....

কোথাও ফিরবার তাড়া নেই | মাহমুদা আহসান



আমি হয়তো বেঁচে নেই, কিংবা রোজ মরতে মরতে বেঁচে যাই। বর্ষাবেলায় যখন একপশলা বৃষ্টিতে কদমের পাপড়িগুচ্ছ ঝড়ে পড়ে, আমি তখনও বেঁচে উঠি কোনভাবে। কোন এক প্রেমিক সে বৃষ্টিচিহ্ন নিয়ে প্রতিক্ষায় থাকে। প্রতিক্ষায় কত কাল - পক্ষ চলে যায়। যেন প্রেমিকের ছোঁয়াবিহীন হাঁসফাঁস লাগে আমার। মরতে মরতে বেঁচে যাই সে যুবকের স্পর্শে। সেদিন পাশের টঙঘরে বসে সিগ্রেট টানছিল সে। ভেঁজা পাপড়িতে আটকে গেলো আমার চোখ। কত যত্নে ছুঁয়ে দিচ্ছে ধোঁয়া— যেন আমাকেই! ভেবে বেঁচে উঠি। উপেক্ষিত হয়েও যুবকের চোখে তৃপ্তি নিয়ে আসি। ক্লান্তি ভর করলে চোখে শরতের কাশবন ভেসে ওঠে। শুভ্রতা কেমন দুলিয়ে দুলিয়ে নাচে! আর ওখানে ঝড়ো হাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হতে হতেই বেঁচে থাকে একটি মেয়ে। রুক্ষ চুলগুলোকে সামলানোর তাড়া নেই যেন। আপন মনে গেয়ে যাচ্ছে মাস্টার মশাইয়ের শেখানো সেই ছড়া—

পুচ্ছ তোলা পাখির মতো

কাশবনে এক কন্যে,

তুলছে কাশের ময়ূর–চূড়া

কালো খোঁপার জন্যে।

 

বাঁচতে বাঁচতে হেঁটে চলি। উদ্দেশ্যহীন এ পথ চলায় বিকেলের ডাক পড়ে। আমার বিষন্ন বিকেলগুলো গোধূলিতেই ধোঁয়াটে আঁধার নামিয়ে আনে। অন্ধকার হাতড়ে বাঁচার আকুতিতে হারিয়ে যাই। জ্যোৎস্নাবিহীন আকাশেও স্বাতী নক্ষত্রের পাশে একটুখানি জায়গা নিয়ে বেঁচে উঠি। আমায় বাঁচিয়ে রাখতে আকাশের কত চেষ্টা!


মোটা ফ্রেমের ফাঁকে ইতিউতি হারিয়ে যাওয়া শব্দ খুঁজতে মরিয়া হই। শব্দেরা এক কদম এগুতেই হাজার ক্রোশ দূরে ছুটে যায় অক্ষর। শব্দ আর অক্ষরের এ স্নায়ুযুদ্ধে অবসাদ নেমে আসে কালিতে। ক্লান্তি থেমে যায়। বাড়ে প্রতিক্ষা। আরেক স্বাতী নক্ষত্র লগ্নের অপেক্ষায় সে প্রতিক্ষা। আমায় যে বাঁচতে হয়। এভাবেই বাঁচতে বাঁচতে ফিরে আসি বহু প্রত্যাশিত এক কাব্য হয়ে।


বেঁচেই ছুটে চলা ফের। ছুটছি অন্তহীন— কুয়াশার পাশ কাটিয়ে। পিচের রাস্তার ধার ঘেঁষে নৈঃশব্দ্যের আনাগোনা হয়! নৈঃশব্দ্যের শব্দ থাকে নাকি? যেন-বা সেই শব্দই দূর হতে ভেসে আসে দাবানলের শিখায়। আর্তনাদ করে। কুয়াশা মিলিয়ে লোমকূপ হতে বেরিয়ে আসে দু'এক ফোঁটা মুক্তোর মতো ঘাম। পাশের ডাস্টবিনে বসে মুখ হা করা কুচকুচে কালো কাকটার অসহায়ত্ব রেখেই ছুটে চলছি আবার।


কখনো নিস্তব্ধতা নেমে আসে হাওয়া জুড়ে। তখন অবহেলিত আত্মার আর্তনাদ ভেসে বেড়ায়। আমিও ভাসছি টুকরো খরকুটোর মতন। হাওয়ার স্রোতেই বাঁচতে হয়। মরতে মরতে বেঁচে যাই শালিক হয়ে। ডানা ঝাপটিয়ে ছুটে চলি উদ্দেশ্যহীন। গন্তব্য কোথায়!


আলোহীন পূর্নিমা দেখার স্বাদ জাগে! তাকিয়ে থাকি তারাহীন আকাশের দিকে। সুনসান নীরবতা ভেঙে পাশের হিজল ডালে ডেকে ওঠে শালিক। ডানা ঝাপটিয়ে ছড়িয়ে দেয় নিঃসঙ্গতার  রহস্যময়তা। শূন্যতার গান ভেসে আসে আঁধার হয়ে। আঁধারের গর্জনে ফোঁটায় ফোঁটায় স্পর্শ মাখি। নেমে আসে বর্ষণমুখর সন্ধ্যা। নির্বিকায় দাঁড়িয়ে নিসর্গ আকাশ দেখার ভাবনা বাঁচিয়ে রাখি। আনন্দ হয়! আনন্দের কাছে ছাড়া— কোথাও ফিরবার তাড়া নেই...


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ