১.
অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ পড়তে পড়তে আমার ভেতর নতুনভাবে শিশু হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আমি শিশু হতে চাইছি— মানে নতুনভাবে জীবন শুরু করার তুমুল বাসনা নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকি; অফুরন্ত সময়ের যোগান আছে ভেবে সময়গুলো হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে দিতে ভাবি, এখনো বয়স হয় নি— আরেকটু বয়স হলে স্বপ্নের বীজ বোনা শুরু করব। নানাবিধ পরিকল্পনা করে রাখি— যেন পরিণত বয়সে তা করা যায়। সেনেকার মতে এক জীবনে মানুষের বিপুল সময়— কিন্তু, এই সময় আমরা অপচয় করতে করতে কখন যে জীবন ফুরিয়ে গেছে টেরই পাই না।
যতদিন বেঁচে থাকার দায় নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি আমরা— ততদিন-ই যদি পৃথিবীতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে নেমে যেতে পারি, এ আমাদের সময়ের প্রকৃত অপচয়। পৃথিবীর পথঘাট আমাদের মনে রাখবে— আমরা বেঁচে থাকব মানুষের হৃদয়ে। যেভাবে বেঁচে আছেন লুকিউস আন্নাইউস সেনেকা।
আমরা মূলত বাঁচি অন্যের জন্যে— প্রেমিকা কিম্বা বন্ধু’র জন্যে। নিজের জন্যে যদি বেঁচে থাকা যায়, এই পৃথিবী তার হবে। সময়ের অবক্ষিপ্ত অপচয়ের পেছনের মূল কারণ হচ্ছে — ‘সময়’ আসলে-ই কি জিনিস সেটা না জানা। এই করব সেই করব ভাবতে ভাবতে দীর্ঘ সময় কেটে যায়, কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আর পৌঁছানো হয় না। আদর্শ এবং সুন্দর জীবন-যাপনে প্রয়োজন কেবল নিজেকে জানা— পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সুচিন্তিত গঠন কাঠামো বিনির্মাণে মানুষের জীবন অত্যাধিক সুশ্রী হয়ে ওঠে। কেবল একটু বেঁচে থাকার আশা নিয়েই তো এত দ্বন্দ্ব-বিবাদ। কিন্তু সময় যখন পারিপার্শ্বিক সবকিছু উপেক্ষা করে জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হয়ে উঠবে, তখন-ই জীবনে সুস্থতার আশা করা যায়।
জীবনের প্রকৃত মানে কি? আমরা কেন এসেছি এই বৃত্তাকার পৃথিবীতে! এর মানে খুঁজতেই বহু পণ্ডিত বেরিয়ে পড়েন অজানার উদ্দেশে— লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন, দেকার্তে বা রাহুল সাংকৃত্যায়ন।
আমরা বেঁচে আছি— কিন্তু কেন বেঁচে আছি তা জানি না। আমাদের কেন বেঁচে থাকা প্রয়োজন তা ভাবার ফলশ্রুতি-ই মূলত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
২.
তৃণকুটিরে— অজস্র লাল-নীল স্বপ্ন সংরক্ষণ করে রেখেছি যেন আমার অবর্তমানে আমার প্রিয় বন্ধুটি তা পূরণে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। আমি জানি না কিভাবে তোমাকে প্লুত করা যায় বন্ধু— আমার কোনো বন্ধু নেই জেনেই কল্পিত মননে এক অদৃশ্য বন্ধু বানিয়েছি তোমাকে। যাকে শয়নে-স্বপনে অনুভব করা যায়৷
প্রিয় খেরোখাতা— যাপনের দিনগুলোতে ভাবছি তোমাকে উপহৃত করব, অজস্র উপভোগ্য মুহূর্ত।
জীবনের প্রারম্ভে প্রতিটি দিন পেরিয়ে যেত যেসকল বন্ধুদের সাথে— আজ তারা আর আমার বন্ধু নেই; আমি বদলে গেছি, আমার পরিবর্তিত চেতনা তাদের সঙ্গ পেতে নিরুৎসাহিত করে। আজ যারা বদলে যাবার কথা বলে, কাল থেকে নতুন সূর্য উদিত হবার কথা বলে বলে সময়ের সাথে মশকরা করে যাচ্ছে— তারা আমার শত্রু এবং আমি আমার শত্রু। বলে-কয়ে বদলে যাওয়া যাচ্ছে না কখনো— সময়ের ঘূর্ণনে, তোমার পারিপার্শ্বিকতা এবং জানাশোনার সীমাবদ্ধতা তোমাকে বদলাতে পারে বন্ধু।
আমি বদলাতে এসেছি এবার— এ আমার ব্যক্তিগত জীবন। অফুরান সময়ের এই আয়োজনে যদি কিছু না করেই চলে যাই আকাশে— কি জবাব দিব বলো!
৩.
আমার সেই গোবেচারা সাদাসিধে দরিদ্র বন্ধুটির সাথে বহুদিন পর দেখা হলে হতাশায় আচ্ছন্ন দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিতে নিতে আবেগ তাড়িত হয়ে নিজের বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতার কথা বলে এবং তুমুল মন খারাপ নিয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি কেবল তাকে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আরকিছুই খুঁজে পাই না— কেননা বিবাহ সংক্রান্ত বহুল অপকৃষ্ট চর্চিত সমাজে বড় হয়েছি আমরা। ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে ওঠা, মাদ্রাসার গণ্ডি পেরিয়ে’ও যারা বিপুল অর্থের লোভে মেয়ে’কে কোনো অসভ্য অর্থ-ধারী পুরুষের কাছে তুলে দিতে চায়। মূলত তারা তার মেয়ে’কে জীবিতকালে জাহান্নামে পাঠানোর সহজতর পন্থা অবলম্বন করে।
আমার দরিদ্র বন্ধুটি আধুনিক বিশ্বের নাগরিক হয়ে’ও চাকরির প্রতিযোগিতায় দৌড়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে দুপুরের রোদে আরো কতক সংখ্যক মানুষ যেই শতবর্ষী গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে চা-সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়ে ওঠে— সে মানুষের কোলাহলে নিরুত্তর চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাবার ভান করে, যেন মানুষেরা তাকে পাগল ভেবে বিরক্ত না করে।
একটি অবক্ষিত সমাজের রূঢ় চিত্র তুলে ধরতে চায় আমার বন্ধু— সে মেকানিজমের কথা বলে, অধুনায়তনের উদ্ভাবক হওয়ার প্রাদুর্ভূত ফ্যান্টাাসিতে ভোগে।
যারা ধর্মীয় সুফি, তারাই হয়ে ওঠে সমাজের হন্তারক— ধর্মের অবক্ষয় এদের দ্বারাই হয়ে থাকে বলে আমার বন্ধু’র অভিযোগ। আমি তাকে বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে ধৈর্য ধরার কথা বলি— কেননা, কুরআনে বলা হয়েছে—‘ইন্নাল্লা’হা মা’আস-সা’বিরী’ন’। আমার বন্ধু নিশ্চুপ হয়ে থাকে— মন খারাপ করে সে আবারও আমার চোখের আড়াল হয়, আমার বন্ধু আর কখনো আমার সাথে দেখা হলে বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে কথা বলবে কি না বোঝা যাচ্ছে না। আমি তার সাময়িক দুর্যোগের কথা ভেবে আকাশে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে দিই।
৪.
আমরা যখন নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলি— তখন আমাদের পারিবারিক টানাপোড়েনের কথা ভাবতে হয়, বাক-স্বাধীনতা-হীন রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের বিবেচনা মাথায় রেখেই বলতে হয় স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে— রাজনৈতিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে একজন সুনাগরিকের দায়বদ্ধতা, অধিকার কেড়ে নিয়ে মূলত সরকার বোঝাতে চান— তিনি বড্ড ক্ষমতাসীন; যদিও বিপক্ষ দল ক্ষমতায় আসলে তার লেজ গুটিয়ে পালাবার দিন আসে।
আমরা এরকম রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় নিজেদের ব্যস্ত রাখি যখন সন্ধ্যা পরবর্তী সময়ে সকলের কর্মবিরতি শেষে এনায়েত চাচার টংয়ে একত্রিত হই। কেউ আবার আড়াল থেকে প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠে— ‘এসব কথা কয়া কোনো লাভ নাই মিয়া ভাই’ কইলেও সাবধানে কন, সরকারি লোক থাকতে পারে আশেপাশে’ তার সতর্কবার্তা অবলম্বনের চেষ্টা করি আমরা— আমাদের দারাজ কণ্ঠ তখন আমাদের কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই ক্লান্ত হয়ে উঠে; রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলা যেখানে গুম হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে— সেখানে এতো কথা না বলে নিজের কাজে মনোযোগী হওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।
আমরা আরও দেখি কিভাবে একজন ইমাম নানানরকম কুকীর্তি করেও মানুষ’কে ভালো হওয়ার বয়ান করছে— একজন হিফজখানার শিক্ষক কোমলমতি শিশুদের বলাৎকার করেও কুরআনের তা’লিম দিয়ে যাচ্ছে। কিম্বা বাবা দ্বারা মেয়ে ধর্ষিত হয় এবং তরুণ-তরুণীদের প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্ক ভেঙে গেলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
মূলত রাষ্ট্রের অবকাঠামো এবং আইনি অনুশাসনের বিলুপ্তি ঘটে গেলে এরকম নানাবিধ আলোচনা, ঘটনা পত্রিকার পাতায় দেখা যায়। আরও বহু বিষয়ে আলাপ-আলোচনার কথা উঠলে আমার কবিবন্ধুটি নীরব থাকার পরামর্শ দেয়, বিপ্লবী হয়ে ওঠার মনোভাব পরিত্যগ করতে বলে— কেননা বিপ্লবী হয়ে এখন আর কেউ বিপ্লব ঘটাতে পারে না। কিছু হয়ে ওঠার আগেই তার নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পায় দৈনিক পত্রিকার বিজ্ঞাপন পৃষ্ঠায়, শহরের গলিপথে, পোস্টারের দেয়ালে দেখা যায় নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি।
৫.
যারা সমাজ বিবর্তনের নামে ‘ন যযৌ ন তস্হৌ’ ধারার কথা বলে— কর্তব্য স্হির করতে না পারার দরুন স্হির হয়ে থাকতে হয়— মুখ বুজে সয়ে যেতে হয় সমাজে চর্চিত নীতিবিরোধী সমস্ত কার্যকলাপ। যখন মার্কসবাদ কিম্বা লেনিন-বাদের সমর্থক হয়ে ওঠা একজন যুবা’কে প্রশ্ন করা হয়— ‘আপনি কেন সমাজের বিপক্ষে অবস্থান করছেন’? যুবা বলে ‘আমাদের সমাজব্যবস্থা কিম্বা সামাজিক অবকাঠামো মানুষের কোনো পরিবর্তন করতে পারে না এবং এই অ-সুষ্ঠু মতাদর্শ আমার মনঃপূত নয়’।
ইউক্যালিপটাসের ফুল— শৈশবে চরকি বানিয়ে খেলতাম আমরা; ইউক্যালিপটাস গাছ দেখলেই মনে হতো— আহা কি বিশাল, যেন আকাশ ছোঁয়া। আমাদের সমাজের কূপমণ্ডূক মানুষগুলোর অবস্থান ইউক্যালিপটাসের মতো-ই। যখন একজন গ্র্যাজুয়েটেড ব্যক্তি’কে জিজ্ঞেস করা হয় ‘এইযে অরাজকতার বিস্তার পৃথিবীময়— এর দায়ভার আপনি কার উপর চাপিয়ে দিতে চান মহাশয়’? তখন তিনি মাথা চুলকাতে চুলকাতে মানিব্যাগের ভেতর থেকে চেপ্টে যাওয়া একটি স্টার সিগারেটে আগুন জ্বালিয়ে ফুঁকতে থাকেন।
এইসব অহরহ বিচার-বিশ্লেষণের দ্বারা বা নানারকম কথাবার্তা বলে সমাজের কোনো সমস্যা দূরীভূত করা সম্ভব নয় কখনো। প্রথমত রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন, সমাজের চর্চিত সমস্ত নীতিবিরুদ্ধ কাজের বিলুপ্তি, ছেলেপেলেদের ধর্মীয় মূল্যবোধ কিম্বা সমাজ পরিচালনা’র সুষ্ঠু শিক্ষা এবং পারিবারিক শিক্ষা’র সমন্বয় কমিটি গঠন করার দ্বারাই হয়তো দেশ, সমাজ এবং সর্বোপরি মানুষের চেতনা স্বচ্ছ হতে পারে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু, নানা মুনির নানা মতের এই সমাজ বিবর্তনের দরোজা খোলা আমাদের দ্বারা হবে না— লেখক এবং কলামিস্টগণ শুধু কলমের খোঁচায় খোঁচায় পত্রিকার পাতায় বড় বড় বুলি আওড়াতে পারবেন— কিন্তু কোনোরকম মানববন্ধনে তারা অংশীদার হতে রাজি না।
এভাবেও বলে রাখা ভালো। যার যার বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবো। এতকিছু না ভাবলেও চলবে।
৬.
ইট’স আ কুয়াইট সিম্পল ম্যাটার টু মি ম্যারি সেইম এইজ গার্ল, অ্যান্ড আই ওয়ান্ট দ্যাট টাইপ অব ইনডিভিজুয়াল। এই রীতিতে বিশ্বাসী হওয়ার তেমন অন্তর্নিহিত কোনো কারণ নেই। আমি মনেপ্রাণে চাই— তুমি আমার সঙ্গী হও৷ আমার চিন্তা-চেতনার সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে, আমার মতাদর্শ তোমার ভেতর লালন করলে আমার ভালো লাগবে না। সমজাতান্ত্রিকতার ঝাণ্ডা উড়িয়ে আমি তোমাকে বলতে পারছি না— এই সমাজ আমাকে কিছু না কিছু উপহৃত করেছে। দেখো, বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে আমার যেই বন্ধুটি’র কথা আমি পূর্বে বলেছিলাম— তার পেছনে কিন্তু সমাজতান্ত্রিকতার উদ্ভট মিথ রয়েছে— বহুবছরের একঘেয়ে কুসংস্কারের ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি ধোঁয়াচ্ছন্ন আকাশ।
পিতা- মাতাদের চিন্তা-দর্শন আর আমার শোষণ উৎপীড়নের মাধ্যমে যেই মস্তিষ্ক ভিন্নভাবে ভাবতে শিখেছে— অন্য দশজনের মতো করে ভেবে উঠতে পারে না— তাকে আর কিভাবে বুঝানো যায়! আমাকে যদি বলা হয় ‘আপনি কত বছর বয়সী কিম্বা কিরকম চিন্তার তরুণী’কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চান’? আমার উত্তর সেই একই— আমার সমবয়সী, বয়সে বড়ো হলেও কোনো সমস্যা নেই৷ আমার আদর্শ তার মনে লালন করলেই হয়৷ আমার মতো করে ভাবতে শিখলেই আমি তাকে সাদরে গ্রহণ করছি। —বাহ্ বাহ্, আপনি তো মারাত্মক বললেন ভাই! লোকটি যখন আমার উত্তর না বুঝেই এরকম কথা বলে— তখন আমার ইচ্ছে হয়, তাকে কষে একটা চড় মারি— কেননা, নির্বোধ মানুষদের আমি কখনো পছন্দ করি না।
আমরা যেসমস্ত সামাজিক কুসংস্কারের দেখে দেখে বড়ো হয়েছি— তার মধ্যে এটাও একরকম অপরিবর্তিত কুসংস্কার। ছেলের চাকরি নেই, বেকার— বিয়ে করে খাওয়াবে কি! অথচ আমার বেকার বন্ধুটি আজ এক সন্তানের জনক৷ তাহলে এর প্রেক্ষিতে সেইসব পিতা-মাতাগণ কি উত্তর দিবেন!
আমি মূলত যা বলতে চাইছি— বিবাহ সংক্রান্ত সমস্ত জটিলতার পেছনে, অর্থাৎ অর্থ- সম্পদের মাপকাঠির ভিত্তিতে যুবাদের বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া দেখতে থাকা আমার মতো নিরীহ তরুণ’কে চিন্তিত করে তোলে। হতে পারে— ভালো কোনো চাকরি কিম্বা আবাসস্থল না থাকায় আমি আমার প্রেমিকা’কে হারিয়ে ফেললাম; এরচে নিদারুণ বাস্তবতা আমাকে যেন দেখতে না-হয় সেজন্যই মূলত এতো এতো সতর্কসংকেত।
৭.
তুমুলভাবে হেনস্থা করা হলো সেইসব বৃদ্ধ উন্মাদদের— যারা স্বপ্ন এঁকেছিল পুরোনো দেয়ালের গা ঘেঁষে; তারা কেন পরিবেশ দূষণ করছে, ফুটপাত ধরে মানুষের হাঁটতে কষ্ট হয়, বমি হয়। এই সম্বন্ধ নানান অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’র কাছে করা হলে— তারা দলবল এসে হাজির হয়, বৃদ্ধ উন্মাদদের বকা-ঝকা আর মেরে-ধরে শহর থেকে বিতাড়িত হতে বলা হয়। কিন্তু, উন্মাদেরা যাবে কোথায়! তারা উদ্বাস্তু— শহরের ফুটপাত, পার্কের বেঞ্চি, টার্মিনাল, স্ট্যাশন-ই তাদের অস্থায়ী আবাসস্থল।
সহায়সম্বলহীন বৃদ্ধা মা— অপুষ্টিতে ভোগতে থাকা তার সন্তানের দিকে চেয়ে চেয়ে চোখের অশ্রু মুছে। কিছু না খেতে পারার বেদনা এমন-ই অসহনীয়; তখন নিরুপায় হয়ে মা ডাস্টবিন থেকে বেছে বেছে খাবার সংগ্রহ করে নিজে এবং সন্তানদের ক্ষুধা নিবারণ করে।
আমি বৈষম্য দেখি— মানুষে মানুষে বৈষম্য; কেউ খাবার নষ্ট করছে, আবার কেউ সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খাচ্ছে কেবল না খেয়ে মরে যাওয়ার ভয়ে— তবুও মানুষের বেঁচে থাকা কি দুর্বোধ্য। আমরা সুস্থভাবে বেঁচে আছি বলে অ-সুস্থ, উদ্বাস্তু মানুষদের উপেক্ষা করে চলি। যদি এমন দিন আমাকে দেখতে হয়, তোমাকে দেখতে হয়— তাহলে ধরে নাও; সেইসব উন্মাদদের মতোই আমাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হবে।
এখনো তো বিপুল সময়— একটি জীবনে মানুষদের ভালোবেসে তাদের মনে বেঁচে থাকো বন্ধু।
৮.
আমরা আত্মহত্যার বিপক্ষে অবস্থান করছি— কিন্তু আত্মহত্যার নেপথ্য-কারণ খুঁজতে আমরা নারাজ। আপাত দৃশ্যমান হলেও কেন এতো এতো আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে— এর কারণ কী, সেইসব খতিয়ে দেখা সময়ের দাবি বলে মনে করছেন এনায়েত সাহেব। তারা দু'পক্ষ-ই সন্ধ্যার পরপর মনসুরের চায়ের দোকানে বসে এবং তুমুল তর্কবিতর্ক শুরু হয়। আমি নীরব দর্শক এবং শ্রোতা।
আমার পর্যালোচনায় বলতে গেলে— আত্মহত্যা মহাপাপ। এই পাপের কোনো ক্ষমা নেই। কিন্তু, এইসব ছুঁড়ে ফেলার মতোন বিষয় নয়৷ আত্মহত্যার পক্ষে অবস্থানকারী লোকটি হেরে যাওয়ার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলে আমাকে প্রশ্ন করে বসে ‘ আপনি কী আত্মহত্যের পক্ষে না বিপক্ষে’? আমি সম্পূরকভাবেই আত্মহত্যার বিপক্ষে— কেননা, নিজেই নিজেকে মেরে ফেলা কোনো যৌক্তিকতা নাই। আমাদের যিনি সৃষ্টি করেছেন— এটা তার অধিকার।
এই অবশ্যম্ভাবী দিনের অপেক্ষায় থেকে থেকে বড্ড ক্লান্ত লাগছে— তোমার হাতের পেয়ালা রেখে দাও টেবিলে, জীবন-জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে আমি উদাসীন— এই পেটপুরে খাওয়ার চিন্তা না থাকলে মানুষের জীবনে কি ঘটে যেতো— তা আমাকে ভাবায়। এনায়েত সাহেবের পক্ষে-বিপক্ষের ধাবমান হওয়ায় আমি দুলছি। কেন যেন মরে যেতে ইচ্ছে হয়— কেবল প্রতীক্ষিত সন্ধ্যায় উষ্ণ চায়ের ধোঁয়া’র মতোন, আমার আত্মা উড়ে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
এই সমূহ বিপন্নতা, তাড়িত ভাবনায় কেন মানুষ দুশ্চিন্তিত হয়ে যাচ্ছে— কেন এতো এতো সতর্কসংকেত জানানোর পর’ও মানুষ এরকম অর্থহীন পথ বেছে নিচ্ছে— তা ঠিক বুঝে ওঠা সম্ভব নয় বলেই প্রায়শই উচ্চারিত হয় মানবতার স্লোগান। আমি কেন এমন একটা কথার ভেতর ডুবে গেলাম— আমি কেন চুপসে গেলাম, নানান প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে আধো খাওয়া চায়ের কাপ ফেলে উদাসীন হেঁটে আসি— এনায়েত সাহেব বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার ফলস্বরূপ তার প্রতি করুণা হয় আমার। অন্যকোনো দিন আমরা আত্মহত্যা’র পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতিতে তার চোখে হাসি ফুটে ওঠে।
0 মন্তব্যসমূহ
অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।