....

ঋতব্রত'র প্রিয় কবিতারা : জানুয়ারি ২০২১ | হিম ঋতব্রত




১.

'ঋতব্রত'র প্রিয় কবিতারা' নামে এই-যা হাবিজাবি লিখছি, তা কে কিভাবে নিচ্ছেন জানি না। তবে আমার কাছে ভালোই লাগছে। যদিও লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত হচ্ছি, মনে হচ্ছে ধুর এসব আজুরে, ভ্যাজালে গদ্যের প্যাঁচাল লিখে শুধুশুধু সময় পার করছি। কিন্তু লেখাটি একেবারে শেষ করে যখন পড়ছি তখন বিষয়টি দারুণ উপভোগ্য হয়ে ওঠছে।

আদতে আমি গদ্যে অতটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না, যতটা স্বাচছন্দ বোধ করি কবিতায় ও আঁকায়। যদিও অনেকেই বলে থাকেন গদ্য লেখাটা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়, একটু পরিশ্রম করলেই গদ্য লেখা যায়। যাক সেসব কথা!

এই 'ঋতব্রত'র প্রিয় কবিতারা'য় এবারও প্রিয় কবি ও কবিতা নিয়েই লিখবো তবে তার সাথে একটু ভিন্ন ও ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতাও শেয়ার করব।


২.

তখন ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়, হুট করে আমার আর এলিনার তুমুল প্রেম ভেঙ্গে গেল। আরসব সাধারণ প্রেম যে কারণে ভাঙ্গে আরকি সেরকমই;— অই কিছুটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং বা মানুষ যে বহুগামী (এই তথ্য ভুল মনে করে নব্য প্রেমিক-প্রেমিকারা) এসব কারণেই। যাক সেসব কথা না বলাই শ্রেয়।

পুরুষের ক্ষেত্রে ব্রেকআপের পর প্রথম কয়েক দিন খুব ভালো লাগে। তারপর যত অশান্তি— প্রেমের সুখময় সময়, প্রেমিকার চলন-বলন-ভাব-ভঙ্গি-শারীরিক বিষয়াদি ইত্যাদি সমস্ত কিছু মগজের ভেতর পাক খেতে থাকে আর উনুনের তাপে ফুটন্ত জলের মতো টগবগ করতে থাকে।

দিন দিন প্রেমিকার প্রতি তীব্র ঘৃণা, আক্রোশ ক্রোধ, দুঃখবোধ, হতাশা ইত্যাদি আরও বাড়তে থাকে। এক সময় এতটাই খিটখিটে মেজাজ হয় যে প্রেমিকার সমস্ত কিছুই যেন গা-জ্বালার উপাদান হিসেবে তৈরি হয়।
তারপর প্রেমিকার স্মৃতি-টিতি, উপহার-টুপহার যা আছে তা নষ্ট করে, অথবা ছবি-টবি থাকলে ছিঁড়ে বা পুড়িয়ে বা সেই ছবির ওপর পেচ্ছাপ করেও গায়ের ঝাল মেটানোর একটা ব্যার্থ উপায় করা যায়!

আমার নিজের ক্ষেত্রেও এমনই ঘটেছে। মোবাইলে এলিনার কিছু ছবি ছিল— একদিন সেসব প্রিন্ট করে, ছিঁড়ে কুটিকুটি করে, দিয়াশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। তাতেও কি মন হাল্কা হয়েছিল? যাক সেসব যত্তসব পাগলামো ব্যাপার-স্যাপার। তবে মজার ব্যাপার হলো এই যে প্রেমে ব্যার্থতা, উপহার নষ্ট করা, ছবি-টবি পুড়িয়ে ফেলা ইত্যাদি সমস্ত বেদনা নিয়ে সেসময় লেখা হয়েছিল 'ছবি পোড়ানো' নামে একটি কবিতা।


ছবি পােড়ানাে

—এই যে ভাই শুনুন,
দেখছেন তাে ছবিটা কত সুন্দর!
কত সুন্দর ঠোঁটের হাসি ।
ফর্সা দেহের রঙ, যেনা সত্যিকারের অপ্সরা।
এই ছবিটা প্রিন্ট করে দেনতাে?

—হমম... আসলেই তাে
সত্যিকারের হুর যেন
এই পৃথিবীতে এসেছে।
এই নিন প্রিন্ট।

—মু! হা! হা! হা...

—আরে ভাই এত সুন্দর ছবিটা ছিঁড়ছেন কেন?
আরে আরে আগুন ধরালেন যে ?

—আরও কয়েকটা ছবি প্রিন্ট করেন,
আমি কিছু দিয়াশলাই নিয়ে আসি।


তারপর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে লিটলম্যাগ 'উত্তরা এক্সপ্রেস' এর দ্বিতীয় সংখ্যায় আমার একগুচ্ছ কবিতার সাথে এই কবিতাটিও ছাপা হলো। ছাপার পর কবিতাটি সম্পর্কে অনেকের কাছ থেকে পাওয়া প্রশংসা বাক্য, নিজের ভাললাগা, আবেগ ইত্যাদি সব মিলিয়ে ভাবলাম কখনও বই করলে কবিতাটি বইয়ে রাখবো।


৩.

তারপর এই কবিতা প্রকাশের প্রায় মাস-ছয়েক পরের কথা। হঠাৎ একদিন আড্ডায় শাবাব ভাই(কাজী শোয়েব শাবাব) অথবা সমতোষদা(সমতোষ রায়) আমাকে বললেন,— 'ছবি পোড়ানো' নামে তোমার যে কবিতাটি ছাপা হলো, এর সাথে অনেকাংশে মিল আছে এরকম একটি কবিতা পড়লাম কবি ওমর আলীর।


একদিন একটি লোক

একদিন একটি লোক এসে বললো ‘পারো?’
বললাম, ‘কি?’
একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে, ‘সে বললো আরো।’
‘সে আকৃতি
অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে—
পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।’
‘কেন?’ আমি বললাম শুনে।
সে বললো, ‘আমি সেটা পোড়াবো আগুনে।’'


কবিতাটি পড়ে আমি অবাক! এ কিভাবে সম্ভব? এই কবিতার থিম আর আমার লেখার থিম প্রায় হুবুহু একই।

অথচ ২০১৮ সালেও আমি ওমর আলীকে পড়িনি। এমনকি হাস্যকর মনে হলেও সত্যি যে— আমি তখনও জানতামই না যে ওমর আলী নামে একজন বিখ্যাত কবি আছেন! 'উত্তরা এক্সপ্রেসে'র দ্বিতীয় সংখ্যায় যেখানে  আমার 'ছবি পোড়ানো' কবিতাটি ছাপা হলো সেই সংখ্যাতেই কবি ওমর আলীর ৭টি কবিতার পুনর্পাঠও ছাপা হয়েছিল এবং সেখানেই আমি কবি ওমর আলীকে প্রথম পড়ি। এবং কবিতাগুলোও আমার ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু কবিতার ভেতর এরকম একটি কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে যাওয়ায় আমার ভীষণ আফসোস হয়! মানে আমার বিষয়টি হয়েছে এমন যে— কোনও বিজ্ঞানি বিজ্ঞান সম্পর্কে নতুন কিছু আবিষ্কার করলেন এবং তা ছড়িয়ে দিলেন সবার মাঝে। আর ছড়ানোর কিছুদিন পর দেখলেন এ আবিষ্কার আদতে নতুন কিছু নয় বরং বহু আগেই তার অগ্রজ কেউ এই আবিষ্কার করে গেছেন।
যাক আফসোস করে আর কি হয়! তাই পরে ভাবলাম যদিও বিষয়টি দুঃখের তবুও হয়তো শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে এমন মিল হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপারই বটে। কারণ আমি তো পূর্ববর্তীদের পথেই আছি; তাহলে তাদের সাথে আমার লেখা, চিন্তা ও দর্শনের ক্ষেত্রে এরকম মিল হতেই পারে; তবে নিজের কাছে সৎ থাকাটাই ভীষণ জরুরী। কারণ যখন কেউ পূর্বপ্রকাশিত কোনও লেখাকে অসৎ ভাবে বা জেনেশুনে ইচ্ছাকৃত ভাবে মুদ্রণ করবেন তখন সেটা তো অনুকরণ বা চুরি বলা চলে।


৫.

যেহেতু শ্রদ্ধেয় প্রায়ত কবি ওমর আলীর কবিতার সাথে আমার কবিতার একটা কাকতালীয় সংযোগ ঘটে গেছে; তাই তাঁর কবিতা আরও বেশি ভালো লাগতে শুরু করলো। পরে 'এদেশের শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি' বইটি পড়লাম। অসাধারণ একটি বই। এটিই কবির প্রথম বই, প্রকাশ কাল ১৯৬০ এবং বইটি বাংলা কবিতার অন্যতম বইয়ের একটি। এই বইয়ের জন্য কবি বাংলা একাডেমি পুরুস্কারও পেয়েছিলেন।
পরে আমি ভেবে দেখলাম— যেহেতু বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে, সেহেতু কবিতাগুলো আরও কিছু সময় আগে লেখা হয়েছিল এই ধারনা করাই যায়।
অর্থাৎ তিনি যেরকম কবিতা লিখেছেন প্রায় ৬০ বছর আগে আর আমি প্রায় সেরকমই কবিতা লিখেছি প্রায় ষাট বছর পরে। তাহলে চিন্তার দিক দিয়ে তাঁর চেয়ে কতটা পিছিয়ে আছি— একবার ভাবুন!
এবং আরো গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এ-ই, দেখুন তাঁর কবিতার শক্তি কতটা প্রবল! প্রায় ষাট বছর আগে লেখা কবিতা, এই আজকেও কতটা প্রাসঙ্গিক এবং বর্তমান। এখনকার বা ভবিষ্যতের প্রেমিকেরাও যা ভাববেন তা তিনি কত সুন্দর উপস্থাপন করে গেছেন এই কবিতায়।
আদতে প্রকৃত কবির শক্তি এখানেই, প্রকৃত কবিতার শক্তিও এখানেই। যা যেকোনও সময়েই প্রাসঙ্গিক ও বর্তমান, মোট কথা যা সময়কে উতরে যায়।

পরে আরও কিছু কবিতা পড়ে ওমর আলীর কবিতার প্রতি ভালোলাগা আরও বাড়তে থাকে। শেষে তাঁর কবিতা সমগ্র পেয়ে যাই। আর সমগ্র পড়ে ঋতব্রতর প্রিয় কবিতাদের ভেতর ওমর আলীর আরও কিছু দারুণ কবিতা যুক্ত হয়ে যায়। সেসব নিয়ে পরে কখনও লেখা যাবে।

শেষ কথা: যদিও আমি 'ছবি পোড়ানো'  কবিতাটিকে বাতিল ঘোষণা করেছি। কিন্তু প্রকৃত সত্য এ-ই, মনে এখনও কবিতাটির রেশ থেকে গেছে; যা হয়তো কখনোই— কিছুতেই বাতিল হবে না এখান থেকে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. সাবলীল কথন। ভাল লাগল। যদিও গদ্য না পদ্য পড়লাম কিছুই বুঝলাম না।

    উত্তরমুছুন
  2. একদিন একটি লোক এসে বললো ‘পারো?’
    বললাম, ‘কি?’
    একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে, ‘সে বললো আরো।’
    ‘সে আকৃতি
    অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে—
    পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।’
    ‘কেন?’ আমি বললাম শুনে।
    সে বললো, ‘আমি সেটা পোড়াবো আগুনে।’'

    উত্তরমুছুন

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।