....

তবু বিহঙ্গ মোর | জিললুর রহমান



প্রিয় কবি ফাউজুল কবির ভাই, 

আপনার পত্রনিবন্ধে আমার “মেলে না উত্তর” কবিতার উপর কিঞ্চিত আলোকপাত করে আপনার কাব্যবোধ এবং কবিতাবিষয়ক ভাবনার যে অসামান্য বিস্তার ঘটিয়েছেন তা আমাকে যার-পর-নাই আনন্দিত এবং আলোড়িত করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি আপনার অসামান্য অগাধ জ্ঞানভাণ্ডারের সামান্য ছোঁয়া পেয়ে ঋদ্ধ হয়েছি। 


“মেলে না উত্তর” কবিতাটি লেখার পেছনে রয়েছে যেমন আমাদের সমকাল তেমনি মহাকালের চেতনা। এই যে, করোনা আক্রান্ত জনপদে যখন চোখের সামনে একের পর এক ইলশেগুড়ি বৃষ্টির মতন মানুষেরা ঝরে পড়ছে, মরে পড়ে থাকছে রাস্তায় কিংবা ঘরের ভেতরে একা, অসহায় — এমনকি চিরকাল সামাজিক জীব বলে দাবী করে আসা এই মনুষ্য প্রজাতির খুব কম লোকই এগিয়ে আসছে স্বজনের সাহায্যে। 


হয়তো বাংলাতেই এমনটি ঘটছে। কারণ বাংলায় ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে এক অসামান্য প্রবাদ রয়েছে যার অজুহাত দেখিয়ে সকলেই কেটে পড়ছে নিজের বাপ-মা-ভাই-বোনকে নিথর শরীরে নীরবে ফেলে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে কোথায় কে জানে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেই মৃত লাশটির মুখে লেগে থাকা মুচকি হাসি আমাদের উদ্দেশ্যে বলছে, কতদূর পালিয়ে বাঁচবে, তোমরাও কদিন পরেই আমাদের মিছিলে সামিল হবে। তখন ভাবনা জাগে, কোথা থেকে আসি, আর কোথা যাই চলে — সেই পুরনো প্রশ্ন। 

রবি ঠাকুর বলেছিলেন, 

প্রথম দিনের সূর্য

প্রশ্ন করেছিল

সত্তার নূতন আবির্ভাবে--

কে তুমি,

মেলে নি উত্তর।

বৎসর বৎসর চলে গেল,

দিবসের শেষ সূর্য

শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিম-সাগরতীরে,

নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়--

কে তুমি,

পেল না উত্তর। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এই যে সত্তার নতুন আবির্ভাবে প্রথম দিনের সূর্য প্রশ্ন করেছিলো, বৎসর বৎসর পরেও দিবসের শেষ সূর্য এই একই প্রশ্নের কোনও উত্তর পায়নি। সেই একই প্রশ্ন যুগে যুগে মানব প্রবাহের স্রোতধারায় অনেকেই করেছেন, কিন্তু উত্তর মেলে না। রবিঠাকুরের শতবর্ষ পরে আমার অবস্থানেও কোন পরিবর্তন আসেনি, এখনো মেলে না উত্তর। শুধু জানি, “and miles to go before I sleep, and miles to go before I sleep” (Robert Frost)। কিন্তু কী আমি নিয়ে যাই, আর কীইবা রেখে চলে যাবো। সারাজীবন ভর পরিশ্রম করে কেউ হয়তো অর্থ বিত্ত, আবার কেউ অর্জন করছেন সুর বা সঙ্গীতে ব্যুৎপত্তি; কেউ কেউ অর্জন করছেন অগাধ জ্ঞান ভাণ্ডার। কিন্তু মৃত্যু এমন এক যতি চিহ্নের নাম, যার পরপ্রান্তে এইসকল সমস্ত অর্জন কোথায় কোন্ কাজে লাগবে? আবারও রবিঠাকুরের আশ্রয় নিয়ে বলি “যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী”। আমাদের যে কর্মফল রেখে যাই তা-ই তো জগৎসভা গ্রহণ করবে, কিন্তু সত্যিই কি তেমন তেমন কিছু রেখে যেতে পারছি? আর সেই যে “এখন আমাকে লহো করুণা করি” (রবীন্দ্রনাথ ছাকুর / সোনারতরী), কিন্তু কে আমাকে গ্রহণ করবে? পরপ্রান্তে কি সত্যিই কেউ আমাদের গ্রহণ করার প্রতীক্ষায় আছে? শুধু মনে মনে বলি “এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা”

(রবীন্দ্রনাথ / দু:সময়)। 


প্রিয় কবির ভাই, আজ আমরা শেষ করলাম নির্মমতার এপ্রিল। যেমন পোড়োজমিতে টি এস এলিয়ট বলেছিলেন “April is the cruelest month”, তারচেয়েও নির্মম একটি মাস এপ্রিল ২০২০, করোনাক্রান্ত এপ্রিল। দুইলক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন, আর সংক্রমনে ধুকছেন কতো লক্ষ লক্ষ লোক সারা বিশ্বময়। এই মারী বা মড়ক যেন নজরুলের ভাষায় বলে উঠছে

“আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর” কিংবা 

“আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরীত্রির; 

আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর।” 

এই মহামারী কি প্রকৃতির খেয়াল? হয়তো, হয়তো না। কিন্তু আপনি তো ভালোই জানেন, করোনা ভাইরাসের এই মড়ক একদিন শেষ হয়ে যাবে। একদিন মানুষ তার অদম্য উদ্ভাবনায় করোনা থেকে মুক্তির পথ পেয়ে যাবে। তারপর একদিন আবার মানুষ মানুষকে মারার পাঁয়তারা শুরু করে দেবে, যেমন করে এসেছে আবহমান কাল থেকে। মহাকাব্য কিংবা শ্লোককাব্যের শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করে একদল আরেক দলের ওপর আবার হুমড়ি খেয়ে পড়বে। বিনা প্রয়োজনে আবার ধ্বংস করা হবে বন ও পাহাড়। সমুদ্রের জলকে দূষিত করে বিপন্ন করে তুলবে জলজ প্রাণীদের নিবাস। কে এই মানুষ? কোথা থেকে আসে? কোথা যায় চলে? মানুষ নামের এই প্রজাতি কি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী নয়? 


অথচ মানুষ সবসময় মনে করে, মানুষকে কেন্দ্র করেই এই মহাবিশ্ব এই পৃথিবী। ধর্মগ্রন্থ বা মহাকাব্য তো বটেই, আধুনিক যুগের কবিও মনে করেন “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্‌” (নজরুল)। এমন ধারণা কেবল যে বাংলার কবিদের তা’ কিন্তু নয়। জর্জ হারবার্ট তার ‘মানুষ’ বা Man কবিতায় বলেছেন —

My God, I heard this day 

That none doth build a stately habitation 

But he that means to dwell therein. 

.... .... .... .....

For man is ev'ry thing, 

.... ..... .... ..... 

For us the winds do blow, 

The earth doth rest, heav'n move, and fountains flow. 

Nothing we see but means our good, 

As our delight, or as our treasure; 

The whole is either our cupboard of food, 

Or cabinet of pleasure. 


এই মনুষ্য প্রজাতি গর্বের সাথে দাবী করে কিংবা ভেবে থাকে যে, পৃথিবীর যাবতীয় ভাল মন্দ মানুষের সুখ দু:খের সাথে জড়িত। সকল জড় ও জীবজগৎ মানুষের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যেই তৈরি বা সৃষ্ট হয়েছে। এই ধারণাটাই মানুষের সবচেয় বড় ভুল। ৬০০ কোটি বছর বয়সী এই পৃথিবীতে মানুষের অবস্থান তো খুব বেশি হলে ১ লক্ষ বছর। পৃথিবী তার আগেও সুন্দর ছিল। মানুষের পর্ব সমাপ্ত হয়ে গেলেও পৃথিবী থাকবে সুন্দর। বরং বলা চলে, পৃথিবীতে মানুষই তার দু:খ-যন্ত্রণা-যুদ্ধ-ধ্বংস আর কলকারখানার বর্জ্য ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে গ্রহটিকে নানাভাব জর্জরিত করে তুলেছে ক্রমাগত।


প্রিয় কবি, আপনার নিশ্চয় মনে আছে আমার সেই সিরিজ কবিতাগুলোর কথা। যেখানে আমি নিজেকে কল্পনার পাখায় চড়ে উপস্থিত করেছিলাম কোটি কোটি বছর পূর্বের কোনো এক পৃথিবীতে। যে পৃথিবীর জীবন সূচনাকালে কেবল ব্যাকটেরিয়ায় আচ্ছাদিত এক পৃথিবীমাত্র ছিল। তখনো জন্মেনি আর কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণী। কোনো এক বরফ যুগে সমস্ত পৃথিবী ঢেকে ছিল বরফে। তখন কোথায় ছিল মানুষ? 

“একদিন সমস্ত জগত ঢেকে গেল বরফের স্তুপে। প্যালিয়াজোয়িক যুগে সেই যে সায়ানো-ব্যাকটেরিয়া আচ্ছাদিত করে সমগ্র লরাশিয়া — আমি তার ফাঁকে ফাঁকে হাঁটতে চেয়েছি কতোকাল। 

একদিন অগ্ন্যুৎপাতে লাভা ঝরতে ঝরতে ঢেকে দিয়ে গেল সমস্ত উত্তর গোলার্ধ জুড়ে। তারপর লক্ষ কোটি বছরের হাঁড় কাঁপানো শীতের সকাল মহাশীতকাল — রোদ্দুর পিছলে যায় বরফের সুমসৃণ শাদা পৃষ্ঠদেশে। বিপন্ন অস্তিত্ব নিয়ে হেঁটে চলি গন্ডোয়ানাল্যান্ডের দিকে — আরও আরও দক্ষিণের পথে।

..... ..... ..... 

কোথাও প্রাণের চিহ্ন লেশমাত্র নেই, ব্যাকটেকিয়া বরফাচ্ছাদিত। আসেনি ম্যামথ কিংবা ডায়নোসরাস।  এমনকি সাগরের পাড়ে দু’একটা তারামাছ যদি থাকতো কিংবা জেলিমাছ। 

রোদ গিলে গিলে হেঁটে চলি বরফ উপত্যকায় — কখনো লরাশিয়ায় কখনো গন্ডোয়ানাল্যন্ডের টেথিস উপকূলে।“ (একদিন বরফ যুগে)


তারও অনেক অনেক পরে কোনো এক বরফ যুগের শেষে যখন দিব্যজ্ঞানে আমার পরিভ্রমণ কোনো সাগর তটভূমিতে, তখন সেই ভূমি বা জলাশয়ের মানচিত্র কিন্তু আজকের মতো ছিল না। টেথিস সাগরের ভূতুরে সন্ধ্যায় কেউ কাউকে অযথা সন্দেহ যেমন করে না, অহেতুক কোনো  আচার-শিষ্টাচার-রিচুয়ালেও কেউ কাউকে বাধ্য করে না। সে এক অদ্ভুত জগৎ, যেখানে বিচিত্র জীবজগৎ তার অপার সৌন্দর্যে পৃথিবীপৃষ্ঠকে নানা রঙে ভরিয়ে তুলেছে। 


“টেথিস সাগরের টেরোডেকটাইল

প্যানজিয়া নামের সে মহাদেশটায় 

বুঝিবা বিচরণ করেছে একদিন

জুরাসিক যুগের ভুতুরে সন্ধ্যায় 


তেমনি ভয়াবহ আগুনে হলকায়

আরো না কতো জীব চড়েছে মহাদেশে

কেউবা ভেসে ছিল টেথিস জলভাগে

কেউবা উড়েছিল পাখনা ভর করে


সে কোন্ দৈবের দীপ্ত অভিশাপে 

আমিও সাঁৎরাই টেথিস উপকূলে 

এখানে একা আমি শঙ্কা নিয়ে বুকে

ভয়াল সাইজের প্রাণীরা হেলেদুলে


কখনো হুঙ্কারে কখনো ঝগড়ায়

আগুনে হলকায় সে কোন্ আক্রোশে

মত্ত হল্লাতে কিংবা আহারের

ব্যস্ত আয়োজনে তপ্ত দিন শেষে 


কোথাও সরীসৃপ কোথাও ডালপালা

ছড়ানো বৃক্ষের হা করা মুখ যতো

আমাকে গিলে খাবে সতত উদ্যত

মানুষ শুধু আমি একাকী বিব্রত 

...... ...   ......  

এদের কারও নেই নামাজ রোজা দেখ 

এদের কারও নেই অযথা সন্দেহ

যখন খিদে জাগে সামনে যাকে পাবে

তাকেই সাথে সাথে করবে বুঝি দাহ” 

(টেথিস সাগরের ভুতুরে সন্ধ্যায়)


এমন কতো বরফ যুগ পেরিয়ে কতো বিচিত্র জীবজগতের সৃষ্টি ও বিনাশের পরে একদিন এই ধরাপৃষ্ঠে মানুষ নামের প্রজাতির বিকাশ ঘটেছে কোনো এক ধরনের এপ (Ape) থেকে। তারপর তো সেই নগ্ন মানুষ, একাকী-অসহায়- শক্তিমত্তাহীন অবস্থা থেকে দলবদ্ধ হয়ে শুরু করে জীবনের কঠিন সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বদলাতে থাকে সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের সমাজ ব্যবস্থা। আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থা থেকে সামন্ত প্রভুর পর্ব শেষ করে নিয়ে অগ্রযাত্রার ফসল আজকের পূঁজিবাদী সভ্যতা। যে সভ্যতায় মানুষও পূঁজিতে পরিণত, মানুষও মেশিন— এবং যথারীতি পুনরায় সেই মানুষ এখন একা, অনেকের মধ্যে একা হয়ে নিজেকেই শুধু বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামেই লিপ্ত। 

“সকল লোকের মাঝে ব’সে

আমার নিজের মুদ্রাদোষে

আমি একা হতেছি আলাদা?

আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আমার পথেই শুধু বাধা?” (জীবনানন্দ দাশ / বোধ)


সভ্যতা যতোই এগিয়ে যাক, একাকী একক জীবন কতোটুকু এগুতে পারে? বড় জোর মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্তই। এই জীবনের কী অর্থ কী সংবেদন? এই জীবন তো এমনি এমনি হাওয়ায় ভেসে আসে না। এ জীবন আরও কতো জীবনকে জড়িয়ে পৃথিবীতে আসে, আরো কতো কতো জীবনের সাথে জড়িয়ে পড়বে বলে। জীবনে জীবন জড়িয়ে গড়ে ওঠে সংসার পরিবার বংশ রাজ্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন জন্ম জন্মান্তরের দড়ি নিয়ে কোনো এক মহাকর্তব্যের কাজে ধেয়ে চলে। তারপর এই জীবনের জড়াজড়ি নিয়ে কতো গল্প তৈরি হয়, কতো উপাখ্যান। এর সবই আপনার অনন্তর জানার ভেতরে টঙ্কার তুলে চলে—

“স্বপ্নের চেয়েও গল্প যে অনেক মাতাল মধুর বুঝেছিলো একটি প্রাণ

জীবনের পাতা লতারজীবন স্বর্ণলতা দেসদিমোনা

ভালোবেসেছিলো শুধু গল্পকেই-- এবং গল্পের জীবন্ত কথাকে

তারপর একদিন নিজে হবে গল্প - গল্প হবে বৃক্ষ কথামালা ছায়াহীন

সময় অদৃশ্য কুঠারের প্রেম হয়ে রূপ নেবে ওথেলোর দুটি হাত

এ কথা নক্ষত্র জানতো সকলের আগে

তাহার অনেক পূর্বে জেনেছিলো মানুষ ইয়াগো -- ইয়াগো মানুষ”

(দেসদিমোনা --ওথেলোর দুটি হাত।। ফাউজুল কবির)


এই যে স্বপ্নের চেয়েও অধিক গল্পের সুরাহা হতে হতে মৃত্যুমুখে পতিত হয় দেসদোমোনা ও এমিলিয়া, এবং আত্মহত্যা করে ওথেলো। অথচ ইয়াগো সফল হয়, তার চক্রান্তও সাফল্য লাভ করে। মেনে নিচ্ছি, চক্রান্ত জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। কিন্তু সেখবর নক্ষত্র জানতো কী করে! আর সবসময় কি এই কনসপিরেসি থিয়োরি খাটে? আমরা যদি ইডিপাসের দিকে তাকাই, যখন পরাজিত রাজ্যের রাণীকে নিজ স্ত্রীতে বরণ করার পরে আবিষ্কৃত হলো তিনি ইডিপাসেরই গর্ভধারিনী। কী জবাব থাকে এমন নিয়তির? অথচ নক্ষত্ররা জানতো। গনক ঠাকুর গুনে গুনে যথার্থই বলেছিল, একদিন এই শিশু মাতৃসম্ভোগকারী হবে। হায় নিয়তি! তাকে কিনা তার পিতা হত্যা করতেও পাঠিয়েছিলো। 

“তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;

আমি তার উপেক্ষার ভাষা

আমি তার ঘৃণার আক্রোশ

অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্ৰ—নক্ষত্রের দোষ

আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা”

(জীবনানন্দ দাশ / বোধ)


আজ সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়েই ধর্মোন্মাদদের যে উড্ডীন পতাকা এবং নিয়ত গর্জমান দামামা, বাংলাদেশ তো সেই যন্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে স্বাধীনতাও অর্জন করেছিল, কিন্তু গিয়েছে কি এসব ধর্মোন্মাদের পৈশাচিকতা। অথচ ৪৭-এর মাউন্টব্যাটেন নামের সেই মহান নক্ষত্রটা জানতো, অনন্তকালের জন্যে পুঁতে দেওয়া এই ভাইরাস, যার নাম সাম্প্রদায়িকতা, ভারত ও বাংলাকে কুঁরে কুঁরে খাবে। করোনা তো সামান্য নশ্বর ভাইরাস। ক’দিন পরেই মানুষ তার মূলোৎপাটন করে ফেলবে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা নামের এই ভাইরাস তো মরবে না! যেমন অমর সব কিতাবসমূহ! এই-ই তো আমাদের মহত্তম সভ্যতা। সভ্যতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখতে রাখতে মানুষ পিরামিড থেকে টুইন টাওয়ার, সামান্য ঘুড়ি থেকে রকেট, গুলতি থেকে মিসাইল পর্যন্ত অর্জন করে ফেলেছে। অথচ হৃদয়ের গভীরে গাঢ় হয়ে কী ভয়ঙ্কর বিশাল অন্ধকার। 


এমনটা অনেকেই মনে করেন, করতেই পারেন, মানুষই পৃথিবীতে সভ্যতার সৃষ্টি করেছে। একথা অস্বীকারের কোনো যো নেই। মানুষই সভ্যতার সূচনা করেছে, পরিচর্যা করেছে, পূর্ণতাও দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, সভ্যতাটি কি পৃথিবীর? না কি মানুষের? সুরম্য প্রাসাদ কিংবা বিশাল স্কাইস্ক্র্যাপার বানিয়ে মানুষ যে তেলেসমাতি নাকি দেখিয়েছে তাতেইবা পৃথিবী নামক বৃহৎ জলাশয়সমৃদ্ধ মাটির ঢেলাটির কী এমন ঘটে গেল? ক’জন মানুষেরইবা এতে উপকার হয়েছে? মানুষের চন্দ্রাভিযান বা মঙ্গলাভিযানেও এই গ্রহের কীইবা আসে যায়? মারণাস্ত্র তৈরি কিংবা রকেট ক্ষেপনে ক’জন মানুষের খুব আয়েশ হয়েছে? আর পৃথিবীর? কতো প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস হয়েছে মহাযুদ্ধের তাণ্ডবে?  

“হেমন্ত কী? বসন্ত কাকে বলে?

যেকোনো মৌসুমেই

সেই আমি, সেই খাঁচা আর ডানা

পালক হারাবার মাতম

আমার বিরান দুঃখঘরের দেয়াল-দরজায়

জন্মেছে সবুজ ঘাস

যার বসন্ত এমন, তার পাতাঝরা

হেমন্তের গল্প কী বলব!

আমার দেয়াল-দরজা ভেদ করে

সবুজ জন্মায় গালিব

আমি বিরাণ মরুতে 

আর ঘরে বসন্ত এসেছে” 

(মির্জা গালিব)


যে সকল নিরন্ন মানুষ নিয়ত ফুটপাতের নিদ্রাযাপন করেন, তাদের জন্যে এপ্রিলই কী আর হেমন্তইবা কী এমন গুরুত্ব বহন করে! তবু আমি দেখি গভীর আস্থার কন্ঠে আপনার কবিতায় উচ্চারিত হয় বিশ্বাসের শব্দাবলী। 


“আমি জানি--জেনেছি এবং জানিয়াছি সময়ের দৃশ্যাবলি

ছেঁড়াখোঁড়া প্রাচীন পুথির পাতা চেয়ে আছে করুণ এলাচ

..... ...... ......

আমি জানি মানুষ হারে না কখনো কোথাও কোনোকালে

যদি না সে নিজেকে হারায় একান্ত স্বেচ্ছায়

আমি জানি জীবনের চেয়ে আনন্দের মহার্ঘ সম্পদ নাই

আমি জানি মৃত্যু তখনই অপরূপ লাবণ্যের রূপ ধরে একা

যখন জীবন এসে বলে -- দিলাম বিদায় নাও শেষের চুম্বন

মৃত্যু হাত পেতে বসে আছে ভিক্ষুকের হাত জীবনের কাছে--“ (সময়ের দৃশ্যাবলি ।। ফাউজুল কবির)


প্রিয় কবি, আপনার পক্ষেই বলা সম্ভব, মৃত্যু ভিক্ষুকের মতো হাত পেতে বসে আছে, জীবনের কাছে মৃত্যুর এই হাত পাতা— কী অবলীলায় আপনি বলে গেলেন। ঠিক এমন করেই বলেছিলেন এই চট্টগ্রামের আরেক নক্ষত্র সিদ্দিক আহমেদ। আপনি এখনও আস্থাবান মানুষের প্রতি, জীবনের প্রতি। একথা তো সত্যিই অনস্বীকার্য যে, জীবনের চেয়ে মহার্ঘ সম্পদ এবং আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু জীবনানন্দের ভাষায় যে জীবন ‘দেয়োলের ফড়িঙের’, সেই বিড়ম্বনার জীবন নিয়ে কতো মানুষ প্রতিদিন মৃত্যু কামনা করছেন, তার খবর নিশ্চয় আপনি আমার চেয়ে আরও বেশিই রাখেন। 


মানুষের সভ্যতায় যেখানে বৃহৎ জনগোষ্ঠীই নিষ্পেষিত, মনুষ্য মর্যাদাহীন জীবন যাপন করছেন, তাদেরই যখন তেমন ব্যত্যয় ঘটেনি, এই সভ্যতায় অন্য জীবজগতের আর কীইবা আসে যায়! কিংবা একতাল মাটি ও জলের গ্রহের! সভ্যতার নামে যে গাড়ি চলে, যে কলের উনুন জ্বলে, তাতে সমস্ত গ্রহের মাটি জল সহ সকল জীবই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশ্বময় করোনা সংক্রমণে গ্রহের দুর্দিন ভেবে, এখন যারা এই গ্রহটির জন্যে আক্ষেপ করছেন, তারা কেবল মানুষের জন্যেই সে আক্ষেপ করতে পারেন। লক্ষ্য করলে দেখবেন, মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণেই এ মড়ক সারাবিশ্বকে নাকাল করেছে। আগেকার যুগে মহামারী একটা নির্দিষ্ট অন্চলের মানুষকে আক্রান্ত করতো। এবং সেই এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকতো। ইদানীং অর্থনীতির স্বার্থে কতো কথাই না বলা হয়। এই করোনাকালেও বিশ্ব অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে বলে কতো আহাজারি। হায় অর্থনীতি! যেখানে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যে বরাদ্দ কেবল মোট বাজেটের ৪–৫ শতাংশ, যেখানে সমর তথা প্রতিরক্ষা বাজেট আমাদের ধারণারও অতীত থেকে যায়, সে অর্থনীতির সুফলইবা ক’জন মানুষ পায়! তারপরও বলতেই হয়, এই অর্থনীতি জিনিষটাওতো মানুষের একান্ত নিজের। এই অর্থনীতির উত্থান পতনেও অন্য জীবজগতের এমন কী জড় জগতেরও কোনো বিন্দু বিসর্গ বিলাপ নেই। জমিদারী শেষ হয়ে গেলে প্রাসাদের পাঁজর বেরিয়ে এলে, কই অন্য কোনো দালান এসে তার শুশ্রুষা তো করে না?

মানুষের বর্তমান জ্ঞান বা ধারণা মতে, অন্যগ্রহে কিন্তু প্রাণ নেই, গাছ নেই, পশুপ্রাণী বা পাখি নেই। মানুষ ছাড়াও পৃথিবী অন্য যে কোনো গ্রহ থেকে সুন্দর বলেই আমি মনে করি। আর এই সৌন্দর্য তার প্রকৃতির জন্যে। সবুজ শ্যামল বৃক্ষরাজির জন্যে। বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির জন্যে। সুউচ্চ পাহাড় পর্বত আর তাকে আচ্ছাদনকারী বরফের জন্যে। আবার কোথাও ধু ধু বালিয়াড়ি, মরুপ্রান্তর এবং মরুদ্যানের সুষমাও অনস্বীকার্য। তবে, যদি অন্য কোনো গ্রহে প্রাণ বা জীবন রয়েছে বলে প্রমাণিত হয়, তখন নতুন করে প্রাকৃতিক তুলনাবিজ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়ে পৃথিবীর সাথে তার সৌন্দর্যের তুলনা করে দেখা যেতে পারে। সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা বহু বিচিত্র প্রাণীজগতের অনেক ধরনের প্রাণীর মধ্যে মানুষ নিতান্ত একটিমাত্র প্রজাতি ভিন্ন অন্য কিছু নয়, তবে অত্যন্ত বিষাক্ত ও বিধ্বংসী বটে।


প্রকৃতির কাছে ব্যক্তি মানুষ কিন্তু অতি ফেলনা, নিতান্ত তুচ্ছ, নগন্য। সেটা প্রতিটি ঝড় জলোচ্ছ্বাসে আমরা নিত্য অনুধাবন করতে পারি। বিশেষ করে যারা চট্টগ্রামের মতো সমূদ্র উপকূলে জীবন যাপন করছি তাদের তো অনেক অনেক অভিজ্ঞতা। ১৯৯১সালের ঘূর্ণিঝড়ে কতো মানুষ মরে গেল, কতো বাড়ি ভেসে গেল, তা আজ মানুষের স্মৃতিতে প্রোথিত। এখন তো সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ঘরপোড়া গরু ভয়ে নিথর হয়ে থাকে। সেসময় লিখেছিলাম—

“এ বেলা হবে না নাওয়া

জলপতেনের শব্দে মূর্ছা যাই

সাজানো বাসরে কালনাগিনীর ফণা

তবু এসো ভাত খেয়ে নিই ভাত

 

খিড়কি দুয়ার নড়বড়ে কাঁপা ো শিথিল

চেঙমুড়িকানি অট্টহাস্যরত

ডিঙা ডুবে যাক মান যেন থাকে জিতে

 

যে ফণা নামে না তাকে বড় ভয়

কালবৈশাখী তেড়ে আসে বন্দরে

ষড়সন্তান মৃত্যুকবলে ডিঙা বাও মাঝি ডিঙা

(এ বেলা হবে না নাওয়া / জিললুর রহমান / জলপতন)


তবে, এই যে জলোচ্ছ্বাস ঝড় বা বন্যা আমাদের নিয়ত সঙ্গী, তার পাশাপাশি পলিমাটি এসে উর্বর করে দিয়ে যায় মাটি। আমরা স্বজন হারাই বটে, বাড়িঘর ভেসে যায় বটে, তারপরও মাঠে মাঠে সোনার ফসলও তো ফলেছে এর পরে। আর এই ধরনের দুর্যোগ আসে একটি অতি সামান্য সময়ের জন্যে। তারপর মানুষকে মোকাবিলা করতে হয় অভাবকে। খাবারের অভাব, বাসস্থানের অভাব, চিকিৎসা সেবার অভাব। তবে, মানুষ তা মোটামুটি সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারে। আজ কিন্তু আমাদের সারা বিশ্ব স্তব্ধ নিথর। এখন এক অজানা শত্রুর সাথে চলছে মানুষের লড়াই। এই সংগ্রাম ভিন্ন। একটি ভাইরাস আজ সমগ্র মানব জাতিকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছে। কেউ কারও ধারে কাছে যেতে পারছে না। শারীরীক বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে রাখতে মানুষ ক্রমশ একা অবসন্নতায় ভুগছে। হয়তো আপনার পাশের লোকটিই আপনাকে ছড়িয়ে দিয়ে যেতে পারে রোগ। এই ক্রান্তি ক্ষণিকের নয়, এবং স্থানিকও নয়। এর থেকে মুক্তিও এতো সহজসাধ্য নয়। 


“চারদিকে গনগনে সূর্য চারদিক ঝকঝকে শুনশান 

রুমির সঙ্গে ঘুরতে যাই না কতোকাল


বাচ্চারা ছটফট করছে ঘরে

মাঠগুলো খালি পড়ে আছে

কেবল দুটো কুকুরছানা আর একটি পরিচ্ছন্ন কাক

বাচ্চাদের খেলতে দিই না কতোকাল


বাইরে বাতাসে প্রেম

রিকশার ঝুনঝুনি ডাকে 

আমার পা’ দু’টো চেরাগী ছুটতে চায় 

আমার এ চোখ দু’টো সাগরের ঢেউ গুনতে চায় 


রুমিকে পাহাড় দেখাবো বলে 

ব্যাকপ্যাক বেঁধেও রেখেছি বহুদিন

কোথাও বৃষ্টির নেই ছিটেফোঁটা 

কোথাও মেঘের নেই আনাগোনা


রুমিকে দু’চোখ দিয়ে ডাকি

রুমিকে ধরতে পারি না কতোকাল” 

(জিললুর রহমান / রুমির সঙ্গে ঘুরতে যাই না কতোকাল)


ঘুরতে যাই না বললেই তো আর সকলেই বসে থাকছে না ঘরে। যাদের না খেয়ে জীবন কাটছে, তাদের বেরোতেই হচ্ছে , ক্ষুধার জ্বালায়, চাকরি হারানোর ভয়ে। তারফলে মৃত্যুর সংখ্যা ধারণাকে ছাড়িয়ে যাবার আশঙ্কা বাড়ছেই। একদিকে অনন্ত ক্ষুধা, চাকুরিচ্যুতির শঙ্কা, বেতনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে, অন্য দিকে দলে দলে মানুষ কাজের জন্যে বা খাবারের জন্যে নেমে আসছে পথে। আর তার সঙ্গী হয়ে শত সহস্র মানুষ প্রতিদিন নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। জানি না, ক’দিন ধরে চলবে, কতো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে শেষ হবে এই মড়কের। আমার পরম বিশ্বাস, মানুষ এই বিপর্যয় অতিক্রমে সফল হবে। এখনো মনুষ্য প্রজাতির বিলুপ্তির কাল বোধ করি আসেনি। তবে, একদিন যে বিলুপ্ত হবে না সে কথা জোর দিয়ে বলি কী করে!

প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে যা কিছু প্রকৃতির জন্যে ক্ষতিকর বা প্রকৃতিতে বিসদৃশ তা কোনো এক সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ পর্যন্ত ৪ / ৫টি বরফ যুগ অতিক্রান্ত হয়েছে পৃথিবীতে। তাই প্রতিবার জীবজগতের নবায়ন হয়েছে। মানুষ তো মাত্র সেদিন এসেছে। শারীরিক দৌর্বল্যের কারণে বুদ্ধি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে জীবনের প্রয়োজনে। তারপর সেই বুদ্ধি দিয়ে মানুষ অন্য প্রাণী মারার জন্যে পাথর দিয়ে অস্ত্র বানায়। তারপর থেকে অস্ত্রের উন্নতির ইতিহাসই মানুষের উন্নতির ইতিহাস। মানুষই বলে প্রস্তর যুগ, তাম্র যুগ, লৌহ যুগ, আনবিক যুগ, পারমানবিক যুগ। এইভাবে মানবিক থেকে মানুষ ক্রমান্বয়ে অমানবিক প্রাণীতে অধ:পতিত হয়েছে। আমরা যে প্রকৃতি দেখে আসছি দীর্ঘদিন, প্রকৃতি তারচেয়ে আরও অনেক বেশি সুন্দর। করোনা হয়তো সেই সুন্দর প্রকৃতিকে গৃহখাঁচায় বন্দী করে মানুষকে দেখার একটা সুযোগ করে দিয়েছে। তাই আজ বৈশাখে তেমন উত্তাপ নেই, বাতাসকে অনেক নিষ্কলুষ মনে হয়। কলকারখানা প্রায় বন্ধ, অনেক গাড়ির ইন্জিন অচল পড়ে আছে। কতো সহজে জানযট উধাও হয়ে যায় শহরের ব্যস্ততম এলাকায়।

একটু ভিন্ন দিক থেকে ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনে বলি, ইলিস সিলভার নামে একজন বিজ্ঞানী যুক্তি দিয়ে বলেছেন, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র এলিয়েন। নিজে টিকে থাকার জন্য পৃথিবীকে ক্রমশঃ বিপন্ন করে তুলছে। আবার এরিক ফন দানিকেন সহ অনেকেই ভিন্নরকম ভিনগ্রহ তত্ত্ব দিয়েছেন। দানিকেনের মতে মানুষ এলিয়েন নয়, এলিয়েনরা পৃথিবির বাইরে থেকে এসে মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সভ্য করেছে। তবে আমি ইতিহাসকে কল্পনার রঙিন চশমাতে দেখতে চাই না। এঙ্গেলসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিতে দেখতে আগ্রহী। হাতে নাতে প্রমাণ হাজির হলে এই তত্ত্বও মেনে নেবো বৈকি! এদিকে Ellis Silver-এর Humans are not from Earth: a scientific evaluation of the evidence গ্রন্থে বরং যুক্তি দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, মানুষ নিজেই এলিয়েন। তার যুক্তিগুলিও ফেলনা নয়। মানুষের বেঁচে থাকার পদ্ধতি, জীবনযাপন পৃথিবীর অন্যান্য জীব-জানোয়ারের চাইতে অনেক পৃথক। তাছাড়া বিজ্ঞানের কোন থিয়োরিইতো নিঁখুত নয়। সমাজ বিজ্ঞানের তো নয়ই! কিছুই নিখুঁত নয় বটে, তবে, মানুষের জন্যে পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তা’ও ৬০০০ বছর আগে সৃষ্ট— এই তত্ত্ব যে সম্পূর্ণ খুঁত তাতে কোনো খুঁত নেই।

কেউ কেউ মনে করেন, মানুষ এরই মধ্যে জেনে গিয়েছে পৃথিবীর প্রকৃত ইতিহাস। সত্যিই যদি জেনে থাকে পৃথিবীর ইতিহাস, তবে মনে রাখতে হবে কিতাবে উল্লিখিত ৬০০০ বছর আগে কিন্তু এই মাটির গোলাটি তৈরি হয়নি। বিজ্ঞানে মনস্বী হলে সব জানতে পারতেন এবং অহেতুক গোমুত্র পান এবং গোমাংস ভক্ষণে দলাদলি করে সময় ক্ষেপন করতেন না শত শত লোক। এক দালান ভেঙে আরেক দালান গড়ার খেলায় বাবর এবং রামচন্দ্র নামের দু’জন শোষক নৃপতির নামে হাজার মানুষের রক্তগঙ্গা প্রবাহিত হতো না। তবু কেউ কেউ জিদ করে দাবী জানান, মানুষই পৃথিবীর সভ্যতার রূপকার। আবারও বলছি, সভ্যতা পৃথিবীর নয়। সভ্যতা শুধু মানুষের একান্ত নিজের অর্জন, মানুষের মধ্যেই তার যতো মহিমা। মানুষ কি আর কোনো জীব-প্রজাতিকে তথাকথিত সভ্য করতে পেরেছে বা করেছে? প্রকৃতি একটা নির্দিষ্ট নিয়মে চলে। তাই সূর্য পূর্ব দিকেই ওঠে, আর পশ্চিমে অস্ত যায়। ইচ্ছা করলেই গ্রহে গ্রহে ধাক্কা লাগার কোনো কারণ নেই। এটা গুলিস্তানের মোড় নয়। মহাবিশ্ব চলে মহাকর্ষের প্রেম ও বিরহের এক মধুর খেলায়। 

একমাত্র মানুষই বিনা প্রয়োজনে যে কোনো দ্রব্য থেকে শুরু করে যে কোনো উদ্ভিদ প্রাণী এমনকি মানুষকে হত্যা বা ধ্বংস করে থাকে। মানুষ আছে বলেই মানুষই পৃথিবীর জয়গান করে। কিন্তু সে জয়গানে বনের হাতি বা শৃগালের কী এসে গেল? নি:সন্দেহে আপনি একমত হবেন যে, মানুষকে তার নখদন্ত সামাল দিতে হবে। অন্যথা মানুষই ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন। পৃথিবীর তাতে কিছুই আসবে যাবে না। 


মানুষ প্রজাতি হিসাবে অন্য প্রজাতির উপর তার অবস্থানের কারণে কী না করে বেড়াচ্ছে! প্রকৃতি ও প্রাণের সর্বনাশ করছে। আর নিজ প্রজাতির মধ্যে বিভেদ ও বৈষম্যের চর্চা এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, আমরা তাকেই স্বাভাবিক বলে মনে করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। মানুষের জীবন ও অর্থনৈতিক ক্ষতি তুলাদণ্ডে রাখছি। আমি — এই আমি, এই আমি মানুষই! আশ্চর্য! 


পৃথিবীকে মানুষ নিজের লাভ আর লোকসানের কাজে সবসময়ে ব্যবহার করেছে। তার ফলতো মানুষকেই ভোগ করতে হবে। এটা আমরা বুঝেও স্বার্থপরের মত না বোঝার ভান করে থাকি। আমার তো মনে হয় মানুষ সভ্যতার অহঙ্কার নাকি লজ্জা, এই প্রশ্নটার সমাধান করা আজ খুব জরুরী।

পৃথিবী নামের এই গ্রহটি তো কেবল মানুষ কেন্দ্রিক নয়। মানুষেরই দেওয়া নাম। অন্য জীব-জন্তু-পাখি-কীটেরা এই মাটির ঢেলাটিকে কী নামে ডাকে আমরা জানি না। যাই হোক, এখন করোনার সংক্রমণে মৃত্যু হচ্ছে শুধু মানুষের। গ্রহটি দিনে দিনে রূপে রঙে ভরে উঠছে। এক লহমায় যানজট নিরসন হওয়ায় মেয়র সাহেবগণ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। সেদিন এক বন্ধু ছবি পাঠালেন দিল্লীর ব্যস্ততম সড়কে গাড়ি চলছে না, বরং ময়ূর পেখম মেলে নেচে বেড়াচ্ছে। তাই গ্রহটি সর্বস্ব হারিয়ে নি:স্ব হচ্ছে—এমনটি ভাবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। মানুষ না থাকলেও পৃথিবীসহ সকল গ্রহ নক্ষত্র ভাল থাকবে। এযাত্রায় তো ভ্যাকসিন এসে যাবে, মানুষ বেঁচেও যাবে। কিন্তু মানুষকে বহুকাল টিকে থাকতে হলে, পরিবেশধ্বংসী কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে প্রকৃতির সাথে তাল মেলানোর পথ ধরতে হবে বৈকি! কিঞ্চিৎ মনুষ্য আদল বিশিষ্ট বলে নিজেকে নিয়ে নিজেই শরমিন্দা আছি। তবে এই এক প্রজাতির স্বৈরতন্ত্রের জায়গায় প্রকৃত পরিবেশতন্ত্র একান্ত দরকার। এতে তিলার্ধও সন্দেহ নেই।


কিন্তু তারপরও কি মিলবে আমার কিংবা রবিঠাকুরের প্রশ্নের জবাব? সব কেমন ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতি এসে গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের মনুষ্য হৃদয়। যতো যা-ই বলি না কেন “মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।” (জীবনানন্দ দাশ / বোধ) সেই বোধের তৃপ্তি ও অতৃপ্তি আমাকে কেবল এই কথাটিই বলতে চায় যে, আমি যদি না-ই থাকলাম, পৃথিবী সুন্দর থাকলেই বা কী, আর না থাকলেই বা কী আসে যায়! তখন কেবলই রবিঠাকুর আর নীলস বোর-এর কথা ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ে শুধু এইটুকু বলে —

“আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,

                          চুনি উঠল রাঙা হয়ে।

                      আমি চোখ মেললুম আকাশে,

                          জ্বলে উঠল আলো

                            পুবে পশ্চিমে।

                গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর',

                            সুন্দর হল সে।” 

                                          (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর / আমি)


ইতি—

আপনারই

জিললুর রহমান

রাত্র ৮:০৪

২৯ এপ্রিল ২০২০

১ম সংশোধন: পূর্বাহ্ণ ১:২৯

৩০ এপ্রিল ২০২০

২য় সংশোধন: বিকাল ৪:৩৭

৩০ এপ্রিল ২০২০


৩য় সংশোধন: বিকাল ৫:৩১

০৩ মে ২০২০



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ