....

দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে

আহমেদ মওদুদ
ছবি: আন্তজাল থেকে গৃহিত

১৫.
আবার মৌসুম এলো কবিতা লেখার। নিজেকে আড়াল করে সাদরে সাজিয়ে রাখো কবিতার খাতা। পথিকের পদছাপ ছাপা হোক এই মৌসুমে। পথিকের পদধুলি ধূসর কাগজ জুড়ে জীবনের চিহ্ন এঁকে দিক, কবিতা হয়ে। যেহেতু মৌসুম এলো কবিতা লেখার, কালিতে কলম রাখো। মগজে মজিয়ে রাখা কথা, স্মৃতি, বিস্মৃতির বেদনা, ধার ও দেনা, হতাশার সারি নিশ্চিন্তে সাঁতার দিবে কাগজের কুল ঘেষে ঘেষে। ও কবিতা, হৃদয়ের হ্রদে হ্রদে বয়ে যাওয়া নিভৃতির নির্যাস, এবার মৌসুমে তুমি ধরলার ঢেউ হও- কেউ হও ইতর আত্নার। আত্নায় আত্নস্থ কর উত্তরের হাওয়া আর দক্ষিণের দরিয়ার উচ্ছাস। উচ্ছসিত হওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখো অবিরত রাখো খাতা খোলা, গোলা ভরা ধান আর গাভীর ওলান ছাপা হোক এই মৌসুমে।
১৬.
রাখালকে গরুর পাল নিয়ে যেতে দাও। দূরে, কোথাও তার জন্য বিস্তীর্ণ মাঠ আর গরুর জন্য সবুজ ঘাস অপেক্ষা করছে। তোমরা অপেক্ষা করো গোধূলির জন্য যখন ফিরবে রাখাল গরু আর ঘাসের অতীত নিয়ে। কিন্তু রাখালকে কোন প্রশ্ন নয়। কারণ তার হাতে উত্তরপত্র থাকে না, থাকে বাঁশি আর সবুজ মাঠের মানচিত্র। চিত্র সমালোচনায় তোমরা তার সহযোগী হতে পার কিন্তু কোন প্রশ্ন করোনা তাকে। প্রশ্নকর্তার বেশে তোমরা দেখছি সারিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছ রাখালের পিছে পিছে-রাখাল যেমন গরুর পেছনে। রাখাল এবং গরু যে যার জায়গায় সন্তুষ্ট। একমাত্র অসন্তুষ্ট তোমরা, যারা উত্তরকে পেছনে রেখে প্রশ্নের পাহাড়ে লুকিয়ে রাখো নিজেদের। তোমাদের লুকানোর কোন জায়গা নেই পৃথিবীতে! তাহলে তোমরা লুকিয়ে যাও গরুর পালে পালে আর বিশ্বস্ত থাকো রাখালের বাঁশির সুরে যা তোমাদের সকল প্রশ্নের সম্মিলিত উত্তর।
১৭.
আত্নহত্যার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে। আপাতত রক্ষা করো হনন-উন্মুখ মানুষের স্বপ্ন যা তাদের চকচকে ছুরির প্রতিবিম্ব। রক্ষা করো তাদের যারা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে নিজেদের খুঁজে নেয় সীমানার সামনে। হত্যাকারী এবং সীমান্তবর্তী লোক যারা নেই, মরে গেছে জীবন ও জীবিকার কল্যাণে তারা প্রার্থনার পাত্র। ধর্মগ্রন্থ এবং কাব্যগ্রন্থ পাশাপাশি রেখে পাঠ করার সময় তাদের পরিচয় পাওয়া যায়। পানপাত্রে তাদের ছবি ভেসে ওঠে আর মাতাল হয় লোকেরা। চুলোয় যাক তারা যারা মাতলামির কারণ। মানুষের জন্য আর কোন প্রার্থনা নয় বরং শুয়োর যারা ময়লার স্তুপ থেকে খাবার খুঁজে নেয় তাদের স্মরণে নির্মিত হোক ভাতের ভাস্কর্য আর শপিঙমল ছেয়ে যাক আর্বজনার স্তুপে।
১৮.
স্বরাঘাতে ভেঙে পড়ছে নীরবতার দেয়াল। অদৃশ্য সে দেয়াল। ভাঙনের ভঙিমাই জানিয়ে দিচ্ছে দেয়ালের পরিধি ও পরিণতি। পরিণয়ে আবদ্ধ ছিল যারা কেবল তারাই শুনতে পায় ভাঙনের ধ্বনি, হননের হাহাকার। অথচ নীরব তারা। ভেঙে পড়ছে দেয়ালের মতোই, নীরবতার। ভেঙে পড়াতেই সুখ কি না-যারা সুখী তারা তা গোপন রাখো। অসুখীরা সর্বব্যাপী মিছিলে ও মঞ্চে। আত্নায় আত্নস্থ করে বিপন্ন সময়, সম-সাময়িক ব্যধি, বেদনার দ্রোণ ও দানা। পথ হারানোর শোকে অশোকের ছায়া পেতে চায়। কিন্তু ছায়াতো নিজেই পথ হারিয়ে দেহে দেহে আশ্রয় নিয়েছে বহু আগে। আর কিছু ছায়া লুটিয়ে পড়েছে অনুরাগে দেহ হারানোর বেদনায়। বেদনা আশ্রয় নিচ্ছে দেহ থেকে ছায়া আর ছায়া থেকে দেহের ভেতর। লুটিয়ে পড়ার তার কোন ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে কেবল সজীব হওয়ার। বেদনার গাঢ় ঘ্রাণে তাই সজীব হচ্ছি প্রতিপলে।
১৯.
নিজের আত্নাকে প্রসারিত করো দুরাত্নদের জন্য। তারা ঘাঁটি গেড়ে বসুক অথবা শুয়ে পড়–ক বিস্তৃত আত্নার কোমল বিছানায়। তাদের শান্তি দেখে নিজেকে শান্তনা দাও। বলো, সুখে আছো সুখীদের আশ্রম বানিয়ে। আশ্বস্ত হওয়ার মতো অনেক কিছুই খুঁজে পাবে পৃথিবীতে, যদি অন্যদের হতাশ না করো। নিজেকে প্রস্তুত রাখো হতাশার শুন্য পাত্রে ঠোঁট ভিজানোর জন্য। নিজের হৃদয়কে তৈরী রাখো হৃদয়হীনদের স্বার্থে। যারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে। ইশ্বরকে ধন্যবাদ, তিনিও প্রস্তুত মৃতদেরকে স্বর্গ ও নরকে পাঠাবার জন্য। তিনি পাঠাবেন মৃতদের কারণ জীবিতরা কথা বলতে পারে। কথা বলার জন্য প্রস্তুত থাকো হে হৃদয়, থেকে যাওয়ার চেষ্টা করো পৃথিবীতে কারণ এখানে স্বর্গ ও নরক নেই আছে ফসলের মাঠ আর রুপালী ইলিশ।

[ কবি পরিচয়: কবি আহমেদ মওদুদ এর কবিতা বই এর সংখ্যা দুই। প্রথমটি মাটিয়াল থেকে ‌‌'দেহের আড়ালে থাকে প্রকৃত স্বজন'(২০১০), দ্বিতীয়টি বাঙ্ময় থেকে 'দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানের খন্ডচিত্র' (২০১২)। এছাড়াও নিসর্গ থেকে প্রকাশিত কিশোর উপন্যাস 'কিশোর' (২০০৯)। বর্তমানে এই কবি জন্মস্থান রংপুরে অবস্থান করছেন। ]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ