সবের উপরে,
যেখানে রাত আজো রাত, দিন দিন,
সেইখানে আছি, আমি আছি—
অতএব প্রকৃতির চেয়ে দুর্বোধ্য কবিতা আমাকে গড়তে বোলো না !
—এমন কথা বলেন যিনি, তাঁর নাম অনুপ চণ্ডাল। যিনি প্রকৃতিকে কবিতা করেন, সমান্তরালে— কবিতায় আত্মব্যক্ত তাঁর পরম প্রকৃতি।
কথারূপে এইবার সেই প্রকৃতিপাঠ হোক...
জন্ম: ৭ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
গ্রাম: গোবিন্দপুর, ডাকঘর: সুন্দলী
উপজেলা: অভয়নগর, জেলা: যশোর
অতি-শৈশবে সাহিত্য-শিল্প অনুপ্রেরণা ও জীবনদৃষ্টিলাভ একমাত্র মামা বিধান চন্দ্র মল্লিকের কাছে।
শিক্ষা:
প্রাথমিক: ১৯৮৩ সালে আড়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, অভয়নগর, যশোর থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন
মাধ্যমিক: ১৯৮৯ সালে মাশিয়াহাটী উচ্চ বিদ্যালয়, অভয়নগর, যশোর থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপন
উচ্চ মাধ্যমিক: সরকারি বি এল কলেজ, দৌলতপুর, খুলনা
বি এ (অনার্স), এম এ (ইংরেজি): সরকারি বি এল কলেজ, দৌলতপুর, খুলনা
শিক্ষকতা: ২০০২ থেকে চলমান। প্রতিষ্ঠান— সিঙ্গিয়া আদর্শ কলেজ, সদর, যশোর
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ:
বহি চলে নীল — নামশূন্য (২০০৬, প্রতিশিল্প)
গার্হস্থ্য (২০০৯, প্রতিশিল্প)
সকলি সমাধিলিপি (২০১৫, উলুখড়)
রসস্তব (২০১৫, প্রতিশিল্প)
HAIKU IN AUTUMN DAYS (২০১৫, প্রতিশিল্প)
কেউ তবে গাহিতেছে গান — ভ্রমাকুল (২০১৭, সুজিৎ কুমার মণ্ডল)
দহকথা দাহকথা অথবা যে অপ্রিয় জল (২০১৮, সুজিৎ কুমার মণ্ডল)
কথা রূপ রাতিয়া (২০১৯, প্রাণগ্রাম)
অরূপরতন
রঙ রঙ অন্ধকার। দখিনার মত কোমল-কাতর। নাড়িতেছে।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ রাত্রিজীবী আত্মার,
গলায় গুনগুন—আজও কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া.....
পায়ের শব্দ উঠে যাচ্ছে নীলিমায়— তবে কি ওখানে
কানন? কোয়েলিয়া? সারাদিন ওখানে তো
নীলিমা ছিল না কোনো, আত্মার কিশোরী কিশোরী মেয়েরা
বুড়ো আকাশের বলাৎকার সয়ে সয়ে রক্তঝরণে
মরেছে; আত্মা এখন ওইসব মরা মেয়েদের জন্য
প্রাণ কুড়োতে যাচ্ছে—তার পায়ের শব্দ উঠে যাচ্ছে নীলিমার।
কার কাছে? ওখানে ভাসছে খোলা গায়ে মনোলোভা অন্ধকারে
সবশেষ প্রেমিকা সেই, যে একদা আত্মহত্যা শিখিয়ে দেবে বলেছিল,
প্রতিদিন জন্মাবার জন্যে বিছিয়ে দেবে কুমারী জরায়ু তার;
কিন্তু সে প্রেমিকা ছিল না সারাদিন;
কাপড়ে লোহার শাসন, ডাল-সবজির কথকতা, মাসবৃষ্টি-ব্যথা.....
এখন
রঙ রঙ কোমল-কাতর অন্ধকারে ভেসে ভেসে
আত্মহত্যা শিখিয়ে দেবে সে
কুমারী জরায়ু তার বিছিয়ে দেবে নিত্য জন্মের আয়োজনে—
ডানার অমৃতসংগীত!—বিলুপ্ত ডোডোরা কি ফিরছে ঝাঁকে ঝাঁকে?
জগতে আনন্দযজ্ঞে
জ্যোৎস্নার আগুনে কারা রাজহাঁস পুড়িয়ে খায়?
প্রেমেতে উথাল এবার ফলন ভাল ভালবাসার
শস্য???
সঙ্গম???
ঘাস!
আকাশ!
জল!
মা-কুকুরের বান-ডাক বানে ছেলেমেয়েদের থৈ-থৈ
ঝোলা চামড়া টানে শিশু আর বৃক্ষটিও জ্বলছে হু-হু
ও বাঁশিঅলা তোমার সুরেতে না কি মাটির পোড়া বুকে ঘাস জাগে
আমিও ভণ্ড অনেকের মত.....তাই
বীঠোভেন-ঝড় উলঙ্গ সূর্যের দেহে খুঁজি রৌদ্রমদ
ওগো আঁধারিত আলো
ওগো আলোকিত আঁধার
তোমারে ছুৃঁয়ে তোমারে ছুঁয়ে
দেখেছি চিনেছি;
চাঁদ পানে প্রাণ পায় নিহত ভায়োলিন!
যুগলবন্দী
০
নৃত্যমগ্ন চোখ
তবু দেখিতে ভোলে না তবু নর্তকীর ভেজা বাহুমূল
১
২
৩
৪
৫
৬
৭
৮
৯
১
এমন বৃষ্টিবেলা, বৈকালে, মৃত্যুতা আসে—মৃদুমন্দ—
ঘরে ঘরে সিক্ত মধুর হল সকল না-ঘুমানো;
কাল রাতে আমাদের চোখের পরেই ভার্জিনিয়া ডুবে গেল;
ভাল লেগেছিল পুরনো প্রাচীন বিয়ের গানগুলো
ঊর্মিল বক্ষ আদিবাসিনীদের;
অমন দীর্ঘ দীঘল কাল নিমজ্জিত মুখে তোমার চিন্তা পান করি…
এখন ঘুমোতে কালে বৃষ্টি বিভোল, প্রায়শই আসে;
মৃত্যুতা আসে— খুব ঘুমহরণ, স্নিগ্ধ, অকূল জাগরণ;
পত্রমর্মর; কান পাতার সময় হল বুঝি; শিশুসংকেত শোনা যাবে
২
রাতে কি জ্যোৎস্না-হননের রক্ত মেখে ঘুমিয়েছিলে?
তারও আগে ছিল তোমার আত্মহননের রক্তশোভা।
এত নীরব রক্ত পেরোতে হল বলেই ভোর এত শাদা!
ভোরে উঠে
খুব ভোরবেলা উঠে
শিশির কুড়োলে
দু হাতে শিশির ছুঁলে
পাপক্ষয়
কার গর্ভে আমি শিশিরের জন্ম দেকি সারারাত জেগে
৩
এই মৃত্যু বড় সুফলা, সারা মাঠ জুড়ে চাষ।
মাঠের ভেতর দিয়ে গঞ্জে গিয়েছে যে-পথ,এখন পাকা। দু দিন সাদামাটা বন্ধের পর আজ আবার ট্রেকার খুলল এই পথে, গেঁয়ো এই পথে, এখন যা পাকা। থ্যাতলানো শিশুটির রক্ত, সংগোপনে জল ঢেলে, ধুয়েছিল কিশোরী দিদি…
আমাকেও গঞ্জে যেতে হয়, নগরে, মহানগরে—লাশ ও লাস্য—মাঠ নেই, মাঠে মাঠে সুফলা মৃত্যু কোনো নেই…
মাঠে ফিরি, খুঁজে ফিরব ব'লে; কী কী রঙ! আহা রাতুল চরণ, ওগো রাঙা পা, এত প্রণাম পেয়ে কেনো উড়ে গেলি? না কি আমারই দু হাত শুকায়ে গিয়েছ? কে এমন শুকায়ে দিলে গো!
ঘুচে যায় পারফিউম-বেলা— একে একে খুলে খুলে আমরা পরস্পর খুঁজে নিই দেহঘ্রাণ—! বলো মাটি, দূর হতে তোমার ঘ্রাণ শুনেই বুঝি নি কি, তুমি আছ—তুমি আছ—!
৪
যতই বাঁধো, যেভাবেই, রাঙা বাছুর তার মায়ের দুধ খেয়ে নিতে জানে
৫
আউশ ধানের গাছে এক আশ্চর্য জলগন্ধ আছে যা কিন্তু ইরিতে পাবে না
১২
সৌর তমসা ছিঁড়ে ছিঁড়ে এই জঙলে আমি।
পাতাদের শবদেহের পাশে জগতে এসেছি?
আমি কি শুনতে এসেছি পাখিনীর গর্ভে তার সন্তানের গান?
তোমার তীর আমাকে বিধবে না, ও ধানুকী,
বিদায়বেলা মা আমার বাঁ হাতের কড়ে আঙুলে কামড়ে দিয়েছে
১৩
ছোট্ট-গর্তে-রাখা এই দুধ, দেখ, সন্ত্রস্ত ছুটেছে,
এবার নিথর হল দেখ— প্রখর লাল হয়ে গেলো;
কোন অচেনা বনে ছুটায়ে ছুটায়ে
আমাদের মা-কে তবে বাঘে ধরে খায়!
তুমি বললে; কাল ভোরে পাখি গান গাবে!
বাঘেরও দেহ কি তবে মাটি হয়?
সে-বাঘ মাটি হলে মা-কে আমরা কুড়োবে মাটিতে?
অথবা কাল আবার মা-কে বাঘে ধরে খেলে
বোলো তবু; কাল ভোরে পাখি গান গাবে!
আঁধার হেঁটে হেঁটে দু হাতে জোনাকি কে যেন গড়ে!
১৭
যখন বৃক্ষ কাঁদে
অথবা কান্না বৃক্ষ হয়ে ওঠে
মনে হয় পৌঁছব ওপারে
মনে হয় খুঁজে তবে পাব
কাঁদো বৃক্ষ…
কান্না, বৃক্ষ হয়ে ওঠো…
১৮
এসেছে, মোমবাতিটি ফিরে দেখতে মেঝেতে তার গলিত অবশেষে; ট্রেনখানি বহমান আধা-নির্জন কামরাটি নিয়ে সেই; ভাঙা চিলেকোঠা, আধ-ভাঙা ছাদ— আমাদের সবে-ধন দক্ষিণডিহি; খুব যাব যাব ব'লে গেলাম না যে, এক পরম অচেনা গাঁয়ে প্রপিতামহী বট আমাদেরে ভাবে আর কাঁদে; মঠ এক প্রাচীন পরিত্যক্ত — কল্পকথার মত দুপুর—নির্জনে আজিও সে চায় দেহের শ্যাওলা—শীতলতায় রতি-শিহর কেউ তুলে যাক; এত বিল কখনো দ্যাখো নি, এত মাঠ, এত কাশবন, শেষ নেই শ্যামল-মথিত পথ, এই সন্ধ্যা, এমন রাত্তির দ্বাদশীর জ্যোৎস্নায় কাশবন এখন আকুল আর এমন লীন কখনো হও নি—এমন লীন যে দ্বাদশীর জ্যোৎস্না হয় আকুল, দ্বাদশীর জ্যোৎস্না আজো আকুল
১৯
পরে
খালের জলেতে একদিন
ভাসতে থাকে মা-দূর্গার লাশ
৩৪
গোলাটা মরেছে সেই কবে।
লক্ষ্মীর ঝাঁপি,আজ তুমি
শুধু এক নন্দন হয়ে—নন্দন শুধু—
যেতেছ নগরে,
নগরবধূয়ার কাছে
আহা যাও!
যেন সে লক্ষ্মী,
প্রাণলক্ষ্মী হয়ে সে যেন রে আসে
এ-গাঁয়ের ঘরে—
ঘরে ঘরে…
মুচি যারা বেঁধেছিল গোলা
তাদের সন্ততিরা আছে
মাঠে মাঠে সন্ততিরা আছে দূর্বাঘাসেরও
রয়েছে সিন্দুর— লক্ষ্মীর ঝাঁপি তুমি
অক্ষয় তিনটি ফোঁটা পরম আঙুলের কাছে নিও
৩৫
এখানে সে-নদীর স্মৃতি শুধু পড়ে আছে;
মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী, বারুণী স্নানের তিথি আজ!
উত্তর ভিটের ভূতে আমগাছটাও কাটা হয়ে গেলো—
নতুন বউটা তবে কোথায় গলায় দড়ি দেবে?
৩৬
দূরগাথা সেই সেই পাহাড়ের তবে কও—
পাথর অতল কালো
অথচ বালিরা সোনালী
অথচ গাছেরা সবুজ—
কেমনে এমন হয় কহ!
কার বীজে প্রজাপতি এত!
আরও গল্প গহন;
উপত্যকায় খেলিছে শিশুরা—
অসীম বেহিশেবি বড়—
আমি তাই নিরুপায়
টিলার ওপরে আমার কুঁড়েখরটিরে জ্বেলে দিয়ে
আগুনে-ধোঁয়ায় ওদেরে জানাই—
দেখ্ দেখ্ বৃষ্টি ঘোর এখনই আসিবে ঢল ফিরে যা ফিরে যা ঘরে!…
বলো বন্ধু, সমতলে এ-সকল গল্প তুমি কও
এখানে সরল মাটি বড় আকুল-কাতর!
যে-সব বৃষদের আমরা নিরীজ করেছি
লাঙল টানবে ব'লে
তারাও আকাঙ্খা হয়—অবহ গোপন—
নিকট খুঁটিতে বাঁধা মোহিনীর তরে
দুরন্ত নিজন দুপুরে;
পাখি গান গায়— আজো গান—;
ভোর জানে
আমাদের বিভোর ভোরগুলি জানে
কতটা কাঁদলে পরে কামনাও কান্না হয়ে ওঠে!…
সমতলে সরল বয়ে শুনি দূরকথা শুধু দূরগাথা শুনি
৬২
সময় তুমি; ধ্যানবিন্দু!
বিপুল দেখাও রাত্রি আর দিন—
আমাদের বিদিন-বিরাত!
এবং পরমা ঋতু!
মগ্ন মৃঢ়তায় সুখে জেনে নেই ঋতুর কুহক—
নিবিড় সংকেত তার মেনে জন্ম হই জনম হয়ে চলি…
ক্রমশ মৃত্যু অর্জন এক, সফলতা—
শিশুর কান্নায় জেগে ওঠে স্তন মৃত নারীর!
৬৩
এখনো কিছু উলুধ্বনি সন্ধেয়
চোখের অন্তিম শয়ান ওই আকাশ
মা—এখনো-বেঁচে-থাকা আমাদের মা—
৬৪
তারাগুলি নক্ষত্রেরা জ্বলিতেছে পাপের মতন;
আমার সকল পাপ নক্ষত্র তারার মত জ্বলে
শম্ভুনাথ হাসপাতাল হয়ে কেওড়াতলা শ্মশানের ঘাট
ফুলে ফুলে সাজানো হয় আমাকেও, ফটো তোলা হয়
৬৬
এমন শিশিরবেলা মরণ হলে শিশির হয়ে আবার তারা ফিরে আসে?
৬৭
তারপর যবে ঘুম রাত্রির আঘাতে ভেঙে যায়
দু চোখ তুমি মোহন শোনো
মানুষের মহাকাশ উথলিত শিউলির ঘ্রাণে!
৬৮
ভাঙা শিশিরের টুকরো তবু কেউ জুড়ে জুড়ে
আকাশের পূর্ণ দেখে নিতে চায়—
৬৯
এ ভাঙা জানালা তুমি কুহুতানে বাতায়ন হলে—
আমার রাত্রি তবে নিশীথ হয়েছে
আমার সকাল প্রভাত হয়ে দোলে!
৭০
দু হাতে মুছিতে আছি আকাশের হাইব্রিড রঙ—
আর থাক্ আমাদের পাতিহাঁস, গাভী, ঘাস আর ধুলো
৭১
ফুল কবে এসেছিলে জানি নি তো—
বটফুল ফুটে আছ পাখির লাগিয়া গো তার ঠোঁটের লাগি!!
৭৩
শ্মশানে যে-কৃঞ্চচূড়া সে বুঝি অধিক লাল;
মৃত্যুর রঙ তবে আমরা তবে শিখি!
রক্তকবরী ওগো,
পরায়েছ নীলকণ্ঠ পাখির পালক--
পরজন্ম হই এ ভাঙা বাঙলায়!
শ্মশানে- কবরে ঘুম জাগায়েছে কেউ
শ্মশানে- কবরে তুমি ফুটেছ অপার ফুটে আছ
রক্তকরবী…
তোমায় তবে, মূর্তি, তোমায় গড়ি…
আমায় তবে, মূর্তি, আমায় গড়…
৭৪
মোমবাতি সহসা নেভালে যে ঘ্রাণ
তার দিকে, অন্তহীন, আমি চেয়ে থাকি
৭৫
তাঁর বিলোকযাত্রা; নিরবধি বিনয় মজুমদার
কোনো কোনো রাতে অশ্রুপাত বিনগ্ন যেন হয়।
ভালো লেগেছিল…
ধূলি হতে জন্মেছিল চোখ যত যত চোখ হলে ধূলিগুলি গোনা হতে পারে
বিলোকযাত্রার আলোয় রাত্রি কৃষ্ণময়ী আজ।
এ-রাত দেখি অঘ্রানের!…
পরজন্মের আকাশে তবে এই অন্ধকার, এই আঁধারখানি রাখি
আঁধার ডুবে গেলে পর অদ্ভুত চাঁদে…অদ্ভুত লালচে চাঁদে…
৮৫
বাতাস তো বহিতে ভোলে না;
থরে ও বিথরে সাজানো দিন—
হঠাৎ করে অকস্মাৎ এসে
খুলে খুলে বিরলে দেখায়
কেঁদেছিলে শেষ কবে!
৮৬
কেউ তবে গেয়েছিল গান- তাই ভোর;
ভোরবেলা দীঘি এক—
ভোরের ব্যথার মত উঠেছিল জেগে
ফুটে উঠেছিল…
কেউ তবে গেয়েছিল গান—
জল-'পরে থির কুহেলিকা
হয় নি কোন রঙিন চঞ্চল;
আধোনীল শ্বেততার তলে
অগণন ফুটিছে রক্তিম…
কেউ তবে গেয়েছিল গান—
দিকে ও দিগন্তের লবণতা ঘোর
ভোরবেলা শুধু এক দীঘি জেগেছিল
ভোরের ব্যথার মত জেগে উঠেছিল
কেউ তবে গাহিতেছে গান— ভ্রমাকুল—
৯২
সে-এক অচিন মহুয়াবন রাতের আকাশে—
একদিন কার্তিক-চাঁদ অস্তাচলের যায়—
তার হিম ছড়ায়ে নিথর আছে জলে,
জলের ওপরে কার অরূপ পদচ্ছাপে
মৃতমক্ষিকার প্রাণের ওপর…
যেন ভ্রমণ ও পরিভ্রমণের স্মৃতি কোনো নেই;
কোন পথে শেষ গরুর গাড়িটি চলে গেছে;
শেষ কাশবন কবে ধানভুঁই;
গর্ভবতী গাভীটিরে বেচা হল কবে;
ভাঙন আসবে কাল-- ছেড়ে-যাওয়া বাস্তুভিটে—
শূন্য, নিঘর,— আধভাঙা উনোন—
বহুকাল সুখে-পুড়ে-পুড়ে যে -রঙ সে লভেছে,
পড়ে আছে তা-ও --নিসাড় গৈরক—;
মোমশিখার এক রাত, বাদলাতুর,
অজানা গঞ্জের পুরনো খুব পথিক-আবাসে--
জানালার ভোর চকিতে দেখেছে উদাস প্রসুখ
অদূর জলের, বার বার ফিরে-আসা ঘাট—;
কোথাও নদীর নাম আজো চন্দনা হয়ে আছে—
আজো তার গ্রামগুলি বাঁশের বনে বনে
সতত গড়িছে আঁধারের রূপকলরোল—;
কেউ কবে গলা ধরে কন্যার মত শুধায়েছে;
অমাকালে পুবে না পশ্চিমে ওঠে চাঁদ?
শুধু এক দেখা
হিম আর জ্যোৎস্নার মত
ভোর হোক—সকাল—দিবস
জ্যোৎস্না ও জ্যোস্নার ছায়া-মাখা
সারা দিনমান, সকল রোদ্দুর—
অচিন মহুয়াবন সকল আকাশে
৯৩
রাখি এই হেমন্তনিশার বাতাসে তোমাকে।
সুথির ছড়ায় রাখি বিমগন বাতাস-উপর।
এ-বাতাস ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ; অবারিত ঘ্রাণপট!
ছড়ানো-তুমি পটের ওপরে রঙ হয়ে ওঠে ধীরে,
রঙগুলি নিবিড় সহজে পরস্পর মিশে যায়;
তারপর সকলই ঘুমায়ে গেলে শুধু চিত্র রয়েছে জেগে!
সমস্ত হেমন্ত তবে ছাতিম ফুলের ঘ্রাণ লেখা যায়।
৯৪
যেখানে বাতাসে পানবরজের গান লেখা আছে,
নিয়ে যাই তোমাকে পরপারে;
চেনা হবে, মরণের আগে, একবার, শটিবন;
শটিফুল, মোহ-আরক্তিম, দেখা হবে…
মরণের আগে বারম্বার নদী পার হয়ে যেন যাই—
প্রতিটি নদীর পরপারে ফুটে আছে গান, শটিবন!
১০০
কোনোদিন অড়হর ফুলে কেউ গেঁথেছ মালিকা?
দেখা হল ঝাঁক ঝাঁক অড়হর পথের দু পারে, দ্বিপ্রহর—
রোদ্দুরও শুভ্র হল আজ; বীণাপাণি পূজা বিদ্যাপীঠ সব;
বালকেরা দেবদারু পাতা এনে সাজাল মন্দির কাল সাঁঝে,
মাঘের পরাণ মাইকেরা সারারাত ভরে হারানো হারানো গানে,—
আনে নি কেউ অড়হর ফুল—বালিকারা এলোকেশী, চন্দন সুভালে,
বালিকারা বীণাপাণি আজি!…
তারপর সুরাত্রির মতো রাত।
সঘন নিবিড়!
মাঘের শুল্কা পঞ্চমী—তবু
সব চাঁদ অস্তকালে আরক্তিম ঘোর!
কোনোদিন গান বেদনারই লাবণ্য গহীন, রসশোভা!
শুধুই শিশুর বেদনার কাছে নতজানু তুমি—
আবিল আকাশ শিশিরতা পায় কিছুকাল
শিশুর বেদনার কাছে বারম্বার অপরাধী হয়ে।
সুরাত্রির মত এই রাত কোথা যাও?
রিক্তচাঁদ হলে আরো ঘন তারকার ভীড়—
তারায় তারায় লুকোনো যে-ঝড়, ভূতলে নেমেছে…
ডানা তবে চৈত্রশোভার দিকে উড়ে যাও, বোশেখের পানে…
বুঝি বৈশাখ!—
শিশুটিরে সাথে নিও, দোকানে দোকানে আজ শুভ হালখাতা!
১০১
নিরালা দাঁড়াবার অপার নক্ষত্রকাল
অদেখা ফুলঘ্রাণ
পূর্ণিমার মাঘী কুহেলিকা…
— কখনো বা ভুলে সব ভেসে যেতে হল।
আজ জ্বলেছে নীল কেরোসিন এই রেলঘাটার ছোট ঘরে;
প্রাচীন স্তব্ধতা সেই— অমর শিরীষের গাছগুলির স্তব্ধতার—
পড়ে-থাকা পাটির গায়ে গায়ে ঘনিয়ে-ওঠা রঙ-গান—
অভয় আঁধারে তুমি কি গো শটিবন, না কি হলুদের ভুঁই?
বিশুদ্ধ ঘাসেরা এইবেলা বয়সের কথা কও?
ঝিঁঝিঁপথ— কোনোখানে পথ আজো বয়—
—এখন তবে এ-ঘাট মাড়ায়ে রাত্রির দ্রুতট্রেন চলে গেলে
উতরোল ছন্দ তার দিয়ে যায়;
নিরালা দাঁড়াবার অপার নক্ষত্রকাল
অদেখা ফুলঘ্রাণ
পূর্ণিমার মাঘী কুহেলিকা…
যেন তবু সকলি কন্যার মত—সুনিকটে— ক্রমশ সুদূর—!
কোনাে এক মৃত প্রাণীর উদ্দেশ্যে
জানালা বন্ধের রূঢ় চাপা খেয়ে
এভাবে যে শুকায়ে রয়েছে টিকটিকি
কখনাে বলাে নি তো!
এভাবে শুকায়ে আছে টিকটিকি, দেখাে---
করুণ রঙিন ফুলে ভরেছে শিরীষ;
এ-বছর চৈত্রে এখনাে ফলে নি রুক্ষতা খুব ---
দেরিতে গিয়েছে শীত, বৃষ্টি বেশ হল মাঝে মাঝে,
যদিও ভেজে নি কেউ, ভেজা তো যাবে না,
এখন যে বিষ থাকে প্রথম বৃষ্টিতে;
তবু আছে আমাদের জল, জলধারা
নিরাপদ জলযাত্রা দু-এক রয়েছে;
সকালে রূপসা তো বিকালে গড়াই ---
পথপাশে পাখি, কবেকার বন্ধ সিনেমা হল,
নির্মাণান্তে পড়ে আছে ছোট স্তুপ ব্যাতিত বালুকা,
আছে জলগৃহে পদ পরিচর্যার পােড়ামাটি আর
গৃহমধ্যে রাত্রিদিন রূপসীর বৈদ্যুতিন মেলা...
এদেশ তবুও গাছেদের—
ধানক্ষেত মাঝে কেমনে দু-একটি তালগাছ হয়ে রয়
শুধু এই গহসা রয়েছে জীবনে;
একবার প্রতিদীক্ষা হলে পাখিরব সারাদিন :
এখন সকলে জানে আমাদের দুটি কালো পাখি- কাক ও কোকিল!
কৃষ্ণচূড়া ও ভাষাফুল
নাচো।
আমার হাতের কৃষ্ণচূড়ায় প্রথম ফুল।
আরো তো বারতা এসেছে
দূর প্রবাসিনী
প্রাণের ভিতরে দেহে
ফোটাল কৃষ্ণচূড়া অতীব প্রথম।
এখানে পাথরে রীতি এই লেখা:
দূর দূর কৃষ্ণচূড়া—
বাতাস বারতা বহে, ব'হে আনে—
সেই ক্ষণে শূন্য ফুটে নীল ভাষাফুল!
নাচো...
না উত্তর
মৃতের নামের পাশে লিখিত সংখ্যাটি
সঙ্গোপন হানে কি দাহ?
এই মাঘ—তার রাত্রি ঘাের
সঘন গহন মাঘরাতে
কোথাও উষ্ণতাকণা নেই—
ভূগর্ভ হতে আসা জলের গায়েতে শুধু;
মনে হয় ছুঁয়ে রই সে গা সারাক্ষণ, সব ভুলে।
তবে কেন এই মাঘ ছেড়ে?
কাল পূর্ণিমায় হারানাে শেয়ালেরা ফিরে দলবদ্ধ ডাকলে
জানাে না কী খুশি হবে কুয়াশাপ্রান্তর
আর ফোঁটা ফোঁটা রাত্রিব্যাপী রস।
হায় মাঘ! এত হিম, অবলুপ্ত শরীর তাই জাগে---
উষ্ণ হয়ে উষ্ণ হয়ে অসীম হিমের সমান বইবে ব'লে।
এই শরীর তুমি কোথা রেখে যাবে?
অথবা ভাত নামের খাদ্যটিরে?
এত সব গ্রন্থসঞ্চয় যাবেন কার হাতে দিয়ে?—বলেছে সে।
পেল না উত্তর
চিরমােহ
আবারও বিষণ্ণ হবার এসেছে সুকাল!
জেগেছ কার তিরস্কারে
দ্বাদশীর জ্যোৎস্নায় পুনরায়?
জেগে জেগে জপো দেহনাম;
ললিত স্ফীতি, মৃদু ও মধুর, সুললিত—
সে-লাবণ্যে দিকে দিক আকুলতা ঘোর,
মুগ্ধ কম্পন!
কার তিরস্কার বাজে অনাদ্যন্ত সুর!
জেগে উঠি :
লাবণ্যদগ্ধ সকল সুনীতি—
দ্বাদশীর আশ্বিন-জ্যোৎস্নার 'পরে
আরাে এক লাবণ্য ছড়ায়ে—
বিমােহিত, ব্রহ্ম কম্পমান ...!
স্থিত
হয়েছ স্থিত ক্রমশ প্রেমে—
তাই শুভজ্যোতি; পোহায়েছে
রুগ্ন রমণার্তি যথাতথা।
অধর-রসের পানে চেয়ে
আছে খরদাহ, হাহাকার
ঋদ্ধ স্তনশোভা যেচে, আছে
লিঙ্গনের মধুর আকুতি...
তবু ধীর স্থিত প্রসন্নতা।
মিলন মধুর অতি হল।
এখন সকল অঙ্গ আর
ক্রিয়াগুলি স্নিগ্ধ কথা বলে—
কথায় কথায় রাত্রিদিন...
ছিল রাত্রিদিন আচ্ছন্ন-বিবশ তপ্ত অন্ধকার;
এখন হাওয়াজল, নক্ষত্র-কুহক, সূর্যরস!
প্রকৃতি
প্রকৃতিপরশহীন লিখন সকল
কেমনে সম্ভবে, বলো? কোথায় হারালো
পুঙ্খ আর অনুপুঙ্খ প্রকৃতি দেবীর?
রয়েছে তোমার করতল, পদস্পর্শ,
গ্রীবাপরশনে মৃদু যে-চঞ্চলতা
আবেশ-বিধুর, স্তনভরা উত্তাপ,
নির্জন অঙ্কুরে সুপ্ত শিহরণ...
প্রতি অঙ্গে আছে প্রাণ, মুগ্ধ প্রাণকথা!
যে-আকাশ, তারা, জল, জলধারা বিনে,
হাওয়া বিনে বাঁচে নি প্রাণ, তারে ভুলে
শুধু দেহ, তোমারি তা, বইছে অশেষ—
দগ্ধতা, হাহাকার, ক্ষুব্ধ হলাহল!
সবেরে গ্রাসিয়া শুধু দেহ হয়ে, দেহক্রিয়া, প্রাণকথা হয়ে
হয়েছ ব্যপ্ত—অনবিচ্ছিন্ন, বোঝালে যে, তুমিই প্রকৃতি।
প্রায়শ্চিত্ত
তােমাকে যে লিখি, লিখে রাখি,
প্রায়শ্চিত্ত এ কি তবে? পাপ
বােঝায়েছে তােমার শরীর!
কোমলতা, রসাস্বাদ, ঘ্রাণ
সকলি স্বর্গের জেনেছি তাে;
হে পবিত্র, আলাে, হে আগুন,
বিনগ্ন-আমাকে ধুয়েছ;
তবু পাপ রয়েছে কোথাও।
তােমার স্নিগ্ধ করতল,
লালাসুধা, স্তন, শুভযােনি
সবারি স্বতন্ত্র আছে প্রাণ,
আছে আছে সবার হৃদয়!
এইসব হৃদয়েরে অবহেলে নিজল লালসে
হল পাপ : হােক মুগ্ধ প্রায়শ্চিত্ত লিখনে লিখনে।
মনােনাট্য
অতলে তােমার নিতি নব মনােনাট্য—
ঘটে প্রতিটি ক্রিয়ার অব্যর্থ ইঙ্গিতে :
ভুজবন্ধন শিথিল কি বিরূঢ় মধুর;
স্তনপানে শুধু চেয়ে থাকা না কি ঘাের
উচাটন হস্ত-অবলেপ, ওষ্ঠাঘাত,
প্রগঠিত নিতম্ব-কোমলে নিঃস্ব-দীর্ণ
আত্মাহুতি-মরণব্রতী যােনিমন্থন;
তােমার ক্ষণিক আঁখি লিঙ্গাগ্নির পানে...
আমি তাই ক্রিয়ার ঘটক শুধু নই—
নাট্যলােভী, সকল ক্রিয়ার মাঝে থির :
নিরবধি অঙ্গ আর অঙ্গের লাবণী,
আকুল সন্ধান তবু যেন আর কারে—
মনােনাট্য তােমার! নাট্যলােভী, ক্রিয়ার অধিক তাই মনােযােগী—
যেন ক্রিয়াবিচিত্রতা হতে নাট্য জটিল, রস ঘন হয়।
লাবণ্যসংরাগে
তােমার লাবণ্যে, লাবণ্যের সংরাগে
জেগে উঠবার অমিত ক্ষমতা তুমি
দিয়েছ গােপনে, সুনিপুণ। দেখায়েছ
অক্লান্তির হৃদয়ালােক—নম্রনীল :
উত্থানসূত্র নিবিড় জেনেছ তাই
পতন-পরের নিথর খণ্ডকাল
স্নিদ্ধ ঘুচায়ে এনেছ পুনরুথান—
কালপ্রবাহের মতাে বহে দেহঢেউ!
নিরন্তর উত্থানে পুনরুথানে,
প্রতিটি দুরন্ত সংগমে এই দেহ—
শরীরধারণ—যেন যাপনযােগ্যতা
বুঝে নেয়, পরীক্ষিত করে নেয়।
লাবণ্যসংরাগে এই জেগে থাকা—এই যে মধুর এই বাঁচা!
লহ মহীয়ান দীপ্ত লিঙ্গ—আমূল লিঙ্গন—আলিঙ্গন চির!
The monk's on his death-bed
A tender girl nursing
Were he a father, a husband!
Cool sky
No stars are dead
Only humans
Weekend sky
Time to feel empty
Rebirths
Leaves dead
falling
Dead letters revive
Firewood in afternoon light
Waiting to turn into light
Very few hours later
The long-cherished name
remained unused
The baby came dead
From son's grave father plucks
a little first bloom
He planted it last year
See, how negligent I've grown
to teaching and earning
November moon never minds
Sunlight and mist
mingled
A milkman's old bicycle moving
Mist-breaking trucks
overloaded with straw
Some thatched houses somewhere
Child in the womb
grows fast to come out
not to miss even one Autumn
Riding on my bike
I go slow
And think Haiku
Aghran— winter approaching
Date trees get prepared
How dryness so juicy!
All dews on the ground
Only some are
on the cobwebs
Sometimes a single leaf falls.
On the ground
are his fellows quite
Morning sun makes you
Two
He knows magic!
Mustard fields unending—
Yellow Sights, Sounds and Smells;
Is yellow the colour of life?
Think Haiku
Think Haiku
throughout the sun and mist of Autumn
We correct all other poems—
Only Haiku is born
Flawless!
The deeper is the night
the closer are the stars—
So I can't go to bed early
Look, look
A deserted brickfield chimney
touched by Autumn light
Little still wate
in the roadside ditches
Breathless green shadows inside
Even a desolate Police Camp
becomes a beauty
in Autumn twilight
Some horse-carts still alive
to carry heavy logs
to the sawmills
Birds love
and give birth
But never get married
Late afternoon autumn fields
Heaps of weeds set to fire
White smokes rise to heaven
Mist soft like affection
Bridge over river
Moon over both bridge and river
Cold pond
Visible even in darkness
Does water have its own light?
The dog's mistresses
now busy with children
Alone he waits for the next Autumn
The woman sleeping
Her breasts wide awake
The baby may cry anytime for milk
Father out for afternoon prayer
The girl feels free
to hug her secret pains
Dense moonlit fog
Trees stand unreal
Turned into silent, still shadows
White Aghran midnight—
Time to come out and hear
music of dropping dews
The model stares at the painting
Alone she thinks
it’s she, herself
Here the sun stays
longer than anywhere—
so I sit in an open field
Smoke rising to the sky
sometimes indicates
someone has died
Dark foggy night
A single star drops
on the speechless house
The vendor's bicycle slow
A bamboo cage on the carrier
Colourful cocks and hens quiet
Bodies of cut down trees
lying here and there—
Does Autumn inspire destruction?
Bamboos cut and processed
Piled up for sale
Growing brown from green
All epitaphs are beautiful
some are
More
Leaves falling all around
just one
on my head
No paths are visible
The fog shows
only itself
Someone lives
just to see
the night sky
সব ভুলে যাবে
যখন দেখবে, নিজের হাতে লাগানো নিমগাছটায়
ফুল ধরেছে।
দেখবে, চলে যাওয়ার আগে নবমী চাঁদের মুখ
কেমন মলিন!
একদিন সে আসে
নিজস্ব শয়নের স্বাধীনতা ভুলে
শুধু শিশুর ঘুমের দিকে চেয়ে থেকে
কেটে যায় রাত্রীর প্রহর...
যে বেসেছে ভাল ভাঁটফুল ফাল্গুনের কোলে
একটি জীবন তার হাওয়ার মতন— সুখে কেটে যাবে
তবু তুমি বললে হাসিমুখ;
অত মেপে রাঁধতে হয় না;
হোক-না কেনা-চাল,
কিছু ভাত তবু বেঁচে যেতে হয়—
পোষা হাঁস আছে, না-পোষা কুকুর-বেড়াল,
কখনো দু-একটা পাখিরও তো খিদে পেয়ে যায়!
সূর্য চলে চলে অস্তাচলে গেলে
একদিন অস্তমিত হলে
লাবণ্য ও রুপ শুধু দূর থেকে দেখে যেতে হয়–
দীর্ঘশ্বাস হয়তো একটু পড়ে
ভাবি
ডাকে না কোকিল যে-দেশে
জীবন সেখানেতেও–
কেমনে বয়ে যায়!
সারা কুহুমাস ফুটে রয়
খর রৌদ্র আলো করে;
এমন প্রদীপ্ত ঘ্রাণ রাত্রি জ্ব'লে থাকে,
জ্বলে হাওয়ামুখর অষ্টপ্রহর–
কোনোদিন তাই পার না মেটাতে দিনবহনের দেনা
এইসব গাছেদের বেচে;
অথবা গড়তে সুশোভন গৃহসজ্জা এদের অস্থিতে;
কিম্বা বিকোয় মেয়ের বিয়েতে খুশি-খুশি সবেদন উপহার...
আমাদের এসব শিরীষ-কড়ই
এরা দেখো কাঠবৃক্ষ নয় কুহুমাসে:
রঙ আর রূপ আর ঘ্রাণ নিয়ে দাঁড়ায়ে রয়েছে
এক-একটি আকাশজোড়া ফুলগাছ!
অস্তমহিমা স্তনদুটি আজ নীরব অকাতর দুগ্ধ-উৎস শুধু!
সহজবোধ্য সর্বপ্রাণবাদ
এবার সকলে সহজে বুঝবেন সব প্রাণ এক— সৌরবিশ্ব জুড়ে অভিন্ন প্রাণের প্রবাহ বিভিন্ন বাহ্য আকার ধ'রে— তা নইলে কি গাভী ও বলদ, পাতিহাঁস-রাজহাঁস, কুত্তা ও খেকি, বিছা ও বিড়াল আর উইপোকা, গরুর গোবর, ব্যাঙ কেঁচো জবাফুল হাঁসের পালক, বুড়ো বাপ, আধমরা মা, ছেলে-মেয়ে ভাই-বোন, মাগী ও ভাতার একাকার হয়ে যেতে পারে? রাস্তার 'পরে। এ কী অপরূপ রূপ তুমি ধরেছ রাস্তা আজ। মানুষ আকাশের নীচে— এমন মিথ্যে কেউ বোলো না বোলো না মানুষের নামে। তবুও মানব থেকে যায় ব'লে পলিথিন, পুরনো টিন, রান্নাঘরের ভাঙা চাচ এনে বেধেঁছে সুন্দর তারা সর্বপ্রাণাবাস। দেখে যাও, শিখে যাও, বাস্তকলা কারে কয়— এখন এখানে এলে ক্যামেরা আর ফিরে যেতে চাবে না কো। যেও না ক্যামেরা, থাকো থাকো, সার্থক হবে জীবন তোমার— আমাদের রাস্তার এই রূপ ফুরোবে না—
জল পারাপার, বিশেষত মুড়িওয়ালীর
আমাদের সব পথ জলপথ আজ। তবে অত জলযান জন্মে নি এখনও— হেঁটে পার হতে হবে। কাছা মেরে চলে গেল হাটুরে ও চাষা। নিজস্ব ডোঙায় গেল ব্যাংকার মাস্টার। শুধু হাজিরা খাতায় সহি উদ্দেশে ফাঁকা ইসকুলে গেল দিদিমণি আধা-ভেজা হয়ে। এখন আমরা এক চুড়িওয়ালীর জল পার হওয়া দেখি। গঞ্জের হাটে যেতে হবে তাকে— ভাতার মরেছে কবে বাজ পড়ে, ঘরেতে বয়েস্তা মেয়ে- গঞ্জের হাটে তাকে যেতেই হবে শনি ও মঙ্গল। কাপড় ভিজবে না তার— যত জল হও কাপড় ভিজবে না তার কোনোদিন। মাথায় মুড়ির বোঝা বাম হাতে ধ'রে আর হাতে ক্রমশ সে ওঠায় কাপড় জলের তালে তালে— কাপড় তার ভিজবে না কোনোদিন— আকাশ বাতাস চোখ মেলে দেখে নাও মুড়িওয়ালীর মূল্যহীন উরু—
মাছ হয় যেভাবে শিশুরা
শিশুসব কী প্রকারে মাছ হয়ে যায়, জেনে রাখো। চারদিকে জল শুধু জল আর জলের কণায় কণায় মাছ– ক্ষুদ্র বৃহৎ এবং মাঝারী। অতএব মৎস শিকারের মহা-উৎসব! বাঁশযন্ত্র কত কত– কত-না বিচিত্র অনাগরিক নাম তার– আর জাল, মহাজাল; আর কামারের হাতেগড়া লোহার শলাকাগুচ্ছ, আদিম তীক্ষ্ণতা যার, পেশল হাতের শোভা।
আজ আমাদের উঠোনভরা মাছ– কখনো বৃহৎ কেউ ঢুকে যায় ঘরের ভিতরে জলে, যে-জল খাটের তলায় খল খল্। আহা শিকারী পুরুষ জানে খাটের ওপরে বসেই কোচে মাছ গেঁথে
ফেলবার উল্লাস কত! একদিন রাতে, ঘুমঘোরে, সহসা সে শোনে ঘরের ভিতরে জলে বৃহৎ মাছের উথাল– চকিতে উঠে ব'সে কব্জির জাদু খেলায় আদিম তীক্ষ্ণতাভরা লোহার শলাকাগুচ্ছে গেঁথে ফেলে তারে: মাছের চিৎকার শুনে বোঝে কখন ঘুমঘোরে তিন বছরের শিশু তার খাট হতে পড়ে মাছ হয়ে গেছে–
জলে জল হয়ে যাও গলে
শুঁড়িরডাঙা, হেলারঘাট কিম্বা হাজিরহাট– আমাদের শ্মশানভূমি সব হল জলাভূমি। চারটি লোহার খুঁটি-গাঁথা বাঁধানো চিতাচাতাল গিয়েছে জলের বহু তলে; আরও তলে চলে গেছে মাটি। তা বলে কি মৃত্যু থেমে থাকে? কোথা তবে ছাই হবে এইসব সোনার অঙ্গগুলো? অথবা মাটির দেহ কেমনে হবে মাটি? আহা, মৃতেরাও তো মানুষ, না কি? তাদেরে এমন দড়ি দিয়ে গাছের গোড়াতে বেঁধে জলের ওপরে ভাসায়ে রেখে চলে যাওয়া যায়? শেয়াল কিম্বা কাক কিম্বা শকুনেরও পায়ের নীচে মাঠি চাই মৃতদেহ ছিঁড়ে খেতে হলে। অতএব হে মৃত, হে গাছে-বাঁধা মানুষ, তোমাকে কেবলি ভেসে ভেসে ক্রামাগত ফুলে উঠে দিনে দিনে জল হয়ে যেতে হবে– আহা, জলে জল হয়ে যাও গলে...!
শালিখকে সান্ত্বনা
মাঠে নেই, উঠোনে নেই,
চাতালে অনেক ধান তবু।
শালিখ তুমি ম'র না,
চাতালে অনেক ধান– ক'টা খাবে!
অনন্তের দিকে
আমি যা পারি নি, তুমি তা ক'র— ব'লে গেল পিতা;
সন্তানও একদিন পিতা রূপ ধ'রে এই কথা ব'লে গেল সন্তানের কাছে—
এইভাবে অপূর্ণতা চলে গেল অনন্তের দিকে
ভোট
তৈয়ার হবে একটি নতুন সরকার।
সে শেষ হলে আমরা শুধু টের পাব
আমাদের বয়স বেড়ে গেছে পাঁচটি বছর—
এই মতো, এক-একটি সরকার আমাদেরে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়
শব্দকাঠ
এত যে লিখছি
মনে হয়
মরে গেলে শুধু শব্দ দিয়েই পুড়িয়ে দেয়া যাবে—
পর্নগ্রাফি ও আমরা
কয়েকটা রাত পার হলে ঠিক বুঝে যাবে
ওইসব বানোয়াট খেলার চেয়ে
আমাদের দমিত চোখের উঁকিঝুঁকি সেও কত ভাল,
কত ভাল স্বপনচারণ!
বাঁশি
পথের বহু আঁকবাঁক পাড়ি দিয়ে
যখন সে, আমার মোটর সাইকেল
উঠতে যাবে প্রশস্ত সরল সড়কে,
তার কিছু আগে, যেমন থাকে, এক অরক্ষিত রেলপথ—
এখানে এসে হঠাৎ সে বাঁশি বাজায়
যেন তার বাঁশি শুনে সচকিত থেকে যাবে ট্রেন;
যেন থেমে গিয়ে, ট্রেন তার চলার বাঁশিটি থামিয়ে
খোলা আকাশের নীচে আশ্বিনের বাঁশি কিছুক্ষণ শুনে নেবে...
জীবনতত্ত্ব
শত দুঃখের মাঝেও জগতে বড় কাকিমার শরীরখানা আছে।
এত অনটন, শোক ও তাপ তার— তবু
কেমনে অটুট ওই বুকের গুরুভার,
ওই তার পাছার গম্ভীর?
জীবনকে তবে অর্থপূর্ণ মনে হয়!
কবিতায় অশ্লীলতা
সে কোন্ বস্তু
এ জগতে কেউ জানে না তা।
শুধু যদি চাকরি চলে যায়, বিশেষত অধ্যাপনার,
তবেই বুঝবে
কবিতায় অশ্লীলতা আছে—
যেমন না-কি ছিল দাশবাবুর
যেমন বসুবাবুর...
আত্মপরিচয়
বড়াই ক'র না—
শিশুকন্যার সামান্য কাশির শব্দে, কবিতা, ভেঙে যাও তুমি!
সকালের বাস
আরও ক্ষুদ্র খুচরার অভাব কারণে
যখন ওদের কারো হাতে দশ টাকা তুলে দেই
সে আমার মাথায় ও বুকে রেখে বার বার মলিন হাত
দোয়া কত করবেই— সংসারের খোঁজখবর– ক'টা ছেলেমেয়ে...
বাসে উঠে সিটে ব'সে অথবা সিটেরে ধ'রে দণ্ডায়মান ভাবি:
দশে এত দোয়া— ভাবা যায়!
তারপর, যত ভীড় হোক হকার উঠবেই—
স্বরকারুকাজে যার সেন্টকে ছেন্ এবং ব্রাশকে ব্রা শোনা যায়
সকালের বাস চলতে চলতে প্রসন্ন ভাবে:
আমাদের ভিখিরি ও ক্ষুদ্রব্যবসায়ীদের মিথ্যেগুলো সুকুমার—
বেঁচে থাক, কিছু মিথ্যে বেঁচে থাক!
অভিন্ন
আমাদের রান্নাঘর, বসার ঘর, পড়ার ঘর সব ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে
কিন্তু যাকে আমরা শয়নঘর বলি সেটাই সঙ্গমঘর।
কম্পোজিশন
শব্দ, সুরের মতো বা রঙের মতোই, তার শরীর দিয়ে
একটি ব্যাকুল শূন্যস্থানকে যখন ভরিয়ে তোলে
তা হয় কবিতা—
ফলে শব্দের লীলাই শুধু নয়, ওই ভরে-ওঠাটাও বিষয়:
শেষপর্যন্ত ওই ভরে-ওঠাটাই বিষয়!
এমনকি একটি দৃশ্যমান কবিতার
শব্দাবলীর পাশে পাশে এবং পত্রপটের ওপর
যতটুকু বিরাজমান শূন্যতা, তা আর স্থানের শূন্যতা আসলে নয়—
শব্দের প্রাণের শূন্যতা ছড়ায়ে রয়েছে! ...
উপলব্ধির মতো করুন
বয়েস হলেই কেবল বোঝা যায়
আমাদের নির্মম উচ্চারণগুলির মতো বেদনাময় আর কিছু নয়।
কবিতা ও কবি
রূপ-ও-আলেখ্যভরা হে বস্তরাশি, তোমাদেরে অবলম্বন ক'রে
বস্তু অতীত এক অনুভব নির্মাণ— এ-ই কবিতা।
হে অনুভব, অবাঙ্মনসগোচর যে-তুমি, তাকেও নির্মাণ যে করে
সে বড় কেমন কারিগর!
কাব্যতত্ত্ব
লিপিবন্দী হতে গিয়ে হয়ে ওঠে দুরূহ নির্মাণ
যদিও, হায়, টলোমলো জন্মখানি তার—
বাক্ ও মনের অগোচর;
তাই যদি কথাগুলো প্রাণবাহী, প্রাণঘাতী হল, সে-ই সব—
তুমি তার বানান ও যতিচিহ্ন ঠিক ক'রে প'ড়।
2 মন্তব্যসমূহ
আমার প্রিয় কবি। তার কথাভঙ্গি, বাক্য, কবিতা এমনকি চেহারা সবকিছুই আমার ভাল লাগে। বলা যায় অনুপ চণ্ডালের কথা ভাবলেই আমি মোহগ্রস্থ হয়ে পড়ি। তাকে এ মাসের কবি হিসেবে তুলে ধরায় দিব্যক কর্তৃপক্ষকে বুকভরা ভালবাসা জানাই।
উত্তরমুছুনআমার প্রিয় কবি। তাঁর লেখা আমার রাতের খোরাক বলা চলে। প্রতি রাতে, নিভৃত হয়ে, খুব নিশ্চুপ হয়ে আমি তাঁর কাব্য পাঠ করি। শব্দের এমন সুচারু ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে খুব কমই হয়।
উত্তরমুছুনঅস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।