....

এ মাসের কবি : আহমেদ মওদুদ


আহমেদ মওদুদ মূলতই একজন কবির অবয়ব, নিজস্ব শব্দের সংসারে যিনি চাষী— ধানসূত্র আঁকেন। যার হৃদয় হতে স্পষ্টত বেরিয়ে আসে কবিতার অতি প্রাকৃতিক বুনন। যার কবিতার সাম্রাজ্য ভ্রমণে আমরা পেতে পারি মাটি-মানুষের আদিম ও আধুনিক গন্ধের মিশেল...





আহমেদ মওদুদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮১ খিস্টাব্দে, রংপুর শহরের মাহিগঞ্জে। মহিন্দ্রাফতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আফানউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে মাহিগঞ্জ কলেজ ও কারমাইকেল কলেজে একাডেমিক পাঠের সমাপ্তি ঘটে। লিটলম্যাগের অন্যতম যোদ্ধা, কাজ করছেন লিটলম্যাগ বিন্দুর সাথে। প্রধানত কবিতা, গদ্য, কিশোর উপন্যাস লিখেন। প্রকৃতই কবি-জীবন যাপন করেন।
পৈতৃক ভিটেয় শিশুর মনন বিকাশে প্রচলিত ধারণার বাইরের পাঠশালা ‘আনন্দপাঠ’ গড়েছেন।

তাঁর প্রকাশিত কবিতাবই: দেহের আড়ালে থেকে প্রকৃত স্বজন (২০০৯); দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানের খন্ডচিত্র (২০১২); দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে (২০১৮)। এছাড়া কিশোর উপন্যাস: কিশোর (২০০৭); কবি (২০১৭)।
গবেষণা-পুস্তক: রংপুরের লোকছড়া (২০১৭)।
জীবনীগ্রন্থ: বিদ্যাসাগর (২০২০)।





মদের মৌসুম

ধানের মৌসুম এলো, ধান এলো, ধন এলো না। এই ভাবনায় ভাবিত কৃষকসভায়, ধেনোমদ খেয়ে, ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে ধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন, উদ্বৃত্ত ধানের থেকে ধেনোমদ হবে। ধানের মৌসুম হবে মদের মৌসুম। হাটে হাটে ধান নয় ধেনোমদ বিকোবে কৃষক। ধানের মৌসুম হলো মদের মৌসুম যথারীতি। মদ আর মদিরায় ভরে গেল দেশ। বেশ, খেয়ে ধেনোমদ, কৃষাণ-কৃষাণী ধোন নেড়ে একে অন্যের, গড়াগড়ি খায় ধানে আর খড়ের গাদায়। গড়িয়ে গড়িয়ে তারা আগুন লাগিয়ে দেয় ধানে, গাদায় আর গদির গায়ে। গদি যদি মদিরায় ভরে যায়, আগুনের দোষ কী বা মাতাল হতে! ভাবে, ছাইয়ের ঢিবিতে বসে কালের কৃষক।


বিশ্বের বালক-বালিকারা

রাতের শরীর থেকে আঁধারের খোসা ছাড়িয়ে খেয়ে নিল বিশ্ববালক। দিনের জন্ম হলো। দিনের শরীর থেকে আলোর খোসা ছাড়িয়ে খেয়ে নিল বিশ্ববালিকা। রাতের জন্ম হলো। এই যে দিবস ও রাত, এর বালক-বালিকারা আলো আর আঁধারের মোহনায় ডুবে গিয়ে ভেসে উঠল কিশোর-কিশোরীর বয়ঃসন্ধিসমেত। এরপর তারা আবার ডুবে গিয়ে ভেসে উঠল যুবক-যুবতীর অবয়বে। এবং তারা আবারও ডুবে গিয়ে ভেসে উঠল বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার মলিন মুখ নিয়ে। বৃদ্ধার আলোর কথা স্মরণে এলো, বৃদ্ধর আঁধারের। দ্রুত তারা একে অপরের খোসা ছাড়িয়ে খেয়ে নিয়ে রাত আর দিনে পরিণত হলো পুনরায়। এভাবেই মূলত বেড়ে গিয়ে বয়স, পেকে ওঠে পৃথিবী। এবার তবে পৃথিবীর খোসা ছাড়িয়ে খাওয়ার পালা।


পাতা ছিঁড়ে লোকালয়ে 

অরণ্যের আত্মীয় তুমি 
পাতা ছিঁড়ে লোকালয়ে! লোকের আলোয় 
ধ্বসে যাচ্ছে তোমার প্রণয়ের পাশা! 

অতএব তুমি 
ঘুমিয়ে পড়লেই 
জেগে উঠবে হন্তারক সংঘ; 
পরিবার, প্রতিবেশী, প্রচ্ছন্ন পুরুষ। 

তারা আত্মীয় একে অন্যের, বন্যের বংশলতিকা তারা।

জাগরণ, তোমার
কেনইবা মেনে নেবে নিভে যাওয়া মশালের ছাই।

হন্তারক যারা 
জলের, জলরং ক্যানভাসের
সবুজ, আহ্ সবুজ ক্যানভাসের
নীলের, নীলরং ক্যানভাসের

ক্যানভাসার তারা, হন্তারক যুগল বৃক্ষের।



ধানসূত্র

[বিভিন্ন লিটলম্যাগে প্রকাশিত কবিতার বর্ণক্রম]

ট.

ধানের জমিনঘেঁষা ঘাসের জায়নামাজ। তাতেই সিজদা দেয় চাষী। মিনার, মসজিদ তার লাগেনা কিছু। পিছুটান নেই তার, আছে খড়ের গম্বুজ আর মনের মাজার। ধানের পূজারী সে, ধান তার লক্ষ্য আর লক্ষী তার ধান। ধানের কাঠির বাঁশি প্রাণের কাঠিতে তার বেজে চলে বাণের পানির মতো, অবিরত, গত মৌসুমের। ধান ধর্মে বিশ্বাস তার, নিশ্বাস তার ঘাসের জায়নামাজে, বাজে, বাঁশের পাতার মতো, মাঝারী হাওয়ার। মাজারে দেয়ার মতো ধান নেই তার, আছে ধানের মাজার।


ঠ.

পেকেছে নতুন ধান ধূতরার বিলে। সেই ধান, সেই নব-অন্ন, অন্যের মুখে তুলে দিতে, মেতেছে নিরন্নপাড়া নবান্ন উৎসবে। শব-বাহকের মতো নিজেদের বয়ে চলা নিরন্নপাড়ার লোকজন, বয়ে চলে আজীবন ধান আর ধানের জীবন। মাঝে মাঝে উৎসবে মাতে, মাতোয়ারা হয়, মাতম করে, গত মৌসুমের পর নিরুদ্দেশ, দেশান্ন উৎসবে যাওয়া ধানের জন্য। তবু দেশান্ন উৎসবের অতিথি তারা হতে পারে না। পারে না আস্থাভাজন হতে দেশাচারের।


ড.

কৃষাণের কাস্তের কাছে পরাজিত সমূহ সকাল। সমূহ দুপুর রোদের নূপুর হয়ে বাজে সোনালী ধানের ক্ষেতজুড়ে। ক্ষত সেরে যায় কৃষাণের, ধানের গোছায় আলগোছে চালায় সে কাঁচি। এই যে ধান, ধানের গোছার জীবনী, ভবিষ্যৎবাণীর মতো আগেই রেখেছিল জপে, জপমালায়, ধানবীজের তৈরি। মালীর মতোই ধানরেণুদের প্রতি ছিল মনযোগী। মনযোগ পেয়ে সেই তো পরাগ, রাগে-অনুরাগে বেড়ে ওঠে অন্ন শিরোনামে। শিরোমণি কৃষাণ তাহার। কিন্তু হঠাৎ কেউ একজন, কৃষাণের হাত থেকে কাস্তে নিয়ে, ধান কাটার অভিনয় করে, ছবি-টবি তুলে, সিনেমাসহ চলে যায় দূরের সংসদে। কৃষাণ তো এসবের বোঝেনা কিছুই। বোঝে, রাজনীতি মানে জেল-জুলুম আর খুনের তত্ত্ব। 


থ.

মেঘের মূরাল থেকে খসে পড়া গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ, তা-ই আজ বৃষ্টি সর্বনামে নেমে আসে আষাঢ়ের মাঠে। নামে কতো কতো ঘোড়া, গাধা, মহিষ আর গাভিন গরু। তারা জলের জাতক, তারা জল পরিবাহী, প্রবাহিত মাঠ থেকে মাঠে, ধানের গোছায়। এদিকে কৃষক, ধান যার ধ্যানের আশ্রম, সে হঠাৎ চেপে বসে মেঘের মূরাল থেকে নেমে আসা মহিষের পিঠে। পিঠাপিঠি ভাই তারা, তারার আলোয় কত ছুটোছুটি ছিল, স্মৃতির শৈশব জুড়ে। কতো হাল টেনে নেওয়া, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। মিলিয়ে নেয়ার এইতো সময় স্মৃতির হিসেব, আষাঢ়ের থৈথৈ মাঠে। মাঠের মহিষ তাই মেঘে চলে যায়, মেঘের মহিষ জল থৈথৈ, নেমে আসে মাঠে। পাঠে ফিরে যায় চাষি, ধান বুনবার, এই বুনো বর্ষায় ।


দ.

বিষণ্ণতা গিলে জেগে উঠলে বর্ষার মেঘ, মাথাল মাথায় বাড়ে চাষির চঞ্চলতা। চঞ্চল চাষির হৃদয়, হৃদয়ের ডাক গিয়ে মিলে মেঘের ডাকে। তাতে ডাক হরকরা, তাতে জল নেমে আসে। ভাসে বিস্তৃত মাঠ, ভাসে ধানের চারা। চাষি চারায় চরেণ, আহা মেঘ গুড়গুড়। ওরে ইলশেগুঁড়ি, শহুরে সরষে ইলিশ। চাষি চেনে না এযে, চেনে কই টুবানি। তার ধানক্ষেত জুড়ে ঘন কইয়ের জাল। জলে জাল আর কই, জালে জল থৈথৈ। চাষি ভালোবাসে জল আর ভালোবাসে জাল। চাল ভালোবাসে আর চুলো ভালোবাসে তার বউ, বর্ষার গাভিন আকাশকে স্বাক্ষী রেখে।


ধ.

গীতল, ধান বোনার গীত, হরিত সঙ্গীত, গেয়ে গেয়ে বুনে যায় ধান, ধানের দুলাল। লালপেড়ে শাড়ি পরা বউ তার, এগিয়ে দেয় ধানের চারা। দুলাল-দুলালী তারা, অপার কৃষাণ। তারা ধানের সবুজ, তারা ফসলের মাঠ, তারা দূরের গ্রহ থেকে দৃষ্টিগ্রাহ্য পৃথিবীর কৃষিপাঠ। পাঠের অধিক এক কৃষিভাষ্য রচনা করবে তারা এই মৌসুমে, বর্ষার। প্রকৃত পাঠক পাবে কি তারা! ভাবে, অপার কৃষাণ। তবু তারা রচে যাবে ধান, ঘ্রাণ নিয়ে মলিন মাটির, মাটিয়াল জুড়ে। জুড়ি বেঁধে তবু তারা গেয়েই যাবে গান, গীতল, ধান বোনা গীত, জীবনের হরিত সঙ্গীত।



ন.

ধার করে মাঠের সবুজ, সবুজাভ শরৎ সকাল। কিছুটা সকাল থেকে কিছুটা শিশির ধার করে ধানের পাতা, একে অন্যের কাছে ঋণী হলো তারা। ঋণগ্রস্ত চাষির দুখে দুখী হলো শারদীয়া মাঠ। মাঠের সবুজ রং চাষি হৃদয়ের প্রতিরূপ। যে হৃদয় হলুদ হলো মাঠের সবুজ ছড়িয়ে ,তার ছবি তোলেনি পর্যটক। ফলে তার ভ্রমণেই ভ্রম, অসম্পূর্ণ পরিযান নিয়ে দূরে যাক তার পরিযায়ী মন। গাঢ় হতে মাঠের সবুজ, দৃপ্ত হোক অকৃত্রিম চাষির ভ্রমণ।



প.

সবুজের মাঝে লাল, বিনীত সকাল, সকল আলোর রেখা ধানের গোছার ফাঁক গলে ফিরে যায় সৌরবিশ্বে পুনরায়। তাতেই সতেজ হয়, সজীব হয়, চিরজীবী হয় লালে লাল, সৌর দুলাল। ফলে ললাটে সৌরটিপ নিয়ে ঘুমাতে যায়, বিস্তৃত, সবুজ ধানক্ষেত, জেগে ওঠে সৌরটিপ নিয়ে। জাগে চাষি বউ, টিপহীন, হীনমন্যতায় ভোগা, ঘুমঘোরে বোবা-কালা, অসাড়, উজবুক স্বদেশ বাসীকে নিয়ে, যারা ঘুমাতে দেয়না তাকে ধানের মৌসুম। মৌসুমি হাওয়া হায়, তবু বয়ে যায়, সবুজ ধানের পাতা ছুঁয়ে।



ফ.

ছাঁয়া খুঁজে নেয়, ধানের গোছায়, খলশে -পুঁটি, মলা-ঢেলা আর সংখ্যালঘু দাঁড়কাক। দাঁড়িয়ে থাকবে তারা পূর্ববর্তী মীন পুরুষের মায়া নিয়ে, ধানের ছাঁয়ায়। ছাঁয়া থেকেই মায়ার উদ্রেক, জানে মীন, জানে মৌসুমি ধান। যেভাবে জানেন চাষি, বীজতলা রোদের কাঙ্গাল, ধানক্ষেত যেভাবে জলের। মীন আর জল আর ধান আর চাষি, অনুযোগহীন এই চার প্রাণ মিলে, পৃথিবী হয়েছে প্রাণময়। প্রাণ ফিরে ফিরে পায় আর গান ধীরেধীরে গায় যারা, তারা কি জানে, ধানের জীবনী চাষির জীবন থেকে অথবা চাষির জীবনী ধানের জীবন থেকে নেয়া। জানেনাতো তারা, না জানুক, তবু তারা ফিরে পাক প্রাণ, চাষির জীবনী থেকে ধার করে ধনঞ্জয়ী ধান।




দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে

[বিভিন্ন লিটলম্যাগে প্রকাশিত কবিতার সংখ্যাক্রম]  


২৭.

মানুষের মুত্যু হলে নক্ষত্র বাড়ে। বাড়ে শূন্যতা। মহাশূন্যতার মহারথে চড়ে এইসব দেখেছি শৈশবে। জেনেছি নক্ষত্র বাড়ে অযুত-নিযুত। বেড়ে যাওয়া নক্ষত্রের কেন্দ্র হতে আলো ছড়ায় মৃতদের আলোঘর। সেই আলোয় বেঁচে আছি দিবস ও রাতের চলাচলে। মৃতরাই বাঁচিয়ে রেখেছে তাহলে! জীবিতরা মৃতপ্রায়, অথচ আলোহীন, নক্ষত্রের ক্ষত; দুর্বিপাকের পাকে পাকে খাপ খাওয়া মহাজঞ্জাল। হায় মৃত্যু, জীবনের যৌথ যাপন, চুপিচুপি চুষে নাও হৃদয়ের রং আর দেহের দখল নাও তোমার খাপে আর বেঁচে থাকো নক্ষত্র হয়ে।


২৮.

রাতের হৃদয় ফেঁড়ে হেঁটে যাই আকাশের এভিনিউ হয়ে। পথে পথে তারাবাতি, দূরে দুর্ঘটনার উদ্ধত উল্কা, গ্রহ-নক্ষত্রের ঘোর ও ঘূর্ণন। তবুও হাঁটতে হয়, তবুও এই হেঁটে যাওয়া পৃথিবীর প্রতিনিধি হয়ে। নক্ষত্রের ক্ষত হতে বিচ্ছুরিত পুঁজ আমাকে দেখায় পথ, বলে, হেঁটে যাও দীর্ঘজীবী গ্রহাণুর মতো, জীবাণুর জীবন ছেড়ে। আমি তাই হেঁটে যাই কেটে যাই রাতের হৃদয়। হৃদয়ের ক্ষত হতে আলো ঝরে রক্তের মতো। সেই আলো গায়ে মেখে পায়ে মেখে অনিশেষ হেঁটে যাই রাতের গভীর হতে আরো গভীরে, আর এক রাতে, আর এক হৃদয়ে।


২৯.

সমবেত দুঃস্বপ্নের রাতে জেগে আছি ভোরের আলোর দিকে চেয়ে। কিন্তু দূরে যে আলোর রেখা সে নয় ভোরের আলো, সে আলো অন্ধকারের সূচনা সংকেত। সূচি ও সীমা ছাড়াই সেই আলো ক্রমাগত জ্বলে। ফলে আরো দুঃস্বপ্ন, ফলে আরো দূরাগত ভোর। এই ভয় ও ভাবনায় ঝুলে আছি দুঃস্বপ্নের তারে। ঝুলে ঝুলে ভুলে থাকবো ভোরের আলোর কথা, অন্ধকারের সকল সঙ্গীত। আলোর শ্লোগান তুলে নিজেই হয়তো হবো ভোর। দোর খুলে খুকুমণি আমাকে জড়িয়ে তার দুঃস্বপ্নের গান ভুলে তুলে দিবে স্বপ্নের মশাল। নিজেই মশাল হয়ে, মলিন হয়ে, লীন হবো খোকায় খোকায়, সমবেত দুঃস্বপ্নের শেষে।


৪০.

বাধ্যগত ছিলো না সে কোনো কালে। অবাধ্যতার অভিশাপে ঝুলে তাই ঘুরে বেড়ায় পথে প্রান্তরে আর দেখে, জগতের সকলেই প্রায় বাধ্যতার শেকলে বাঁধা। এমনকি তারা নিজেরাই বেঁধে রেখেছে নিজেদের এবং ঘর থেকে বেরুবার সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নেয় নিজেদের শেকলের সৌন্দর্য্য, বাধ্যতার। এতো বাধ্য কেনো সকলে? ভাবে, অবাধ্য আর আনাড়ী লোকটা এবং দেখে বাধ্যগত লোকজনের উপর যখন শান্তি বর্ষিত হচ্ছে তখন তার দিকে তেড়ে আসছে একটা অবাধ্য বর্শা, তাকে গেঁথে ফেলবার আশায়। সে বর্শাটাকে ভালোবাসে, হৃদয়ে গেঁথে নিয়ে এগিয়ে যায় বাধ্যগত পৃথিবীটাকে প্রদক্ষিণ করার দৃঢ় সংকল্পে আরো অবাধ্য আরো আনাড়ি রূপে, রূপসার তীর ধরে।


৪১.

মেঘালয় থেকে এসে মেঘ সাহারার দিকে যাবার আগেই ঝরে পড়ে কেনো, এই ভাবনায় আচ্ছন্ন আবহাওয়াবিদের পুরো পরিবার। পারিবারিকভাবে তারা মেঘমুখী হয়ে থাকে। সেখানে মেঘের শরীর জুড়ে ছুটোছুটি করে জলরঙ্গে আঁকা সব ঘোড়া, গাধা আর উট। যাদের কি-না ছোটার কথা ছিলো সাহারার বুক চিরে। আবহাওয়াবিদের বুকে ব্যথার মেঘ জমলে সে তার দপ্তর সরিয়ে নেয়ার কথা ভাবে সাহারার কাছাকাছি। কারণ সে জানে আবহাওয়া দপ্তরকে ঘিরেই ঘোরাফেরা করে পৃথিবীর যতো মেঘ, মেঘের ঘোড়া, গাধা আর উট। মেঘের ঘোড়ারা যদি দাপ্তরিকভাবেই নেমে পড়ে সাহারার বুকে, মরুর মজ্জ্বায়। এই ভেবে শান্ত হয় আমাদের আবহাওয়া অফিস আর পুরো পরিবার, আবহাওয়াবিদের।


৪২.

হৃদয়ের ডাক শোনার জন্য যার বুকেই মাথা রেখেছি পেয়েছি পাথরের প্রণাম। প্রস্তর যুগে আছি। পাথরের প্রতি এতো মোহ মানুষের অথচ মোহন পাথর নেই একটাও। তথাপি পাথর থরে থরে সাজানো। তথাপি পাথর ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে চাই কিন্তু কিছু পাথর পেছনেও বাঁধা। সামনে পেছনে পাথর। মানুষ এতো পাথর প্রবন যে প্রস্তর যুগটাকে ধরে রেখেছে সুকৌশলে। বেঢপ আর কুৎসিত সব পাথর বিভিন্ন নামে নানান অবয়বে সচল। সচেতনে পথ চলতে গিয়েও রেহাই নেই। একেকটা পাথর একেক নামে এসে বাধা দেয়। প্রস্তর যুগেই আছি তবে।


৪৩.

শিশুদের সাথে থাকি। শিশু শিক্ষালয়ে। তাদের কাছে পাঠ নেই। জগতের সকল পাঠই মূলত শিশুতোষ এবং সকল সুসমাচার শিশুদের সখ্যতায় পাওয়া অথচ আমরা কি-না তাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলাতে অনিচ্ছুক আর অপারগ এবং তাদের এড়িয়ে চলার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করে আমরা তার নাম দিয়েছি ব্যক্তিত্ব। সম্ভাবনার আঁধার এই সব শিশুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমরা অনবরত তাকিয়ে থাকি শিশুদেরই ব্যর্থ সংস্করণ বৃদ্ধদের দিকে যারা কি-না তাদের  শৈশবকে অস্বীকার করে, শৈশবের স্বপ্নকে প্রত্যাখান করে জলের পঁচন আর বাতাসের দূষণকে ভালোবেসে শেষমেষ নিজেদের ভর তুলে দিয়েছে নিজেদের মতোই বেঁকে যাওয়া একটা লাঠির উপর। আর কে না জানে এই সব লাঠির যতœ তারা এমনভাবে নেয় যেভাবে তারা নিয়েছিল তাদের অবাধ্য শিশ্মের যতœ সারা জীবনভর। ভর ও বেগের সূত্রে শিশুদের তাই কিছুই যায় আসে না তাই শিশুদের সাথেই থাকি, শিক্ষা শিক্ষালয়ে।


৪৪.

পাথর কেটে এগিয়ে যাওয়া লোকটার হৃদয়ে পাহাড়ে পথ তৈরির সংকল্প। অথচ বর্বর পাহাড়িরা পাথর ছুঁড়ে মারছে তার দিকে আর লোকটা একহাতে পাহাড় কাটছে এবং অন্য হাতে তার দিকে তেড়ে আসা পাথর খ- থেকে নিজেকে রক্ষা করছে। রক্ষাকর্তার বেশে এগিয়ে এসে বর্বরদের সর্দার জানালো, এই পাহাড় তাদের দেবতা এবং কারো অধিকার নেই এর গায়ে বল্লম চালানোর। চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরির সংকল্প করা লোকটা তার হাতিয়ার গোছাতে গোছাতে সর্দারকে বললো, কিন্তু আমিতো তোমাদের দেবতা হতে চাইনি। দেবতার ভ্রম  থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলাম।


৪৫.

পাহাড় বেয়ে উঠে যাওয়ার সময় দৃষ্টিগ্রাহ্য পাহাড়ের চূড়া তার গতি বাড়িয়ে দিয়েছিলো বার বার। অতঃপর সে তার সমস্ত গতিকে সঙ্গে করে আছড়ে পড়ে পাথরের রাস্তায় যেটা কি-না পাহাড় কেটেই তৈরি এবং যা তাকে ধরে রাখতেও পারছে না। রাস্তাগুলো বরাবরই সরল আর সমতলমুখী আর কে না জানে কেবল অথর্ব আর অর্বাচীনরাই সমতলের মাপজোখ নেয়। কিন্তু সে ডিঙ্গোচ্ছে পাহাড় আর স্পর্শ করছে চূড়া এবং একটা চূড়া স্পর্শ করার উল্লাসের উন্মাদনায় পুনরায় সে ছিটকে পড়ে পাথরের রাস্তায় এবং রাস্তা থেকে পুনরায় সমতলে। আহা সমতলে এতো এতো তল আর মোহনীয় চূড়া! চুর হয়ে থাকে সে চূড়ায় চূড়ায়, সমতলের, আজীবন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ