....

‘কবিতা তো কবির রুচির পরিচায়ক, পাঠকের নয়’ : জিললুর রহমানের সাক্ষাৎকার

জিললুর রহমান। কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও উত্তর আধুনিক চিন্তক। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলায় জন্ম, নিবাস, কর্ম। পেশায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষক। আশির দশকের শেষদিক থেকে লেখালিখি। উত্তর আধুনিক কাব্যচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। লিরিক, নিসর্গ, একবিংশ, সুরমস, বিন্দু-সহ বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লিখে আসছেন দীর্ঘদিন। আমরা ই-মেইলের মাধ্যমে ৩১ জুলাই ২০১৯ তারিখে তাঁকে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিলাম, তিনি যে উত্তর আমাদের পাঠিয়েছেন, আমরা তা হুবহু প্রকাশ করলাম। -সম্পাদক

সা ক্ষা  কা 


প্রশ্ন
ছোটবেলায় কী হতে চাইতেন? মানে ‘এইম ইন লাইফ’ রচনায় কী লিখেছেন, তা নয়; বরং মনের ভেতরে সুপ্ত বাসনা ছিলো কি কোনো কিছু হবার জন্য?

জিললুর রহমান
যতটুকু মনে পড়ে, খুব ছোটবেলা থেকেই আমি জানতাম আমি ডাক্তার হবো। এটা কেমন যেন মনের গহীনে একদম স্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। হতে পারে, বাবা-মা আত্মীয় পরিজনদের এতে ইন্ধন ছিল। তবে মাঝেমাঝে আমি শিক্ষক হতাম। বাঁশের কন্চি ভেঙে ছাত্র বানিয়ে তাদের পড়াতে আমার খুব ভাল লাগতো। তারপর যখন ১০/১২ বছর বয়স তখন থেকে শব্দ, ছন্দ নিয়ে, কবিতা নিয়ে প্রচণ্ড কৌতুহল বোধ করতাম। মনে হতো, যদি কবি হতে পারতাম!

প্রশ্ন
একজন  লেখকের  ভেতরের ‘মানুষসত্তা’কে  কীভাবে  ব্যাখ্যা করেন?

জিললুর রহমান
আমি কখনও লেখককে কোনো দৈব চরিত্র মনে করিনি। এমনকি লেখক কোনো ভিন্ন জগতেরও কেউ নন। তার সুখ দুঃখ আনন্দ হতাশা সবই আর দশটা মানুষের মতন। মানুষসত্তা সম্পূর্ণরূপে তার ভেতরে থাকলেও তার একটা বিশেষ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তৈরী হয়। যা তাকে সাধারণ মানুষ যা দেখে না, তা দেখার এবং বর্ণনার সুযোগ করে দেয়। এভাবেই মানুষসত্তা কবিসত্তায় রূপান্তরিত হয়।

প্রশ্ন
জন্ম-মৃত্যুর  মাঝখানের  জীবন  সম্পর্কে  আপনার  অনুভূতি কী?

জিললুর রহমান
একজন ব্যক্তির জন্ম তো প্রকৃতির ইচ্ছা মাত্র। আর মৃত্যু এক অনিবার্যতার নাম। এর মধ্যখানের কালখণ্ডকে আমরা ব্যক্তির একক জীবন বলি। ব্যক্তির জীবন সেভাবে অর্থময় বা অর্থহীন নয়। তবে আমি মনে করি, জীবন এক মহাকালিক এবং সমস্ত জগত সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মহাকালের যাত্রায় কোনো এক মুহূর্তে যে জৈব পদার্থের সৃষ্টি হয়েছিল সেই থেকে জীবনের সূচনা। সে জীবন ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে, এককোষী থেকে বহুকোষী, প্রাইমেট থেকে হোমোস্যাপিয়েন্স—অনন্ত জীবনের স্রোতে আমারও একটি কালপর্বের উপস্থিতি, যতটুকু সময় মিলবে ততক্ষণে যেন মহাকালের চাকা একটু এগিয়ে নিতে পারি এই কামনা করি।

প্রশ্ন
লেখার ক্ষেত্রে আপনার কোনও প্রেরণার জায়গা আছে কি?

জিললুর রহমান
আমার প্রেরণা মানুষ, অনাগত কালে এই মানুষের সুন্দর সাম্যের জীবন আমার প্রেরণা। 

প্রশ্ন
বর্তমানে  বাংলা  সাহিত্যের  আলোচনা-সমালোচনা  চর্চা  কতটা গঠনমূলক হচ্ছে?

জিললুর রহমান
তেমন কিছু কি আছে? 

প্রশ্ন
‘কবিতায় ছন্দ’ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?

জিললুর রহমান
ছন্দ কবিতার কাঠামো এবং ভঙ্গি তৈরী করে। 

প্রশ্ন
ছোটবেলায় কি লেখালিখি করতেন?

জিললুর রহমান
অষ্টম নবম শ্রেণী থেকেই লেখা শুরু। কবিতা এবং কবিতাই লিখেছি কৈশোরে। 

প্রশ্ন
লিখতে কেমন লাগে?

জিললুর রহমান
ভাল লাগে বলেই তো লিখি। 

প্রশ্ন
আপনি কী ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন?

জিললুর রহমান
আমি সব রকম বইই পড়ি। তবে কবিতা আর উপন্যাসে বেশী সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কখনও স্মৃতিকথা, কখনওবা ভ্রমণকাহিনী, এমনকি গোয়েন্দাগল্প, আবার কখনও কখনও সিরিয়াস প্রবন্ধের বইও বেশ বুঁদ হয়ে পড়ি। 

প্রশ্ন
এখন কোন বইটা পড়ছেন?

জিললুর রহমান

এখন পাশাপাশি দুটো বই পড়ছি। শংকর-এর ‘চরণ ছুঁয়ে যাই’ এবং খন্দকার মাহমুদুল হাসান-এর ‘যেমন করে মানুষ এলো’। 

প্রশ্ন
আপনি বারবার পড়েন, এমন কবির নাম জানতে চাই।

জিললুর রহমান
আমি বারবার পড়ি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, রবার্ট ফ্রস্ট, এমিলি ডিকিনসন, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, অরণি বসু, আবুল হাসান।  

প্রশ্ন
বর্তমান  সময়ের  কবিতার  বিরুদ্ধে  জনবিচ্ছিন্নতা  ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ  বিষয়ে  কিছু  বলেন। কবি  কি পাঠকের  রুচির  সাথে আপোষ করে  কবিতা  লেখা উচিত?

জিললুর রহমান
কবিতা কখনওই জনপ্রিয় ছিল না। সাধারণ মানুষ সে অর্থে কবিতার পাঠক কখনওই ছিল না। বিদ্যালয়ে বাধ্য হয়ে পাঠ্যবইয়ের যে ক’টি কবিতা পড়েছিল তা সম্বল করেই সেসব লোক এমন অভিযোগ করে। যে পাঠক কবিতার ধারাবাহিকতার সাথে নিজের পাঠঅভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করতে পারে না, কবিতা তার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকবে বৈকি। কবিতা তো কবির রুচির পরিচায়ক, পাঠকের নয়। 

প্রশ্ন
লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে  অন্তর্জালকে  কীভাবে দেখছেন?

জিললুর রহমান
আমি লিটল ম্যাগাজিনের কর্মী। এখনও একটি ছোটকাগজে ছাপার হরফে আমার লেখা প্রকাশ পেলে অপার আনন্দ পাই। তবে, ইদানীং অন্তর্জালে বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে এবং বেশ ভাল ভূমিকা রাখছে। এসব অনলাইন পত্রিকা খুব দ্রুত অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যায় খুব সহজেই। আমিও তাই আমার লেখা এখন অনলাইন পত্রিকায় ছাপাতে খুব পছন্দ করি। তবে, মাঝেমধ্যে সন্দিহান থাকি, পড়ছে কি না? নাকি দেখেই খালাস।

প্রশ্ন
আপনার কি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে?

জিললুর রহমান
আমি আশৈশব মার্কসীয় চিন্তায় বিশ্বাসী। তবে, নব্বই দশক থেকে উত্তর আধুনিক চেতনা নিয়ে এবং বর্তমান সময়ে আমি মানবিক উন্নয়ন, সাম্য ইত্যাদি বিষয়ে ‘উত্তরচেতনা’ এবং মানুষের ক্রমাগত উত্তরণ সংক্রান্ত দর্শনচিন্তা নিয়ে পাঠ ও কাজ করছি। 

প্রশ্ন
আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন, না কি বারবার সংশোধন করেন?

জিললুর রহমান
আমি সাধারণত এক বসাতেই লিখি, তবে পরবর্তী পাঠে যে কখনও সখনও কিছু সংশোধনও করে থাকি না তা নয়। 

প্রশ্ন
আপনার প্রেমের কবিতাগুলো কি কল্পনাসৃষ্ট না কি ব্যক্তিগতঅভিজ্ঞতালব্ধ?

জিললুর রহমান
আমি মূলত জীবনের কবিতা লিখি। কল্পিত বা আমি তুমি মার্কা শব্দযোজনা আমার ঘটে না। যা লিখি তা অভিজ্ঞতাসঞ্জাত এবং যা দেখতে চাই তার দ্যোতনা।

প্রশ্ন
লিটল ম্যাগাজিনগুলি সাহিত্য বিকাশে কী গুরুত্ব বহন করে?

জিললুর রহমান
সাহিত্যের সত্যিকার পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্যে লিটল ম্যাগাজিনের কোনো বিকল্প নেই। 

প্রশ্ন
আপনি দিনের কোন সময়টাতে লিখতে পছন্দ করেন? কোনো রুটিন আছে কি এ ব্যাপারে?

জিললুর রহমান
আমার যেমন জীবন, ঘটা করে লিখতে বসতে গেলে লেখাই হতো না, লেখার সেই সময়ই বের করতে পারতাম না। তাই যখন শব্দগুলো মগজে গিজগিজ করে, তখন যা করে হোক লিখে ফেলি।

জিললুর রহমানের বই 
প্রকাশিত বই: 
কাব্যগ্রন্থ: ১. অন্যমন্ত্র (লিরিক, ১৯৯৫),
২. শাদা অন্ধকার (লিরিক, ২০১০),
৩. ডায়োজিনিসের হারিকেন (ভিন্নচোখ, ২০১৮)
৪. আত্মজার প্রতি (দীর্ঘ কবিতা, বাঙ্ময়, ২০১৭),
৫. শতখণ্ড (দীর্ঘ কবিতা, বাঙ্ময়, ২০১৭)
প্রবন্ধ: ১. উত্তর আধুনিকতাঃ এ সবুজ করুণ ডাঙায় (লিরিক ২০০১, খড়িমাটি ২০১৯)
২. অমৃত কথা (লিরিক, ২০১০)
অনুবাদ: ১. আধুনিকোত্তরবাদের নন্দনতত্ত্বঃ কয়েকটি অনুবাদ (লিরিক, ২০১০),
২. নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ (বাতিঘর, ২০১৮),
৩. এমিলি ডিকিনসনের কবিতা (চৈতন্য, ২০১৮)।
প্রকাশিতব্য বই:১. পপলার বন মরে পড়ে আছে (২০২০)
২. জিললুর রহমানের দীর্ঘ কবিতা (২০২০)
সম্পাদনা সম্পর্কিত তথ্য: ১. সম্পাদক, যদিও উত্তরমেঘ
২. সম্পাদনা পরিষদ সদস্য, লিরিক
৩. সম্পাদক, লিরিক বুলেটিন
৪. সম্পাদনা পরিষদ সদস্য, তরঙ্গ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. "আমি আশৈশব মার্কসীয় চিন্তায় বিশ্বাসী। তবে, নব্বই দশক থেকে উত্তর আধুনিক চেতনা নিয়ে এবং বর্তমান সময়ে আমি মানবিক উন্নয়ন, সাম্য ইত্যাদি বিষয়ে ‘উত্তরচেতনা’ এবং মানুষের ক্রমাগত উত্তরণ সংক্রান্ত দর্শনচিন্তা নিয়ে পাঠ ও কাজ করছি।" cheers

    উত্তরমুছুন

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।