আমরা স্বপ্ন দেখি নাআমাদের হৃদয় উত্থান করেআমাদের বুক, চোখ, মুখ, নিতম্বেকামার্ত প্রেম জাগে!আর দর্শকের করতালিঅন্য কোন শব্দের অনুষঙ্গ খোঁজে৷(একা বহমান সুন্দর / সৈয়দ সাখাওয়াৎ)
যে কোনও বিষয় যথার্থ বুঝতে হলে অবশ্যই তা দেখা উচিত অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত চলমান ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে; ধারাবাহিকভাবে। কিন্তু এই লেখায় তা করা সম্ভব নয়; কেননা এদেশে ঘটে যাওয়া, ঘটতে থাকা ধর্ষণের যদি অতিসংক্ষিপ্ত বর্ণনাও করতে চাই, তাহলে তার পরিমাণ এত বেশি হয়ে যাবে যে, তা বিশালাকার বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানের সবগুলো খণ্ডকেও ছাড়িয়ে যাবে। বাঙলাদেশ এখন ধর্ষণের উর্বরক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই যে দেশব্যাপি এত এত যৌন সন্ত্রাসী, তা কি একদিনে অথবা হঠাৎ করেই তৈরি হয়েছে? নিশ্চয়ই তা নয়। দিনের পর দিন সামাজ ও রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে বিকৃতমনষ্ক মানুষ গড়ে তোলা হয়েছে, হচ্ছে। একদিকে মানুষ হবার গণতান্ত্রিক শিক্ষাহীনতা, অপরদিকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে বিপর্যস্ত এদেশের জনগণের মনোজগৎ-সংস্কৃতি।
এই দেশের সামগ্রিক সমস্যার প্রধান কারণ এর শিক্ষাসংকট। বাঙলাদেশের অগণতান্ত্রিক, বহুধাবিভক্ত যে শিক্ষাব্যবস্থা, সেখানেই সমস্যার প্রকৃত কারণ লুকিয়ে আছে। অতএব নজর দিতে হবে ওইদিকে। একজন মানুষ কেমন হবেন, তার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে তা নির্ভর করে তার শিক্ষার উপর। আপনি যদি কাঁঠাল ফল খেতে চান তাহলে কাঁঠাল গাছ থেকেই খেতে হবে; পেয়ারা গাছ আপনাকে তা দিতে পারবে না। তেমনিভাবে, আপনি যদি বাঙলা ভাষার বিকাশ ও উন্নয়ন কামনা করেন, তাহলে বাঙলাকে সেই অনুযায়ী যথাযোগ্য মর্যাদায় কাজে লাগাতে হবে। যদি মাদ্রাসার কাছে বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ আশা করেন, তবে তা হবে আপনার ভ্রান্তি অথবা ভণ্ডামি।
এদেশে দুই ধরণের মানুষ পুরুষতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে। প্রথমদল টাউট। এরা নিজেদের প্রয়োজনে, পরিবর্তিত সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত কৌশল নির্মাণ করে। অপরদল প্রথমদলের আজ্ঞাবাহি। এরা অশিক্ষিত, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, দাস। এই দুই দলভুক্ত সদস্যদের সকলে পুরুষ নয়, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীও রয়েছেন।
পুরুষতন্ত্রের প্রধান মৌলিক প্রবণতা হলো নারীর শরীর ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া। প্রাকৃতিকভাবে যেহেতু নারী শক্তির আধার, তাই তাকে নিজ অধিনস্ত ক'রে, তাঁর শক্তি করায়ত্ব ক'রে ক্ষমতার রদবদল ঘটানোই পুরুষতন্ত্রের মূল লক্ষ্য। পুরুষতন্ত্রের রোগে এদেশে ডানপন্থীদের পাশাপাশি উল্লেখসংখ্যক বামপন্থীও আক্রান্ত। সব্যসাচী লেখক হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন,
রূপসীর সামান্য নগ্ন বাহু দেখে ওরা হৈ চৈ করে, কিন্তু পথে পথে ভিখারিনির উলঙ্গ দেহ দেখে একটুও বিচলিত হয় না।
নারীশরীর নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে পুরুষতন্ত্রের অনেক পুরনো তরিকা আছে। একজন নারী কতটুকু/কীভাবে হাসবেন বা কাঁদবেন, শরীরের কোন অংশ কতটুকু খুলে রাখবেন বা ঢেকে রাখবেন, কখন/কোথায়/কীভাবে যাবেন বা যাবেন না, কোন পোশাক পড়বেন বা পড়বেন না; এমন কি যে সন্তান পেটে ধারণ করেন নারী, সেই সন্তানের বিষয়েও সমস্ত সিদ্ধান্ত পুরুষতন্ত্রই গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে স্থানভেদে প্রয়োজনানুযায়ী ভালোবাসা, পেশিশক্তি, প্রথা, আইন, ফতোয়া, ধর্ম, যুদ্ধ, তত্ত্ব ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিল করাই পুরুষতন্ত্রের রণনীতি। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের বাস্তবতা হলো, পুরুষতন্ত্র জারি রাখতে আগের মতো সকল ক্ষেত্রে প্রবলভাবে পুরুষদের হাজির থাকতে হচ্ছে না। বরং অনেকক্ষেত্রে নারীরাই পুরুষতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে প্রধান ভূমিকা রাখছে।
ক্যাপিটালিজমের নির্মম পরিহাস হলো, অনেকক্ষেত্রে বাম এবং ডান উভয়পন্থীকেই সে পুরুষতন্ত্রের রক্ষকের কাতারে দাঁড় করিয়েছে।
ডানপন্থী মৌলবাদিরা তো আগে থেকেই নারীকে গৃহবন্দী করার ব্যাপারে জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছে। মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে এর সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু বামপন্থী মৌলবাদি। পুরুষতন্ত্রের এই সেবকদেরও তীব্র আকাঙ্ক্ষা নারীকে নিয়ন্ত্রণের। এরা সেই নারীকেই প্রশ্নবানে জর্জরিত করে, যে নারী নিজ শরীর-মন নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতে চান। আবার, পুরুষতন্ত্র দ্বারা মগজধোলাই হবার কারণে এক ধরনের বাম নারী/পুরুষের ধারণাই হয়েছে এমন যে, বামপন্থী হতে হলে নির্দিষ্ট বেশধারী হতে হবে। এই সমস্ত প্রবণতাগুলোই পুরুষতন্ত্রের ফসল। আশ্চর্য সত্য এ-ই যে, বাইরে নারী অধিকার আদায়ের কথা প্রচার শেষে বাড়ি ফিরে স্ত্রী পেটানো, স্ত্রীকে বাড়িতে আটকে রাখা, পোশাক থেকে শুরু করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া কিংবা পর্ণো ছবি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে স্ত্রী ধর্ষণ; এই সবই পুরুষতন্ত্রের অন্যতম প্রবণতা।
এই ধরনের মৌলবাদি বামপন্থীরা ডানপন্থীদের বক্তব্যের তত্ত্বায়ন করে। এদের সংখ্যা যদিও সামান্য তবুও এই রোগের দ্রুত প্রতিকার করতে না পারলে এরা বাম আন্দোলনের জন্য ভয়ংকর ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। মহামারী রূপ নেবে।
যে নারী উপরোক্ত মৌলবাদিদের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয়, সে ঘরে-বাইরে অজস্রবার ধর্ষিত-নিপীড়িত হয়েও মুখ বুজে সহ্য ক'রে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। এসবের খবর আমরা জানতেই পাই না। আর যে নারী ধর্ষিত হয়ে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার আজ্ঞাবাহী না হয়ে প্রতিবাদ জানায়, তার মধ্যেও অল্পসংখ্যক খবরই আমরা মিডিয়ায় পাই। যেগুলোর সাধারণত কোনো বিচার হয় না! উল্টো ঐ নারীকেই গালমন্দ, অপবাদ শুনতে হয়, এক ঘরে হয়ে থাকতে হয়। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা ধীরে ধীরে মানসিক-সামাজিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ঐ নারীকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে।
মূল বিষয় হলো, একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করবে বা করতে চাইবে কেন? কে শাদা শাড়ি পড়বে, কে লাল জামা পড়বে না কি শার্ট-প্যান্ট পড়বে বা হিজাব পড়বে, তা সে নিজেই নির্ধারণ করবে তার প্রয়োজন এবং নিজ বোধ দিয়ে; অন্যের দ্বারা বাধ্য হয়ে না।
এটাই তো ব্যক্তির স্বাধীনতা।
ইসলামি মৌলবাদিরা সবসময়ই জোর গলায় বলে, পর্দা ব্যবহার না করায় ধর্ষিত হচ্ছে নারীরা। অথচ পর্দা ব্যবহারকারী অজস্র নারী ধর্ষণের ঘটনা আমাদের হাতের নাগালেই রয়েছে। শুধু তাই নয়, দুধের শিশু ধর্ষণের ঘটনাও আমাদের জানা। অতএব এইসব খোঁড়া যুক্তি ধোপে টেকে না ।
ধর্ষণ ও সকল প্রকার যৌন সন্ত্রাসের দুই ধরনের সমাধান হতে পারে:
এক. ন্যায় বিচার করে পর্যাপ্ত শাস্তি প্রদান করার মধ্য দিয়ে অপরাপর যৌন সন্ত্রাসীদের ভীতি প্রদর্শন করা। এটি ক্ষণস্থায়ী সমাধান। অবশ্য বলা যায় প্রকৃতপ্রস্তাবে এটি কোনো সমাধানই নয়। এতে যৌনসন্ত্রাস বন্ধ হবে না। আদতে শাস্তি দিয়ে পৃথিবীতে কোন্ও কাজই বন্ধ করা যায় না।দুই. যৌন সন্ত্রাসীর মস্তিষ্ক থেকে আবর্জনা পরিস্কার করা। এটি দীর্ঘস্থায়ী এবং কার্যকরী সমাধান।
ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে অনেকে লিঙ্গ কর্তনের প্রস্তাব করেন। কিন্তু লিঙ্গ কর্তনে প্রকৃতপক্ষে মূল অবস্থার চিরস্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব না। কারণ
ধর্ষণের চিন্তা লিঙ্গের মাথায় থাকে না, থাকে ধর্ষকের মাথায়। অতএব কাটতে হলে ধর্ষকের আবর্জনাবোঝাই মাথা থেকে ঐ নোংরা চিন্তাটিকে কেটে ফেলতে হবে।
রচনাকাল: ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ
2 মন্তব্যসমূহ
ভাইরে, যা বললেন তাতো ঠিক, কিন্তু এটা ক্যাপিটালিজমের পরিহাস নয়, ক্যাপিটালিজমের সফলতা৷ বরং আমাদের ব্যর্থতা যে আমরা ক্যাপিটালিজমকে উপেক্ষা করতে পারিনি, নির্লজ্জ আত্মসমর্পন করেছি৷
উত্তরমুছুনঅভিনন্দন সাম্য রাইয়ানকে,চমৎকার প্রকৃষ্ট প্রবন্ধ লেখার জন্য।
উত্তরমুছুনঅস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।