কি?

সোয়েব মাহমুদ
সহজ ভাষায় মানুষ। মানুষকে আমি ভালোবাসি পাগলের মতন।

প্রশ্ন
বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনা চর্চা কতটা গঠনমূলক হচ্ছে?

সোয়েব মাহমুদ
দেখুন আমরা অনেকেই বলি কবিতা পড়ছে না মানুষ, যা ডাহা মিথ্যে, মানুষ পড়ছে- যথেষ্ট পড়ছে- কিন্তু কবি'রা আটকে গ্যাছে। মানুষের কাছ থেকে মানুষের কবিতা সরে গ্যাছে। কবি ব্যস্ততায় সময় কাটাচ্ছেন শিল্প করবেন বলে। কবি'র দর্শনের জায়গা পাঠককে পরিস্কার করতে পারছেন না। আর আমাদের আলোচনা সমালোচনা মানেই তীব্র ব্যক্তিক প্রশংসা অথবা আক্রমণ। গঠনমূলক কিছু হচ্ছে না। দশ-বারোজন একসাথে হাটছে কম ভারী ভারী নাম পড়ছে বেশি। কিন্তু...

প্রশ্ন
‘কবিতায় ছন্দ’ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?

সোয়েব মাহমুদ
দেখুন পৃথিবীর সব কিছুই কোন না কোন ভাবে ছন্দে পড়েই যাচ্ছে, এ-ই যে ছন্দপতন বা ছন্দহীনতা এটাও কিন্তু ছন্দ এক ধরণের। সমস্যা হচ্ছে যখন শিক্ষক নিয়ন্ত্রণ করবেন অথবা করতে চাইবেন কবিতা তখন প্রধান হবে ছন্দ, তখন ভাত-টাত খেতে টেবিলে বসে একটা হাত লুংগীর ভেতর ঢুকিয়ে লেখা হবে কবিতা যা মানুষকে ছোবে না কোনদিন। 
কবিতা মানে প্রকৃতিপ্রদত্ত ওহী, যা নাযিল হবে প্রকৃতির ভাষায়, যা এনকোডিংএ-র মাধ্যমে আমরা পাবো বড়জোর ১৬-১৭% তাকে মানুষের জন্য মানুষের ভাষায় লেখাটাই কবি'র একমাত্র কাজ, আমি ছন্দেই লিখবো এ-র বাইরে না- সেটা কবিতা হবে না প্রবন্ধ হলেও হতে পারে। কারণ "প্রেমিকাকে চুমু খাওয়ার বিশ নিয়ম" - এর বই কিনে পড়ে আমি কবিতা লিখি না।


প্রশ্ন
ছোটবেলায় কি লেখালিখি করতেন?

সোয়েব মাহমুদ
আমার মায়ের হাতে হাত রেখে স্লেটে লেখা প্রথম স্বরে "অ" আমার প্রথম কবিতা। 

প্রশ্ন
লিখতে কেমন লাগে?

সোয়েব মাহমুদ
আমি তো লিখি না, আমি কথা বলি। তাই বলতে পারছি না।

প্রশ্ন
আপনি কী ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন?

সোয়েব মাহমুদ
সব ধরনের কোন ক্যাটাগরি নেই। এমন কী বাসে টেম্পুতে দেয়া কলকাতা হার্বালের বিজ্ঞাপনগুলোও। 

প্রশ্ন
এখন কোন বইটা পড়ছেন?

সোয়েব মাহমুদ
এখন পড়ছিলাম ভাস্করের "শয়নযান"; প্রতিমাসে একবার পড়া হয়, আর পড়ছিলাম ডানবারের " lyrics of lowly "

প্রশ্ন
আপনি বারবার পড়েন, এমন কবির নাম জানতে চাই।

সোয়েব মাহমুদ
রাকিবুল হায়দার, সাম্য রাইয়ান, আহমেদ মওদুদ, রাইসুল নয়ন, হৃদয়, হিমেল হাসান বৈরাগী, কৌশিক, শুভ্র, সজল, তামান্না তুলি, জীবনানন্দ দাশ, শহীদ কাদরী, রফিক আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ভাস্কর চক্রবর্তী, আহমদ ছফা। 

প্রশ্ন
বর্তমান সময়ের কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলেন। কবির কি পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিত?

সোয়েব মাহমুদ
জনবিচ্ছিন্নতা - শব্দটা জোশ কিন্তু। দূর্বোধ্যতা একটা টার্ম যা পূর্ববর্তী কবি'রা যখন দেখেন পরবর্তী যারা আছেন তারা অচলায়তন ভেঙ্গে ফেলছেন তখন পত্রিকার পোষা প্রাবন্ধিক দিয়ে প্রচারণা চালান। 
তবে হ্যাঁ এটা সত্য যে জনবিচ্ছিন্নতা তৈরী হয়েছে অনেক - কবি তা-ই লিখবে যা সে বিশ্বাস করে, কবি তা লিখবে না যা সে বিশ্বাস করে না কিন্তু প্রতিষ্ঠা পেতে পত্রিকায় ছাপা হতে কাজে লাগে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে - প্রবলভাবে দায়বদ্ধ একটা সময় আমরা পার করছি দায়বদ্ধহীনতার অপরাধ করে শুধু "পাঠকের ইচ্ছে মতন লিখি না" এ-ই মিথ্যে প্রলাপে। এবং এ-ই লাইনগুলো কবি নিজেই বলেন অথচ কবিতা লিখেন বিচিত্র গোষ্ঠীর ফাই ফরমায়েশে। কেনো অন্যায় বাড়ছে জানেন, কারণ কবি'রা কবিতার জন্য, মানুষের জন্য এমনকী নিজের জন্য কবিতা লিখছেন না ২৮ বছর। তারা লিখছেন প্রতিষ্ঠা পেতে, অনুকম্পা পেতে, কবিতা ছাপা হবার জন্য। তাই বইমেলায় হুমায়ুন মারা গেলেও তাকে কপি করা তার ভাষায় লেখা নতুন লেখকের দাম বেশি, জীবনানন্দের ভাষায় কবিতা লেখা কবি'কে নিয়ে আলোচনা বেশি। অথচ নিজস্ব, স্বকীয়ভাষা তৈরী করেছেন যে ক'জন তাদের নামই জানিনা আমরা। কবিতা লিখছি (স্বান্তনা) অথচ কবিতা যাচ্ছে না মানুষের কাছে, তাই মানুষ আলোড়িত হচ্ছে না, তাই অন্যায় স'য়ে নেয়াটা অভ্যাস এখানে, তাই রাষ্ট্র নিরোধের ব্যবসায় লাভজনক অবস্থায়। 
এভাবে বিশাল এক জনবিচ্ছিন্নতা তৈরী হয়ে গ্যাছে। কবি'কে নিজের জীবন, নিজের কথা বলতে হবে। বলেন তো ১৯৯০ সালের পর ক'জন কবি'র, কয়টা কবিতায় আপনি আপনাকে পেয়েছেন? কিংবা পেয়েছেন আমাদের ছয়টা ঋতুকে? পান নি কারণ এখানে প্রকট বসন্ত বর্ষা অথচ প্রকট নয় প্রবল হবার কথা। 

প্রশ্ন
লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে অন্তর্জালকে কীভাবে দেখছেন?

সোয়েব মাহমুদ
যুগের চাহিদায় অন্তর্জাল স্রেফ একটা দূর্দান্ত প্ল্যাটফর্ম, এ-র বাইরে কিছু নয়।

প্রশ্ন
আপনার কি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে?

সোয়েব মাহমুদ
হ্যাঁ, অবশ্যই আমি মানুষ এবং বাংলাদেশে বিশ্বাস করি, এটাই রাজনৈতিক দর্শন আমার।

প্রশ্ন
আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন, না কি বারবার সংশোধন করেন?

সোয়েব মাহমুদ
এটা আসলে বলে কয়ে হয় না, আমার সকল কবিতাই মোটামুটি রাস্তায় হাটতে হাটতে কিংবা অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে লেখা কবিতা। আমি মেধাবী নই, মাথায় শব্দ নিয়ে হাটা মানুষ নই। তাই আমাকে লিখে ফেলতে হয়। কিছু কবিতা যেমন "দেখা অদেখা কাব্য, দুইশো তেত্রিশ কিলোমিটার, বাবুই, সিড়ি ভাঙ্গছি সিড়ি, আর ট্রাম দূর্ঘটনার আটদিন পরশম্ভুনাথ হাসপাতাল রাত এগারো পয়ত্রিশ এ-ই কবিতাগুলো সংশোধন হচ্ছে এখনও, শেষে যে কবিতার কথা বললাম এটা সাড়ে তিনবছর যাবত লিখছি, এখন পর্যন্ত ৩৪ পৃষ্ঠা হয়েছে। প্রতিদিন লিখছি। 

প্রশ্ন
আপনার প্রেমের কবিতাগুলো কি কল্পনাসৃষ্ট না কি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ?

সোয়েব মাহমুদ
ব্যাক্তিগত, প্রেম কল্পনা করতে পারি তখনই যখন সেটা ব্যাক্তিজীবনে হয়েছে। আসলে টেমস নদী না দেখে কখনও টেমস নিয়ে লিখতে আমি পারি না।

প্রশ্ন
আপনি দিনের কোন সময়টাতে লিখতে পছন্দ করেন? কোনো রুটিন আছে কি এ ব্যাপারে?

সোয়েব মাহমুদ
নাহ কবিতা আমার অক্সিজেন আমার জন্ম আমার মৃত্যু, এখানে রুটিন নেই, আচ্ছা সঙ্গমের কি রুটিন হয়? 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. না, সঙ্গমের কোন রুটিন হয় না, সঙ্গমও অক্সিজেনের মতো তয়....

    উত্তরমুছুন

  2. ব্যাক্তিগত, প্রেম কল্পনা করতে পারি তখনই যখন সেটা ব্যাক্তিজীবনে হয়েছে। আসলে টেমস নদী না দেখে কখনও টেমস নিয়ে লিখতে আমি পারি না।-- চমৎকার অভিব্যক্তি।

    উত্তরমুছুন

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।