....

মাহবুবুল ইসলাম এর প্রবন্ধ 'আত্মহত্যার ইতিহাস ও মনস্তত্ত্ব'

 


"Every death is one kind of disguised  suicide" —Freud.


এই আত্মহত্যা কী শুধু modern crisis? নাকি সমাজের সিস্টেমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ?

৭৩ সালে মাসাদায় ১০০০ ইহুদি আত্মহত্যা করে রোমান অধিকার ও দাসত্বে থাকার প্রতিবাদে। 

ওল্ড টেস্টামেন্টে চার ব্যক্তির আত্মহত্যার কথা বলা আছেঃ স্যামসন, শৌল,অবিমেলক ও অহিয়থোপেল।নিউ টেস্টামেন্টে জুডাস আত্মহত্যা করে। সিমোন দি বোভোয়ার তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ"আ ইজি ডেথ" এ বলেন"মানুষের জীবনের মতোই মৃত্যু একটা অস্বাভাবিক ব্যপার। মানুষের চারপাশের বাস্তবতা,যখন অর্থহীন হয়ে উঠে মৃত্যুই  অর্থবহ হয় প্রতিবাদস্বরুপ।"

গ্রিক পুরান ভর্তি হয়ে আছে আত্মহত্যার কাহিনিতে।

রোমান দৃষ্টিতে আত্মহত্যা হচ্ছে আদর্শ  নির্গমনের পথ।

সেনেকা আত্মহত্যাকে বলেছেন "মন্দের সমাপ্তি"। সেনেকারা মধুর সমর্থন দিতো। সেনেকা বলেন— "যখন বুঝব, আমার দুঃখের শেষ নেই, তখন জীবন থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াব"।

ম্যাকবেথ এর পঞ্চম অংকে ম্যাকবেথের উক্তি ছিলো" রোমান যোদ্ধার মরব না হয় নিজের আসিতে"অর্থাৎ রোমানরা পরাজয় বা মর্যদা রক্ষার জন্য আত্মহত্যা করতো। উল্লেখ্য শেক্সপিয়ারের নাটকে ৫০এর বেশি আত্মহত্যার ঘটনারকথা আছে।

জাপানে বা উন্নত দেশে দলবেঁধে সুইসাইড পয়েন্টে আত্মহত্যা করার প্রবণতাও প্রাচীন।তখন ব্যর্থতা বা কর্তব্যচ্যুত অবস্থায় লজ্জা থেকে বাঁচার জন্য সংগঠিত আত্মহত্যা করতো। এরা "হারাকিরি" মর্যাদা লাভ করতো।

সমাজবিজ্ঞানী এমিলি দুরকহাইম তার বিখ্যাত গ্রন্থ "সুইসাইড" এ চার ধরণের আত্মহত্যার কথা বলেন—

ইগোয়িস্টিক

ম্যানিয়াক

এ্যানোমিক

পরার্থবাদী অলট্রুইসটিক। 

ইগোস্টিক সুইসাইড ঘটে যখন ব্যক্তি তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাইতে পারে না। এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজেকে outsider ভাবে।

অলট্রুইসটিক আত্মহত্যা আগেরটার বিপরীত। এক্ষেত্রে সমাজের সিস্টেমের বিরুদ্ধে বা একটা সমাজ, গোষ্ঠীর জন্য, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণ ত্যাগ করে। সক্রেটিস, ১০০০ ইহুদির আত্মহত্যা এধরণের।

ম্যানিয়াক আত্মহত্যা এটা সংস্কৃতিগত, জাতির প্রবণতা। দুইশ বছর আগেও আত্মহত্যাকে "ইংরেজ অসুস্থতা" বলে ইউরোপীয়রা অভিহিত করতো। ফরাসিরা ইংরেজদের বলত আত্মহত্যাপ্রবণ।

মন্টেস্কু "দি স্পিরিট অব দি ল" তে বলেন "রোমানরাও মহৎ কারণে প্রাণ দিতো"। 

তবে ইংরেজরা কোন দায়বদ্ধতা ছাড়াই আত্মহত্যা করে। চরম সুখেও তারা তা করে।"

জাপানীরা প্রতিবছর গড়ে ৩৫ হাজার আত্মহত্যা করে।

একই আবহাওয়া সত্ত্বেও সুইডিশদের আত্মহত্যার হার নরওয়ের চেয়ে বেশি।

আধুনিক সমাজের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ এ্যানোমিক বা অম্বয়বাদী আত্মহত্যাকে দায়ী করেছে।

অ্যানোমিক বা অম্বয়বাদী  আত্মহত্যার ক্ষেত্রেও সমাজ-সম্পৃক্ততা  রয়েছে। হঠাৎ বিশাল প্রাপ্তি বা চ্যুতি, ব্যাপক ও মারাত্মক লাভ লোকসান, পারিবারিক বিচ্ছেদ সব অনুসঙ্গ অ্যানোমিক আত্মহত্যা বলে অভিহিত। 

ক্যামু মানুষের হৃদয়ের মুক্তির উপর গুরুত্ব দিয়েছেন।আত্মহত্যার চিন্তা খুব কম সময়ের। তবুও ঘটে। কোথা থেকে সংকট দেখা দেয় তা অজানাই থাকে। মূলতঃ এক অজানা অদৃশ্যে জন্ম নেয়া এক পোকা কুট কুট করে কেটে দেয় বাঁচার অদ্ভুত স্নায়ুমন্ডলিকে।"


ফ্রয়েড "বিয়ন্ড দি প্লেজার প্রিন্সিপাল" এ আত্মহত্যা বিষয়ে বলেন— "মানুষ আত্মহত্যা পছন্দ করে না। তবে প্রত্যেকটা মানুষের মনে "death instinct" মৃত্যুর  প্রবণতা আছে। আমাদের স্বাভাবিক সত্তার ভেতর এক ইচ্ছা মৃত্যু আছে। মানুষ জীবনে অসংখ্যবার আত্মহত্যা করতে চায়। প্রতীকী অর্থে বহুবার করেও। তাই সব মৃত্যুই ছদ্মবেশী আত্মহত্যা।"

Of human bondage" এ মম বলেন— "মানুষকে ল, পাবলিক অপিনিয়ন, কনসিয়েন্স বাধা দিয়ে রেখেছে বলে সে অবদমন করে রাখে মৃত্যু ইচ্ছাকে।"

ভ্যানগগ একবার মঁপাসাকে  বলেন— "একটা রিভলবার দাও তো, এই জীবন আর ভালো লাগে না।" উল্লেখ্য,  অসংখ্য সাহিত্যিক আত্মহত্যা করে এবং অনেকে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

আলভেজ তাঁর বিখ্যাত বই "দ্য সেভেজ গড" এ দুই হাজার বছর ধরে ইতিহাস ও সাহিত্যে আত্মহত্যার দিকটি তুলে ধরেন। মধ্যযুগ থেকে রেনেসাঁ হয়ে যুক্তির যুগ এবং রোমান্টিক কালের আত্মহত্যার কথা ব্যাপকভাবে এসেছে। বস্তুত উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর স্মরণীয় ও বরণীয় লেখকই হ্যামলেটের মতো মৃত্যুতে আবিষ্ট কিংবা আত্মহত্যাপৃষ্ট।

সাহিত্যও আত্মহত্যাকে একটা শৈল্পিক রূপ দিয়েছে।

সিলভিয়া পাথে বলেন— "মৃত্যুবরণ এক শিল্প, অন্যসব কিছুর মতোই আমি তা চমৎকারভাবে করি"।

রোমান্টিকদের কাছে মৃত্যু ছিলো এক সাহিত্যিক সম্পাদন। ১৮৩০ সালের দিকে ফ্রান্সে রোমান্টিকরাই সবচেয়ে জনপ্রিয় করে তোলেন। দাদাবাদী জাক ভাশে বলেছিলেন— "যুদ্ধে মারা যেতে আমার আপত্তি, আমি তখনই মরব যখন মরে যেতে চাই।"

মানিক বন্দোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথা'য় যাদবের এক অদ্ভুত ইচ্ছে মৃত্যুর দেখা পাই যে তার মৃত্যুর দিবস, ক্ষণও ঠিক করে রাখে।

এদিকে প্রাচ্যের দিকে তাকালে আত্মহত্যার এতো মর্মান্তিক ইতিহাস নেই। যদিও মনুসংহিতা' হিন্দুদের অন্যতম বিধানগ্রন্থ বা কোড তবু মহাভারত' এ পাওয়া যায়, মানুষ দুঃখ-দুর্দশার ফলে আত্মহত্যা করে।

উল্লেখ আছে "দেহধারী জীব বিপরীত বুদ্ধির বশে অসৎ কর্মে প্রবৃত্ত হয়; সে অতিভোজন করে বা অনাহারে থাকে, পরস্পরবিরোধী বস্তু ভোজন ও পানাহার করে, ভুক্ত খাদ্য জীর্ণ না হতেই আবার খায়, দিবসে নিদ্রা যায়, অতিরিক্ত পরিশ্রম বা স্ত্রী সংসর্গের ফলে দুর্বল হয়ে যায়। এই রূপে বায়ুপিত্তাদির প্রকোপিত করে এবং পরিশেষে প্রাণান্তকর রোগের কবলে পড়ে। কেউ কেউ উদবব্ধনাদির দ্বারা আত্মহত্যা করে।"


তবে রামায়ণ মহাভারতে ইচ্ছামৃত্যু চোখে পড়ে। প্রাণত্যাগের উল্লেখ আছে যা প্রাচীন রোমানদের সাথে মিল আছে। যদিও ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ। 


মূলতঃ  প্রাচ্যের দর্শনে আত্মহত্যার বীভৎসতা নেই।

এর মূল কারণ, এখানকার দর্শনে মানুষ আত্মমগ্নতা, ধ্যান, নির্বাণ তত্ত্ব, বৈষ্ণববাদ, সুফীবাদ আত্মার ভেতর ডুব দিয়ে একজন তপসী বা সাধক হয়ে জন্ম নেয়। সুখে, দুঃখে নির্বিকার থাকার এক চৈতন্যবোধ বা প্রাচীন গ্রীসের stoicism যেটাকে বলে। জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিশে যাবার এক আকুতি প্রাচ্যের মানুষকে বাউল সাধকে রূপান্তরিত করতো।

অন্যদিকে ফ্রয়েড, জাং, এডলারদের  সাইকোএ্যানালাইসিস মেথড  মানুষের মনোবৈকল্য, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, নিহিলিজম খুঁড়ে বের করে যা অধূনা মনোবিদদের দ্বারা একটা ব্যবসা ছাড়া আর কিছুনা বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন—

আত্মহত্যা, ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার জন্য মোটিভেশনাল স্পীচ, বই, ইউটিউব গুরু, থেরাপি, মনোবিজ্ঞানী কোন কাজে আসে না।

এই মোটিভেশনাল গুরুরাই (ডেল কার্নেগি) আত্মহত্যা করেছেন। ফ্রয়েড যিনি আত্মহত্যার উপর ব্যাপক গবেষণা চালান, উঁনিও বিষাদে, হতাশায় ১৯৩৯ সালে রোগী দেখা বন্ধ করে দেন। তিনি তার চিকিৎসককে বলেন প্রাণনাশক মরফিন দেয়ার জন্য। সে বছরের সেপ্টেম্বরে মারা যান। তার মৃত্যু তার নিজস্ব ভাষার মতো "এক ছদ্মবেশি আত্মহত্যা"।

Man is not made for defeat. A man can be destroyed not defeated. —এই বিখ্যাত, মোটিভেশনাল কথা যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে "The old man and the sea" তে বলেন, তিনিও অসংখ্যবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।


পরিশেষে গ্রেগরি জিলবোর্গ এর কথা টেনে বলা যায়—

"মানব জাতির মতোই আত্মহত্যা প্রাচীন, এটা সম্ভবত নরহত্যার মতোই পুরোনো এবং সব স্বাভাবিক মৃত্যুর মতো শ্বাশ্বত। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধি এবং আবহাওয়ার সাথে এর মাত্রাবৃদ্ধি  ভিত্তিহীন। আত্মহত্যা পরিসংখ্যানের বিষয়ও নয়। মানুষের মনোজগতে বাস করে দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য মৃত্যু যন্ত্রণা।

মূলতঃ আত্মহত্যার ইতিহাস লুকিয়ে আছে সংস্কৃতি, দর্শন, পুরাণ,  ও জন ইতিহাসের গোপন অলিখিত দস্তাবেজে।"

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ