....

‘আর্ট কোনো আপোষের বিষয় না’ : কবি অসীম নন্দনের সাক্ষাৎকার

কবি অসীম নন্দন। ১৯৯৪ সালে টাংগাইল জেলার মধুপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ত মানে ঢাকায় থাকেন। প্রকাশিত কবিতার বই দুইটি। বৃক্ষরোপণ গান (২০১৭, বাঙ্ময়), নভেম্বর মাসের কনফেশন (২০১৬, চৈতন্য)। আমরা ই-মেইলের মাধ্যমে ৩১ আগস্ট ২০১৯ তারিখে তাঁকে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম, তিনি যে উত্তর আমাদের পাঠিয়েছেন, আমরা তা হুবহু প্রকাশ করলাম। -সম্পাদক

সা ক্ষা  কা 


প্রশ্ন
ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন? মানে ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় কী লিখেছেন তা নয়; বরং মনের ভেতর সুপ্ত কোনো বাসনা কি ছিল কিছু হবার জন্য?

অসীম নন্দন
ব্যাপারখানা ক্লাস এইটের আগ পর্যন্ত অই গড়পড়তা ‘এইম ইন লাইফ’ রচনার মতনই ছিল। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হেন-তেন এরকম কিছু। কিন্তু ক্লাস এইটে উঠার পর সব পাল্টায়ে গেল। মানে সেই সময় থেকেই বই পড়ার নেশা ধরে গেছে। মনে পড়তেছে, সেই বছরই আমাদের মধুপুর উপজেলায় প্রথম বইমেলার আয়োজন করা হয়। বইমেলায় প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন বর্তমান কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক ভোলা। তিনি সেখানে প্রতিশ্রুতি দিলেন, উপজেলায় পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হবে। তাতে আমরা যারপরনাই খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু জানা কথা, সকল প্রতিশ্রুতিই একদিন মৃত দেবতার মতো মিথ্যা হয়ে যায়। গত দশ বছরেও সেই পাবলিক লাইব্রেরি হয়ে উঠতে পারে নাই। যাক এসব কথা, তখন আমি আর অন্তু (আমার বেস্ট ফ্রেন্ড) বই ধার করে বেড়াতাম। অই বয়সে তো পকেটে টাকা থাকতো না। বই কিনতে না পারার কষ্টগুলা মিষ্টি মধুর ছিল। বইয়ের দোকানে গিয়ে দাড়িয়ে থাকতাম, দাম দেখতাম, গন্ধ নিতাম তারপর চলে আসতাম। আর একটা নতুন বই হাতে পেলেই তা গোগ্রাসে গিলতাম। বেশির ভাগই হুমায়ূন আহমেদ আর জাফর ইকবালের বই। তাই ওগুলাকে গেলা বলাই ভালো। এবং গিলে নিদারুণ আনন্দে থাকতাম। তারপর বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায় , শরৎ চট্টোপাধ্যায় এগুলাও কিছু কিছু ধারে পেতাম। তো এরকম পড়তে পড়তে ভাবতাম, লেখকেরা কিভাবে এইরকম গুছিয়ে একটা কল্পজগত ক্রিয়েট করে! এরকম ভাবতে ভাবতেই একসময় লেখক হবার একটা সুপ্ত বাসনা জেগে উঠে।

প্রশ্ন
একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষসত্তা’কে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?

অসীম নন্দন
মোড়ালিটির দিক থেকে যখন আমরা দেখবো, তখন অবশ্যই প্রত্যেকটা  মানুষেরই উচিত ভালো মানুষ হবার প্র্যাকটিস করা। এবং একজন লেখকের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন। যেখানে ভালো এবং মন্দের মাপকাঠিটা ভীষণ অস্পষ্ট সেখানে ভালো মন্দের বিচার করাটাও কঠিন। বেশ কিছুদিন আগে একটা ট্রাকের গায়ে লেখা দেখলাম, “দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় আদালত হলো মানুষের বিবেক”। এরকম লেখাজোখা যদিও  ইদানিং আর সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। আবার দেখেন গত এক মাসে ‘ছেলেধরা’ গুজবের প্রভাবে কতগুলা প্রাণ চলে গেল। এখানে মানুষ ভাবতে চায় না। খুব তাৎক্ষণিক বিচার করে ফেলে। ভালো এবং মন্দের মাপকাঠিকে বিশ্লেষণ করেই আলাদা করতে হয়। এখানে সংশোধনের ব্যবস্থা কোথায়? যাক সে কথা। তো যা বলছিলাম। একজন লেখক চোর ,ডাকাত, দালাল ইত্যাদি যেকোনো কিছু হতে পারে। তবে আমাদের উদ্দেশ্য তো লেখক হওয়া নয়, আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত একজন বিবেকবান মানুষ হয়ে উঠা। আর একজন বিবেকবান মানুষ যদি লেখক হন, তবে তো আমরা নিজেরাই বুঝতে পারছি সেই লেখার শক্তিতে সমাজের আরও কত কত মানুষের বিবেক জাগিয়ে তোলা সম্ভব।

প্রশ্ন
জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানের জীবন সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী?

অসীম নন্দন
জীবন আসলে একটা চমৎকার অর্থহীন ব্যাপার। কথাটা নিহিলিস্টদের মতন শোনাচ্ছে তাই না? চরম নৈরাশ্যজনক। হ্যা ঠিক তাই। তবে এই অর্থহীন ব্যাপারটাকেই এই যে অর্থপূর্ণ করার বিশেষ তাগিদ, আসলে এই ব্যাপারটাই শিল্প। শিল্পই বিজ্ঞান ,বিজ্ঞানই শিল্প আর শিল্পই জীবন। এখন মানুষগুলা তো প্রত্যেকে আলাদা, তাই প্রত্যেকে নিজের মতন করে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কেউ খুন করছে, কেউ টাকা মেরে দিচ্ছে , কেউ চাকরি খুঁজছে, কেউ গান গাইছে, কেউ আবার আবিষ্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকছে। আর বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে তো একটা ভদ্রস্থ জীবন যাপনের জন্য দরকার টাকা। সেই টাকার রেসে সকলেই লেগে গেছে। মানে আপনাকে তো টিকে থাকতে হবে। এবং সেই টিকে থাকাটাও অবশ্যই সম্মানের সাথে হতে হবে। আরবান সোসাইটি আপনাকে এভাবেই ভাবতে বাধ্য করতেছে। মোড়ালিটির মায়েরে বাপ করে দিতেছে। মানে মানুষগুলা জীবনকে অর্থসূচক করার তাগিদ বোধ করছে অথবা করছে না কিংবা স্রেফ মরে যাচ্ছে। আসলে এই জীবনের আগে বা পরে তো তেমন কিছু নাই। মানে যা কিছু নগদ তার সবটাই এই জীবন। এই দুনিয়াতে মানুষ হাসবে, কাঁদবে, হিংসা করবে, রাগ করবে, আদর করবে, প্রেম করবে, ঘেন্না করবে এবং সব শেষে একদিন ‘নাই’ হয়ে যাবে। জীবনকে অর্থবোধক করার যা কিছু চেষ্টা-সবই একদিন অন্ধকারে চলে যায়। তো এই চরম অর্থহীন ব্যাপারটাকে একটু মিনিংফুল করার জন্যই তো মানুষগুলা স্বপ্ন দেখছে বা দেখতে চাইছে বা দেখাতে চাইছে।

প্রশ্ন
লেখার ক্ষেত্রে আপনার কোনো প্রেরণার জায়গা আছে কি?

অসীম নন্দন
লেখার ক্ষেত্রে প্রেরণার জায়গা ব্যাপারটা আসলে খুব আপেক্ষিক আর পরিবর্তনশীল। মানে যখনই কোনো ভালো লেখা নজরে আসে পাঠ করি , তা থেকেই  ইন্সপায়ার হই। মানে নিরন্তর নিজেকে ভেঙ্গে গড়ার মধ্যেই থাকা। তবে প্রথম প্রেরণা পেয়েছিলাম ক্লাস এইটে। সেসময় কোনো এক নিউজপেপারে হুমায়ূন আহমেদের একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। সাক্ষাৎকারে ছোটদের জন্য লেখক হবার কয়েকটা টিপসের কথা তিনি বলেছিলেন। ব্যাপারটা মজার! অবশ্য তিনি আরও বলেছিলেন, শুধু প্র্যাকটিস করেই লেখক হওয়া সম্ভব না। লেখক হবার জন্য ভাবুক মন থাকাও জরুরী। যাক সে কথা। প্রচুর বই পড়া, ডায়েরি লেখার অভ্যাস এবং ছড়া লেখার প্র্যাকটিস। এইগুলা ছিল লেখক হবার সম্ভাব্য টিপস। তো আমিও তাই প্র্যাকটিস করা শুরু করলাম। তখন আসলে গল্পকার হবার ফ্যাসিনেশনে ভুগতাম। গল্পের বইই বেশি পড়তাম। কবিতার ভুত তখনও মাথা খায় নাই। পাঠ্যবইয়ের থেকে জীবনানন্দ দাশের নাম ততদিনে জানা হইছে। কিন্তু আগ্রহ জাগে নাই। এই আগ্রহটাও পেলাম হুমায়ূন আহমেদের থেকে। তিনি কোথায় যেন বলেছিলেন, জীবনানন্দ দাশের মতন কবিতা লিখতে পারলে তাঁর জীবনে আর কিছুই চাওয়ার থাকতো না। তো এরকম ভাবেই আগ্রহ জন্মায়। তারপর আমি জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতাসমগ্র কিনি। কচি সবুজ রঙের মলাট। আমার প্রথম কেনা কবিতার বই। তখন আসলে কবিতার টেক্সটে ঢুকতে কষ্ট হত। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেবল বনলতা সেন ,কুড়ি বছর পরে এই কতকগুলা কবিতা পড়তাম। এরপর আমার কেনা দ্বিতীয় কবিতার বই ছিল কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাম্যবাদী’। মনে পড়তেছে , একটানে এই কবিতার বই আমি পড়ে শেষ করেছিলাম। মানে জীবনানন্দের থেকে নজরুলের টেক্সটে খুব সহজেই ঢুকতে পারতেছিলাম। এই তো শুরু হল কবিতার জ্বর। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন কবির লেখাতেই ইন্সপায়ার হয়েছি। কখনও বিনয় মজুমদার , কখনও ফাল্গুনি রায়, কখনও রুমি, কখনও জিবরান। আবার কখনও দস্তয়ভস্কি,মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎ চট্টোপাধ্যায়, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। আগেই বলেছিলাম ইন্সপায়ারেশনের ব্যাপারটা পরিবর্তনশীল। এই আরকি।

প্রশ্ন
‘কবিতায় ছন্দ’ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?

অসীম নন্দন
কবিতাকে কবিতা হয়ে উঠার জন্য ছন্দের দরকার নাই। কবিতায় ছন্দ কেবল একরকম প্রসাধনী বিশেষ। মানে প্রসাধনীর কাজ ঠিকঠাক হলে সুন্দর লাগে, কম বা বেশি হলে বিকট লাগে আর প্রসাধনী না থাকলে রিয়েল লাগে। কবিতায় যে জিনিসটা বিশেষ দরকার তা হল ধাক্কা। মানে একটা কবিতা পাঠের পর যদি সেই কবিতার টেঁক্সটের সাথে পাঠকের সংঘাত না হয়, মানে পাঠককে যদি ঝাঁকুনি না দিতে পারে, তাহলে আর সেই কবিতার ধারটা থাকলো কীসে? যেমন ধরেন ফাল্গুনি রায়ের কবিতায় আমরা যা পাই। ফাল্গুনি রায়ের টেঁক্সট পাঠককে এমন এক বাস্তবতার সামনে হাজির করে যে, পাঠক নিজের ভাবনাকে নিয়ে আবারো ভাবতে বসে। ‘মানুষের সঙ্গে কোন বিরোধ নেই’ কবিতায় ফাল্গুনি রায় যখন বলছেন, “রামকৃষ্ণের কালীপ্রেমে দেখি সার্বভৌম যৌনশান্তি/ বাবলিদের স্বামীপ্রেমে দেখি সার্বজনীন যৌনসুখ”, ঠিক তখনই পাঠককে নড়েচড়ে বসতে হয়। এইখানে কিন্তু ছন্দের এক ফোঁটা দরকার বোধ হয় না।

অসীম নন্দনের কবিতার বই: নভেম্বর মাসের কনফেশন

প্রশ্ন
ছোটবেলায় কি লেখেলেখি করতেন?

অসীম নন্দন
নাহ। একেবারে ছোটবেলায় লেখালেখি করতাম না। তবে অই হাইস্কুল লেভেলে উঠে কিছু কিছু শুরু করি ক্লাস এইটে। একটা মজার স্মৃতি মনে পড়তেছে। সেইবার স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য আমি প্রথম কবিতা জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু স্কুল ম্যাগাজিন আমার কবিতা ছাপে নাই। সেজন্য আমার তখন খুব অভিমান হইছিল। তারপর আর কখনও স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য লেখা জমা দেই নাই। যাদের ছাপা হইছিল তারা এখন আর কবিতা লেখে না। ঘটনাটা মনে পড়লে এখনও হাসি পায়!

প্রশ্ন
লিখতে কেমন লাগে?

অসীম নন্দন
‘লিখতে কেমন লাগে’ প্রশ্নটা খুব বিব্রতকর। যেমন ধরেন, কেউ যদি জানতে চায় সেক্স করতে কেমন লাগে? হাহাহা!! তখন আসলে কী বলা যায় কতটুকু বলা যায় তা নিয়েই ভাবতে বসতে হয়! এরকম প্রশ্নের জবাব দেয়াটা বিব্রতকর। যাক। খারাপ লাগে না। ডিসকোর্সের মাঝে আলাদারকম একটা অনুভূতি আছে। তাকে আনন্দ বলা যায় কিনা আমি জানি না। মানে মাথার ভিতর যা কিছু বাষ্প জমা হইতেছে তাকে লিখে ফেলতে পারলে কখনও কখনও ভারমুক্তি লাগে।

প্রশ্ন
আপনি কী ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন?

অসীম নন্দন
সাধারণত ফিকশন পড়তে ভালো লাগে। আর তা যদি হয় হিস্টোরিক্যাল ফিকশন তবে তো আনন্দে আটখানা। নন-ফিকশনের মধ্যে ফিলসফিক্যাল বইগুলাই বেশি ভালো লাগে। ওহ হ্যাঁ, পোয়েট্রির কথা তো বলতেই ভুলে গেছিলাম। এই আরকি।

প্রশ্ন
এখন কোন বইটা পড়ছেন?

অসীম নন্দন
এখন পড়তেছি Coleman Barks এর অনুবাদ করা রুমির কবিতা ‘The Essential Rumi’ আর বিবেকানন্দের বায়োগ্রাফি। আর পড়তেছি Charles Bukowski’র ‘Love is a dog from hell’। ফাল্গুনি রায়ের ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিশন’টাও এই কয়েকদিন আগে আবার পড়লাম। রুমির কবিতা আমি বেশ অনেকদিন যাবতই পড়তেছি। এই বইটা পাঠের ফাঁকেই আসলে আরও ২০/৩০ খানা বই পাঠ শেষ হয়ে গেছে।

প্রশ্ন
আপনি বারবার পড়েন, এমন কবির নাম জানতে চাই।

অসীম নন্দন
বারবার পড়ি জীবনানন্দ দাশ, বিনয় মজুমদার, ফাল্গুনি রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রুমি, এঁদেরকে। 

প্রশ্ন
বর্তমান সময়ের কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা এবং দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলেন। কবি’র কি  পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিত?

অসীম নন্দন
প্রথমে আমি আপনার সেকেন্ড কোয়েশ্চেনের জবাব দেব তারপর প্রথমটায় ফিরে আসবো। আশা করি তাহলেই ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে যাবে। আর্ট কোনো আপোষের বিষয় না এই জিনিসটা আগে আমাদের বুঝতে হবে। যদি জীবনানন্দ দাশ আপোষ করতেন তাহলে আমরা যে জীবনানন্দ’কে আজ পেয়েছি তা পেতাম না। মানে আধুনিক কবিতার এই যে বিমানবিক বৈশিষ্ট্য তা আর থাকতো না এবং রোম্যান্টিক কবিতা থেকে তা আলাদা করা যেতো না। আমজনতা আসলে কী চায়? তারা চায় পুরাতনকে ধরে রাখতে। নতুনকে গ্রহণ করতে গেলেই এক ভীষণ সংঘাতের জন্ম হয়। নতুনের জন্য আবার নতুন করে ভাবতে বসতে হয়। আর আমজনতা সেই ভাবতে বসা থেকে পালিয়ে বেড়ায়। ভাবনার জন্য তো সময় চাই। সেই সময় তাদের কোথায়? সবাই তো টিকে থাকার জন্য টাকার পিছনে রেসে লেগে আছে। আমজনতা চায়, তাদের  দৈনন্দিন জীবনের সাথে যা কিছু রিলেটেড তা নিয়েই ভাবনা চিন্তা করতে। যেমন ধরেন, এই বেশ কিছু দিন আগেই। আমি আমার এক বন্ধুকে Self Help এর একটা বই ধার দেই। সেই বন্ধু ইদানিং GRE’র প্রিপেয়ারেশন নিতেছে। তো কিছুদিন পর তার বাসায় গিয়েছি। জানতে চাইলাম বইটা কেমন লাগছে কতটা পড়া হয়েছে। সে জানালো একটা চ্যাপ্টার পড়া হয়েছে। তো আমি এম্নেই দেখার জন্য বইটা হাতে নেই। হাতে নিয়ে দেখি মাঝে মাঝে কিছু কিছু শব্দ দাগানো। আমি ঘটনা বুঝতে পারলাম। তারপরেও জানতে চাইলাম, মানুষেরা বই পড়লে তো লাইন কোট করে-তবে সে কেন শুধু শব্দই কোট করেছে? উত্তরে সে জানালো, GREতে ভালো স্কোরের জন্য তাকে ইংরেজি শব্দ জানাটাই দরকার। কোনো প্রিয় লাইন কোট করার কোনো দরকার নাই। ব্যাপারটা আসলে এরকমই। এখন চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ কিনতে গেলে তো কাউকে ভ্যান গগকে চিনতে হবে না। ভ্যান গগ বা পিকাসোর আর্ট সম্পর্কে না জেনেও দিন গুজরান সম্ভব। ইনফ্যাক্ট একজন চায়ের দোকানি বা আলু বিক্রেতা বা সুপার শপের মালিক তাদের চেনেও না। কিংবা বিনয় মজুমদারকে না জানলেও তাদের দিব্যি দিন গুজরান হয়। এখন পাঠক বলেন আর কঞ্জিউমার বলেন এদের রুচির সাথে আপোষ করলে কি আমরা তাবত তাবত সব আর্টিস্টদের পেতাম? পেতাম না। হাংরি মুভমেন্টের কথা ভাবেন তো। কিংবা রেনেসাঁর কথাও ভাবা যায়। যদি কঞ্জিউমারের রুচির সাথে আপোষ করা হয় তবে নতুন কোনো আর্টেরই কোনো সম্ভাবনা দেখা যাবে না। কঞ্জিউমার কি কখনও চাইলেই ঠিক করতে পারে, সে বাজার থেকে ২০ টাকা কেজিতে ভালো চাল কিনবে? কিংবা একটা দশম শ্রেণির ছাত্র কি তার পাঠ্যপুস্তকের পাঠ্যতালিকায় বোদলেয়ার, র‍্যাবো কিংবা ফাল্গুনি রায়ের কবিতা রাখার কথা ভাবতে পারে? পারে না। বিশেষ সিন্ডিকেট মহল তা ঠিক করে দেয়। সেই সিন্ডিকেট মহল কখনও হয় মিডিয়া কখনও রাষ্ট্র আবার কখনও বুদ্ধিজীবী মহল। তা বুদ্ধিজীবীকে আপনি বুদ্ধিজীবীই বলেন আর বুদ্ধিবেশ্যাই বলেন। তা সেকেন্ড কোয়েশ্চেনের একরকম জবাব দেয়া গেল। এখন আসি প্রথম কোয়েশ্চেনে। কবিতার বিরুদ্ধে যে জনবিচ্ছিন্নতা এবং দুর্বোধ্যতার অভিযোগ করা হয় তা হাল আমলের সমস্যা নয়। অতীতেও এই অভিযোগ করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও করা হবে। এমনকি জর্জ অরওয়েল ‘পোয়েট্রি এন্ড মাইক্রোফোন’ নামে একটা প্রবন্ধই লিখেছিলেন, যেখানে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে কবিতাকে জনপ্রিয় করার উপায় হিসেবে রেডিও মাধ্যমের কথা বলেন। তার মানে এই সমস্যা যে শুধু প্রাচ্যে তা নয়, পাশ্চাত্যেও এই একই সমস্যা দেখা যায়। অনেকে বলে থাকেন গান এত জনপ্রিয় আর্ট কিন্তু কবিতা কেন নয়? মানে গীতিকবিতা থেকেই তো গান হয়। এখানে বুঝতে হবে গান হল একরকম ভোকাল আর্ট। শুধু শব্দ নয়, গানে সুরের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। গান কেবল শুনলেই চলে।গান আপনাকে পড়তে হয় না। মানে গানের সুরে যদি সেই আর্টটা থাকে তবে গানের মানে বোঝোরও আপনার দরকার থাকে না। এবং ভাবতে হয় না। সুরের লহমাতেই বিশেষ আমেজ চলে আসে। ইনফ্যাক্ট এমন অনেক গান আমি শুনেছি যার লিরিক্সের অর্থ বোঝার আমার দরকার হয় নাই। যেমন ধরেন, নেদারল্যান্ডের ফোক ব্যান্ড Omania’র একটা গান আমি একসময় খুব শুনতাম। কিন্তু লিরিক্সের মানে বুঝতাম না। তাহলে কেন শুনতাম? কেননা সেই গানে বাঁশির এমন সুন্দর কাজ ছিল যে সেই সুরের আমেজেই বারবার শুনতাম। কিন্তু কবিতা তো সেরকম কিছু না। কবিতা আদতে শব্দেরই কাজ। এবং কবিতা পাঠ করে ,পাঠের আমেজ নিতে হয়। কবিতাকে নিয়ে যদি ভয়েস হিসেবে কাজ করা হয় তবে কিছু উপকার হতে পারে। তবে সকল কবিতাকে দিয়ে ভয়েসে কাজ করা সম্ভব নয়। কেননা এমন অনেক কবিতা আছে যা বুঝতে হলে পড়তে হবে। শুধু ভয়েসে তা সম্ভব না। কিন্তু পাবলিক তো পড়তে চায় না। মানে পাঠ করা ব্যাপারটা বিশেষ কষ্টসাধ্য বলে এড়ায়ে যেতে চায়। আর পাঠক চায় তার পঠিত বিষয়ের সাথে নিজেকে রিলেট করতে। রিলেট করতে পারলেই তা ভালো-বোধগম্য; না পারলেই খারাপ। পাঠক চায় গল্পে পাওয়া রাজপুত্র যেন তার মহল্লার কোনো ছেলের সাথে মিলে যায়। কবিতায় পাওয়া ইমেজে যেন তার না পাওয়া প্রেমের গন্ধ থাকে। আর একটা ব্যাপার খুব মজার। আমাদের দেশের ছেলেপেলেরা প্রেমে পড়ার আগে বা পরে যেন কেমন কেমন কবি-কবি হয়ে যায়। মানে ভালোবাসার মানুষটাকে পটানোর জন্যই কেবল তখন কবিতার খোঁজে বের হয়। যাক তাতে আমার কোনো সমস্যা নাই। আমি তা পজিটিভ ভাবেই নেই।
অসীম নন্দনের কবিতার বই: বৃক্ষরোপণ গান

প্রশ্ন
লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে অন্তরজালকে কীভাবে দেখছেন?

অসীম নন্দন
আজকের এই মাইক্রো-মেকানিকসের যুগে ইন্টারনেট একটা ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। ইন্টারনেট ছাড়া তো আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রিন্ট মিডিয়ার থেকেও শক্তিশালী মিডিয়া এখন ইন্টারনেট। কাজ করা সহজ। এবং কানেক্ট হবার সম্ভাবনাও বেশি। ভিন্নমাত্রার কাজ যারা করতে চায় তাদের জন্য বিশেষ উপযোগী। তবে কাজের মান নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তাতে আমি ভয় পাই না। যেমন ধরেন ফাল্গুনি রায়ের কবিতা আমি ইন্টারনেট থেকেই পড়েছি। ‘রাফখাতা’ (সাম্য রাইয়ান পরিচালিত) নামে একটা ব্লগ থেকে। তার মানে ভালো কাজ হয়ে থাকলে তা কোনো না কোনোভাবে পাঠকের কাছে পৌঁছে যাবেই। ইদানিং ‘বিন্দু’ তো ওয়েবম্যাগ হিসাবে ভালো কাজ করছে। তাছাড়া ১৫/১৬ সালের দিকে ‘শিরীষের ডালপালা’ নামে একটা ওয়েবজিন দেখেছিলাম। তাদের কাজ তখন বেশ উদ্যমের সাথে চলছিল। এখন আর তেমন হাঁকডাক পাই না যদিও। ২০১৭ তে ‘কালকূট’ নামে একটা ওয়েবজিন আত্মপ্রকাশ করেছিল। যারা লেখক-সম্মানীর ব্যবস্থাও শুরু করেছিল। আবার ‘চিলেকোঠা’ নামে একটা ওয়েবজিনকেও দেখেছিলাম লেখক-সম্মানী দিয়ে কাজ করতে। তবে এগুলাকে এখন আর দেখা যায় না। ‘কালকূট’ তো দেখলাম বন্ধই হয়ে গেছে। বর্তমানে ওয়েবজিনগুলাকে এই লেখক-সম্মানীর ব্যাপার নিয়ে ভাবতে শুরু করা উচিত। লেখক-সম্মানী যত ক্ষুদ্রই হোক, হতে পারে এক কাপ চা বা এক প্যাকেট সিগারেট বা ৫০ টাকা মোবাইল রিচার্জ কিংবা বই-যেকোনো কিছুই হতে পারে। লেখক-সম্মানীর কথা আমি যে কারণে বললাম, এতে করে সম্পাদকেরা লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হয়ে উঠতে পারে। আর আপনাদের মানে ‘দিব্যক’র প্রতিও আমি খুব আশাবাদী।

প্রশ্ন
আপনার কি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে?

অসীম নন্দন
এখনও গণতন্ত্রেই আস্থা রাখার চেষ্টায় আছি। তবে নানা কারণে সেই আস্থায় আঘাত লাগতেছে। ভরসা হারায়ে যাইতেছে। আমাদের সংবিধানের চারটা মূলনীতির অন্যতম একটা হল সমাজতন্ত্র। যে সমাজতন্ত্রকে চর্চা করে দেশের পরিস্থিতিকে ঘুরিয়ে ফেলা সম্ভব। অথচ সমাজতন্ত্রের কোনো চর্চাই নাই। দেশের কোনো রাজনৈতিক দলই সংবিধানের এই মূলনীতি মানে নাই। আমজনতা তো জানেই না গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র কারে বলে? খায় নাকি মাথায় দেয়? যাক, এখন রাজনৈতিক মতাদর্শ বলতে যদি বিশেষ কোনো দলের কথা বুঝিয়ে থাকেন- নাহ কোনো দলের সাথে আমার কোনো আঁতাত নাই। মানে কোনো দলের উপরই আস্থা রাখতে পারতেছি না। তবে আশার কথা এই যে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধ-শক্তি এখন ক্ষমতায় নাই।

প্রশ্ন
আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন, নাকি বারবার সংশোধন করেন?

অসীম নন্দন
ঠিক নাই। আসলে ব্যাপারটা এইরকম যে, আমার কবিতা পায়। আর যখন পায় তখন লেখি। তা কখনও এক বসাতেও একটা কবিতা নামিয়ে ফেলা যায়। আবার কখনও মাসের পর মাস একটা কবিতাই চলতে থাকে। তবে যেভাবেই লেখি সংশোধনের ব্যাপার থেকেই যায়। ঘড়ি দেখে বিষয় ঠিক করে কলমে শান দিয়ে মেশিনম্যানের মতন কবিতা লেখার দিন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন কবিতা মানে মাথায় জমতে থাকা বাষ্পকে বমিটিঙের মতন বের করে দেওয়া। কিংবা বলতে পারেন আজকে কবিতা মানে ভিতরে ভিতরে যে ভাবনার পাপ জমতে থাকে- তাকে মাস্টারবেটের মতো ডিসকোর্সে মুক্তি দেয়া।

প্রশ্ন
আপনি দিনের কোন সময়টায় লিখতে পছন্দ করেন? কোনো রুটিন আছে কি?

অসীম নন্দন
কোনো রুটিন নাই। তবে রাতের বেলাটাই পছন্দ বেশি।

প্রশ্ন
লেখালেখি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।

অসীম নন্দন
দূর ভবিষ্যতে কি করব জানি না। আপাতত একটা পাণ্ডুলিপি গোছানো আছে। কিন্তু কোনো প্রকাশকের সাথে আলাপ হয় নাই। বইটা প্রকাশের কথা ভাবছি। কয়েকটা গল্পও জমে আছে। সেগুলাকেও গুছায়ে কিছু একটা করতে চাই। আর রাস্কিন বন্ডের লেখা একটা বই অনুবাদের কথাও ভাবছি। মানে পরিকল্পনায় আছে। কিন্তু কাজে হাত দেয়া হয় নাই। ‘ধরবো ধরবো করছি কিন্তু ধরতে পারছি না’ ব্যাপারটা এরকমই। এছাড়া একটা ফিকশন লেখার পরিকল্পনাও সুপ্ত অবস্থায় আছে। ফিকশনটাকে হিস্টোরিক্যাল ফিকশন বলতে পারেন। কিন্তু কবে হাত দিতে পারব জানি না। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ