....

চরাচর | সরদার মোহাম্মদ রাজ্জাক




চরাচর

THE UNIVERSE



০১.

(এই গল্পটির কোনো চরিত্রের বয়স, শারীরিক গঠন, আকৃতি, প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয় নি। গল্পের ভেতর দিয়েই পাঠক বিষয়গুলি সম্পর্কে অবহিত হতে পারবেন)।       


           শেষ পর্যন্ত এক অসামান্য চৈতণ্যলোকের অতি বেগুনি রশ্মিটি ওর চিন্তা প্রবাহের মাত্রাটিকে একটি নির্দ্দিষ্ট সীমার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে দিয়ে স্থির হয়ে গেলো। অবশ্য স্থির হবার অর্থ এই নয় যে, চৈতণ্যের শিখাটি একেবারেই নিভে গেলো। ইরাবতী বোঝে এই স্থির বিষয়ক জটিলতাটি অনিবার্যভাবে সাময়িকতার একটি সীমাকে ইঙ্গিত করছে। চৈতণ্যবোধ স্থির হবার বস্তু নয় এবং কখনই স্থির হয় না- যদি না মৃত্যু নামীয় এক অলঙ্ঘনীয় যন্ত্রনার ভালোবাসা অদৃশ্যলোক থেকে অভিসারে বেড়িয়ে অতিসন্তর্পণে পায়ে পায়ে এসে আত্মাকে স্পর্শ করে। এর বাইরে যদি সে চৈতণ্যকে বোধশক্তির অতিমাত্রিক রক্তিমতা দিয়ে সঞ্জীবিত রাখা যায়। যদিও চৈতণ্য এবং বোধ পারস্পরিক সম্পৃক্ত তবুও এ দুটিকে পৃথক সত্ত্বা হিসেবে গ্রহন করতে হবে- এ কারণে যে, চেতনা থেকে বোধের উৎসারন হলেও ওই উৎসারিত বোধের অসাধারণ শক্তিই আবার একই অর্থে চৈতণ্যকে প্রখর থেকে প্রখরতরতার দিকে ধাবিত করে চৈতণ্যলোককে সমৃদ্ধ করে অবশ্যই। যে কারণে চৈতণ্য বিলুপ্তির পূর্বে বোধের অস্তিত্ব অদৃশ্য হয়ে যায়। এখানে হয়েছেও তাই। ইরাবতীর চিন্তা প্রবাহের মাত্রাটিকে যে স্তরে পৌঁছে দিয়েছে ওর চৈতণ্যলোকের সেই অতি বেগুনি রশ্মিটি সে স্তরটিই হলো ওর সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বশেষ সিঁড়ি। মস্তিষ্কের কোষে কোষে, তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে ওই চৈন্তিক প্রবাহ-মাত্রার যে দূর্দমনীয় রক্তাক্ত সঞ্চরন তাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যতীত দ্বিতীয় কোন জানালা দিয়ে নিজেকে বের করে আনবার ভিন্ন কোন পথ বা উপায় কোনটাই খোলা থাকে না।     

           সাদা শাড়ীর আঁচলে একফোঁটা কালির আঁচড় আর চরিত্রের কপালে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটি কালো টিপের বিন্দুসম কণা- তা সে যতই উজ্জ্বল আর আকর্ষনীয় হোক না কেন- দুটোই এক- কলঙ্কের উৎপ্রেক্ষা। তোমার ধর্মগত দিক থেকে তুমি ঠিক তাই। যেহেতু তোমার ধর্মের ভিত শুণ্য। সেই শুণ্য ধর্মভিতে দাঁড়িয়ে তুমি কপালে কালো টিপ পরে সেজে গুজে ধার্মিক- বস্তুতঃ যা তোমার প্রানান্ত প্রতারণা। এর বাইরে তোমার সঙ্গে তুমি যোগ করেছ একজন অরিন্দম রায়হানকে-যে তোমার Junior Associate- অস্বীকার করবে কি করে ? নিশ্চয়ই আমি মিথ্যে বলছি নাÑ রসুল মালিকের এ কথা গুলিকেই ভাবছে ইরাবতীÑ যে কথাগুলিকে কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না ওকারণ রসুল মালিকের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব কোনো কিছুর সাথেই মেলে না এ কথাগুলি| হঠাৎ নতুন করেই যেন রসুল মালিকের দৃষ্টিসীমায় Postmortem--কৃত ইরাবতীর বহুধাবিভক্ত শুভ্রতাশুণ্য ধর্মপাত্র, চরিত্র-ভান্ড। এ যেন আকালের চুলোয় দুর্ভিক্ষের চাল-সেদ্ধ, যেন অসভ্যের হাটে সভ্যতার কেনা বেচা যা রসুল মালিকের চূর্ণ চৈতণ্যের অভ্রান্ত অবিমৃষ্যতার জরায়ু থেকে বেরিয়ে আসা এক স্বকপোলকল্পিত অভূতপূর্ব-রংধনু-আবিস্কার। আরও যেন ধর্মের আবরনে ওর ভয়ঙ্কর Envious Cruelty.   

       শত শত ঝি ঝি পোকার একটানা শ্রবণ-বিরোধী উৎকট কন্ঠযুদ্ধের নির্মম আর্তনাদ ইরাবতীর দুকানে তপ্ত Zinc-এর গলিত বান। যেন আসমুদ্র হিমাচল মন্থন করা এক অভাবিত কুৎসিত ব্যাঙ্গাশ্রিত তিরস্কার আর ঘৃণার অবিকল বিম্বিত রূপ।  

`You have already lost your-“Basic selfness”-and dismissed your character selfly with extreme deception. Your worship based Religious stand is totally meaningless, dirty and worsen’- extreme deception. Your worship based Religious stand is totally meaningless, dirty and worsen’- রসুল মালিকের উচ্চারিত এ কথাগুলির মধ্যে দিয়ে যেন ইরাবতীকে ও বুঝিয়ে দিলো আরও অধিকতর স্পষ্ট এবং মাত্রাহীন নষ্ট বোধের বিকলাঙ্গ উত্তরাধিকার রসুল মালিক। 


           মননের সব কটি সুকুমার বৃত্তিই যেন একটি একটি করে পাখনা মেলা পিপিলিকার মতো উড়ে গিয়ে সেচ্ছা-অনলে ভষ্মিভূত ইরাবতীর। হৃৎপিন্ডের রক্তক্ষরণ শবযাত্রায় লীন। পূরুষ্ঠু দ্বৈত ওষ্ঠের সিক্ত দৃঢ়তা চুপসে যাওয়া Blotting Paper. জিহ্বার সজীবতা চিন্ চিনে ত্রাসের আতঙ্কিত শ্বাসে কেড়ে নেয়া। অথচ বিবাহের চুক্তিপত্রে অঙ্গিকার ছিলো ধর্ম পালনগত বিষয়ে যে যার ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ স্বাধীন।                                                                                                                                                                                                                                                             

এর মধ্যে ইরাবতী চূড়ান্ত ভাবে নিশ্চিত হয়েছে রসুল মালিক কোন্ এক যাত্রাদলে সংঘটিত একটি হত্যাকান্ডের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থান করছে। ভাবছে ইরাবতী- এখন কী করবে ? ওকে মুক্ত করে আনবে নাকি কিছুই করবে না। ভ্রান্ত আর অভ্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দোলাচলে দুল্ছে ইরাবতী। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। একটি নির্ভুল সিদ্ধান্তই পারে ওদের দুজনের জীবনে একটি নতুন বাঁকের সৃষ্টি করতে। কি করবে। অস্থির হয়ে উঠছে ইরাবতী। একটি ভুল সিদ্ধান্ত- এখন পর্যন্ত যে প্রত্যাশার ক্ষীণ আলোর রেখাটির ইঙ্গিত দৃশ্যমান তাকেও নিভিয়ে দিতে পারে। এ মুহুর্তে প্রয়োজন একটি নির্ভূল সিদ্ধান্তের। একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে ইরাবতী। একটি নির্ভুল সিদ্ধান্ত.................. 

চিন্তার কৌণিক জাল আকষ্মিক ছিঁড়ে গেলো একটি পরিচিত কন্ঠস্বরের শব্দে।              

মাজি দাদা সাব 'এসেচেন- বিন্নির কন্ঠস্বর।

ওকে বসতে বলে চা দে। বিন্নির দিকে না তাঁকিয়েই নির্দেশ দিলো ইরাবতী       

আর কালমাত্র বিলম্ব না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো ইরাবতী-

ওকে মুক্ত করতে হবে। ওকে উদ্ধার করতে হবে। না করলে ইরাবতীর আত্মবিশ্বাসের মৃত্যু ঘটবে-এটাই চূড়া| এটাই সিদ্ধান্ত ইরাবতীর। আর ভাবলো না কোন কিছু।

          

           এই দাদা সাহেব লোকটি হলেন- এ্যাডভোকেট অরিন্দম রায়হান। ইরাবতীর আইন সংক্রান্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান- THE IRABATI  LAW FARM AND ASSOCIATES’-এ কর্মরত ইরাবতীর জুনিয়র সহযোগী। আরও কিছুক্ষণ Laptop-Gi - Screen-এ থাকা প্রথম এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠার লেখাগুলির ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে লিখিত পৃষ্ঠা দুটির Print out করলো ইরাবতী। এবার কাগজ দুটি নিয়ে Drawing room-এ এসে বসলো| 

যে ভাবে বলেছিলাম সে ভাবে কাগজপত্র সব তৈরী করেছো তো? - ইরাবতীর প্রশ্ন।       

Yes Madam, All the  papers are Okayed.’

All Right. এ দুটি কাগজও ওগুলির সাথে Enclose করে দিয়ে Submit করে দাও। On the scheduled date- Hearing অমি করবো। তুমি Zzwg Assist করবে। Ok ?’

`Yes Mam.’

তুমি এসো| কাগজের কোথাও কোন ধরনের ত্রুটি থাকুক- এটি আমি চাই না।      


            চলে গেলো দাদা সাহেব। ইরাবতীও আর খধঢ়ঃড়ঢ়-এ বসলো না। আলো নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। কিন্তু অনেকক্ষণ বিছানায় ওলট পালট করে প্রানান্ত চেষ্টা করবার পরেও দু'চোখের ঘণ কাজলমাখা পাতায় ঘুম নামের ঝিল্ মিলে সুখবতী তণিকে কিছুতেই নামানো গেলো না। বরং এক অবিশ্বস্ত দুশ্চিন্তার ঐন্দ্রজালিক বি¯তৃতি ঘটতে শুরু করলো আবার দ্রুততম লয়ে উদ্ভট মাকড়সার ঘিণ্ ঘিনে আঁঠালো লালায় মাথার শিরা উপশিরাগুলিকে মূহুর্মূহু যেন কুঞ্চিত করে করে একেবারে নিষ্কৃয়তার শেষ প্রান্তে নিয়ে গিয়ে। এ কোন রসুল মালিক ? আলোকিত দিবসের অপসৃয়মান শেষ মূহুর্তের অস্বচ্ছ অস্পষ্টতার মতো, রাত্রির ঘনায়মাণ তৃতীয় প্রহরের দৃষ্টিরহিত অভেদ্য অন্ধকারের মতো অজানা অচেনা এ কার প্রতিকৃতি ? এ তো চিরদিনের ভালোলাগা, কাছে থাকা অতি পরিচিত, অতি-আপনার সে রসুল মালিক নয়। ঠিক এই মূহুর্তে বহুদিন আগে দেখা- অলৌকিক লোকালয়- নামের একটি বাংলা কাব্যনাটকের একটি বিশেষ সংলাপের কথা ওর মনে পড়ে গেলো। স্বার্থের ছুরি দিয়ে নির্দয় টুকরো করা পিতার দ্বিখন্ডিত লাশের শরীর স্পর্শ করে বল্লম উঁচিয়ে ধরে পুত্রের রক্তোজ্জ্বল অঙ্গিকার-   

আইজ থিক্যা তুমি জানবা বাজান   

সন্ধ্যার থিক্যা ভোরের আজান,

যে করে তামাম উপাসী মাইন্ষের উধাও ঠিকানা- 

বল্লম খাড়া, তাক ঠিকঠাক,

সে-ই ফলার পয়লা নিশানা।

           নাটকটি বাংলার আঞ্চলিক ভাষায় রচিত। সে কারণেই সম্ভবতঃ সংলাপটি এত দূর কল্পচারী দ্যোতনার শৃঙ্গে নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করে নিতে সক্ষম হয়েছে| সাধু অথবা চলিত বাংলায় যা হয়তো সম্ভব না-ও হতে পারতো। সংলাপটিতে বেঁচে থাকবার অঙ্গিকার যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি-ঋদ্ধ আহ্বান। সর্বোপরি উপোসী দীন দুঃখী সাধারণ মানুষগুলির ঐক্যবদ্ধতার নিরঙ্কুশ স্ফুরণের বিচ্ছুরণ- যা কেবল ইরানী ছুরির শাণিত ধারের ঝিলিকের সাথেই তুলিত হতে পারে বলেই বিশ্বাস করতে চায় ইরাবতী। আরও চায় সেই ইরানী ছুরির ঝিলিকের মতো তারও হত্যাকৃত পিতার লাশটিকে স্পর্শ করে ওই সংলাপটি গ্রীবা উঁচিয়ে ততোধিক উচ্চকন্ঠে উচ্চারণ করতে। যদিও আক্ষরিক অর্থে ইরাবতীর পিতা খাদ্যের অভাব জনিত কারণে কখনই উপোসী ছিলেন না কিন্তু সর্বোচ্চ উদার মানবিক উৎকর্ষ বিকাশের প্রাচুর্যের দিক থেকে ছিলেন চিরদিনের ক্ষুধার্ত। আরও মানবিক হতে চাইতেন, আরও মরমী হতে চাইতেন। আর সে ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্যেই তিনি ইরাবতীর অসম বিয়েকে নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন এবং সর্বোত সহযোগিতা দান করেছিলেন। অথচ সেই চরম উদারপন্থী মানবতাবাদী নির্বিরোধ মরমী ক্ষুধার্ত মানুষটিকেই হত্যা করা হয়েছিলো উন্মাদ ধর্মান্ধতার তীক্ষè ছুরি দিয়ে। ইরাবতী জানে কী তার পিতার অপরাধ। ইরাবতী নিজে ব্রহ্মধর্মী হয়েও এক ভিন্নধর্মী তরুনকে বিয়ে ক;রে তাকেও ইরাবতীর মাধ্যমেই ব্রহ্ম ধর্মে  ধর্মান্তরিত করবার অদৃশ্য ইন্ধনের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টির কালপুরুষটি যে আর কেউ নয়- তারই পিতা- উগ্র ধর্মীয মৌলবাদীদের এই একটি মাত্র অবাঞ্ছিত ধর্মান্ধ হিংস্র সন্দেহের ফলাফল ইরাবতীর পিতার শুণ্যরক্ত লাশ। কিন্তু ইরাবতীর বিপদসীমার মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া দুর্ভাগ্য যে, সে তা করতে পারে নি। আর এ না পারার পেছনের মৌল কারণের কেন্দ্রে সে স্থাপন করেছিলো রসুল মালিককে। কেন করেছিলো তার যথাযথ যুক্তি এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কারণও ছিলো ইরাবতীর কাছে- প্রশ্নমুক্ত না হলেও যা সে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলো ইচ্ছাশক্তির শতভাগ সমর্থন না থাকবার পরেও। যেহেতু সে দিনের সেই বিশেষ পরিস্থিতিটিই বাধ্য করেছিলো তাকে এ ধরনের একটি বিশ্বাসের ওপর তার পূর্ণাঙ্গ আস্থাটি স্থির করতে। কিন্তু তারপরেও ইরাবতীর প্রাণের গভীর অতলান্তের কোথায় যেন কৃষ্ণপক্ষ-রাত্রির গায়ে জ্বলা জোনাকীর আলোর মতো অতিক্ষুদ্র একটি আলোর কণা বার বার করে বলতে চাইছিলো- রসুল মালিক হয়তো হত্যাটি করে নি। অনেকদিন থেকেই লক্ষ্য করে আসছিলো ইরাবতী- সময়ের প্রতি প্রহরে ভয়ঙ্কর রকমের ক্ষিপ্র গতিতে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিলো রসুল মালিক। Over Ritualistic Radicalism- - এর দিকে ধাবিত হচ্ছিলো ক্রমাগত। ওর আচরণ থেকে পরিচ্ছদ ব্যবহারের বিশিষ্টতা পর্যন্ত একটি বিশেষ ISM”-এর দিকে চলতে শুরু করেছিলো অব্যহত ভাবে। একটি সাধারণ কথাও সে স্বাভাবিকভাবে বলতো না। প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করলেও ক্ষেপে যেত। মূলতঃ সেখান থেকেই সন্দেহের অঙ্কুরোদ্গম ইরাবতীর। বিশ্বাস করতে শুরু করে ইরাবতী-Fundamentalism-Gi Hypnotized অন্ধ কুয়োয় রসুল মালিক নিপতিত। তাকে উদ্ধার করাটিই ইরাবতীর কাছে এখন সময়ের একমাত্র প্রয়োজন।


           ভাবতে থাকে ইরাবতী- আকন্ঠ প্রগতিবাদী, মানবতাবাদী, পূর্ণ চৎড়মৎবংংরাব সংস্কারবাদী, যে কোনো ধরনের ‘কৌলিণ্যপ্রথা-বিরোধী’, অতি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন Varsity’শিক্ষক- যে ইতোমধ্যে Sociology’তে PhD’ সম্পন্ন করেছে- সে কিনা অগ্রবর্তী সময়ের উত্তাল নান্দনিক আহ্বানকে প্রত্যাখান ক’রে পশ্চাতবর্তী আদিমতার দিকে ধাবমান হতে পারে শুধুমাত্র  ঈশ্বর-তান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন থেকে Primitive Fundamentalism’কে প্রতিষ্ঠা করবার জন্যে ? তাহলে তার শিক্ষা, তার প্রজ্ঞা, তার মানবিকতাবোধ, তার Progressive Conscience,-,-তার PhD Thesis, Sociology,-এ সবের মূল্য ? Theology-ই কি চরাচর সৃষ্টির শেকড়ের সন্ধান সম্পর্কিত অতিগুঢ় তত্ত্বটি প্রদান করে না ? জাতি, রাষ্ট্র, সমাজ, মানুষ, মানবিকতা, প্রগতিশীলতা, চরাচর- এ সবের মূল্যায়ন কি Theology-’তে নেই ? Theologyতে কি নিষিদ্ধ চরাচর ? তাহলে মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনের দিক-নির্দেশণা Theologyতে থাকে কী করে ? আইয়্যামে জাহেলিয়াত-শব্দ দুটি আরবী ভাষা থেকে উত্থিত- যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় অন্ধকারের যুগ- এই অন্ধকারের যুগকে বিলুপ্ত করে চরাচরকে আলোকিত করবার প্রত্যয় কি Islamic Theology ঘোষনা করে না?  

          

             পিতা নিহত হয়েছেন তার নিজস্ব পাঠকক্ষে মধ্যরাত্রির কিছু পর। লেখার টেবিলে Laptop টি তখনও ON করা। রাত্রি শেষের কিছু আগে পিতার শোবার ঘর থেকে ভেসে আসা একটি অস্বাভাবিক অস্পষ্ট শব্দ শুনে পিতার কক্ষে প্রবেশ করেই যদিও সে একটি অস্ফুট চিৎকার করে উঠেছিলো কিন্তু সে শব্দটি উচ্চারিত হয় নি। 


            মেঝেতে পিতার লাশটি তার প্রবহমান রক্ত ধারার ওপর বক্ররেখায় শায়িত। কিছুক্ষণ পিতার অন্তিম যন্ত্রনাক্লিষ্ট মুখটির দিকে তাঁকিয়ে থেকে কোন মতে পিতার রক্ত স্রোত বাঁচিয়ে খালি পা ফেলে এগিয়ে গেলো ইরাবতী টেবিলে রক্ষিত Laptop--টির কাছে। অন্তরক্লিষ্ট যাতনার বিষন্নতায় বিপন্ন হ’লেও ইরাবতীর মুখায়োববে সে বিপন্নতার এতটুকু চিহ্নমাত্র নেই। ধীর, স্থির, অতিশান্ত পায়ে Laptop -টির দিকে এগিয়ে গেলো ইরাবতী।  পিতার রক্তের উঞ্চতার অনুভব যেন ইরাবতীর পায়ের পাতায়, অন্তরের প্রচ্ছদে গাঢ়তর- বোঝাই যায় কিছুক্ষণ আগেই পিতাকে হত্যা করা হয়েছে ।  ON করা Laptop টির  Button  চেপে- Mail Option-এ গিয়ে Incoming Mail Box-wU open K‡i me©‡kl Mail- কৃত Message’-টি দেখলো ইরাবতী- চার দিন পূর্বে প্রেরিত। ইংরেজীতে লেখা-                                     



                                                                                      

ROFESSOR ‘MR. DIKSIT,                                                         AL-HIKMAH HEAD QUARTER      

                                                                                                                  

                                                                                                        LOCATION-  UNAVAILABLE,                                                                                                              

Department of Philosophy, 

ÒUniversity of Foolish”, 

           Dhaka . 


                                                                                                                                             Take Preparation. You are going to be Assassinated within four days NEXT  by AL -HIKMAH” from the  date of this Message.  Keep  yourself  Protected.’   


     S/d-                                                                                                                                                                                                                                                                                               


THE CHIEF ,


AL-HIKMAH                                                                                                                                                                   

ASSASINATION BRIGADE”    

DATE– 

THIRTEENTH DAY OF  JULY ,  2011.                                                                                                                                                                      



                                                                                                                                                    

          এই ইংরেজী Message’-টিতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, Message’-টি যে Draft করেছে সে নিশ্চিত শিক্ষিত। এবং সম্ভবতঃ শিক্ষিত ব্যক্তিদেরকেই যে AL -HIKMAH  প্রাধান্য দিয়ে থাকে- ইঙ্গিতটি সে রকমেরই। সে দিক থেকে সন্দেহের তীরটিও রসুল মালিককে  ওর বর্তমান আচরণগত কারণেই বিদ্ধ করবার প্রচ্ছন্ন সম্ভাবনাটিকেও একেবারেই নাকচ করে  দেয় না। আল-হিকমা’- একটি উগ্র ধর্মান্ধ ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের নাম। যে সংগঠনটির চুলের ডগা থেকে পায়ের নখের ডগা পর্যন্ত বর্বর মৌলবাদী হিংস্রতা দিয়ে মোড়ানো। ন্যূণতম সভ্যতা, মানবিকতা বলে কিছু নেই। তাদের দর্শনের বাইরে হলেই সে মুরতাদ। দোষী নির্দোষী নির্বিশেষে নির্বিচার মানুষ হত্যা করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই তাদের মূল দর্শন- এ কথা তারাই প্রচার করে। অথচ পবীত্র- আল-কোরআন এবং ইসলামের কোনো বিধি বিধানের কোথাও বলা নেই যে, শক্তি প্রয়োগ করে অথবা কাউকে হত্যা করে কারো ওপর ইসলাম ধর্ম আরোপ করা যাবে। অথবা কাউকে ইসলামধর্ম গ্রহনে বাধ্য করা যাবে। বরং উল্টোটাই বলা হয়েছে- ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত- এখানে শক্তি প্রয়োগ অথবা আরোপ করবার মতো কিছু নেই। এমন কি এ-ও বলা হয়েছে- স্ত্রী যদি ভিন্ন কোনো ধর্মেরও হয় সে ক্ষেত্রে স্বামী ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও স্ত্রীকে যেন তার নিজ ধর্ম পালনের অনুমতি প্রদান করে। এত উদার ইসলাম অথচ এই উদারতাকে হিংস্র মৌলবাদী গোষ্ঠিগুলি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ?


           যেদিন পিতার Laptop -এ Message টি পাঠনো হয়েছে সেদিন ছিলো ১৩ জুলাই, ২০১১। সেদিন থেকে ঠিক তিন বছর আগের আরেক ১৩ জুলাই- ইরাবতীর Flat- - এ ইরাবতীকে শ্বাসরোধ ক’রে হত্যার সর্বশেষ চেষ্টাটি করেছিলো রসুল মালিক। এর আগেও করেছে কিন্তু সেদিনের মতো ততোটা হিংস্র কামান্ধ কুকুরের মতো নয়। "Of course You will have to bring out yourself  from your DARKEN  shape of the Ritual belief and Idiology and to be diverted into my Religious authority. Otherwise you must have to welcome your Ultimate termination. It is the decisive ” বাক্য ক'টি বলবার পর পরই রসুল মালিক ওর উচ্ছৃত পেশীযুক্ত শক্ত দুহাতের আরও শক্ত দশটি আঙ্গুলের পূর্ণ শক্তি দিয়ে টিপে ধরেছিলো ইরাবতীর গ্রীবাদেশ। শ্বাস প্রায় নিঃশেষিত হয়ে এসেছিলো ইরাবতীর। ঠিক ওই মূহর্তে কলিং বেলের একটি শব্দে উধাও রসুল মালিক। আর ফিরে অসে নি কোনদিন। ইরাবতীও আর থাকে নি ওর নিজের Flat-এ। পিতার Flat-ই শেষ ঠিকানা। সময় কখনও গতিহীন হয় না। নিজের গতিতেই ধেয়ে চলে অবিরাম। 

                                                                                                                                 

               এই ধেয়ে চলার ভেতর দিয়ে কেটে যায় আরও একটি বছর। কিন্তু ইরাবতীর ভাবনার শেষ হয় না। এই ভাবনাই যেন ইরাবতীকে ধ্বংশের শেষ সীমার দিকে ধাবিত করে। অতীতের বাঁকে বাঁকে যে যন্ত্রণা সে যন্ত্রণার সাথে আর একটি অনিবার্য যন্ত্রণার বাঁক সৃষ্টি করে ওখান থেকেই আবার ডিঙ্গি বাইতে শুরু করেছিলো ইরাবতী ওর নতুন জীবন-খোঁজ-এর মধ্যগাঙ্গে। আর ভাবতে পারে না ইরাবতী। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে প্রবেশ করে পিতার কক্ষে। আলো জ্বালিয়ে লেখার টেবিলের কাছে যায়। Laptopটি ON করে অনেকক্ষণ ধরে Laptopটির দিকে তাঁকিয়ে থাকে। এক সময় পিতার মৃত্যুর তারিখটিকে সূচনা ধরে পিতার Laptop’টিতেই  লিখতে শুরু করে-         

০১/০১.  

আজ ১৭ জুলাই, ২০১১।  ঠিক পাঁচ বছর আগে- এই দিনে.................................  

সকাল এগারটা বেজে কয়েক মিনিট। নির্দ্দিষ্ট একটি অফিস থেকে বেরিয়ে অভিজাত একটি Land Cruiser -এ চেপে যাত্রা শুরু করলো দু'জন। অবিশ্রান্ত গাড়ীটি চলছে। কোথাও কোনো বিরতি নেই। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হয়েছে অনেকক্ষণ। প্রচন্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছে। পুরো আকাশ মেঘে ঢাকা। মুষল ধারার বৃষ্টির বোধ করি লোভনীয় সৌন্দর্যের পাশাপাশি আলাদা একটি গন্ধও আছে- যে গন্ধের কাছে শেফালীর মিষ্টি গন্ধও হেরে যায়। অনুভূতির তীব্রতা না থাকলে যে গন্ধটিকে উপলব্ধি করা যায় না। সচরাচর এ ধরনের Over Intensive Feeling’s Fitness সবার মধ্যে থাকবার কথাও নয়। যে কারণে বৃষ্টি সেই আটপৌঢ়ে সাধারণ বৃষ্টির মতোই থেকে যায় অধিকাংশের কাছে। পৃথক কোন আবহ তৈরী করতে পারে না ওদের মনের পরিধিতে। এই বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ীটি বিরামহীনভাবে খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। Speedo metre -এর কাঁটা সত্তর থেকে আশি Killometre-এর মাঝখানে নড়াচড়া করছে। সামনেই Cox`s Bazar Sea Beach. গাড়ীতে আরোহী যে মাত্র দু‘জন তা আগেই বলা হয়েছে। একজন পূরুষ অপর জন নারী। পূরুষটি Drive  করছে। নারীটি পাশের আসনে উপবিষ্ট। নারীটি ওর হাতে থাকা সেলোফোনটির কয়েকটি Button টিপে কানে ধরলো।  অপর প্রান্ত থেকে কিছু একটা শুনবার পর নারীটি কথা  বললো-আমরা কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, আপনি Cabin-টিকে তৈরী রাখুন। বোঝা গেলো Cox`s Bazar Sea Beach- এর কোন একটি Motel- এর একটি Cabin-এর জন্যে আগেই Booking দিয়ে রাখা হয়েছিলো। গাড়ীতে সামান্য কিছু কথা হলো দু'জনের মধ্যে। পূরুষটিই শুরুটি করলো-   

Òআসলে তোমার সব Arrangement -ই ‘A’-Graded. প্রশংসা না করে উপায় থাকে না।  

`It should be explained.’

`যেমন, আমরা যে অফিস থেকে এসেছি সে অফিসটি যেমন ছিলো টিপ টপ- আমাদের কিছুই করতে হয় নি, মাত্র দু'টি স্বাক্ষর করা ছাড়া, ঠিক তেমনি যেখানে আমরা যাচ্ছি সেখানেও সব টিপ টপ- ফোনে তোমার কথা থেকে যা বোঝা গেলো, সেখানেও আমাদের কিছুই করতে হবে না, সবই তৈরী পাওয়া যাবে।

`Just Right. না হলে আমরা এত বেশী Pay করবো কেন ?


           ওরা পৌঁছে গেছে মোটেলটির সামনে। দু'জন Attendant তৈরীই ছিলো। কোথায় গাড়ী Park করতে হবে- দেখিয়ে দিলো। Parking - এর ঝামেলা শেষ করে ওরা গাড়ী থেকে নেমে এলো। Attendant দু'জন গাড়ীর Career open করে Luggage নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরের দিকে এগুতে লাগলো- পেছনে ওরা দুজন। নির্দ্দিষ্ট কক্ষটির তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে কক্ষের সব কিছু ওদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে Attendant দু'জন চলে গেলো। ওরা চলে যাবার পর নারীটি পূরুষটিকে জিজ্ঞাসা করলো-

-রাতে কি খাবে ?

-তুমি যা খাবে তা-ই।


           নারীটি মৃদু হাসলো। তারপর ফোনে Reception কে খাবারের Menu জানিয়ে দিলো। এরপর ওদের মধ্যে আর কোন কথা হলো না। দুজন দুজনের পরবার কাপড় চোপড় নিয়ে দুটি বাথরুমে প্রবেশ করলো। গোসল শেষ করে নারীটির আগে পূরুষটি বেরিয়ে এলো। ভেজা কাপড় বারান্দায় টাঙ্গানো তারের ক্লিপে আটকে দিযে এসে Dressing ’ -এর সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনি করে মুখে সামান্য ক্রীমের হালকা প্রলেপ বুলিয়ে নিলো। Long Drive Journey’র পর খুবই Fresh লাগছে এখন। সোফার টেবিল থেকে দৈনিক কাগজটি নিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ইতিমধ্যে নারীটিও বেরিয়ে এসেছে বাথরুম থেকে। এসে পূরুষটি যা করেছে সে-ও তাই করলো। ভেজা কাপড় বারান্দায় টাঙ্গিয়ে দিয়ে Dressing Mirror--এর সামনে বসে ফ্যানের হাওয়ায় কিছুক্ষণ চুল শুকিয়ে নিয়ে চিরুনি ক’রে প্রসাধন শেষ করলো। Dressing Mirror-এ পূরুষটিকে দেখা যাচ্ছে। চিত হয়ে শুয়ে কাগজ পড়ছে। খুবই অপূর্ব মনে হচ্ছে ওকে নারীটির চোখে, খুবই আকর্ষনীয়। না চাইলেও কাছে টানে। Mirror-এ অনেকক্ষণ ধরে দেখলো ওকে। পূরুষটির চোখ কাগজের পাতায়। 

                                                                                                                                            

নারীটির প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলো না সে। এবার নারীটি এসে বিছানায় বসলো পুরুষটির পাশে। বললো-                                                                                                                        

-তুমি কি কাগজের পাতায় মগ্ন থাকবার জন্যেই এখানে এসেছো ?                                                                                                                                                        

-না না, তা কেন ? তুমি প্রসাধন করছো- ভাবলাম Prime news গুলি একটু দেখে নিই- এই তো , এর বেশী কিছু না। তাছাড়া মেয়েদের প্রসাধন করবার সময় ওদের দিকে নাকি পুরুষদের তাকাতে নেই তাতে না কি ওদের অতি যত্ন আর সোহাগমাখা প্রসাধনটিই চৌচির হয়ে যায়। 

-তাই নাকি ? অনেক শিখেছো তো। কে শেখালো ? তুমি এখন অনেক Matured হয়ে গেছো। ভাবা যায় না যে !

-তাহলে এতটা বয়সে এসেও তুমি কি আমাকে Immatured -ই থাকতে বলো ?


          Attendant খাবার নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করলো। পাশের Dining Room -এ খাবারগুলি সাজিযে রেখে বলে গেলো- আপনাদের Menu অনুযায়ীই খাবার দেয়া হয়েছে। খাওয়া শেষ হলে Calling Button -এ চাপ দিলেই আমি এসে  Plate, Glass সহ সবকিছু নিয়ে যাবো। রাত অনেকটাই হয়ে গেছে। ক্ষিধেও পেয়েছে। Dining Table--এ বসলো ওরা দু'জন। অনেকক্ষণ ধÕরে খেলো। খাবার টেবিলে খুব একটা কথা হলো না ওদের। খাওয়া শেষ হলে বেডরুমে এসে নারীটি Calling Button চাপলো। Attendant এসে Plate, Glsss ইত্যাদি নিয়ে যাবার সময় জিজ্ঞেস করলো- Sir, A/C  দেবেন না ?   

-না। ওতে আমার সমস্যা হয়। নারীটির উত্তর।

Ok Madam’- নিষ্ক্রান্ত হলো Attendant কক্ষ থেকে। একটি সোফায় পাশাপাশি বসলো ওরা দু'জন। খুব ঘনিষ্ট হয়ে। নারীটির একটি হাত পূরুষটির মাথার পেছন দিয়ে ওর ডান পাশের কাঁধটি স্পর্শ করলো। একটি উত্তেজিত শিহরনের সর্পিল রেখা যেন ওর পায়ের আঙ্গুলের ডগা থেকে মাথার চুলের ডগা পর্যন্ত এক অদ্ভূত কম্পণের চক্রজাল সৃষ্টি করতে থাকলো। কথা বললো পূরুষটি- 

'রাত তো অনেক হয়ে গেলো, এখন কি ?

-আবার কি ? বিছানা।

-তোমার ভালো লাগবে ?

-ভালো লাগবার জন্যেই তো এত আয়োজন। তাই না ?


     শুয়ে পড়লো ওরা দু'জন বিছানায়। তবে বিছানায় যাবার আগে নারীটি গাঢ় নীল রংয়ের একটি Maxi পরে নিলো। বিছানায় শুয়ে ওর হাত থেকে কাগজটি  নিয়ে হাত বাড়িয়ে সোফার টেবিলে রাখলো। Bed Switch’ টি টিপতেই দুটো Tube -এর উগ্র Silver আলোর বন্যা মিলিয়ে গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে Silver জ্বলে উঠলো। বোঝা গেল Switch-টি Automated. -পূরুষটি কথা বললো-

-নিভিয়ে দিলে ?

-আমি তো জানি নীল রং, নীল আলো তোমার খুব পছন্দ?

-আমি কি বলেছি তা নয় ?

`Dim Bulb -এর নীল আলো আসলেই মনকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। একটি স্বপ্নিল আবেশের সৃষ্টি করে, চাঁদের আলোকেও তখন মনে হয় আত্যন্তিক উগ্র- নয় কি ? আমার ভারী  প্রিয়।

-বলে পাশ ফিরেই দু'হাতে পূরুষটির মাথাটি টেনে নিয়ে দু'টি ঠোঁটই নিজের ঠোঁটের ভেতর পুরে নিলো। পূরুষটিও সাড়া দিলো যথার্থ কাঙ্খিতভাবে। নারীাটি নিজে নগ্ন হয়ে পূরুষটিকেও নগ্ন করলো। তারপর অনেক সময় ধরে ওই স্বপ্নিল নীল আলোর তোলপাড় করা ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে ভেসে চলা Speed Boat--এ চড়ে দূরন্ত বেগে কেথায় যে খোঁজহীন হয়ে গেলো জানে না কেউই। Boat -টি যখন থামলো তখন দু'জনকে শ্রান্ত মনে হলেও ক্লান্তির চিহ্নমাত্র ওদের মধ্যে দৃশ্যমান হলো না। এবার নারীটি কথা বললো-    

আজ থেকে এক বছর আগে কোন একটি বিশেষ Sequence--এ তুমি আমাকে বলেছিলে- I Desire to watch the Nude Geographic Aspect, Appearance and Beauty of an Adult Girl What I have Never seen yet- তুমি কি দেখবে আজকে ?                                                                        

দেখছি তো।                                                                                                                

না। এ ভাবে নয়। Dim Bulb -টি Off করে দিয়ে তীব্র Silver colour আলো জ্বালিয়ে আমি Dressing Mirror -এর সামনে সম্পূর্ণ Nude দাঁড়াবো। তুমি তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাকে দেখবে- যে ভাবে তোমার দেখতে ইচ্ছে করে ঠিক সে ভাবে। তোমাকে আমার Blank Cheque দেয়া থাকলো। চলো এখুনি দাঁড়াবো। তোমার কোন চাওয়াকে আমি অপূর্ণ রাখবো না।

নেমে এলো দুজন বিছানা থেকে। Switch-টি টিপে দিলো নারীটি। নীল আলোর নরম মোহময়োতাকে মুহুর্তেই অদৃশ্য করে দিয়ে প্রখর Silver colour আলোতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো কক্ষটি।  পূর্ণ নগ্ন নারীটি সরাসরি দাঁড়ালো Mirror -এর সামনে। Mirror-এ   নিজের প্রতিবিম্বিত রূপ দেখে নিজেই বিষ্মিত হলো। এত অপরূপ সে ! দারুন গর্ব অনুভব করলো ভেতরে ভেতরে ।  এর  আগে কখনই দেখা হয় নি ওর নিজেকে এভাবে, সত্যিই মুগ্ধ হলো নারীটি। সামান্য দূর থেকে পূরুষটি Mirror -এ  দেখছে এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্যকে- বিশ্বাস করা যায় না-  এ কী অপরূপ Poetical Rhythm - সুগঠিত উন্নত স্তন যুগল যেন বিদ্যাপতির- পীণ পয়োধর........রাধা। দেহের প্রতিটি বাঁকে যেন জীবনানন্দের- শ্রাবস্তীর কারুকাজ। ডাগর চোখ দু'টি যেন-পাখির নীড়ের মতো ঘন দুর্বালতার বিপুল আয়োজনে সমৃদ্ধ। চোখের পাতাগুলি যেন ঘোরকৃষ্ণ রাত্রির ছায়া দিয়ে আবৃত। চুলের দিকে তাঁকালে মনে পড়ে যায় একটি অতিপ্রিয় কবিতার একটি পঙতির কথা- চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। ভারী প্রশস্ত নিতম্বটি যেন- কোন বিদগ্ধ চিত্রকরের মনোলোভা আকাঙ্খার রং মাখা তুলি দিয়ে চিত্রিত পরিপূর্ণ বিকশিত নীল পদ্মের পূর্ণ অবয়ব। আদি থেকে অনন্তকাল ধরে দেখলেও বুঝি এ দেখবার তুষ্ণা ফুরোবে না। নারীটি এবার ঘুরে দাঁড়ালো। মুখোমুখি হলো পূরুষটির। অপূর্ব নির্লোম জঙ্ঘার স্ফীত উত্থান। স্বাস্থ্যবান দু'উরুর প্রলোভিত আহ্বান। পাশাপাশি পূরুষটিরও ঈর্ষা করবার মতো দৈহিক আকর্ষনের প্রলোভন- কিছুতেই আর সামলাতে পারলো না দু'জন দু'জনকে- পূরুষটি জড়িয়ে ধরলো নারীটিকে। নারীটিও পূরুষটিকে অনুকরন করে দ্বিগুণ মাত্রায় সাড়া দিলো। লিপ্ত হলো একই ক্রিয়ায় দু'জন। গালে গাল, ঠোঁটে ঠোঁট ঘষতে থাকলো।  তারপর পূণরায় জৈবিক তাড়নায় Drug Addicted Patient -এর মতো উত্তাল দু'জনই বিছানায়। 



০২.

           সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার পরেও মুহুর্ত, মুহুর্ত করে অনেকটা সময় কেটে গেছে ওর হত্যা মামলার যাবতীয় কাগজ পত্র অত্যন্ত নিখঁতভাবে Process করতে। প্রতি মুহুর্তে তিল তিল করে উপলব্ধি করেছে রসুল মালিককে। ওকে ছাড়া বাঁচবে না ইরাবতী। এরপর হঠাৎ একদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলারের কক্ষে ইরাবতী। রসুল মালিককে ওর সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। রসুল মালিককে আগেই বলে রাখা হয়েছিলো এক ভদ্রমহিলা ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। অপলক দেখছে ইরাবতী রসুল মালিককে। কিছুই বলছে না। অবশেষে রসুল মালিককেই কথা বলতে হলো- 

-আপনি ! আপনেরে তো আমি.....!

-আমাকে চিনতে হবে না। এতক্ষণে আত্মস্থ  হলো ইরাবতী।

-এই জেলখানায় আপনি আমারে দেইখ্তে এইসেছেন !-একই সাথে চরম আশ্চর্য এবং অভিভূত হয়ে পড়ে রসুল মালিক।

-না। তোমাকে আমি দেখতে আসিনি। নিয়ে যেতে এসেছি। তবে আজকে নয়। কয়েক দিন পর। এখন এই কাগজটিতে একটি সই করে দাও। -বলে ব্যাগের ভেতর থেকে একটি ছাপানো কাগজ আর একটি কলম বের করে রসুল মালিকের দিকে এগিয়ে দিলো ইরাবতী।

-এইটে কিসের কাগজ ?

-এটি এক ধরনের পাওয়ার অব এ্যাটর্নি। সোজা চলিত বাংলায় যাকে সবাই বলে- ওকালতনামা।এটিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে তুমি তোমার পক্ষে আদালতে আইনী কথা বলবার জন্যে একজন আইনজীবিকে ক্ষমতা প্রদান করছো। তাছাড়া এটি তো তোমার না জানা থাকবার কথা নয়।

-কী যে বলেন।  আমি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ, বিদ্যে বুদ্ধিতে তেমন...............................।

-থাক্ ওসব। তুমি সইটি করে দাও।

-তা কোথায় সইডি করতি হবি ? কাগজটির দিকে তাঁকাতে তাঁকাতে বলে রসুল মালিক।

ওপরে। এখানে- দেখিয়ে দিলো ইরাবতী।

দ্বিধাহীন ভাবে নির্দ্দিষ্ট স্থানে স্বাক্ষরটি করে কাগজটি ইরাবতীকে ফিরিয়ে দিলো রসুল মালিক। কাগজটি ব্যাগে পুরতে পুরতে ইরাবতীর শেষ কথা-

তৈরী থেকো। কয়েক দিন পর আবার আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব।

           থাকলো না আর ইরাবতী। চলে গেল ওর সামনে থেকে। কিছুই বুঝতে দিলো না রসুল মালিককে। রসুল মালিকের মতো একজন খুনের আসামিকে মুক্ত করবার জন্যে একজন অপরিচিত নারী কেন এত উৎসাহিত হচ্ছে, আগ্রহ দেখাচ্ছে ? ওকে চিনলোই বা কি করে, ওর নাম এবং সে যে জেলে রয়েছে তাই-ই বা জানলো কিভাবে ওই নারী ? -ভাবতে পারছে না রসুল মালিক।                                                                                             


          ঠিক পঞ্চদশতম দিনের মাথায় আবার দেখা হলো ইরাবতীর সাথে রসুল মালিকের। রসুল মালিক আদালতের ডকে দন্ডায়মান। আইনজীবি আর দর্শনার্থীদের দিয়ে আদালত কক্ষ কাণায় কাণায় পূর্ণ। ইরাবতী রসুল মালিকের পক্ষে তার  Bail Move করছে, Argument Place, Documentary Evidence Show করছে। Prosecution- এর পক্ষ থেকে প্রবল Objection - থাকবার পরেও ইরাবতীর Argument’‡KB Accept  করে  Court. জামিন মঞ্জুর হয়েছে রসুল মালিকের। ভাবতে পারেনি রসুল মালিক একজন খুনের আসামির এভাবে Bail হয়ে যেতে পারে ! আদালতের কাগজপত্রে স্বাক্ষর সংক্রান্ত কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে আধা ঘন্টার মধ্যেই আদালত থেকে বেরিয়ে এলো ওরা দুজন- ইরাবতী আর রসুল মালিক। বেরিয়ে এসে নিজের গাড়ীর দরোজা খুলে দিয়ে ওকে বসতে বলে ইরাবতী Steering-এ বসলো। গাড়ীটি Start করে আদালত চত্বর থেকে বেরিয়ে যথেষ্ঠ প্রশ্বস্ত হলেও মূল সড়কের দুপ্রান্ত থেকে ছোট বড় অসংখ্য চলমান গাড়ীতে ঠাসা সে সড়কের ওপর দিয়েই ধীরে ধীরে গাড়ীটি চালাতে শুরু করলো ইরাবতী। কোথায় যাচ্ছে ইরাবতী ওকে নিয়ে। কেন মুক্ত করে আনা হলো ওকে জেল থেকে ?  আর কেনই বা কিছু না বলেই ওকে এভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না রসুল মালিক। ভাবছে। শুধুই ভাবছে। কিন্তু কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পাচ্ছে না। কিছু সময় পর গাড়ীটি এসে প্রবেশ করলো একটি তিন তলা বাড়ীর Ground Floor-এ। গাড়ীটি Garage করে গাড়ী থেকে দুজনে নেমে ইরাবতীর আহ্বান- ওপরে 1st Floor-এ উঠে Calling Bell-এ একবার মাত্র চাপ দিলো ইরাবতী। ভেতর থেকে পনেরো ষোল বছর বয়সের একটি মেয়ে এসে দরোজা খুলে দিলো। মেয়েটির নাম বিন্নি। রসুল মালিককে Drawing Room-এ বসতে বলে ওপরে যাবার সিঁড়িতে পা রাখলো ইরাবতী।  

           বিন্নিরা সাঁওতাল উপজাতির। ওর মা-ও এ বাড়ীতে থাকে। অনেক দিন থেকে। রান্নার দিকটি ওর মা-ই সামলায়। মেয়েটি রান্নার কাজে মাকে ছোট খাটো সাহায্য, সহযোগিতা করে। ইরাবতীর শোবার ঘরটি এবং সে ঘরটির Drawing Room, Furniture,  Wide Bed, Dressing Table-এর ওপর এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা টুকিটাকি, বইয়ের Shelf-এ রক্ষিত অসংখ্য বইপত্র, TV, Laptop, Desktop, Writing Table, Telephone Set   ইত্যাদি- সবকিছুকে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখবার দায়িত্বটি ওর ওপরেই।     

কক্ষটি Drawing Room. একটি সোফার ওপর বসেছে রসুল মালিক। বারবার করে দেখছে কক্ষটির চারদিক। কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না নিজেকে এ কক্ষটির সাথে। বড় বেমানান লাগছে নিজেকে। কক্ষটিতে প্রকৃতিকে ধারন করে বিশাল মাপের অত্যন্ত মূল্যবান Water Colour -এর যে তিনটি Painting রয়েছে- ওরা যেন তিরস্কার করছে রসুল মালিককে। ওরা যেন বলতে চাইছে- এ স্থানটি তোমার জন্যে নয়, তুমি উন্মুক্ত প্রকৃতির মানুষ, প্রকৃতির কাদামাটি জলের সাথেই তোমার সম্পর্ক। তুমি সেখানেই ফিরে যাও। আবার ভাবছে- সব কিছুই তো প্রকৃতি থেকেই সৃষ্ট।  তাহলে- সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। নিজেও Confused  হয়ে যাচ্ছে। 


           বিন্নি একটি Tray তে করে Cold Drinks-এর ছিপি খোলা একটি বোতলসহ Fast Food জাতিয় কিছু খাবার নিয়ে এসে ওর সামনের টেবিলে রেখে যাবার সময় বলে গেলো- মাজি খেয়ে লিতে বলেছেন। ইকটু পোরে মাজি আসবেন। রসুল মালিক খাবারগুলির দিকে তাঁকালো বার দুয়েক কিন্তু খেলো না। ভাবতেই থাকলো- এ ভাবনার যেন শেষ নেই। এর মধ্যে বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে। ওপর থেকে নেমে এলো ইরাবতী পরিবর্তিত পোষাকে। শাড়ীর স্থানে একটি ঢিলে ঢালা Maxi এখন ওর শরীরে, পায়ে হালকা চপ্পল। এসে সোজা রসুল মালিকের মুখোমুখি দাঁড়ালো। মাঝে সোফার টেবিলে রক্ষিত খাবারের পাত্র। প্রশ্ন করলো ইরাবতী- Òকি ভাবছো এত। খাওনি কেন ? জেলখানায় সাতসকালে খেয়েছো তো মাত্র দুটি শুকনো রুটি। ক্ষিধে তো পাবার কথা।এতক্ষনে সংবিত ফিরে পেলো রসুল মালিক। ওর দিকে তাঁকিয়ে কোনমতে উচ্চারণ করলো- ও আপনি? বসবেন না ?

-বসছি, তুমি খাও। ইরাবতী পাশের সোফায় বসলো| রসুল মালিক একটি বিস্কিট খেয়ে এক চুমুক Cold Drink নিলো। আর কিছু খেলো না।  

-আমি আপনেরে একডি কতা জিজ্ঞেস করতি চাই।

-হ্যাঁ। বলো।  

-মাইনে, আমারে তো ফাঁসির দড়িতে ঝুলতিই হবি। তা আপনে আমারে বাঁচানের জইন্যে এ্যাত চেষ্টা করতিছেন ক্যান্ ? আপনের সাথে আমার তো কোন পরিচয় বা সম্পর্ক- কিছুই নাই। আমি তো আপনের কেউ নই-ও। অথচ আপনে আমারে এ্যাত দয়া, এ্যাত করূনা করতিছেন ! এ্যাত ঋণের শোধ আমি কইরবো ক্যামন কইরে ?

-ঋণ করলে পরিশোধ করতে হয়। এটাই নিয়ম। না করলে ঋণ গ্রহীতার Moral Surface ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তুমি যদি মনে করো আমার কাছে তোমার অনেক ঋণ- তাহলে সে ঋণ তুমি শোধ করবে। শোন, এখন থেকে খাবার আমরা এক সঙ্গেই খাবো। এখন চলো তোমার থাকবার ঘরটি তোমাকে দেখিয়ে দিই।                                               

          

            2nd Floor -এ উঠে গেল ওরা। এ Floor-টিতেও বেশ কয়েকটি কক্ষ। প্রথমটি Drawing পরেরটি Dining এবং Dining এর পরে পর পর পাশাপাশি তিনটি কক্ষ। আর একটি Drawing Room-এর একেবারে মুখোমুখি। এই মুখোমুখি কক্ষটিতেই  থাকবার ব্যবস্থা হলো ওর। এ কক্ষটিও সুন্দর করে গোছানো। TV, Laptop, Writing Table, Dressing Table, খুব চওড়া মাপের খাটের ওপর মসৃণ বিছানা, বিছানার চাদরের রংটি মনকাড়া, Bed Table-এ Telephone Set, Book Shelf  Telephone Set, Book Shelf -ভর্তি বই, কোন কিছুরই অভাব নেই যেন। রসুল মালিককে সবকিছু বুঝিয়ে দিলো ইরাবতী। Attached Bathroom’wU দেখিয়ে দিলো। প্রশস্ত Bathroom হালকা গোলাপী রংয়ের দামী Tiles দিয়ে আগাগোড়া মোড়ানো। Pan - এর পাশাপাশি Commode-ও রয়েছে। দেখলে এমনিতেই মুগ্ধ হতে হয়। সব কিছুতেই যেন একটি জড়সধহঃরপ রুচি-w¯œগ্ধতা মনকে নিমেষেই ছুঁয়ে যায়। 

-তুমি গোসল করে Fresh- হয়ে খাবার টেবিলে এসো। আমিও আসছি। বিন্নি এখুনি তোমার কাপড় চোপড় দিয়ে যাবে। নীচে নেমে গেলো ইরাবতী। 


           খাবার টেবিলে বসেই খেতে খেতে অনেক কথা হলো ওদের দুজনের মধ্যে। ইরাবতী শুরু করলো- তুমি তো অনেকদিন যাত্রাদলে ছিলে। যাত্রাদল, যাত্রাগান, যাত্রাদলের মানুষজন, তাদের একেক জনের পৃথক পৃথক ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত সংস্কৃতি- এসব সম্পর্কে তোমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হবার কথা নিশ্চয়ই।

-তা হয়তো ইট্টু আধটু হইয়েছে। সে দিয়ে আপনি কি কইরবেন ?

-ঝুমনিকে তুমি খুন করো নি আমি জানি। তোমাকে জেলে আসতে হলো কেন? প্রিয়বালাকে তুমি খুব ভালোবাসতে ?

-প্রিয়বালারে আপনে চিনলেন ক্যামন কইরে ?

-তোমাকেও তো আমার না চেনবারই কথা-তাই না ? তারপরেও তো চিনেছি। মনে করো সেভাবেই। এখন বলো প্রিয়বালাকে তুমি......................?

-অনুমতি কইরলে একডি কতা জাইনবের চাই আপনের কাছে।

ইরাবতী পানির গ্লাসটি হাতে নিয়ে মাথা ঝাঁকালো।  

-আপনে তো লেখাপড়া জানা মানুষ। অনেক জানেন-  আমারে কন্ তো কাউরে ভালোবাসতি গেলি মাইরষের কি থাক্তি হয় ?

-তুমি তো মূর্খ, বার বার করে বলছো। কিন্তু প্রশ্নটি তো তোমার শিক্ষিত মানুষকেও ছাড়িয়ে যায়। ভালোবাসবার জন্যে অতিরিক্ত কিচ্ছুরই প্রয়োজন হয় না- শুধু প্রয়োজন হয় স্বচ্ছ আঁরশির মতো একটি মন।

-এই তো সঠিক কতাডিই কইয়েছেন। আসলে সেইডিই তো আমার নেই। কোনো কালে কেউ কি শুইনেছে যাত্রাদলের আমার মতো কোনো একজন মানুষ নামের সঙ্ কাউরে ভালোবেইসেছে ? চাল নেই, চলো নেই, ঠিকানাডিও নেই- খালি দুইবেলা দুইমুঠো ভাতের লেইগে যাত্রাপালার সঙ সেইজে মনডিরে তো নিজেই চুরি কইরে বইসে রয়েছি। আমার আবার ভালোবাসা ! কী দিয়ে ভালোবাসতি যাবো আমি কাউরে ?

-তাহলে প্রিয়বালা ? মানে অর্থটি এই যে, তার সাথে তোমার কোন প্রেমসঞ্জাত সম্পর্ক নেই বা ছিলো না- এটিই তো বলতে চাও তুমি?

-সে-ই তো ঝুমনিরে খুন কইরেছে। খুন কইরে অধিকারীর ইশারায় আমার নামডি কইয়ে দিয়েছে। ভিতরে ভিতরে অধিকারীর সাথে প্রিয়বালার ক্যমুন জানি কি একডি আছিলো। এখনোও রইয়েছে। অধিকারীর কথাতেই ও আবার দলের লোকরে বইলে বেড়াতো আমি নাকি ওরে ভালোবেইসে ওর পেডে আমার সন্তানরে দিয়ে দিইছি। আসলে অধিকারীই প্রিয়বালার পেটের সন্তানের দায় থেইকে নিজে বাইচবের জন্যি আমারে ফাঁসিয়ে দিবের চেইয়েছিলো। যাত্রাদল তো ! মিছে কতা ছাড়া কিছু পাবেন না নে।

-তাহলে তোমার কথাগুলিই যে সত্যি- এটি বিশ্বাস করবার পন্থাটি কি ? -ইরাবতীর সন্দেহজাত প্রশ্ন সরাসরি রসুল মালিকের দুচোখের ওপর চোখ রেখে। 

-কিচ্ছু নেই। আমি তো বইলিনি আমার কথাগুলিনরে আপনের বিশ্বেস কইরতি হবি। আপনের মনে চাইলে বিশ্বেস কইরবেন, না চাইলে কইরবেন  না। তবে মিছে কতারে আমি ঘেন্না করি। যাত্রাদলের মানষিদের সত্যি কতাডিরেও কেউ বিশ্বেস করে না। এইডিই সবচেইতে বড় সত্যি।    

-ঝুমনির খুনের পেছনে কিছু একটা থাকবার কথা নিশ্চয়ই।                                                             

-আমি ঠিক জানিনে, তবে দলের কেউ কেউ বলাবলি কইরতো- নাচিয়ে ঝুমনিরে অধিকারী যাত্রাপালার হিরোইন কইরে দিয়ে ওরেই বিয়ে কইরবি- এই ভরসাতেই ঝুমনি ওর ট্যাকা পয়সা যা লুকিয়ে লুকিয়ে জমিয়ে রেইখেছিলো তার সবই অধিকারীরে দিয়ে বইসেছিলো- এইডি প্রিয়বালা সইহ্য কইরতে পারে নি। হিরোইন প্রিয়বালা চাইতো অধিকারী তারেই বিয়ে করুক। মাঝখানে ঝুমনি ঢুইকে পইড়ে সর্বনাশডি কইরেই ছাড়লো। তাছাড়া যাত্রাদলে এইসব তো ত্যাল্ নুন। একটু থেমে আবার শুরু করলো রসুল মালিক।                                                                                                                                   

-অধিকারী একডি ধরিবাজ রকমের লোক- এইডি বুঝতে ঝুমনির খুব ভুল হইয়েছিলো। আর যাত্রদল চালাতি গেলি ধরিবাজ লোকেরই যে দরকার। ওইডি না হলি তো যাত্রাদলের অধিকারী হতি পারা যায় না। এই সবের পরেও কিছুদিন আগে একডি ঘটনা ঘইটেছিলো- ঝুমনির মাতার সোনার টিক্লিডি নাকি হারায়ে গিইছিলো। দলের কয়জন বুদ্ধি কইরে বইলতে শুরু কইরলো- টিকলিডি আমিই চুরি কইরেছি। আমার লোটা কম্বল সব চেইক করা অইলো কিন্তু পাওয়া গেলো না। তখন বলা অইলো আমি ওইডি বেইচে খেইয়ে ফেইলিছি। আমার ভাগ্যি ভালো যে, যাত্রাদলের ঐ কঞ্চা- যাত্রাদলের পিওন। যাত্রাপালায় অভিনয় কইরতি এইসে পিওন হইয়ে গেছে। তবুও দল ছেইড়ে যায় না কুনোখানে পোড়াকপাইলে। মাঝে মইধ্যে কারো কারো বোতল থেইকে ছিটে ফোটা ইট্টু আধটু বাংলা মদ চুরি কইরে লুকোয়ে লুকোয়ে খায়- কেউ কিছু বলে না, ছুডো বিষয় তো। সে-ই তক্কে তক্কে থেইকে একদিন প্রিয়বালার টেরাঙ্ক থেইকে টিকলিডিরে উইদ্ধের কইরে  আনলো। আর এর ফল অইলো ঝুমনির উপরে প্রিয়বালা হিংসের মাপডি একশ ডিগ্রীর উপ্রে উইঠে বইসে থাকলো।  একদিন ঠিকই অধিকারীর বুদ্ধিতে ঝুমনিরে প্রিয়বালা খুন কইরে ফেইললো। ফাঁকের থেইকে আমারে জেইলে ভইরে দিলো- এইডিই অইলো ঝুমনি-খুনের আসল বেত্তান্ত। কিন্তু এই আসল বেত্তান্তডি আমি বইল্লে বিশ্বেস কইরবি কিডা ? একসাথে এ্যাত কতা কুনোদিন আমি কইনি। সব কেমন গুলোয়ে যেতিছে।

-ঠিক আছে। মাত্র দুটি কথা জানতে চাইবো তোমার কাছে। ঝুমনিকে যে প্রিয়বালাই খুন করেছে- তুমি জানলে কি করে ?

-আমিই তো জাইনবো। আমি নিজের চোখে দেইখিছি যে। কিন্তু দেইখলিও তো বলা যাবি নে। তাই ইচ্ছে কইরেই বলি Subject তোমার তো ফাঁসি হয়ে যাবে- তুমি নিজেই বলেছ। ভয় করছে না ?

-ভয় কইরবি ক্যান্ ? মইরতি তো হবিই। তা ভিক্ষে কইরে দিনে দিনে না খেইয়ে মরার চেইতে একবারে ফাঁসিতে ঝুইলে মইরে যাওয়াই তো ভালো। দুই তিন মিনিট ইট্টু কষ্ট হবি- এই তো !

-আশ্চর্য মানুষ তো তুমি ? মৃত্যুকে এত তুচ্ছ মনে করো ?

-এইতো একডি ভুল কতা কইলেন। মিত্যু তুইচ্ছ হতি যাবি কোন দুঃখে ? তুইচ্ছ তো জীবন। মিত্যুরে তো কেউ বাইন্ধে রাখতি পারবি নে। আসলে যাত্রাদলে আমারে ঠিক মানায় না। আমি ওদের সাথে মিইলে চলতি পারি নে। ক্যান্ যে মরতি এইসেছিলেম !

-অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে তোমার। যদিও তুমি বুঝবে না, তবুও বলছি। আমি PhD  করছি। “বাংলার লোক সংস্কৃতিতে যাত্রাগানের ভূমিকা এবং প্রয়োজন- সামাজিক দৃষ্টিকোন থেকে যাত্রাগানের মূল্যায়ন। এটি Subject. এই Subjectএর ওপরই আমার PhD  করবার চেষ্টা। এক্ষেত্রে তোমার সাহায্যের প্রয়োজন আমার। ইতোমধ্যেই আমি Thesis’ টি লিখতেও শুরু করে দিয়েছি। একদিন তোমাকে সাথে নিয়ে তোমাদের যাত্রাদলে যাবো এবং সবার সাথে কথা বলবো, পরিবেশটি দেখবো।

-সর্বনাশ, বলেন কি ! আমারে সাথে নিয়ে ওখানে গেলি ওরা খালি আমারেই মাইরে ফেইলবিনে, আপনেরেও বাইচতে দেবে নে।

-সে তো ভবিতব্য। ঝড়ের ইঙ্গিত পেয়েও পাখিরা কি উড়ে চলা বন্ধ করে ? যাও, এবার বিশ্রাম। -চলে গেলো রসুল মালিক ওর ঘরে। ইরাবতী বসেই থাকলো।


           বুঝে নিলো ইরাবতী অতীতের পূরোটাই ভুলে গেছে রসুল মালিক। নিজেকে চিনবার ক্ষমতাও ওর আর নেই। ইরাবতীকে মোটেই চিনতে পারে নি। যেদিন সর্বশেষ ইরাবতীকে হত্যার চেষ্টা করেছিলো সেদিন থেকে রসুল মালিককে আর দেখা যায় নি। শুধু শুনেছিলো ও নাকি কোন একটি মৌলবাদী ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে  ওর মস্তিষ্কে ¯œvয়ু জনিত সমস্যার সৃষ্টি হওয়ার কারণে সেখানেও আর থাকে নি। তারপর থেকে ওর খোঁজ আর পাওয়া যায় নি। চরম অভিমান আর ক্রোধে ইচ্ছে করেই খোঁজ করে নি ইরাবতীও। তবে সমুদ্রের তলদেশে Depression সৃষ্টি হবার মতো ওর মনের আত্যন্তিক অনুভুতির গভীরতম প্রদেশে বুঝি এক ধরনের Depression-এরই সৃষ্টি হয়েছিলো। মনে মনে ভাবতো- রসুল মালিক হয়তো ফিরে আসবে। চাইতোও- রসুল মালিক ফিরে আসুক। কিন্তু ফিরে আর আসেনি রসুল মালিক।      

                                                                                                                                 

           একটি খুব বড় মাপের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেল্লো ইরাবতী। রসূল মালিকের অতীতকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্যে প্রয়োজন একজন Higher Leveled Psycheatrist এর। এবং ওকে কোনো Psycheatric Clinic-এ ও রাখা যাবে না। কোনভাবেই ওকে বুঝতে দেয়া যাবে না ও মানসিকভাবে সুস্থ্য নয়। ইরাবতীর কাছে রেখেই যা করবার তা করতে হবে। সুস্থ্য হবার পর পিতা হত্যার Clue-টিও হয়তো বা উদ্ধার করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে ইরাবতীও হয়তো ওর নিরুদ্দিষ্ট রসুল মালিককে আবার ফিরে পেতে পারবে। ভাবনা প্রবাহ অসম্ভব দ্রুততর হচ্ছে। আশ্চর্য ! নিজের অতীত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত হলেও প্রকৃতিজাত স্বভাবের এতটুকু পরিবর্তন হয় নি ওর। সেই সহজ সরল দৃঢ়চেতা নিষ্ঠাবান প্রগতিবাদী সত্যাচারী রসুল মালিক অবিকল একই রয়ে গেছে এখনও। এ প্রেক্ষিতকে বিবেচনা করে এই মূহুর্তে ইরাবতীর বদ্ধমুল প্রতীতি জন্মে যায় যে, শুধু কিছুটা সময় ওর জীবন থেকে জোর করে কেড়ে নেয়া হয়েছে কেবলমাত্র Fundamentalism based HypocrisyÕi gva¨‡g I‡K Hypnotized  করে। সে সময়টিকেই ওকে ফিরিয়ে দিতে হবে। আর কোনভাবে কিছুতেই হারাতে চায় না ওকে ইরাবতী। খাবার টেবিল থেকে উঠে শোবার ঘরে ঢুকে টেলিফোনের রিসিভারটি তুলে নিয়ে কয়েকটি নাম্বার টিপলো। পেয়ে গেলো অপর প্রান্তে কাঙ্খিত ব্যক্তিটিকে। কথা শেষে পরদিন সকালে  আসতে বলল ওকে ইরাবতীর নিজের ফ্লাটে। পক্ককেশ ড. স্টুয়ার্ট মেলভিন। ভদ্রলোক কানাডিয়ান। বহু বছর থেকে এ দেশে আছেন। এদেশের মানুষের সাথে একেবারেই মিশে গেছেন। বাংলা ভাষাটিকেও মোটামুটি রপ্ত করেছেন তিনি অসীম ধৈর্যের সাথে অপরিমেয় শ্রম দিয়ে। PsychologyGes Psycheatry’ `yটি সাবজেক্টেই Doctorate করেছেন। এ দেশের প্রথম শ্রেণীর মনো-চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম একজন। বাবার সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই ইরাবতীর সাথে ওর পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা। বাবা এবং মেলভিন দুজন একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। বাবা দর্শন শাস্ত্রে আর মেলভিন মনোবিজ্ঞানে। কয়েক বছর পর ড. মেলভিনকে University of Medical Science- - এর Psycheatry বিভাগের প্রধান করে স্থানান্তরিত করা হয়। পরবর্তীতে অবসরে গিয়ে তিনি নিজে একটি Psycheatric Clinic-এর প্রতিষ্ঠা করেন। এখন পর্যন্ত সে Clinic-এরই প্রধান তিনি।     


           শুরু হয় ইরাবতীর নতুন  Mission.’ বলা যায়- রসুল মালিকের ওপর রসুল মালিককে প্রতিস্থাপন প্রজেক্ট বাস্তবায়ন।- যা প্রকৃত অর্থেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবার এক দুঃসাধ্য অভিযানের সমান্তরাল। কিন্তু ইরাবতী স্থির। অবিচল।  



০৩.

(ইরাবতীর মিশন শুরু হবার দুবছর আগের একটি যাত্রাদলের পালার নেপথ্যে ঘটে চলা প্রতিদিনের প্রায় স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মের অতিক্ষুদ্র একটি খন্ডচিত্র এটি)।


           -বিয়ে বিয়ে কইরে আমার মাতাডিরে তুই গিইলে খেতিছিস ক্যান্ কতো ? ঘিলুগুলোন সব আমার গইলে যেতিছে। তুই আমারে এইখেনে নিয়ে আসলি ক্যান ? আমি তোরে বিয়ে কইরবো- এই কতাডি শুইনবের জন্যি। আমি যে তোরে বিয়ে কইরবো- এমুন কুনো কতা আমি তোরে বইলিছি কুনোদিন ? উল্টো আমি যে তোরে বিয়ে কইরবোই নে- এ কতাডিই তো কতোবার কইরে তোরে আমি বইলিছি। তোরে বিয়ে না করলি তো অধিকারীর মরন পইর্যন্ত হবি নে। পালা না থাকলি তুইও তো অধিকারীর মশারীর নীচে শুইবের যাস- ঠিক না ? তুই তোর অধিকারীরে নিয়ে যাত্রাগানরে তো শিল্প শিল্প বইলে মুখে ফ্যানা তুইলে ফেলাস, কিন্তু পালা না থাকলি অধিকারীর মশারির নীচে দুই জনে মিইলে সেই শিল্পের ক'টা বাজায়ে দিস কতি পারবি তুই ? নির্ঘাৎ পারবি নে। সবাইরে খালি ডেইকে ডেইকে কইয়ে বেড়াতি পারবি- আমি তোরে বিয়ে করইরতে চেইয়েও বিয়েডি করিনি। ক, কতাডি কবি নে তুই ? তোরে চিনিনে আমি ? স্বামী স্বামী কইরে তো গলায় রক্ত তুইলে ফেইলেছিস। আর সেই রক্ত গিলবের জইন্যি তো তোর অধিকারীবাবা কাতলা মাছের মতো দুই দিকের ফুলকো ফাঁক কইরে হা মেইলে বইসেই রইয়েছে। তা সেডি না কইরে তুই তোর ওই নীল রংয়ের রক্ত গুলোনরে আমারে দিয়েই গিলেতি চাচ্ছিস- কেবল অধিকারীর কাছে তোর দামডিরে ইট্টু চড়ানের লেইগে তাই নে ? ক, কতাডি ঠিক কি নে ? 

-তুই ভেইবেছিস আমি কিচ্ছু বুঝি নে- এই তো। একশ ভাগ ধইরে নে আমি তোরে বিয়ে কইরবো নে। তোর সাথে আমার এমুন কিছু নেই যে, তোরে আমার বিয়ে কইরতিই হবি।   রসুল মালিকের এই সোজা সাপটা কথাগুলির মধ্যে দিয়ে একটি গর্বিত সত্য প্রকাশের প্রচ্ছন্নতার ইঙ্গিত যেন প্রকাশ পায়।      

-ধইরে নেবো ক্যান্ ? হ্যাঁ, ধইরে নেবো ক্যান্ ? বিয়ে তো আমারে তোর কইরতিই হবি। সে তুই যত কতাই আমারে কস না ক্যান আর যত ফন্দি ফিকিরই আটস না ক্যান।জ্ঞান গম্যির দিক থেকে প্রিয়বালাই বা ওর চাইতে কম কিসে- ভাবে প্রিয়বালা ? তাই, ওর দিকে না তাঁকিয়ে অনেকটা বিজ্ঞের মতো কথাগুলির উত্তর ওভাবেই দেয় প্রিয়বালা।  

-তার মানে তুই আমারে বিলাকমেলকরবি- এই তো।  ঠিক আছে যা- তোরে বিয়ের কপালে আমি আগুন দিলেম।

-না করলি বিয়ে। কিন্তু আমার এই পেটডির মইধ্যি কি করছে- ভেইবে দেইখিছিস তো। পেটটিতে দুহাত দিয়ে ইস্তিরী করতে থাকে প্রিয়বালা। পেটটি তখনও কিছুমাত্রই ফুলে ওঠেনি ওর- যাতে বোঝা যেতে পারে- ওর পেটে ভ্রুণের সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। 

-কার না কার মাতার বোঝা আমার !

-কি কলি ?                                                                                                                     

-কি কবো আবার। এখনোও তো পেটডি ফুইলে ওঠে নি। ক'দিন পরে সত্যি সত্যিই যদি ফুইলে ওঠে তাইলে তো বইলে বেড়াবি নে- সুযোগ পেইয়ে জোর কইরেই আমি তোর পেটে ওরে ঢুকোয়ে দিইছি। থাক তুই তোর পেট নিয়ে। মিছে কতা কইবের হাড়ি তো তুই।

-ঠিক সেই জইন্যেই তো তুই আমারে সবার চোখের ডগার উপরেই বিয়ে করবি। কারণ আমার মিছে কতাডিরেও সবাই সইত্য বইলেই বিশ্বেস করে। 

-সেইডি ভেইবেই থাক্। আমারে পেতি হবিনে। -রসুল মালিকের শেষ কথা।                                                         

এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতেই কথাগুলি বলে আসছিলো দুজন। এবার রসুল মালিক হাঁটতে শুরু করলো উল্টো দিকে। প্রিয়বালা কিছু বললো না, দাঁড়িয়েও থাকলো না। সামনে বি¯তৃত বিশাল কাশবন। কাশবনের পাশ দিয়ে হেঁটে চলবার সরু মেঠো পথ। ঐ পথের এক প্রান্তে গিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে বসলো প্রিয়বালা। আঁচলে বেঁধে রাখা পান সুপারি তামাকপাতা ইত্যাদি বের করে একটু বেশী পরিমান তামাক পাতায় চুন মেখে পানের মধ্যে দিয়ে মুখে পুরলো প্রিয়বালা। চিবুতে লাগলো। বিন্দুমাত্র পরিবর্তন এলো না ওর মধ্যে। কারণ, প্রিয়বালা জানে একটু পরেই ও এখানে ফিরে আসবে। ঘন্টা খানিক অতিক্রান্ত হয়েছে- ফেরেনি রসুল মালিক। ইতোমধ্যে আরও দুটি পান গিলে নিয়েছে প্রিয়বালা। এখন দেখছে কাশবনের সাদা সাদা দৃষ্টিনন্দন দোলায়িত কাশফুল। কাশবনের ওপাশের নাম না জানা বিভিন্ন বর্ণোজ্জ্বল বৃক্ষরাজির ঘণকৃষ্ণ পত্রপল্লবের ছায়ায় আশ্রয় নেবার জন্যে ঝাঁক বেঁধে উড়ে আসা ছোট ছোট পাখির নিবিড় কোলাহল, মিষ্টিমাখা ঝগড়ার হাঙ্গামা। ওদের কলকাকলিতে ভরে ওঠা বৃক্ষ-কুলের w¯œগ্ধ অঙ্গন। অঘ্রান-বিকেলের প্রশান্ত নীলিমায় টুকরো টুকরো সাদা মেঘের তরঙ্গায়িত চলাফেরা- যেন রাশি রাশি কাশফুলকে কাছে পেয়ে পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে একে অপরকে একান্ত আপন করে নেবার এক দূরন্ত উন্মাদনা। কখনও বা একেবারে নীচে নেমে আসছে আবার কখনও বা শীর্ণ হাওয়ার চুড়োয় চড়ে দূর শুণ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে -এ যেন সুবিশাল অনিরুদ্ধ আকাশ দেখবার উন্মূখ আকাঙ্খাকেও অবলীলায় মনের গহিন থেকে তাড়িয়ে দিয়ে কেমন এক দূরোতিক্রম্য নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হবার মতো বুঝিবা। শৈশবের হাসি কান্না, কৈশোরের প্রজাপতি ধরা অথবা মেঘের রাজ্য পার হয়ে চাঁদের দেশে হারিয়ে যাবার অনাবিল ভাবনার আকুলতা, যৌবনের অকারণ উচ্ছ্বাস, প্রৌঢ়ত্বের অসহায়ত্ব, বার্ধক্যের যন্ত্রণা,  পারিপার্শ্বিকতার সৌন্দর্যকে নিজের মধ্যে ধারণ -এসব তো মানুষী বিকাশেরই এক একটি অধ্যায়। আর এসব অধ্যায়ই তো নষ্টালজিয়ার প্রান। এবং প্রিয়বালাও যে এই মানুষী বিকাশের বহির্বৃত্তের কেউ নয়-এটি তো নিশ্চিত। তারপরেও প্রিয়বালাদের মতো মানুষের এ জাতিয় ভাবনা আঁধার রাত্রির মাঝখানে শুণ্যে দোলায়মান প্রহেলিকার  মতো।  


           সে প্রেক্ষিত বিবেচনায় প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয় যে, আমাদের সমাজের সাধারণ মূল্যবোধের বিচারে যাত্রাদলের নট নটীদের মনের ভেতরে এই নষ্টালজিয়া বিষয়ক জটিলতার অস্তিত্ব থাকবার বিষয়টি কি শোভন, বিলাসিতা,  অথবা যৌক্তিক ? মূলতঃ শোভনতা বা অশোভনতা, বিলাসিতা বা কৃচ্ছতা-কোনটিই এখানে প্রযোজ্য নয় বরং যৌক্তিকতার ইতিবাচক বিষয়টিই বোধ করি প্রধান। যুক্তিটি অনেকের কাছে নেতিবাচক মনে হতে পারে। যেহেতু যাত্রাদলটি কথিত শিল্পের আঁড়ালে একটি নোংরাচ্ছন্ন ভিন্ন মাত্রার ব্যবসা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান- যাকে আমাদের সাধারণ সমাজের দৃষ্টি দিয়ে তির্যক ভঙ্গিতেই  দেখা হয় যৌক্তিক অর্থেই। আর সে কারণে এ ধরনের ব্যবসায়ের কুশীলবদের অন্তরে কেবল ন্যুনতম মান নিয়ে বেঁচে থাকবার জন্যে একমাত্র কাঞ্চন জাতিয় জটিলতা ব্যতীত নষ্টালজিয়ার মতো সুখের অনুভুতি আসে কোত্থেকে ? অথবা আসবার সময় এবং স্থানই বা কোথায় ? আসলে ব্যবসাটিও মৌলিক নয়, মৌলিক হলো ঐ ব্যবসাটির এক ধরনের চারিত্রিক প্রকৃতি। এবং সে প্রকৃতির একটি বিশেষ    open Secret’  বৈশিষ্টের কারণে সন্দেহের উদ্রেক, আর সে সন্দেহের ভেতর থেকেই এ ধরনের প্রশ্নের উত্থান যদিও, তবুও শেষ অর্থে যাত্রাদলের নট নটীরাও ঐ মানুষী বিকাশেরই চুড়ান্ত পরিণতি। আর মানুষের হৃদয়িক মাপ জোখের মধ্যেই তো নষ্টালজিয়া হাত পা ছড়ায়। স্মৃতিবিধুরতা বয়োঃপ্রাপ্ত হয়। যেখানে অন্য কোন জীবের ক্ষেত্রে প্রশ্নটি অবান্তর।    


           ফিরে আসছে রসুল মালিক। মধ্যপথে ওকে আসতে দেখে মূহুর্তেই ছিঁড়ে গেল প্রিয়বালার নষ্টালজিয়ার সব সুখময়োতার প্রিয়তোষ ইন্দ্রজাল। আঁচলের গিট খুললো প্রিয়বালা। পান সুপারি এসব বের করে মুখে পুরবার জন্যে তৈরী করতে শুরু করলো। কাছে এসে ওর পাশে বসে কতকটা নিস্পৃহভাবেই উচ্চারণ করলো রসুল মালিক-

-একাই খাবি ? আমারে দিবি নে ? এতটাই নিস্পৃহ রসুল মালিক যে, গোটা মুখোমন্ডলটিতে ঘন বিষন্নতার ছাপ সুস্পষ্ট। 

-খুব তো দেমাগ দেখিয়ে চইলে গেলি। ফিরে এইলি যে !প্রিয়বালা রসুল মালিককে বোঝাতে চায়- রসুল মালিকের চলে যাওয়া আর ফিরে আসাতে ওর কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। একেবারেই আগের মতো স্বাভাবিক।

-চল্ যাই। সইন্ধ্যে তো হইয়ে এলো। ইট্টু পরেই তো আবার তোর অধিকারীডি হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দেবে নে- রসুল কই গেলো, প্রিয়বালা ভেইগেছে নাকি ? ওরে কঞ্চা, তোরে কি খালি খালি হামাগুড়ি দেবার জইন্যে বইসে বইসে ভাত গেলাচ্ছি                                                                     নাকি ? চাইর দিকডি ইট্টু ভালো কইরে দ্যাখ না বাবা। মেকআপে বসতে হবি তো। আইজকের পালাডিরে ঠিকমতো জমাতি না পারলি কাইলকে তো চাট্টি মাট্টি সব গুটোয়ে ফেল্তি হবে নে। একডি ট্যাকাও ওরা দেবে নে- আগেই বইলে দিইয়েছে।


           অধিকারীর প্রতিদিনই ঐ একটিই কথা- আজকের পালাটিকে যেভাবেই হোক ভালো করতে হবে, নইলে আয়োজকরা একটি পয়সাও দেবে না। অর্থটি হচ্ছে আয়োজকরা টাকা না দিলে কুশীলবদেরকেও টাকা দিতে হবে না- এটি যে অধিকারীর দৈনন্দিনের একটি সস্তা কুটিল চালাকি- বোঝে সবাই দলের।  

-রসুল, তোরে একডি কতা কই- একটি পান রসুলকে দিয়ে অন্যটি নিজের মুখে পুরে কথার বাকি অংশটি শেষ করে প্রিয়বালা- 

-আমি আর যাত্রাদলে থাইকবো নে।

-কোনে যাবি ?                                                                                                                         

-তা জানি নে। তবে যাত্রাদলে আর থাইকবো নে।

-তাহলি তো ভালোই হয়। ঝুমঝুমির আইসবের পথডি ফাঁকা হইয়ে যায়।

-আর সাথে সাথে তোর মনের মধ্যিও কালা কেত্তন পালার খঞ্জনি বাইজতে শুরু করে- তাই নে, আমারে আর বিয়ে করতি হবি নে বইলে । আসলে যাত্রা দলে খুব সস্তায় মেইয়ে মানুষরে পাওয়া যায় তো, তাই পূরুষগুলোনও আলজিভ বের কইরেই থাকে কাত্তিক মাসের ঐ হ্যাংলা পূরুষ কুইত্তে গুলোনের মতো। বুঝলি, আসলেই আমি অধিকারীরে বিয়ে কইরবো নে। চল্ এক কাম করি দুইজনেই একসাথে দল থেইকে ভেইগে যাই।মনে হয় যথেষ্ট আস্থা নিয়েই কথাগুলি কলে প্রিয়বালা রসুল মালিককে। 

-শোন, আমি এই যাত্রাদলে এইসেছি মাত্র দুই বছর। এই দুই বছরে তোর আর অধিকারীর কেত্তনের পালার সবডিই তো আমি স্বচক্ষেই দেইখেছি। সব দেইখে শুইনে তোরে বিয়ে কইরবের আহ্লাদ আমার হবি- এইডি তুই ভাবলি কি কইরে ? তাছাড়া-

-আর তাছাড়া কতি হবি নে। বুইঝে ফেইলিছি আমি তোর সব জারিজুরি। তুই ঝুমঝুমিরেই বিয়ে কইরবি তাই নে ? চল্ এতক্ষণে বুঝি অধিকারীর কপালে ভাঁজ পইড়ে গেছে। -মুহুর্তেই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে প্রিয়বালার মুখোমন্ডল। যেন রক্তশুণ্যের রোগী। সব হতাশা যেন একসাথেই প্রিয়বালার মুখোমন্ডলের সব রক্ত শুষে নিয়েছে। সাদাটে হয়ে গেছে ওর গোটা মুখোমন্ডল।

-তা তোর যা ইচ্ছে তুই ভেইবে নিবি- আমার বইলবের কি আছে। তবে আমি আমি-ই। সোজা ছাড়া ব্যাকা পথে হাইট্‡eর শিক্ষে আমার বাপ মায়ে আমারে দেয় নেই। ক্যামন কইরে যে জঘন্য এই যাত্রার দলডিতে ঢুইকে পইড়িছিলেম নিজেই কইবের পারি নে। ক্ষোভ আর ঘৃণা ঝরে পড়ে রসুল মালিকের কথায়। কিছুকক্ষণ সামনের রাস্তার দিকে চরম বিষন্নতায় জীর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে সামনের দিকে। বাধ্য হয়ে প্রিয়বালাও ওর সাথে নীরবে যাত্রা প্যান্ডেলের দিকে চল্তে শুরু করে, মুখে আর কিছুই বলে না। 



০৪.

         ১৭ জুলাই২০১১। এ দিনটির পর আরও চার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। রসুল মালিককে নিয়ে ইরাবতী দুবার ওই যাত্রাদলে গিয়েছে। প্রথমবার কুমিল্লায়, দ্বিতীয়বার ব্রাহ্মনবাড়িযায়। অধিকারী, প্রিয়বালা সহ দলের প্রায় সবার সঙ্গেই কথা বলেছে ইরাবতী। ওদের বাইরেও সাধারণ মানুষের সাথে যাত্রাগান নিয়ে কথা বলেছে, বুঝে নেবার চেষ্টা করেছে ওদের মনোভাব। সবাই সহযোগিতা করেছে ওকে। এই কথা বলা, এই বুঝে নেয়া- যথেস্ট কাজে লেগেছে ওর Thesis-টি লেখার ক্ষেত্রে।  ঝুমনি হত্যাকান্ড সম্পর্কে কিছু না বললেও যতটুকু বোঝার তা বুঝে নিয়েছে ও। ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে ফিরে আসবার এক সপ্তাহের মধ্যে অধিকারী ও প্রিয়বালাকে Police custody তে নেয়া হয়েছে। বেশ কিছুদিন মামলা চলবার পর খড়বিৎ Lower Court -এর Trial-এ অধিকারীর যাবজ্জীবন এবং প্রিয়বালা মৃত্যুদন্ডাদেশ হয়েছে। আদালত রসুল মালিককে নির্দোষ হিসেবে খুনের অভিযোগ থেকে অব্যহতি দিয়েছে। এর পর যাত্রাদলটি আর টেকে নি। ভেঙ্গে গেছে। 

           এই চার বছরের ভেতর দুবছরের মধ্যেই রসুল মালিক আমূল পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ড. মেলভিনের অক্লান্ত পরিশ্রম, ইরাবতীর রাত দিন প্রাণপন শুস্রুষার পাশাপাশি সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা। ড. মেলভিন নিজেই প্রতিরাতে একটি করে ইনজেক্শন দিয়ে যান। মাঝে মাঝে ওর ক্লিনিক ছাড়াও বিভিন্ন সেমিনারে ওকে নিয়ে যান। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেন ওর স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনবার- সব মিলিযে বলা যায় রসুল মালিক এখন প্রায় নব্বই ভাগ সুস্থ। সে এখন চলিত বংলা, ইংরেজী দুভাষাতেই কথা বলতে পারে। Laptop -এ Compose করতে পারে। অধিকাংশ সময় সে এখন Laptop টি নিয়েই থাকে। লেখে। প্রায় সব লেখাগুলিই ওর সমাজতত্ত্বের ওপর। ইরাবতী ওর পাশে বসে ওকে সাহায্য করে, উৎসাহ যোগায়। তারপরেও মাঝে মাঝে ও ভীষন অস্থির হয়ে ওঠে। রাগে ফেটে পড়ে। চিৎকার করতে থাকে অব্যাহতভাবে। কি যেন বলতে চায় কিন্তু বলতে পারে না। অসীম ধৈর্য এবং সহনশীলতার সাথে পরিস্থিতি সামলে নেয় ইরাবতী।  প্রচুর সম্পদ রেখে গেছেন ইরাবতীর পিতা। ঢাকায় নিজস্ব দুটি বাড়ী। দুটি বড়ীতে বারোটি Flat. তার পৈত্রিক গ্রাম- Òরিটা কুমারী'তে পর্যাপ্ত ফসলী জমি। ব্যাংকে সঞ্চিত যথেষ্ট অর্থ- যার সবকিছুরই Nominee তিনি করে গেছেন তার একমাত্র কন্যা ইরাবতীকে। বিষয়টি ইরাবতীকে আগেই জানিয়েছিলেন ওর বাবা। বাবার আজীবনের স্বপ্ন ছিলো একটি উন্নতমানের Charitable Trust গঠনের পাশাপাশি একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলারÑ যে Trust থেকে মেধাবী ছাত্র ছাত্রী দেরকে বাৎসরিক একটি সম্মানজনক বৃত্তি প্রদানসহ উচ্চমানের পুরস্কার-প্রদান ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেইসব ছাত্র ছাত্রীকে বিনামূল্যে উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হবে-যাতে তারা একটি সুন্দর জাতি গঠনে তাদের মূল্যবান ভুমিকা রাখতে পারবে। 

      বাবার নৃশংস হত্যাকান্ডের পর ইরাবতী দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বাবার সম্পদের কোন কিছুই সে তার নিজের কাজে ব্যবহার করবে না। বাবার আরাধ্য কাজটিই সে বাস্তবায়িত করবার চেষ্টা করে যাবে। একটি Charitable trust প্রতিষ্ঠা করবে- যে trus থেকে মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদেরকে বাৎসরিক বৃত্তি প্রদান করা হবে। শুধু তাই নয় সমাজের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা জন্যে যারা কাজ করবে, বিশেষ অবদান রাখবে তাদের জন্যে প্রতি বছর উচ্চমান এবং মূল্যের একটি সম্মানজনক পুরষ্কার প্রবর্তন করা হবে। যা ইতোমধ্যে ইরাবতী করেছেও। বাবার একটি বাড়ীকে- PRFESSOR DIKSIT CHARITABLE TRUST’- এর প্রধান কার্যালয় হিসেবে ঘোষনা করে অপর বাড়ীটিতে বিনামূল্যে মাধ্যমিক- উত্তর ছাত্র ছাত্রীদেরকে উচ্চ শিক্ষাদান প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে- যেখানে শুধুমাত্র সেই সব ছাত্র ছাত্রী পড়াশুনার সুযোগ পাবে- যারা সমাজকে কল্যাণকর মাত্রায় বিনির্মানে নিষ্ঠবান থাকবার এবং যে কোন ধর্মের গোড়মীর উর্দ্ধে থেকে সকল মৌলবাদ, সকল হিংস্র ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহন করবার অঙ্গিকার করতে পারবে। জাতির অগ্রগামীতার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবার ক্ষেত্রে প্রত্যয়দীপ্ত হবে এবং এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীদেরকে সে শিক্ষাই দেয়া হবে এবং সে ভাবেই তাদেরকে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হবে।


           এখন প্রচন্ড ব্যস্ত ইরাবতী। একদিকে তার নিজের খধি Law Farm, Trust - এর দেখাশোনা, Trust-এর প্রয়োজনে দেশী বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ। এর ওপর রসুল মালিককে সময় দেয়া। যদিও দুজন নার্স সার্বক্ষণিকভাবে ওর দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত তারপরেও ইরাবতীর মনের কোনে একটি অতৃপ্তি কাজ করে সব সময়। কেন সে ওকে আরও বেশী সময় দিতে পারছে না ? ইরাবতী জানে ওর জীবনে রসুল মালিক ছাড়া এখন আর কিছু নেই। যে ভাবেই হোক ওকে পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে হবে। এবং ও পরিপূর্ণ সুস্থ হবার পর নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্ব ওকেই দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নামটি হবে    ‘PRFESSOR  DIKSIT INSTITUTE.’                                                                                                                                  

০৫.                                                                                                                                       

          তিন বছরের মাথায় একটি অভাবিত ঘটনা ঘটে গেলো। ড. মেলভিন কিছুদিন আগে কানাডা গিয়েছিলেন। গতকালই ফিরেছেন। ফিরেই ইরাবতীকে ফোন করে জানিয়েছিলেন আগামীকাল সন্ধ্যায় তিনি ইরাবতীর Flat-এ আসবেন। ইরাবতী স্বস্তি পেয়েছিলো। পরদিন নির্ধারিত সময়েই ইরাবতীর Flat-এ ড. মেলভিন আসলেন। ইরাবতীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো। কি কথা হলো জানা গেলো না। তারপর ড. মেলভিন চলে গেলেন। সেদিন রাতেই ইরাবতী-                                                                    

রসূল মালিককে জানিয়ে রাখলো আগামী পরশু ওরা Cox’s Bazar যাচ্ছে। Cox’s Bazar যাবার কথা শুনে রসুল মালিক খুব পুলকিত হয়েছিলো। ইরাবতীকে বলেছিলোÑ

-এতদিন আমরা যাইনি কেন ?

-এখন তো যাব। ভালো লাগবে না তোমার ?

-Cox’s Bazar Sea Beach, সমুদ্রে সূর্যাস্ত যাওয়া, সমুদ্রের জোয়ার ভাটা- এসব না দেখলে জীবনের অনেক কিছুই বুঝি অপূর্ণ থেকে যায়।

-তোমার তো এখন কবিতা লেখা উচিৎ। কি অপূর্ব ছন্দে তুমি কথাগুলি বললে ! সত্যিই মুগ্ধ হতে হয়।

আসলেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো ইরাবতী। ভাবতে পারে নি এতদিন পর এত অদ্ভুত ভাবে কথা বলবে রসুল মালিক। আস্থা জন্মায় ইরাবতীর ভেতরে- অচিরেই পূর্ণাঙ্গ স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে রসুল মালিক। 

নির্ধারিত দিনে সকাল এগারটার কিছু পরেই যাত্রা শুরু করলো ওরা "Cox’s Bazar” -এর দিকে। ড. মেলভিনও ওদের সঙ্গে তবে পৃথক গাড়ীতে। সেদিনও প্রচুর বৃষ্টি। সারাটা পথ বৃষ্টির ভেতর দিয়েই যেতে হয়েছে। সময় মতোই ওরা পৌঁছে গেলো মোটেলে। সবকিছু Arrange করাই ছিলো। Attendant’iv ওদের Luggage নির্দিষ্ট কক্ষে পৌঁছে দিলো। রাত্রে অনেক কথা হলো ওদের  দুজনের। কিন্তু বিপত্তিটি ঘটলো শুতে যাবার সময়। রসুল মালিক কিছুতেই শোবে না ইরাবতীর সাথে একই বিছানায়। কেমন যেন একটি ভীতি কাজ করছিলো ওর মধ্যে। যতবারই ইরাবতী ওকে আহ্বান জানিয়েছে ততবারই রসুল মালিক ভয়ে কুকরে যাচ্ছিলো। ইরাবতী বারবার করে বললেও কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না- ইরাবতী ওর স্ত্রী। শেষ পর্যন্ত ইরাবতী বলেছিলো- আমরা রাত্রে ঘুমোবো না, সারা রাত শুধু কথা বলে কাটিয়ে দেবো- আর কাল সকালে আমরা সমুদ্র  দেখতে যাবো- ঠিক আছে ?

-OK.


          

            পরদিন সকাল দশটার মধ্যেই ওরা বীচে পৌঁছে গেলো। এর মধ্যেই অসংখ্য পর্যটকে পরিপূর্ণ  Sea Beach. আকাশ মেঘাচ্ছন্ন- সূর্য নেই। কেউ কেউ Sea Beach -এ শুয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বা সমুদ্রের পানিতে Speed Boat--এ চড়ে Romance  উপভোগ করছে। অদ্ভুত এক ভালো লাগার দৃশ্য। ইরাবতী রসুল মালিককে নিয়ে একটি Speed Boat-এ  উঠলো। Boat টি চলতে শুরু করলো পূর্ণ গতিতে। দুজনই উচ্ছসিত Boat টিতে। চলতেই থাকলো ওরা। ধীরে ধীরে আকাশে মেঘ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতাসের গতিবেগ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। Beach -এ আতঙ্ক চিৎকার ইত্যাদি শুরু হয়ে গেলো। যারা Speed Boat -এ সমুদ্রে ছিলো তারাও অতি দ্রুত ফিরে আসতে শুরু করলো। কিন্তু ইরাবতীদের Boat টি ফিরে এলো না। ইতোমধ্যে বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেলো। এ রকম একটি Situation -এরই অপেক্ষা করছিলেন ড. মেলভিন। যদি প্রাকৃতিক দূর্যোগ সৃষ্টি না-ও হতো তাহলেও ওদের Boat টিকে পরিকল্পিত ভাবেই সমুদ্রের একটি নির্দ্দিষ্ট এলাকায় ডুবিয়ে দেয়া হতো। তারপর ওদেরকে Rescue করা হতো। অর্থাৎ একটি প্রবল মানসিক ঝাঁকুনির প্রয়োজন ছিলো রসুল মালিকের পূর্ণাঙ্গ স্মৃতিশক্তি ফিরিয়ে আনবার জন্যে- যা ওর মস্তিস্কে Electric Shock Therapy প্রয়োগ করেও সম্ভব হতো না- এ কারণে যে- ওই Therapy টি হতো কৃর্তৃম। আর যে পরিকল্পনাটি ওরা করেছিলো সেটি ছিলো রসyল মালিকের মননের সাথে সম্পৃক্ত। যদিও এ রকম একটি Situation  ছিলো ইরাবতী, রসুল মালিক দুজনের জন্যেই প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ তারপরেও এ ছাড়া কোন বিকল্প ছিলো না রসুল মালিকের স্মৃতি ফিরিয়ে আনবার। বিষয়টিতে ইরাবতীর সম্মতি পাবার পর ঝুঁকিটি নিয়েছিলেন ড. মেলভিন।  Rescue Team -কে প্রস্তুত করে রাখাই ছিলো আগে থেকে। এ Team -এর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ড. মেলভিন। ওদের Boat থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে আরও দুটি Speed Boat ওদেরকে Escort করছিলো। এ Boat দুটিতে ছিলো Highest Protective ব্যবস্থা এবং Boat দ’টি ছিলো Survival -এi জন্যে Well-Equipped. 

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর Rescue Team -ওদেরকে উদ্ধার করেছিলো পূরোপুরি জ্ঞানহীন অবস্থায় তবে জীবিত- একে অপরের সাথে জড়ানো।                                                                                                

         উদ্ধার করবার পরপরই ওদেরকে নেয়া হয় একটি বিশেষায়িত ক্লিনিকে। তাৎক্ষণিকভাবেই ড.মেলভিনের Supervision -এ শুরু হয় ওদেরকে সুস্থ করবার যাবতীয়  পªক্রিয়া। একদিন পর ইরাবতী মোটামুটি কিছুটা সুস্থ হলেও রসুল মালিকের জ্ঞান ফিরতে লেগে যায় পুরোপুরি চার দিন চার রাত। এক পর্যায়ে ইরাবতী ভীষন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে- আর বোধ হয় রসুল মালিককে বাঁচানো গেলো না। ড. মেলভিনের মুখের দিকে অসহায়ের মত শুধু অপলক তাঁকিয়ে থাকে। ড. মেলভিন আশাবাদী- ধৈর্য ধারন করবার পরামর্শ দেন ইরাবতীকে। পঞ্চম দিনের মধ্যরাত্রি। শায়িত রসুল মালিকের মুখের দিকে অবিশ্রাম তাঁকিয়ে ইরাবতী। সামান্যতম ঘুম বা তন্দ্রা- এসবের কিছুই নেই ওর দুচোখে। হঠাৎ অস্ফুট স্বরে কি যেন বলে উঠলো রসুল মালিক।  উৎকর্ণ হলো ইরাবতী। চোখ মেলে তাঁকালো রসুল মালিক। অনেকক্ষণ ধরে তাঁকিয়ে থাকলো ইরাবতীর মুখের দিকে। মনে হলো কাকে যেন খুঁজছে।  

-কাউকে খুঁজছো তুমি? -ইরাবতীর আকুল জিজ্ঞাসা।                                                                        

-তুমি ইরাবতী না ? কথাটি বলেই আবার জ্ঞান হারালো রসুল মালিক।

সঙ্গে সঙ্গে ইরাবতী ফোন করলো ড. মেলভিনকে। কিছুকক্ষণের মধ্যেই ড. মেলভিন আসলেন ক্লিনিকে। শুনলেন সবকিছু। বললেন- "you are the most lucky one. And you have achieved your success. যে অবস্থাতেই থাক্ কাল সকালেই ওকে মোটেলে নিতে হবে এবং তোমার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য দিতে হবে ওকে।"


           পরদিন সকালে ঘুমের মধ্যেই ওকে মোটেলে নেয়া হলো। শুইয়ে দেয়া হলো বিছানায়। ড. মেলভিন ওকে একটা ইনজেক্শন পুশ করলেন। যাবার সময় বলে গেলেন শুধু ঘুমাবে। যত বেশী ঘুমাবে তত বেশী ওর স্মৃতি ফিরে আসবে। লক্ষ্য রাখবে ওর ঘুমে কেউ যেন ডিসটার্ব না করে। আর ঘুম থেকে উঠে ও খেতে চাইবে ওর নিজের কক্ষে। সেদিন আর বাইরে গেলো না ইরাবতী। সারাক্ষণ রসুল মালিকের কাছে কাছেই থাকলো। কতক্ষণে চোখ খুলবে রসুল মালিক, কখন কথা বলবে। অপেক্ষার প্রহর যেন ফুরোতেই চায় না। সারাটি দিন একটি গুমোট অস্বস্তিতে কাটালো ইরাবতী। অবশেষে সন্ধ্যার কিছু পর সেই বিশেষ মুহুর্তটি এলো। ঘুম থেকে জেগে উঠলো রসুল মালিক। বিছানায় শুয়ে থেকেই কক্ষটির চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখলো। খুবই পরিচিত মনে হলো কক্ষটিকে। কক্ষটির সবকিছুই যেন পরিচিত। কোনোদিন হয়তো ও এসেছিলো এ কক্ষটিতে; মনে করতে পারছিলো না এই মুহুর্তে। দেয়াল ঘড়িটিতে তখন সাতটা বেজে বারো মিনিট।  ইরাবতীর নাম ধরে ডাকলো ওকে। ইরাবতী দ্রুত কক্ষে প্রবেশ করলো-

-ঘুম ভাংলো ? কতক্ষণ হলো জেগেছো ? খুবই উৎফুল্ল ইরাবতী। খুবই হাসি খুশি। ওর আনন্দের মাত্রাটি যে কয়েকগুণ  বেড়ে গেছে বোঝা যায় ওর আচরণে। অকারণেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো যেন ভীষনভাবে।

-এইতো এখুনি।

-কিছু খাবে এখন ? অনেকক্ষণ তো ঘুমিয়েছো ; ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়ই। তুমি শুয়েই থাকো আমি তোমার খাবার নিয়ে আসছি।

 -না না , আমার ক্ষিধে পেয়েছে ঠিকই তবে এখন  শুধু এক কাপ চা। মাত্র তো সন্ধ্যে সাতটা বেজে বারো মিনিট। এখন অন্যকিছু খেলে রাতে তো খেতে পারবো না।

-রাতে কি খাবে ?  


-ঠিক আছে আমি রিসেপ্শনকে জানিয়ে দিচ্ছি।  আজকে রাতে আমরা তিনজন এক সঙ্গে খাবো।                                       

তিনজন কেন ? আর একজন কে ? -রসুল মালিকের প্রশ্ন।

-একজন অতিথি- ড.স্টুয়ার্ট মেলভিন। কানাডিয়ান। খাবার টেবিলেই তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো।

Attendant এসে দুকাপ চা আর দুবোতল পানি কক্ষে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো। একটি সোফায় দুজন খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে পাশাপাশি বসলো। ইরাবতীর একটি হাত রসুল মালিকের ঘাড়ের ওপর দিয়ে মাথার চুলের ভেতর। চা খেতে খেতে কিছু কথাবার্তা হলো ওদের মধ্যে। রসুল মালিকই শুরু করলো- 

-আজকে কত তারিখ ? আমার ছুটি তো চারদিনের। আমরা ঢাকায় ফিরবো না ? ছুটি শেষ হয়ে গেলে Phone -করে Department কে জানিয়ে দিতে হবে।

-ওসব তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। এমনও হতে পারে কালই আমরা ঢাকায় ফিরে যাবো। -মৃদু হেসে কথাগুলি বললো ইরাবতী। আরও কিছুক্ষণ এলোমেলো কিছু কথা বললো ওরা। এর মধ্যে কলিং বেলটি দুবার বেজে থেমে গেলো। 

ইরাবতী দরোজা খুলে দিলো। কক্ষে প্রবেশ করলেন ড. মেলভিন। ওকে দেখে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো রসুল মালিক। বয়স্ক মানুষ। করমর্দনের জণ্যে হাত বাড়িয়ে দিলো রসুল মালিক। Hallo Youngman` বলে ড. মেলভিন করমর্দন করলেন ওর সাথে। পাশের সোফাটিতে বসলেন ড. মেলভিন। বসে প্রথম ড. মেলভিনই কথা বললেন-  

-তুমি তো Sociologyy তে PhD করেছ। তোমার Thesis টি আমি পড়েছি। ওতে তো তুমি সমাজের অনেক না জানা সুক্ষ্ম সমস্যা উন্মোচিত করেছো, আলোচনা করেছো এমন কি সে সব সমস্যার সমাধান কতভাবে হতে পারে তারও একটি নির্ঘন্ট দেবার চেষ্টা করেছো- যা অত্যন্ত চিন্তাঘন এবং শ্রমসাধ্য। তোমার Thesis-এর একটি বড় অংশ জুড়ে তুমি ধর্মীয় জঙ্গি মৌলবাদ, ধর্মান্ধ উগ্রবাদের সাথে সামাজিক সন্ত্রাসবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদ সম্পর্কে যথেষ্ট Speculative এবং যথার্থ মতামত ব্যক্ত করেছো- যাতে তুমি একটি- ÒAdvanced thoughtful and literate socio-circled’- রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছো এবং যেখানে তুমি ওইসব   ÒবাদÓ-কে একেবারেই সরাসরি বাতিল করে দিয়েছো। কিন্তু এসবকে নির্মুল করবার জন্যে যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক শক্তির Upsurge -এর প্রয়োজন সে শক্তি জাতি অর্জন করবে কিভাবে ? 

‘Social Movement. And this movement must build-up the ‘super-structure’of Great Peoples Revolution some day.. আমি নিশ্চিতভাবেই মনে করি ‘Social Movement. And this movement must build-up the ‘super-structure’of Great Peoples Revolution some day. নির্মান করবার প্রথম শর্তই হলো- Social Advanced Speculation’এর নির্বিঘœ প্রবহমানতা- যেটি অবশ্যই অনিবার্য এবং Ultimate. -এখানে ব্যর্থ হলে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। সমাজ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে, অগ্রগামীতার গতি রুদ্ধ হবে, And our basic existence shall not be sustained. আর এ কারণেই সাধারণ মানুষকে তাদের Common আকাঙ্খার একটি বিন্দুতে একীভূত করে প্রবল ‘Social Movement গড়ে তুলতে হবে। আর তখন রাজনীতিও বাধ্য হবে Social Movement -কে মেনে নিতে। এবং এ ক্ষেত্রে অবশ্যই Karl Marx, Vladimir Illich Lenin-এদের দর্শনকে সামনে রাখতে হবেÓÑরসুল মালিকের মন্তব্য। এখানে স্পষ্ট- রসুল মালিক রাজনীতির বাম ধারায় উদ্বুদ্ধ।                                                                                                             

ওদের কথোপকথনের মধ্যেই টেবিলে খাবার দেয়া হয়ে গেছে। ইরাবতী ওদেরকে আহ্বান জানালো খাবার টেবিলে-

-চলো, টেবিলে খাবার দেয়া হয়ে গেছে। খেতে খেতে অনেক কিছু নিয়েই আলোচনা করা যাবে।

ওরা তিনজনই খাবার টেবিলে গিয়ে বসলো। কিন্তু খাবার টেবিলে যেভাবে কথা হবার কথা ছিলো সেভাবে কোন কথাই হলো না। শুধু ড. মেলভিন একটি প্রশ্ন করলো রসুল মালিককে এবং সেই প্রশ্নের সূত্র ধরে কিছু কথা হলো ওদের দুই  জনের মধ্যে।

-রসুল, তোমাকে আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই। তুমি কি প্রশ্নটির উত্তর দেবে ?

Of course and certainly- কেন দেবো না ?

তোমার Thesis--এ দেখলাম অনেকগুলি মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনের নাম তুমি Refer করেছো, কিন্তু--‘Al-Hikmah’- নামের নির্দ্দিষ্ট একটি চরম মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনকে তুমি Elude করলে কেন ?

What ? Al- Hikmah.’- একটু সময় নিয়ে কি যেন ভেবে উত্তর দিলো রসুল মালিক- 'Please allow me some time to Answer your Question. It will be better and relaxable for me to Answer the question by tomorrow.’                                                                                                                                             

-OK. তোমার সময় মতো তুমি আমাকে বলো।

খাবার শেষে টেবিল থেকে উঠে পড়লো ওরা। যাবার সময় ড. মেলভিন ওদেরকে ধন্যবাদ জানালো- 

-Many Thanks for your warm hospitality.’                                                                         

        ইরাবতী, রসুল মালিক দুজনই ওকে গাড়ী পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে See off  করে নিজেদের কক্ষে ফিরে গেলো। কক্ষে ফিরে এসে আর দেরী করলো না রসুল মালিক। শার্টটা হ্যাঙ্গারে রেখে শুয়ে পড়লো বিছানায়। ইরাবতীকে বলল- আমি শুয়ে পড়লাম, তুমি এসো।

                                                                                                                                            

           ইরাবতীও মুখে w¯œগ্ধ পাউডারের হালকা পাফ্ বুলিয়ে নিয়ে রসুল মালিকের পাশে শুয়ে নীল আলোর Bed Light-- টি জ্বালিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে পুরো কক্ষে একটি স্বপ্নীল আবহের সৃষ্টি হয়ে গেলো। অনেকক্ষণ ধরে কথা বললো ওরা দুজন। ঘুরে ফিরে একই কথা বলতে থাকলো রসুল মালিক-  

-ইরাবতী, ড. মেলভিন আমাকে আল-হিক্মা-সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। আসলে আমি অনেক কিছু  হারিয়ে ফেলেছি; অনেক কিছু ভুলে গেছি- ড. ইব্রাহিম-আল-সালাফি VarsityÕ‡Z Theology পড়াতেন- এই লোকটিকে আমি খুব বেশী বিশ্বাস করতাম। আর আমার এই বিশ্বাসগত দুর্বলতার সুযোগটি গ্রহণ করেই তিনি আমাকে বিভ্রান্ত করেছেন, আমাকে আল-হিক্মাতে Endorsed করেছেন। আমাকে দিয়ে ওদের সাংগঠনিক দর্শনকে আমাদের সামাজিক কাঠামোর ওপর বি¯তৃত করবার চেষ্টা করেছেন। তার দর্শনে তোমাকে প্রভাবিত করবার জন্যে তিনি আমাকে ব্যবহার করেছেন- যে কারণে আমি তোমার সঙ্গেও যথেষ্ট দুর্ব্যাবহার করেছি। এমন কি আমি তোমাকে হত্যা করবার চেষ্টা পর্যন্ত করেছি। এক সময় আমি ওদেরকে পুরোপুরি  অস্বীকার করলে ওরা আমাকে হত্যারও হুমকি দিয়েছে। আমাকে হত্যা করতে না পেরে তোমার বাবাকে হত্যা করেছে এবং আমাকে পাগল করে দিয়েছে। তোমার বাবাকে হত্যা করবার পর আমি সব ভুলে গেছি, কিছুই আমার মনে নেই। কোথাকার কোন এক জঘন্য যাত্রাদলে গিয়ে আমি অবলীলায় যাত্রার সঙ সেজেছি। আমার জীবন থেকে কতটা বছর যে হারিয়ে গিয়েছে- আমি জানি না। আমি শুধু এটুকুই জানি তোমার বাবার মৃত্যুর জন্যে একমাত্র আমিই দায়ী। এ দায় থেকে কোনদিনই আমি আমার নিজেকে মুক্ত করতে পারবো না, নিজেকে ক্ষমাও করতে পারবো না। এতবড় অপরাধ করবার পরেও কি তুমি আমাকে স্বামী  হিসেবে মেনে নিতে পারবে ? আমাকে তোমার ঘৃণা করবে না ?

-মেনে নিয়েছি তো। ঘৃণা করবে কেন ? Beyond your sense You became hypnotized by ‘Al- Hikmah’, So, How the question of hatred can be raised ?  আসলে আমি কি বলবো আমি কুলিয়ে উঠতে পারছি না। আমার কত সময় নষ্ট হয়েছে, আমার চাকুরীটি কি আছে ? বলবে তুমি ?

-আমার বলবার প্রয়োজন নেই । তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। যা করবার আমিই করবো। কালকেই আমরা ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি।

-তাই ?

-অবশ্যই তাই। আচ্ছা রসুল, ভেবে দেখোতো এই মুহুর্তে যে কক্ষটিতে, যে কক্ষের বিছানাটিতে আমরা শুয়ে রয়েছি, কথা বলছি- সেই কক্ষটিকে, সেই বিছানাটিকে তোমার পরিচিত মনে হয় কি না ? কখনও আমরা এখানে এসছিলাম কি না ? যদি এসে থাকি তাহলে এই কক্ষে রাত্রে আমরা  কী করেছিলাম ?

-আমার জীবনের সবচাইতে বড় অর্জন আমি ভূলে যাবো- এত অকৃতজ্ঞ তুমি আমাকে ভাবলে কি করে ? হ্যাঁ আমি ভূলে গিয়েছিলাম, আমাকে ভূলিয়ে দেয়া হয়েছিলো; আমার পুরো স্মৃতিকে কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। আমি তখন অসুস্থ ছিলাম; আমার স্বাভাবিকতাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু এখন আমি পুরোপুরি সুস্থ স্বভাবিক। আমার বিলুপ্ত স্মৃতিকে তুমিই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছো। কয়েক বছর আগের সে দিন ছিলো সতেরো জুলাই- আমাদের বিয়ের পর বাসর রাতটি আমরা এ কক্ষেই উদযাপন করেছি। সে দিন এই Beyond your sense You became hypnotized by ‘Al- Hikmah’, So, How the question of hatred can be raised ?-এর সামনে দাঁড়িয়েই আমরা দুজন Absolute Nude হয়েছিলাম। প্রাণ ভরে দুজন দুজbকে দেখেছি। তোমার Nude সৌন্দর্যের সমুদ্রে আমি অবগাহন করেছিলাম- এ সব কি কখনও ভোলা যায় ? 

-আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম- তুমি কবিতা লেখা শুরু করো। যে কথাগুলি তুমি বললে তার পুরোটাই তো কবিতা। ভেতরে অসাধারণ কবিত্ব না থাকলে এ ধরনের Rhythmic কথা কেউ বলতে পারে? -মিট্ মিট্ করে হেসে কথাগুলি বললো ইরাবতী।

-কেউ পারে কি না আমি জানি না। তবে আমি Rhythmic কিছু বলিনি। তুমি আমাকে খুব নিবিড় করে ভালোবাসো তেv তাই হয়তো তোমার কাছে Rhythmic মনে হয়েছে। আসলে তোমার অজান্তে তুমি নিজেই যে এক অসামান্য  প্রতিভা লালন করছো তেমার ভেতরে- যা তোমার বোধে আসেই নি কখনও। তোমার সব কথাই যে শুধু কাব্যিক কেবল তাই-ই নয়, তোমার প্রতিটি কাজই তো Rhythmic. রসুল মালিক দৃষ্টি স্থির করলো ইরাবতীর দুচোখের ওপর।

রসুল মালিকের কানের কাছে ঠোঁট দুটি নিয়ে ফিস্ ফিস্ করে বললো ইরাবতী-

-আজকে আমাকে Nude দেখতে ইচ্ছে করছে না ?

-না। তাহলে আমাদের বাসর রাতের ওই অপরূপ মধুরিমার স্মৃতিটুকু আর থাকবে না, ম্রিয়মান হয়ে যাবে- যা আমার শ্রেষ্ঠতম সম্পদ এবং সম্বল। অন্ততঃ ওই টুকু সম্পদকে কোনোকিছু দিয়েই আমি ঢেকে দিতে চাই না এবং চাইলেও পারবো না।

-প্রগাঢ় মমতায় আলিঙ্গনবদ্ধ হলো দুজন। তারপর প্রশান্ত নীলিমার মতো অফুরন্ত নীল আলোর গাঢ় থেকে গাঢ়তর গভীরতায় ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকলো ওরা।                                                                                                  

০৬.

           কেমন করে ইতোমধ্যে দুবছর পেরিয়ে এসেছে ওরা ভাবতেই আশ্চর্য মনে হয় ওদের। রসুল মালিক ওর চাকুরী ফিরে পেয়েছে। নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছে এখন। আগের মতোই লেখালিখি করছে। সেগুলি প্রকাশিতও হচ্ছে বিভিন্ন জাতিয় দৈনিকে। বিভিন্ন Magazine-এ। প্রথম দিকে ইরাবতী নিষেধ করেছিলো। কিন্তু ও শোনেনি। ইরাবতী জানে ওর ভেতরে আগুন জ্বলছে। কিন্তু সে আগুনে ওরা সবই যদি পুড়ে যায়- এই একটি আতঙ্কেই আতঙ্কিত ইরাবতী। তারপরেও, পরে আর বারন করে নি ওকে। এক বছরের মাথায় একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে ইরাবতী। দুজন মিলে ওদের নামের উপাধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে নাম রেখেছে দিক্ষিত মালিক। আজকে ১০ জুলাই। সামনের ১৪ জুলাই দুবছরে পা দেবে 

                                                                                                                                 

ওদের একমাত্র সন্তান। দুজনের খুশি যেন উপচে পড়া। ভাষার গাঁথুনী  দিয়ে যে খুশির প্রকাশ ঘটানো মোটেই সম্ভব নয়। ওদের গোটা জীবনের গতিটাকেই যেন পাল্টে দিয়েছে ওদের ওই এক বছরের পুত্র সন্তানটি। সন্তানটিকে নিয়ে স্বপ্ন আর পরিকল্পনার কোনো শেষ নেই ওদের। পিওন এসে একটি লম্বা খামে একটি চিঠি দিয়ে গেলো ইরাবতীকে। চিঠিটিতে Acknowledgement Letter -যুক্ত করা। স্বাক্ষর করে নিতে হলো ওকে। 

                                                                                                                                

             চিঠিটি International University of Dhaka’ থেকে প্রেরিত। চিঠিটি তখুনি খুললো না ইরাবতী। কত চিঠি তো প্রায়ই Law Department থেকে আসে। কখনও English Literature Department আজকেও English Literature Department থেকে এসেছে। গুরুত্ব দিলো না ইরাবতী। বাবুকে নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। বাবুকে দুধ খাওয়াতে হবে, জামা কাপড় পরাতে হবে, ঘুমিয়ে দিতে হবে। রসুল মালিকও ‘Varsity” তে। ও ফিরে আসুক। ইরাবতীর ব্যাস্ততা বেড়ে গেলো বাবুকে নিয়ে। চিঠিটি লেখার টেবিলে রাখলো। সন্তানটি জন্মাবার পর থেকে ইরাবতীর ব্যাস্ততার যেন একদমই শেষ নেই।  

Varsity থেকে ফিরে এলো রসুল মালিক। এসে দেখলো ইরাবতী সোফায় বসে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত। মৃদু হাসলো রসুল মালিক। দেখলো সামান্য সময়। তারপর বললো- অপূর্ব ! এইতো মাতৃত্ব। একেই বলে মাতৃ‡¯œহ। এ ছবি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই                                                                                                

           ঘরে গিয়ে Dress Change করে লেখার টেবিলের সামনে গিয়ে দেখলো সাদা খামে একটি চিঠি- university’ থেকে এসেছে। ইরাবতীকে Address করা। চিঠিটি নিয়ে সন্তানকে দুগ্ধদানরত ইরাবতীর কাছে গেলো রসুল মালিক-

-চিঠিটি খোলো নি যে?

-অত সময় কোথায় ? বাবুকে খাওয়াতে হবে না ? ঘুমিয়ে দিতে হবে না ? তুমি খোলো।

           

              খামটি খুলে চিঠিটি দুবার পড়লো রসুল মালিক। তারপর চিঠিটি আবার খামে পুরে ইরাবতীর সামনে বসে খুবই শান্ত এবং স্বাভাবিকভাবে বললো-

`Hallo Dr. Mrs Irabati Diksit.’-রসুল মালিক ইরাবতীকে ডাকলো।

-কি বলছো ? -ইরাবতী ঠিক বুঝতে পারলো না।

-আজকে আমার জীবনের একটি অপূর্ণ সাধ পূর্ণ হলো-এই একটি চিঠি আমার সে লালিত সাধকে পূর্ণ করে দিয়েছে।

-কি ভাবে ? একটি চিঠিতেই তোমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়ে গেলো ? আশ্চর্য তো? -ইরাবতীর প্রশ্ন।

-প্রথম সম্বোধনটি আমিই করলাম। তোমার Thesis-wU‡K Department Accept করেছে। আসছে ১৪ জুলাই তোমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে PhD দেয়া হবে।  -চিঠিটি পাবার পরেও ইরাবতী বিষয়টি নিয়ে ওভাবে চিন্তাই করে নি। আসলে মনেই ছিলো না ওর যে, ওর GKwU Thesis’ Department -এ Submit করা আছে।

-কিন্তু সেদিন যে বাবুর জন্মদিন। ও দ্বিতীয় বর্ষে পা দেবে। -ইরাবতীর প্রতিক্রিয়া।

-তোমার সন্তান ভাগ্যবান। সেই সাথে তুমিও। ওর জন্মদিনে তোমারও একটি নতুন জন্মদিনের সৃষ্টি হলো। একই সঙ্গে দুটি জন্মদিনকেই Celebrate করবো আমরা।

           তিনটি দিন ওদের ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কেটে গেলো। বাবুর জন্যে অনেক জামা কাপড়, খেলনা কিনলো ওরা। ইরাবতী Department এ গেলো পর পর দুদিন। কিছু কাগজপত্রে স্বাক্ষর করবার ছিলো সেগুলি করলো।                                                                                                                                                    Department -এর সবাই  আগাম অভিনন্দন জানালো ওকে। অত্যন্ত তৃপ্ত ইরাবতী। কি ভাবে যে সময় কেটে যায় বুঝতেই পারে না। কখনও কখনও অকারণেই জড়িয়ে ধরে রসুল মালিককে। পাগলের মতো চুমু দিতে থাকে ওর দুঠোঁটে। চুমুতে চুমুতে অস্থির করে তোলে ওকে। কখনও বা বলে-     

-তুমি যাত্রাদলে গিয়েছিলে বলেই হয়তো আজকে আমার এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। নইলে হয়তো কোনদিনই হতো না। তোমার দেয়া সব তথ্যই আমি আমার Thesis -এ Include Thesis -টি পড়লেই তুমি বুঝতে পারবে।                           

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                

          যেহেতু বিকেল পাঁচটায় University’তে অনুষ্ঠান সেই হেতু দুপুরের খাবারের আগেই বাবুর জন্মদিন পালন করলো ওরা। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে ঘরভর্তি অতিথি। বাবুকে কোলে নিয়ে কেক কাটলো ইরাবতী। করতালিতে মুখর হলো গোটা বাড়ীর পরিবেশ। কেকের প্রথম টুকরোটি ইরাবতী তুলে দিলো রসুল মালিকের মুখে। তারপর সবাই খেলো। এক সময় অনুষ্ঠান শেষ হয়ে এলো। অতিথিরা সবাই চলে গেলো। এবার Varsity’তে যাবার পালা। 


           বাবুকে বিন্নির মায়ের দায়িত্বে দিয়ে পাঁচটার কিছু আগে ওরা Varsity’তে পৌঁছে গেলো। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো না। শুরু হতে হতে সন্ধ্যে অতিক্রান্ত হলো। ইরাবতী রসুল মালিককে বাসায় পাঠিয়ে দিলো বাবুকে দেখবার জন্যে। শুধু বললো- 

-তুমি বাসায় গিয়ে বাবুকে দেখো, অনুষ্ঠান শেষ হলেই আমি চলে আসবো। 


             রসুল মালিক বাসায় ফিরে এলো। যদিও অনুষ্ঠানটি উপভোগ করবার খুবই ইচ্ছে ছিলো ওর, কিন্তু হলো না। উপায় নেই। অনুষ্ঠানের সামগ্রিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অনুষ্ঠানটি শেষ করতে প্রায় মধ্য রাত্রি হয়ে এলো। Varsity’i VC নিজেই PhD Certificate ইরাবতীর হাতে তুলে দিলেন সেই সাথে ওর Thesis -টির দুটি কপি- একটি বাংলা,একটি ইংরেজী ভার্সনের। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়লো সারা হলরুম জুড়ে। করতালির শব্দ যেন শেষ হতেই চায় না। এর পর অতিথিদের সম্মানে ছোট্ট একটি চায়ের অনুষ্ঠান। সব শেষে অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষনা। 

                                                                                                                                 

          বাড়ীতে ফিরে এলো ইরাবতী। কিন্তু এ কি ? বাইরের প্রবেশ পথে রক্ষী নেই কেন ? বাড়ীতে আলো জ্বলছে না কেন ? সবকিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন কেন? আতঙ্কিত হয়ে পড়লো ইরাবতী। গাড়ীটি গ্যারেজ না করেই গাড়ী থেকে নেমে সোজা ওপরে উঠে গেলো ইরাবতী। বিন্নির মাকে ডাকলো। কোন সাড়া নেই। বিন্নিকে ডাকলো- ওরও কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না। বাবুরও কোনো শব্দ নেই। উদভ্রান্তের মতো শোবার ঘরে প্রবেশ করলো। প্রবেশ করেই চিৎকার করে উঠলো- 

-এ কি ?


           মেঝেতে বাবু শুয়ে আছে রক্তের ওপর। সারা মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পিতার উষ্ণ রক্তস্রোতের ওপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তারই শিশুপুত্র। কি বিচিত্র চরাচর ! কি অবোধ্য নিয়তির বিধান ! বিছানায় রসুল মালিক চিৎ হয়ে শুয়ে। তখনও ওর বুক থেকে রক্তের ধারা বইছে। বাবুকে কোলে তুলে নিলো, বুকে কান পাতলো, নিশ্চিত হতে চাইলো- বাবু বেঁচে আছে কি না ? বেঁচে আছে। নিঃশ্বাস বইছে। Heart bit স্বাভাবিক। বাবুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বিছানার কাছে গেলো । রসুল মালিককে স্পর্শ করলো। না নেই। চলে গেছে চিরদিনের জন্যে। শরীরটি তখনও উষ্ণ- কিছুক্ষণ আগেই ধারালো ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে- ঠিক যেভাবে ওর পিতাকে হত্যা করা হয়েছিলো। তবে রসুল মালিককে দ্বিখন্ডিত করে নি ওরা ইরাবতীর পিতার মতো। চোখ দুটি খোলা- বিস্ফারিত। ডান হাত দিয়ে চোখ দুটি বুজিয়ে দিলো ইরাবতী। রসুল মালিকের ডান হাতের মুঠোয় একটি সাদা কাগজের চিরকুট। বোঝা যায় হত্যার পর ওর হাতের মুঠোয় ওটি পুরে দেয়া হয়েছে। চিরকুটটি নিয়ে পড়লো ইরাবতী। ইংরেজীতে লেখা-


We Assasinated one of the members of -’AL-HIKMAH’-who betrayed with our organization. It’s simply a poor Revenge against his betrayal. Wait for the NEXT.’ 


         Sd/-

                                                                                                                                                                                                                                     


       Illigible                                                                                                                                                                                   

AL- HIKMAH

                                                                                                                                

০৭.

           স্তম্ভিত, রুদ্ধবাক ইরাবতী। চোখ দুটি মুদ্রিত। অশ্রƒধারার কোনো রেখাও কপোলে নেই। হৃৎপিন্ডের রক্তে তোলপাড়। মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা উপশিরার ভেতর দিয়ে শত শত Head Light-বিহীন কয়েক হাজার অশ্ব-শক্তি সম্পন্ন যান্ত্রিক ইঞ্জিন চালিত সুদীর্ঘ বি¯তৃত দুরন্ত গতির ট্রেন ধাবিত হচ্ছে। প্রগতিশীলতার যা কিছু চিহ্ন সম্মুখে- সব কিছুকে দুম্রে মুচ্রে ধ্বংশ করে দিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। কোন কিছুই রোধ করতে পারছে না ওই অন্ধ ট্রেনের অনিরুদ্ধ গতিকে। ট্রেনের Compartment গুলির দুপাশের খোলা জানালা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে অজস্র কালো কঙ্কালের কালো নগ্ন বাহু- দুপাশে যা কিছু পাচ্ছে তাই-ই ধ্বংশ করে চলেছে নির্মমভাবে। প্রাণের পর প্রাণ সংহার করে চলেছে ওই বিভৎস, কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর বাহুগুলি। একটু পরেই হয়তো ইরাবতীর জীবনকেও সংহার করবে। ওদের চিরকুটে তো সে কথারই ইঙ্গিত। প্রলয়কান্ড ঘটে যাচ্ছে চরাচরে। কিন্তু এ কি চরাচর ? তাহলে রসুল মালিক, ইরাবতী, অধিকারী, প্রিয়বালা, ঝুমনি, কঞ্চা- এরা ছাড়াও বিভিন্ন  শ্রেণী পেশার নির্দোষ, নিরপরাধ, অসহায় কোটি কোটি সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকবার  জন্যে আবার নতুন করে কোন্ চরাচরে জন্ম নিতে হবে ? অতি ন্যূনতমভাবে জীবন যাপনের জন্যে, সারাদিনের ক্লান্তির শেষে রাত্রিতে সামান্য এতটুকু প্রশান্তিতে ঘুমোবার জন্যে আসলেই এ কি মোটেও নির্ভরযোগ্য-বিশ্বস্ত চরাচর ? নাকি ওদের জন্যে এ প্রকৃতই-নিষিদ্ধ চরাচর ??

                                                                                              

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. লেখাটি কিছুদূর পড়েই বিবমিষা জেগেছে৷ একারণে লেখককে বিরক্তিকর, আত্মহংকারতাড়িত, কূপমণ্ডুক, উদ্ধত লেখক বলে মনে করার জন্য সবিনয়ে দুঃখ প্রকাশ করছি৷

    উত্তরমুছুন

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।