....

চতুর্থ সংখ্যা : ডিসেম্বর ২০১৩

সম্পাদকীয়

অবশেষে, ৯ দিন দেরি করে প্রকাশিত হল চতুর্থ সংখ্যা। বিশেষ কিছু নয়; কিছু নতুন যুক্ত হল এই সংখ্যায়, নতুন কবি, নতুন বিভাগ; আরো কিছু থাকবার কথা ছিল, সম্ভব হল না। আফসোস রয়ে গেল। এই আফসোস-অসন্তুষ্টি থেকেই জন্ম নেবে পরবর্তী সংখ্যা। পাঠককে সেলাম।

ছবি: আল নোমান

মৃত্তিকা, দ্বিধা হও! ...
আরণ্যক টিটো

কেটে যাচ্ছে, রক্ত বেরুচ্ছে না! ...
দেখছে না কেউ, দেখছে না হরতনের রাজা,
প্র/শাসন
কিঙবা বিধান! ...
ভয়ে
কলিসব ফুটছে না,
পাখিসব ডাকছে না,
আহা পোড়াজমি, ফসল, ফলছে না! ...
মৃত্তিকা!
দ্বিধা হও! ...

জীবনকেন্দ্রের ভার কাকে দিয়ে যাবো? ...

কেটে যাচ্ছে,
রক্ত বেরুচ্ছে না! ...
ব্যঁথায় কুকড়ে যাচ্ছি,
বলতে পারছি না, উহ্! আহ্ !
ভয়, লোকজন
ঠারে ঠারে ঠাউরাবে, ধুর, শালার পাগল!
.....................

কেটে যাচ্ছে,  রক্ত বেরুচ্ছে না! ...
দেখছে না, দেখছে না কেউ,
রে মদন,
বুঝিনা! বুঝিনা!
কোনবা বাতাসে নড়ে তালগাছ মহাশয়,
ঝরে
বাবুইয়ের বাসা, শিল্পলোক!

ব্যঁথায় কুকড়ে যাচ্ছি,
বলতে পারছি না, উহ্! আহ্ !
ভয়, লোকজন
ঠারে ঠারে ঠাউরাবে, ধুর, শালার পাগল! ...
মৃত্তিকা,
দ্বিধা হও! ...


সুজাতা
তুহিন দাস

সুজাতা, চিরসন্দ্যিগ্ধ অশ্রু পারাবার মুছে
একদিন ঠিক আমি নীল ট্রফি এনে দেব,
এখানে চায়ের দোকান থেকেই দেখছি মোটরকারের
চাকা ঘোরাতে ঘোরাতে রাস্তায় লোক যায়,
শীত আসছে সুজাতা -- পথে পথে ঝরাপাতাদের
অজস্র দেবতারা উড়ছে, মানুষেরা এই ঋতুতে আরো মানবিক হবে
শীতবস্ত্র দান করবে আবার পিকনিকেও যাবে; জমে উঠেছে
বিকেলের মাঠে মেয়েদের ব্যাডমিন্টন খেলা
পাশেই চুনুরী চুন ঘুটছে, বেগুনী জামা পরা
লোক আমি প্রায়ই শীতের এই বিখ্যাত খেলা দেখি;
সুজাতা সুজাতা বিকেলবারান্দার ইজিচেয়ারের বিষণ্নতা ছেড়ে
তুমিও এবার নেমে এসো আমাদের এ খেলায়



দু টি  ক বি তা
হাসনাত শোয়েব

ঈশ্বরের জামা

ঈশ্বরের কমপক্ষে একটা জামা থাকতে হয়। যার পকেটে থাকবে জিরাফের ছবি। আমরা মধ্যাহ্ন বিরতিতে গিয়ে মাঝে মাঝে সেই ছবি দেখে আসব। ছবি দেখে আমদের মন খারাপের মত কিছু একটা হবে। তখন আমরা চিড়িয়াখানায় গিয়ে সত্যিকারের জিরাফ দেখব। ফিরে আসার সময় ঈশ্বরের কথা পুরোপুরি ভুলে যাব।


শহুরে এলজেব্রা

শহরটা ক্রমাগত পাতাহীন এলজেব্রার দখলে। আমরা এখনো গড়পড়তা সোডিয়াম হয়ে জ্বলে আছি। নিস্তরঙ্গ ডবলডেকার কিংবা উজ্জ্বল রেস্তোরাঁর হিলিয়াম মাছখেকোদের দখলে আছে সিনিকদের সময় থেকেই। শেষ পর্যন্ত আমরা পা থেকে রাস্তার কোন দূরত্বই আর তৈরি করতে পারিনি। তবুও রাস্তাগুলো আজন্ম মানুষের স্বাদ নিয়ে বাঁচবে বলে আমাকে ধরে রাখে।

এলজেব্রা কখনো মানুষের বিষয় ছিলো না।



প্রশ্নবিদ্ধ সূর্য
ফরহাদ নাইয়া

বাঘের গলায় হাড়। /
ক্রমাগত বক টানে /
মুখো মুখি সূর্য........ /
লাল বেদনার জবা। /
পূর্নিমার চাল কুমড়ো /
বন্ধ ডেকেছে....... /
হ্যারিকেন জ্বেলে খুঁজি আগরবাতি, / নদীটির শিয়রে পুতে দেবো / চোখ ওঠা বিঘুম রাত /
ব্রন ওঠা বিঘুম রাত /
মাইগ্রেনের বিঘুম রাত /
কোথায় সিডাক্সিন ?



তি ন টি  ক বি তা
শাহেরীন আরাফাত

উপলব্ধি

দূরে তবু অস্তিত্বের নিকটে
পৃথক তবু বৈপরিত্বের ঐক্য
মনের অতল গহিনে যেন কার আনাগোনা
নিয়ত তাতে কার ধ্বনির প্রতিফলন
শত প্রতিকূলতার  মাঝে চেতনায় তার অনুরণন...

যেন শ্রাবণের অঝর ধারার মতোই-
কাছে টানে
অথবা-
দূর্দান্ত ভ্যাপসা গরমে তার শীতল স্নিগ্ধ
অনুভূতির  পরশ

কৃত্রিম নগরীর অমানবিকতার তন্ত্রেও-
আশাবাদী করে যে কণ্ঠ
জীবনের দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণেও -
যেন তার বিকাশের উপলব্ধি.....

ঢাকা, ২৭ জুলাই ২০১৩



বিষবৃক্ষ

বিয়াল্লিশ বছর আগে রোপিত হয়েছিল
যে বিষবৃক্ষের বীজ
সে কেবল স্বরূপে আবির্ভুত আজ
খুব জানতে ইচ্ছে করে-
তার এ রূপে
এতো হাপিত্যেষ কেন তোমাদের?

যে বিষন্ন পাতায় ছিল সবুজের ভ্রান্তি
তা ধুয়ে মুছে ক্রমেই সে প্রস্ফুটিত করছে
বিষাক্ত স্ফটিক
যেখানে ছিল ছায়া সুনিবিড়তার মায়া
সে মায়ার ছল কাটিয়ে কন্টকাকীর্ণ রূপে
সমগ্রটাই নিংড়ে নিচ্ছে তার বিষাক্ত ছায়া

খুব বেশি জানতে ইচ্ছে করে-
এখনো কি তোমাদের মোহ কাটেনি?
এখনো কেন সেই বিষবৃক্ষ টিকিয়ে রাখতে
তোমাদের যতো আক্ষেপ?
আর এই আবেগের রসাতলে
অথবা মোহের ছলনায়
বিপন্ন মানবতা...

তোমরা এটুকু  জেনে রেখো-
এখন আর ওই বিষবৃক্ষ ছোট্ট চারাটি নেই
তার হাজারো ডালপালা
আর
রয়েছে সদা বর্ধিষ্ণু বিষের থলি...

অথচ

এখনো তোমরা গেয়ে যাচ্ছো তারই গুণগান
কেন উপড়ে ফেলছো না ওই বিষবৃক্ষকে?
কবে জাগবে তোমরা,
বিষের গ্রাসে করায়ত্ব হলে পরে?
নাকি ভয় পাচ্ছো লড়াইকে?

সংগ্রামে  দিতে হতে পারে চরম মূল্য
যেমনটা দিয়েছিল তোমার পূর্বজরা,
বিসর্জন বিনে কি অর্জন হয়!

জেগে ওঠো
গর্জে ওঠো
বিষাক্ত নিশ্বাসের ছোবল থেকে
মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়
তোমরা এগিয়ে চলো,
নিজেদের তৈরী করো
যেন দুটি হাত, দুটি মেশিনগান...
এই লড়াইয়ে নিশ্চিত জয় তোমাদেরই...

ঢাকা, ২৬ নভেম্বর ২০১৩



বন্দি

আমরা এক অদৃশ্য খাঁচায় বন্দি
যে খাঁচায়-
আমরা স্বাধীনতার নামে শৃঙ্খলিত
মুক্তির নামে পরাজিত
আর অধিকারের নামে পীড়িত...

তবু কিছু আশা
বাঁচিয়ে রেখেছি সযতনে-
একদিন আমরা মুক্ত হবো
উড়ব ঐ সুনীল  আকাশে
শ্যামল ছায়ায় হবে আমাদের মাতামাতি...

কিন্তু ক্রমেই যেন ক্ষীণ হয়ে আসে
সেই স্বপ্নেরা
কারা যেন  ছিনিয়ে নিতে চায়
আমার স্বপ্নের স্বাধীনতাটুকুও...

তারা স্বদম্ভে হেসে উঠে
তাদের অট্টহাসিতে
ক্রমশ বিলীন  হতে থাকে
আমার আবেগী স্বপ্নেরা...

এখন আর স্বপ্নেরা
ফসলের মাঠ আর হাসিমাখা মুখ হয় না
এখন সেখানে জায়গা হয়েছে
কালো কাপড়ের জল্লাদ আর
সাদা কাফনের...

তাদের আমি বলি-
আমায় তো বন্দি রেখেছো খাঁচায়
তবে কেন ঐ নির্বাক স্বপ্নদেরও
ছিনিয়ে নেওয়ার পায়তারা
কী করে বন্দি করবে আমার চিন্তাকে?

মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়া হয়েছে
হাতগুলোও শেকলে আবদ্ধ
চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণেরও
সর্বাত্মক চেষ্টা...

তবু মুক্তির আকাঙ্খা মরেনি
তবু চির অম্লান সেই চেতনা
শেকলে বন্দি শরীরেও
যে চেতনা বহমান...

ঢাকা, ২২ আগস্ট ২০১৩


আমাদের আর্তনাদ ডুবে যায় অজস্র নামহারা পাখিদের গানে
সৈয়দ সাখাওয়াৎ

১.
রোদগুলো পুড়ে গেলে শহরের ঘরে ঘরে আলোকবাতি জ্বলে উঠে, জ্বলে উঠে পোকাদের বংশগতি, রাত্রি থেকে রাত্রিতে শুরু করে শোক সঙ্গীত। মানুষের শোক সঙ্গীত পোকাদের চেয়ে আলাদা। মানুষ একটা ল্যাম্পপোস্টের ভেতর পুরে দিয়ে সমস্ত রাত্রি ঘর থেকে ঘরে জুড়ে দ্যায় বিষন্ন আলাপ। তারপর ঘুমের নিরুদ্দেশ ভ্রমণ শেষে হয় এক একটি জোনাক পোকা। আদতে মানুষের ঘুমঘোর ঝিঁঝিঁদের একটানা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, বিষণ্ণ বৃষ্টি।

২.
আমিও ঢুকে পড়ি স্নানঘরে ছায়ার সাথে। ছায়ার শরীরে গড়িয়ে পড়া জল দেখতে দেখতে ছুঁয়ে দ্যাখি কাশফুল বন। স্নানঘরে তখন তীব্র হাসির রোল।

৩.
শহরে নেমেছে শিকারী দল। লোহার সাড়াশী পেটের উপর চাপা সারমেয় দল। ইনজেকশন পুশ করার আগে বুক চিরে দেওয়া তীব্র চিৎকার একইভাবে বের হয়ে আসে মানুষের কণ্ঠচিরে। দারুণ মিল!

৪.
আঙুলগুলো লতার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেন এক ঘেরাটোপ। আহা! এ বড় জটিল জাল, তোমার কাছ থেকে আমি কিংবা তুমি বেরিয়ে আসতে পারি না। ওদিকে রাত্রিবেলা অনেকগুলো মশারি মুখোমুখি এঁকে যাচ্ছে বাড়ীর ভেতর ঘরের ইতিহাস। আপাতত আমি সেই ইতিহাস বই দ্যাখে তোমার নামতা পড়ে যাচ্ছি। নামতা যেন তোমার প্রতিরূপ। কেননা হিসাবের মানচিত্র আমি এক জীবনে একবারই এঁকেছিলাম-তোমায় দ্যাখে।

৫.
কেইবা দিতে পারে এমন বিশ্বস্ত আস্থা, তোমার দিকে ফিরে তাকাবে না সময়ের নিঃশব্দ যাত্রা। বেমালুম তোমাকে রেখেই উড়ে যাবে সময়ের অগণিত ঢেউ। এপার থেকে ওপারে কত কত ফেনায়িত শব্দমালা উড়ে যাবে মেঘ থেকে মেঘে। এরকম নিস্তরঙ্গ একটি দিন ঠিক ফুরিয়ে যাবার আগেই, ভেঙে দিবে অসমাপ্ত ঘোর। তারপর; উড়ে যাওয়া দীর্ঘ চিলের ডানায় তু্মি গুঁজে দেবে ঐশ্বর্যের অনাহুত প্রেমিকার নাম-দীর্ঘশ্বাস!

৬.
বৃষ্টিজল ঝরে পড়ে বর্ষাতির গায়ে। ভেতরে অজস্র বৃষ্টিফোঁটা স্বেদবিন্দু হয়ে ঝরে। তোমাদের কাছে মেঘ মানে বর্ষাতি। আর আমার বৃষ্টিঝরা দিনে- ঘাম ছেড়ে জ্বর চলে যাবার অনুভূতি নিয়ে একাকী।

৭.
খরানো রোদ, জলের শরীর থেকে তুলে আনা শীতল পরশ নিমিষে উধাও হলে-আমাদের শরীরজুড়ে নেমে আসে কান্না। আমাদের আর্তনাদ ডুবে যায় অজস্র নামহারা পাখিদের গানে।

৮.
কত কিছুই তো ঢেকে রাখো, কত কী...

নগ্ন রঙিন চোখের কারুকাজও!

৯.
আমি ডাকলাম এসো, নেমে এসো উপর থেকে কথা বলি মুখোমুখি কিছুক্ষণ। তুমি বললে আসছি, বলে রয়ে গেলে-নেমে আসলে না। মাঝখানে বিষণ্ন দেয়াল দিকভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। এ-কথা নির্ঘাত শুনেছ সহস্রবার, কেননা বলে প্রত্যেকেই- তোমার কাছে যারা আসে। আমিও দাঁড়িয়েছিলাম অনেকক্ষণ মাঝে দশ কদম চায়ের দোকান, সিগারেট: পুড়ে গেলো ফুসফুসে দাগ কাটতে কাটতে। তুমি আমায় শিখিয়েছ কীভাবে চুষে নিতে হয় অপেক্ষার সকল প্রহর।

আমি বললাম যাই, এ-বেলা কিছু মুদ্রা কুড়াই। তুমি হাসলে তারবার্তায়, এখনও কী পথ ভুলে নেমে আসে বেহুদা চড়ুই? ভুলে গেলে অপেক্ষার কথা। শেষবার পুড়ে যাবার সঙ্কল্প নিয়ে এ-পথ ও-পথে চিলমারি করি। একটা মানানসই শিকার পেলে নির্ঘাত পেয়ে যাবে ঘরের ঠিকানা। তুমি আমায় শিখিয়েছ, বেমালুম ভুলে যেতে ইতিহাস!


অতৃপ্ত অনুভবে চিঠি গুলো কেঁদে মরে
শুভ্র সরখেল

অতৃপ্ত অনুভবে চিঠিগুলো কেঁদে মরে
বহমান রাতে ছিঁড়েছ বালকের মন-----
হামাগুড়ি সময় আধারে সহবাস করে
দিয়েছিলে পরন্ত সন্ধায় শেষ চুম্বন-----

নির্ঘুম প্রতিমার চুপচাপ অর্চনায়
রুগ্ন সুর তোলে প্রখর গুঞ্জন------
চীৎকারে ভেসে আসে স্বপ্নের পদধুলি
অতল গভীরে আমি হারিয়েছি এখন -----

বাহিরের খোলা পথ সোনামাটি গোধূলি
ডেকে যায় আবিরাম দিনক্ষণ-----
প্রতিবার হাঁটুভাঙ্গা সত্ত্বাকে লুকিয়ে
শিখে গ্যাছ কেঁদে ফেলা একমন-----

[Bran Adams(Inside out) Just for my soft corn!!! থেকে অনুপ্রাণিত।]



চুল
শার্ল বোদলেয়ার
অনুবাদ/অনুলিখন: বুদ্ধদেব বসু

অনেক, অনেকক্ষণ ধরে তোমার চুলের গন্ধ
টেনে নিতে দাও আমার নিশ্বাসের সঙ্গে;
আমার সমস্ত মুখ ডুবিয়ে রাখতে দাও তার গভীরতায়
ঝর্ণার জলে তৃষ্ণার্তের মতো;

সুগন্ধি রুমালের মতো তা নাড়তে দাও হাত দিয়ে
যাতে স্মৃতিগুলো ঝরে পড়ে হাওয়ায়।
তুমি যদি জানতে যা-কিছু আমি দেখি! যা-কিছু আমি শুনি!
যা-কিছু আমি অনুভব করি তোমার চুলের মধ্যে!
আমার আত্মা উড়ে চলে তার সৌগন্ধ্যে
যেমন অন্যদের, সংগীতের পাখায়।

তোমার চুলে সম্পূর্ণ একটি স্বপ্ন বিজরিত,
সেখানে পালের আর মাস্তুলের ভিড়;
তার মধ্যে অনেক বিশাল সমুদ্র, যাদের উপর দিয়ে
মৌসুমী আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় মোহময় দেশে
আকাশ যেখানে আরো নীল,
আরো গভীর
যেখানে বায়ুমন্ডল ফলে-ফলে সুরভি,
আর পাতায়, আর মনুষ্যচর্মে।

তোমার চুলের মহাসমুদ্রে আমি দেখছি
বিষণ্ণ গানে-গানে গুঞ্জিত এক বন্দর,
সেখানে সমস্ত জাতির বলশালী মানুষ,
আর সমস্ত রকম আকারের জাহাজ
তাদের সুক্ষ্ম, জটিল স্থাপত্য খোদাই করছে বিশাল আকাশে-
চিরন্তন উত্তাপের সেই ধাত্রী।

তোমার চুলের আদরের রাশিতে আমি ফিরে পেয়েছি
ভালো একটা জাহাজের কেবিনে
অনেক ফুলদানি আর ঠাণ্ডা জলের কুঁজোর মাঝখানে
ডিভানে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ঘন্টার আলস্য,
বন্দরের অলক্ষ্য চঞ্চলতায় দোল খেতে-খেতে।

তোমার চুলের উজ্জ্বল চুল্লিতে
আমি আফিম আর চিনি মেশানো তামাকের ঘ্রাণ নিচ্ছি;
তোমার চুলের রাত্রিতে আমি দেখছি,
ঝলমল করছে গ্রীষ্মমণ্ডলের অসীম নীলিমা;
তোমার চুলের পালক-নরম প্রান্ত বেয়ে বেয়ে
আমি মাতাল হয়ে যাই
আলকাৎরা আর মৃগনাভির আর নারকোল তেলের মিশোনা গন্ধে।

আমাকে কামড়াতে দাও, অনেকক্ষণ ধরে, তোমার ঘন কালো গুচ্ছ-গুচ্ছ চুল।
স্প্রিং-এর মতো বেশামাল, বিদ্রোহী তোমার চুল
আমি যখন দাঁত দিয়ে কুটকুট করে কাটি
আমার মনে হয়, আমি একটু-একটু করে স্মৃতিগুলোকে খাচ্ছি।


[ প্রথম লিখন: ১৯৩০ ■ বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতা ■ প্রকাশক: দে'জ পাবলিশিং, কলকাতা ■ চতুর্দশ সংস্করণ : মাঘ ১৪১৬, জানুয়ারি ২০১০ ]


‘জীবনানন্দ দাশের ক্যাম্পে, তুহিন দাসের হাতে, মলয় রায়চৌধুরীর জখম’
সঞ্জয় চৌধুরী

তুহিন দাসের সম্পাদনায় একটি অন্যরকম পত্রিকা ক্যাম্পে। যারা ক্যাম্পে পড়েছেন, অন্যরকম বলার কারণটা তাদের তো নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। যারা পড়েননি তারা বোধকরি এই আলোচনা থেকে কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারবেন এবং পত্রিকাটা পড়তে উৎসাহী হবেন।

এই লেখার শিরোনামটা কবি সাম্য রাইয়ানের কাছ থেকে ধার করা। সাম্য যথার্থই বলেছেন। কেননা জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা আছে ক্যাম্পে নামে, যার কিছু অংশ পত্রিকাটির ব্যাক কভারে মুদ্রিত; আর তুহিন দাস সম্পাদিত পত্রিকাটি মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ কবিতাটির উপর আলোচিত।

প্রচ্ছদে মুদ্রিত সম্পাদকীয় দিয়েই পত্রিকাটির সূচনা এভাবে, কতো ছোটকাগজই তো আত্মপ্রকাশ করে অসীম সম্ভাবনা নিয়ে, দ্বিতীয়বার আর আলোর মুখ দেখে না - ওই নিকষ অন্ধকারের মধ্যেই হাতড়াতে হাতড়াতে মুদ্রণযন্ত্রের পিনিয়াম ভেঙে নেমে এলো এই কাগজের শীত - যা পর্ণ/পণ্যসাহিত্যের দালাল/দলিল লেখকদের জন্য চরম ঈর্ষা ও অস্বস্তির।

পুরো পত্রিকা পড়ে এই সম্পাদকীয় ভাষ্যেরই সত্যতা প্রমাণিত হয়।

‘জখম’ সম্পর্কে লেখক মলয় রায়চৌধুরীর একটি বক্তব্য আমরা পাই প্রারম্ভেই, ‘জখম’ কবিতাটি যখন লিখেছিলুম তখন পশ্চিমবাংলার কবিতার জগত ছিল লর্ড ম্যাকলের শিষ্যদের দখলে আলোচকরা স্বীকৃতি দিতে ভয় পেতেন। তারপর, উত্তরঔপনিবেশিক কালখন্ডে পৌঁছে, কবিতা লেখার ধারাই সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়ে এমনই একটি পরিসর গড়ে দিল যে ‘জখম’ নিজের একটা জায়গা নিজেই তৈরি করে ফেলল, আর তাতে আমার কোনো অবদান নেই।

১৯৬৫ সালে প্রকাশিত মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা জখম-এর নানা আঙ্গিকের আলোচনা নিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো পত্রিকাটি। আলোচনা করেছেন নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীর (আসুন আমরা মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’গুলো চিহ্নিত করি), অনুপম মুখোপাধ্যায় (জখম), জাহিদ সোহাগ (জখমের উৎসমুখ নিয়ে কিছু কথা), রিঙকু অনিমিখ (A journey by injured), মিছিল খন্দকার (যাকে উপেক্ষা করা যায় না) ও তুহিন দাস (‘আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব, মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন’)। এর মধ্যে সবচেয়ে গভীর পর্যালোচনা দেখতে পাই অনুপম মুখোপাধ্যায়ের লেখায়। তিনি এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন যা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র মনে হলেও, কবিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। রিঙকু অনিমিখের লেখায় তিনি মূলত কবিতাটি পড়ার পর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন বলেই মনে হয়। আর নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীরের আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা হাংরি জেনারেশন, মলয় রায়চৌধুরী, জখম বিষয়ে এই চমৎকার সুগঠিত আলোচনা পাই। আর ফাঁকিবাজি মনে হয়েছে সম্পাদক তুহিন দাসের লেখাটি। আমি অনেকদিন থেকেই তুহিন দাসের লেখা পড়ি, তাই তার কাছে এরকমটা আশা করিনি, দায়সারা গোছের।

কবি অনুপম রায়ের যথার্থ আলোচনার ক্ষুদ্রাংশ উদ্ধৃত করা প্রয়োজন মনে করছি, বাংলা ভাষা এবং যেকোন ভাষায় লিখিত চিরস্মরণীয় দীর্ঘ কবিতাগুলির একটি হল মলয়ের ‘জখম’। এর সম্পর্কে কথা না বলে বাংলা কবিতার কোন আলোচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না। অবশ্যই একটি আধুনিক টেক্সট। কিন্তু বাংলার শেষ আধুনিক কবিতা হিসেবেই আমরা জখমকে গ্রহন করব। এর পর বাংলা কবিতায় আধুনিকতা সম্পৃক্ত হয়ে গেছে, এবং তলানি জমতে শুরু করেছে। এখনও জমে চলেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।