বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির এই বাংলাদেশে বারোমাসে বারো রূপ থাকে। এই রূপে মজে মানুষ ভাবুক হয়, কবি হয়, উদাস হয়— আরও যে কত কী!
কবিগুরু লিখেছিলেন, "বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে"। বৈশাখে কেন হাঁটুজল থাকে! চৈত্রের খরায় ছোট নদীটির জল শুকিয়ে যায়, চৈত্রের শেষে বা বৈশাখের শুরুতে ঝড় হয়, সেই ঝড় এমন ঝড় যে তাকে কালবৈশাখী বলে। কেন কালবৈশাখী ঝড় বলে? কাল অর্থ সময়, যুগ, অবসর, ক্রিয়ার কাল। একটি বর্ণ বা রঙের নামও কাল। আবার যম-কে কাল বলে, সর্ব্বনাশের কারণ যে সেটাও কাল। যে ঝড় সর্ব্বনাশের কারণ হয়, তাকে কালবৈশাখী ঝড় বলে। তো ঝড়ের সময় কেবল আম পড়ে তাতো নয়, বৃষ্টিও পড়ে। সেই বৃষ্টির জল শুকনো নদীতে জমে জমে হাঁটু জল হয়, সে জলে ছেলেরা আনন্দে মাছ ধরে।
হাঁটুজল যখন ডুবজলে গড়ায় তখন সাঁতার জানা জরুরী যদি কেউ ওই জলে নামতে যায়। কারণ ডুবজল হচ্ছে গভীর জল, যে জলে মানুষ ডুবে যায়। ‘ড’ বর্ণের অর্থ ডয়ন, ডয়নের লতার মতন গড়ায়, আবার উড়ায়। ডয়ন যখন নবরূপে পাল্টে গিয়ে উপরের দিকে হয় তখন তা উড্ডয়ন হয়। উড্ডয়ন-এর ডয়ন আবার নীচের দিকে নবরূপে পাল্টে গিয়ে হয় ‘ডু’; ডুব = অব-ডয়নকে নহন করে যে। অর্থাৎ ডয়নের অবগমনকে (এটা নিম্নগতিপ্রাপ্ত নবরূপ) উদলোকের উল্টো অবলোকের অভিমুখে ডয়িত করছে। ডু-কে বহন করে ডুব শব্দটি। ডুবে ডুবে জল খায় যে সে গভীর জলের মাছ, আবার ধরা পড়লে ডুবজলে এমন ডুব দেয় যে খুঁজে পাওয়া যায় না, কী করে পাওয়া যাবে! ডুব অর্থ নিমজ্জন,অবগাহন, স্নান। ডুব দিলে আড়াল হয়, লুকানো হয়; তাই ডুব দিয়ে জল খেলে কেউ দেখে না। ডুব দিয়ে জল খেতে থাকলে হয় ডুবে ডুবে জল খাওয়া, মানে লুকিয়ে লুকিয়ে জল খাওয়া। এর প্রকৃত মানে চুপিসারে লুকিয়ে কোনকিছু করা।
ডুবজল তো গভীর জল, এই জল যদি মানুষ হয় তবে ডুবমারা হবে অনেক মানুষ ভীড়ে লুকিয়ে থাকা, কারণ ডুবমারা অর্থ লুকিয়ে থাকা, আড়াল হওয়া। যে গর্ত্তে বর্ষায় গভীর জল থাকে, তাকে বলে ডোবা। ডুব দিতে যে পটু, তাকে বলে ডুবুরী। ডুবুরীরা গভীর জল থেকে মনিমুক্তা খুঁজে আনে। ডুব দিয়ে স্নান করে, ডুব এর সার্ব্বিক আশ্রয় ডুবা, অর্থাৎ যে আধারে ডুব দিলে আংশিকভাবে নয়, পুরোপুরিভাবে ডুবে যাওয়া যায়। ডুবা অর্থ জলে নিমগ্ন হওয়া, প্লাবিত হওয়া। পানীকৌড়ী পাখীর নাম ডুবারু, কারণ সে ডুব দিতে জানে। যখন পুরোপুরি ডুবে না, তখন ডুবুডুবু অবস্থা হয়, আর এই অবস্থা হলে মানুষ হাবুডুবু খায়। গড়ান-উড়ানশীল ডয়নী সত্তা উল্টোমুখো হলে, সে জলে ডোবে, রসে ডোবে, গল্পে ডোবে, গানে-প্রেমে-ভাবে ডোবে, ভোগরসে ডোবে। মানুষের নাম-যশও ডোবে। ডুব এর সার্ব্বিক বিকাশ ডোব। কোন কোন ডোব বিলুপ্তির সমুদ্রে ডোবে, যেমন ব্যবসা ডোবে, চাঁদ ডোবে, গৌরবের সূর্য্য ডোবে।
ডুব নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতাটি মনে আছে তো!
ওই যে—
"চুপ চুপ - ওই ডুব
দ্যায় পান্ কৌটি
দ্যায় ডুব টুপ টুপ
ঘোমটার বৌটি"।
0 মন্তব্যসমূহ
অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।