....

মেহেদী হাসানের ৫টি কবিতা


কয়লা-কালো

           জন্ম যদি হতো ঘোর আফ্রিকাতে
ওখানেতো কেউ সাদা নয়-শরীরের রঙ সবারই কালো,
          অথবা যদি  ঠাস-বর্ণিল ইউরোপে-
আমার গায়ের চামড়া নিশ্চয় রঙধনু সাত-রঙের সমাহার হতো!
           সাদা-কালোর রঙ্গিন দেশে জন্মে-
শক্ত অন্ধকার হয়ে-হয়েছি (অসুন্দরের অন্য নাম) কালো।

যখন আমি ছোট্ট কুট-কুটে শিশু, পাড়া-পড়শীরা বলে; 
      দেখো-দেখো বাচ্চাটি হয়েছে কেমন কুচকুচে-
মাথা নেড়ে প্রাচীন দাদী বলে, সোনার আংটি যে বাঁকাও ভালো।
     এ সোনা যে শুধু বাঁকা নয়, এ যেন কয়লা-কালো! 

         সেই থেকে কালোর হল যাত্রা শুরুঃ
আমাকে আরো কালো করলো খেলাচ্ছলে শরীরে মাখা ধূলো।
          খা-খা করা চৈত্রের দুপুরে বগলে
      বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যেতে যেতে,
বিকেল বেলায় কাদা-মাঠে ফুটবল খেলে খেলে
     -রোদে পুড়ে হলাম কাক-কালো;
লাল জ্বলজ্বলে সূর্যটি আমার চামড়াটিকে
      করতে থাকলো অবিরাম গাঢ়।

সাদা কুয়াশায় ঢেকে এলো কড়কড়ে ঠান্ডা শীত
 ও’ শীত কালো-কালো গোলাকার-ছোপ মুখে রেখে দিয়ে গেলো।

আকাশ কাঁপিয়ে রঙ ছড়িয়ে বর্ষা এলো-
জমাট মেঘ জড়িয়ে ধরে ময়লা মোরে করল আরো।

উজ্জ্বল বসন্তে মসৃন কোকিল শুনিয়ে গেলো গান,
সিগারেট খেতে খেতে যে, ঠোঁট দুটিও থ্যাবড়া কালো
 সত্যি বলছি; প্রিয়ার মুখে স্নিগ্ধ-চুমু খেতে পারিনি-তাই এখনো।

অবয়বহীন কিছু লোকের উত্তাল মিছিল-বিপ্লব হবে আজকালই,
কলার খোসা পচে গেলে হয় যেমন কালোঃ
রোদের উষ্ণতা এখানেও আমাকে ফাঁকি দিলো।  


হোয়াইট কলারের দাবড়ানি খেয়ে শরীরে রংহীন জখম হলো-
দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেলাম, বসতে গিয়ে উবু হলাম,
        কিছু ধুতরা-বিবর্ণতা ঘিরে ধরল।

মানুষের রঙ্গীনপনা মুখ দেখে যখন
দিয়েছি হেসে খিল-খিল---
বড়-বড় ধবল দাঁত গেছে বেড়িয়ে;
এতোবড় ঝলমল যুগেও হয়েছি তাই
 নিতান্তই চৌদ্দ ইঞ্চি সাদা-কালো।

তীব্র শীতের দেশে গিয়েছি, অন্য কারো নয়ঃ
 নিজেরই শরীরটাকে টেনে নিয়ে-
বরফ রঙা টিকোলো নাক জিজ্ঞেস করে,
কেনো তুমি নিকষ কালো?


কালো হই বয়সের চাপেও 
চুলগুলোও তবু হচ্ছে ধূসর ক্রমান্বয়ে------ 




এক ও অনেক

এক:

চতুর্দিকে শক্ত পাথরের  মজবুত দেয়াল-
মাঝখানে কিছু খসখসে বস্ত্রহীন জমিন।
এরই মাঝে ঘুরে ঘুরে চলা ফেরা-
একই পথরেখায় পরপর পায়ের ছাপ,
ঘুরছি, ঘুরছে, ঘুরছো পরস্পর অনতিক্রান্ত।
মাথার সামান্য উপরে টাইলসের ছাদ
লাফ-ঝাপ মাথায় দারুন আঘাত;
বিকলাঙ্গ, কখনো বা মৃত্যু অবধারিত।

সহস্র বছরের সাধনায় বেড়েছে কি একটু সীমারেখা?
এক আধ ইঞ্চির বেশী নয়! 

একই পেষ্ট, পুরোনো ব্রাশ, ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতে
প্রত্যেকদিন সকালে ঘষা।

একই সাবান-শ্যাম্পু অভিন্ন শরীরে-মাথায়
 প্রত্যেকদিন দুপুরে গোসল।

একটি নারী, দুটি মাত্র স্তন, নিবেদিত জঙ্ঘা, উরু
 প্রত্যেক রাত্রে মন্থন।

অনেক:

একটি মাত্র ছিদ্র শুধু
নানা রঙ্গা আলোর প্রবেশ-
একই বাঁশিতে কত সুর!
একটি কি-বোর্ডে মেলা বোতাম
একটি চিত্রকলা-অনেক রঙের ছোপ
একটি বই সংখ্যাহীন অক্ষর,
চিত্র-বিচিত্র ফুল ফল
সীমাহীন অনুভূতি-
বুদবুদের মত চিন্তা-ভাবনার উদয়;

একজন এক ও অনেক। 



চে-সুগন্ধী

             মানুষের মাজা বাজারে ঘুরে-চরে, চলে-ফিরে
দেখেছি অনেক পন্য; কতরকমে সাজানো-সার বেঁধে মগ্ন-
         বাজার আজকে সয়লাব, খোলা মুদ্রানীতির বিশ্ব।
সাবান, শ্যাম্পু, ফেসওয়াস, রোল-অন ডিওডোরেন্ট-স্প্রে--ফূৎকার--চুরুটের ধোঁয়াঃ 
          হরেক রকম গেঞ্জী, সার্ট, ফতুয়া, টুপি, অন্তর্বাস-কাচুলী, জাঙ্গিয়া, পাদুকা।


                 হঠাৎ আবিষ্কার তুমি
সমাজতন্ত্রের মোড়কে-তোমার সুদৃশ্য, চকচকে মোহ ধরা প্যাকেটে
              ঝিমিয়ে পড়া বিপ্লব, জং ধরা মানবতা;
দেদারচ্ছে বিকোচ্ছো-আদর্শের ট্রেডমার্ক-স্টারমার্ক লাগিয়ে।


    যদিও অমূল্য, তবুও এখন দামী সবচেয়ে এই ভূমায়-
           উন্মুক্ত বাতাস-অক্সিজেন হয়ে বদ্ধ পিপায়।

মধ্যবিত্ত-(ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, খেতমজুর, সর্বহারা)
 এখন বেকার বুদ্ধিজীবি-অকেজো সাহিত্য সম্পাদক;
দু-মুঠো অন্ন যাও জোটে নিকোটিনের অভাব মোটে ঘোচেনাঃ  



 কবিতা, ছোট গল্প, মুক্ত গদ্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ লেখা হবে,
            তোমার গাঢ়-লাল টকটকে রক্ত ছেনে ছেনে; 
তোমার লাঞ্ছিত মৃত্যু, বাঞ্ছিত জীবন বাক্স বন্দী করে-
           অনেক দামে বিকোবে সাহিত্য বাজারে!

রাজপথে নামার আগে- 
তোমার চিত্রাঙ্কিত ডিওডোরেন্ট----
            দুই বগলে আচ্ছামত; 
            গা থেকে ভুস-ভুস করে বেরোবে চে-চে গন্ধ--
দেহ-কাঁপানো, মন-ধাঁধানো, হৃদয়-দোলানো, চে-চে সুগন্ধ---




স্বপ্নহীন

বিশ্বাসের  বিশাল ভাঙ্গা হাতুড়ি দিয়ে ওরা প্রতিনিয়ত আঘাত করে
আমার মননবোধে, ফেটে চৌচির হয় শিল্পিত ফুলগুলো;
যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে হয়ে উঠে অন্ধ,
ফিরে আসে; হয়তো আবার মেলতে চায় পাখা ঐ নীলাকাশে
কিন্তু আকাশটাও ঘোলা আজকে; ওদের নষ্ট বাতাসে।  

গতকাল রাত্রে গভীর মানবিক ডুব দিয়েছিলাম-
মাথায় আচানক আঘাত পেয়ে লাল চোখ খুলে দেখি,
মেছতা পরা মুখে ডলছে বিবর্ণ তৈলাক্ত ক্রীম;
আর রঙ্গিন কৌটা পারফিউম মোজা গন্ধ শরীরে।
মোহিত হতে থাকে শুধু পাশের বিশাল আলমারিটি-
মরচেরা আরো ঘন হয়ে উঠে। 


ফ্লোরোসেন্ট আলোয় বসে, বিজ্ঞানের উজ্জ্বল মুখে
কঠিন অমাবস্যা ওরা মেখে দেয় দল বেঁধেঃ 
নুয়ে পড়তে পড়তে গাছের শুকনো পাতাহীন ডালের মত
       বেমানান বোধ হয় নিজেকে।  

     একদিন ক্লান্তবেলায়
কঠিন রুক্ষতায় প্রশ্ন ছুড়েছিল,
বল- আর কে আছে তোদের দলে?   
        নাকি তুই একা! 
     আমাদের আবার সংঘ!
চেপেচুপে কারো মুখই মনে আসেনি-
আমরা যে পারিনা জোট বেঁধে থাকতে-
        ভেড়া থাকে দল বেঁধেঃ   
একাই ঘুরে বেড়াই-হঠাতই হয়তো কখনও
    কারো সাথে দেখা হয়ে যায় স্বপ্নের কিনারে।
   
মুখে মহুয়া বাঁকা হাসি, বেলের মত গোল স্তন, সিগারেটের মত সরু কটি;
ঘোড়ার লেজের মত রাশি রাশি চুল ক্লিপের অসংখ্য মার-প্যাচে বাঁধা-
        রক্তের জারক কনাগুলোর অস্থিরতা থাকে বাড়তে ।
ধেয়ে যাই উন্মাতাল- যাদিও অনেক দিনের জমানো পচা গন্ধ!
    হোয়াইট মাস্ক চামড়া কঠিনরকম স্বচ্ছ-
    ভেতরের নাড়ি-ভূড়ির নগ্ন আনাগোনা-
থেঁতলানো মুখ ফেরাই গোধূলির রক্তাভ বিচ্ছিন্ন আকাশে।


            টগবগে যুবক-নরম কান্তি মুখ,
মাছের পোনার মত রক্ত দাপিয়ে বেড়ায় সমস্ত আঁটসাঁট শরীর জুড়ে;
     পিছন দিকে ঘাড় ফুড়ে বের হয়েছে আরেকটি মাথাঃ
   সামনের দাঁত নেই-বাকী গুলোতে রাশি রাশি ময়লার স্তর।
প্রথম সুন্দর, দ্বিতীয় কুৎসিত মিলে মিশে তৈরী হয় ফ্যাকাশে পিচ্ছিল শ্যাওলা। 


বড় ঘুম পাচ্ছে, অনেক বিশাল ঘুম-পানির মত তরল;
        সামান্য টুকটাক ঘৃণায় জেগে উঠি।
স্বপ্নেরাও তাড়া খেয়ে গেছে  ফিরে-ওরা নাকি আর এদিকটা মাড়াবেনা!
       স্বপ্নহীন এক জোসনা রাতে অবিরাম এ বেঁচে থাকা আমার।


সময়ের আহ্বান

মিছিলের সাথীর চেয়ে আছে বন্ধু কি ঘনিষ্ঠ?
হতে পারে কেউ সহযোদ্ধার চেয়ে আপন কোন সঙ্গী?
স্বপ্নের চেয়ে আবেদনময়ী কোন মানবী নেই।
কোন সে মানবী স্বপ্নের চেয়ে আবেদনময়ী!
বন্ধুরা- তোমরা কি ফুলে ফুলে শুধু মধু খোঁজো? 
সঙ্গীরা- তোমরাও কি এখন নিশীথ চন্দ্র শুধু? 
স্বপ্নের সারথিরা- তোমরা কি এখনও মজ্জমান?
স্বপ্ন, তুমি  কি পেতেছো সংসার নপুংসকের সাথে  মসৃন দেয়ালের অভ্যন্তরে?
           আমি সময় বলছিঃ অসময়ের সীমানায় দাঁড়িয়ে, 
           আজ যদিও ম্রিয়মাণ- ক্ষয়িষ্ণু, কিছুটা নড়বড়ে;
           তবুও রক্তের ভেতর অশান্ত সুনামী খেলা করে।
           এসো বন্ধু, এসো মিছিলের সাথী, এসো সারথি, এসো হে মানবী;                                                                                                                                                                
           আমি আবার মিছিলে যাবো-মনকম্পের উন্মাদনায় জেগে উঠবে রাজপথ।
                    কতকাল নামানো সময়ের হাত পাতালের দিকে!
                    আবার উৎক্ষিপ্ত হবে- মুষ্টিবদ্ধ, ক্ষ্যাপা, তেজী, উন্মত্ত।

তোমরা কি শুনতে পাচ্ছো সময়ের দৃপ্ত, দৃঢ় আহ্বান-
               বুক পেতে; 
তোমরা তো কেউ নেমেছো ভ্যাপসা মাটির গহ্বরে।
অসময়ের খাপছাড়া প্ররোচোনায়
কেউ উঠেছো বিষন্ন চিতায়।
তোমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো এখনো জ্বলে
শিখা চিরন্তনীর মত অনাগত সময়ের পাজরের ভেতরে।
অগ্নিকুন্ডে নিজেকে মুড়ে উঠে এসো চিতা থেকে
মুঠো ভর্তি নতুন আহ্বানের পলি নিয়ে ফুড়ে উঠো কবর থেকে-
  তোমরাই যে সময়ের দগদগে হৃদপিন্ড। 

আমিও অকালের সিড়ি ভেঙ্গে আসবো নেমে
অলস দর-দালানের কুঠুরি থেকে।
স্বপ্ন, তুমিও চলে এসো স্বামীর গোছানো সংসার দু পায়ে দলে, 
আসো তোমার  উন্মাতাল প্রেমিকের কাছে।
বন্ধুরা তোমরাও আসো- সময়ের আহ্বানে আসো;
জেনো, কেবল স্পর্ধাই সময়।
প্রশাসনিক ভবন থেকে আসো,
সচিবালয়ের কুঠুরি থেকে আসো,
সংবাদ পত্রের কন্ট্রোল রুম থেকে,
বিজ্ঞাপনের দামী বাক্স থেকে,
দমবন্ধ সরকারী অফিস থেকে,                 
বেসরকারী সংস্থার আরাম কেদারা ছেড়ে আসো।
অলিগলি থেকে, রাস্তার মোড়ের কোলাহল ছেড়ে,
চা স্টলের প্রফুল্ল আড্ডা বগলদাবা

                                                করে, ঝাঁকে ঝাঁকে আসো বেরিয়ে-
গায়ে গা লাগিয়ে অখন্ড মেঘের মত জমাট বেঁধে আসো।
              আমরা আবার মিছিলে যাবো-
সূর্যের প্রখর রোদে জ্বলজ্বল করবে নগ্ন রাজপথ।
          
          আসো শ্লোগান ধরো-
শ্লোগানের চেয়ে মধুরতম কোন সঙ্গীত নেই।
            ফেস্টুন রাখো উঁচিয়ে-
ফেস্টুনের চেয়ে কান্তিমান কোন পতাকা নেই।
           ব্যানারে মুড়ে নাও ফুলে উঠা শরীর- 
ব্যানারের চেয়ে অভেদ্য কোন বর্ম নেই।
         আসো হাতে অস্ত্র লও, হও সশস্ত্র-
মিছিলের চেয়ে নেই শোষণ ধ্বংসী কোন যুদ্ধাস্ত্র।
       রাজপথে পায়ের পর পা ফেলে যাও এগিয়ে- 
এর চেয়ে অনিন্দ্য কোন তাল নেই।

আসো কাঁধের জোয়াল ফেলে কৃষক,
আলপথ ধরে মাল কোছা মেরে দৌড়ে আসো ক্ষেত মজুর,
মাথার বোঝা অবলীলায় ঝেড়ে ফেলে কুলি,
কারখানার চাকা বন্ধ করে শ্রমিক,
সেলাই কলের তীক্ষ্ণ সূচ হাতে কিশোরী,  
সেনা ছাওনি থেকে হুল্লোড় করে আসো জোয়ান,
পুলিশ লাইন থেকে সটান দাঁড়িয়ে আসো কনস্টেবল,
সীমান্তের কাটা তার ছেড়ে আসো রাইফেলস,
বয়স্কা নারীরা আসো ঘোমটা ফেলে
শহীদের মা হয়ে।
স্কুল ব্যাগ কাঁধেই আসো ছাত্র,
কি-বোর্ড সাথে করে আসো ব্লগার,
চোখা কলম বাগিয়ে ধরে এগিয়ে আসো সাহিত্যিক,
সময় তোমাদের ডাকছে, অসময়ের কিনারে দাঁড়িয়ে; 
তার স্পন্দমান হৃদপিন্ডকে দু হাতে সামনে মেলে ধরে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।