....

'মায়ার মলাট' হতে কবিতাগুচ্ছ | সাজ্জাদ সাঈফ


প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু 


রাষ্ট্র

১.

দ্বিধাকে হাঁটিয়ে এনে শেষে
ঘাসফুলে এলিয়ে দিচ্ছি এখনআমি কেনো ক্ষয়কাশের রোগীকে
জীবনের বানান শেখানো জীবন বেছে নিয়ে একলা হয়েছি গ্রহে!

সেই কথা উহ্য থাকএক পশলা বৃষ্টিকে ফিরে পেতে
 পাড়ায় ব্যাঙের বিবাহ আজঘাড় গুজে আজ সারাদিন 
আমার বিষণ্নতাকে পড়ে থাকতে দেখেছি বিছানায়সেও জানে অবিশ্বাস কাকে বলে!

তোমাদের গুঞ্জন থেকে আমি 
খড়কাঠি কুড়াতে এসেছিদেশলাই ঠুকে
আগুন ধরাবো স্মৃতিরতারপর স্বপ্ন দেখতে দেখতে
ভিড় থেকে সরে দাঁড়াবো আবার!

আমি কেনো
গর্ভপাতে বিষণ্ন মায়েদের
মুড ফেরানো ওষুধ লেখা শিখে গেছি
সেই কথা বিশেষত্বহীনপ্রথার বন্দুক তাক করে
শত শত বাঙালি কবি সরে দাঁড়াতে বলছেএই কথা বেফাঁস লাগছে কারো;

তোমাদের মশকরার সামনে
আমি ক'টা অক্ষর ফেলে দিয়ে এই ভাটিরাষ্ট্রের হাতে
অনেক উজান ধরিয়ে দিয়ে চলে যাবো
যেনো এই রাষ্ট্রকে নিয়ে ছেলেখেলা
ক্রীড়নকসহ ভেসে যায়ডুবে মরে!


.

(পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার শিক্ষকের দাবীতে গুলিবিদ্ধ রাজেশকে)
      
মাত্রই পানের বরজ পার হয়ে এলো বৃষ্টিনোকতার মতো হেডলাইট উসকে দিচ্ছে আলো;

এও ভালোভাষাতিমিরের নিচে শান দিচ্ছি মূর্ধন্য!

ঘুঘুডাক মনে হয় এই বাজের আওয়াজ
তাওয়াধরা উনুনের দিকে চেয়ে
নিভে থাকা তারাদের সংলাপ
এই ভাষাময় ফুটে থাকা ফুল চেনে?

দ্বিধাঘামে চুঁইয়ে নামছে হাওয়া
নির্মিয়মান নীড়ের ভিতর ভিজে
ঘুঘু আগলায় বৃষ্টিপাতের ধাওয়া
এই দ্বিমনে অভিপ্রায়ের ভাজে
কাঁপে শিকারীর রিভলবারের ছায়া

শিথিল ট্রিগার থামছে বিরাগভাজন
ডাকো তারেনাম ধরে ডাকোরাজন!



পাতাও পর্যটক

এই দেখো ভ্রমণক্লান্ত চোখ
একটা প্রগাঢ় ঘুম তাকে দেয় দায়সারা গোধূলির হাসিএখানে পাতাও পর্যটকস্রোতে পড়ে গিয়ে উধাও হচ্ছে কোথাও;
সেদিকেক্ষণকাল চেয়ে থেকে এক নতুন চরের বালিতেআটকায়;
ঘুঙুরধারী পায়ের মতো একটানা হাঁটছে হৃদয়ে কেউ
কত কিছু বেনামে ওড়ে আর নামেকালো ক্যাকটাসে ভরে যায় মহৎ মরুদ্যান-

এই সমস্ত অদিতিলন্ঠনের নিচে
আমার বাক্যেরা উজ্জ্বলপ্রেতপাখি ধড়ফড়ায়
স্মৃতির সামনে পড়েভ্রমণে জ্বলে যাওয়া ত্বক
আয়নায় হাস্যোজ্জ্বলতুমি এক মূদ্রানীতি,আমার সামনে খুলে রেখেছো ভ্রুকুটিএকটা জনমভরঢেউ পেয়ে রোদকে ডাকছে জল;

এই বুঝি তিতিক্ষার পাড়েফিরে আসে স্মৃতির সরোদ ;
অশ্রুও প্রাণান্ত হয়কারো হয় পোষমানা কেউশান্ত   শারদে পূর্ণ মেঘদিগন্তে উপচে পড়ে
মায়ায়মৃত্যুকে ঘাড়ে প্যাঁচানো মাফলার বলে ভ্রম হয়!



শিকার

আজ কোনো প্রহরীর দিকে ছুটে আসে তারাদের ছুঁড়ে দেয়া শিসআর সেইসব শিসের টুকরা কুড়াতে পৃথিবীতে মেঘ নামেযেনো প্রশ্নপত্র বাঁধা এক দিগন্তের অধিকারী তুমিশিকারে এসেছো আর ডাল থেকে ডালে ঝাঁপ দেয় ভ্রান্ত বানরভগ্ন হৃদয় থেকে আসে বাজের আওয়াজ– কার হাতে তুলে দিতে চাওএকে

তুমি এক গল্পের ঘোর থেকে ছুটে যাও আরেক যুদ্ধগাঁথায়, মাটিতে দেবে আছে কর্ণের রথের চাকা, ভীম নেই তবু শোনা যায় শল্যের চিৎকারতুমি নিঃসঙ্গনিজেই ছিঁড়েছো তোমার হাস্যোজ্জ্বল ফটোঘর থেকে হাত বের করে আঁচ করতেছো শীত।

ঠান্ডা বাতাস আসেমৃতদের কথা নিয়ে নির্বাক পৃষ্ঠা ওড়েসমস্ত রাত;
এই ফাঁকে ভেবে নিতে চাও নাকিকলোনির ছাল ওঠা ছাদ?

ঐদিকে হেলে আছে কাকতাড়ুয়াধান থেকে ধানের দূরত্বে উঁকি দেয় শোলের পোনাবাতাসে জুড়ায় নিশিধরোএই পথ একদিন তোমার ছিলোএঁকেবেঁকে এসে সারারাত শেষে পেয়ে গেছে সড়কের দেখাএই মাটি তোমার চেনাএইখানেতিতির গড়িয়ে নেমে আসে গম্ভীরা!

কতো রাত থেমে গেছে ঢালের দিকে এসেহোস পাইপ-চাতাল লক্ষ্য করেদ্যুতি  দন্ডের কাছে ম্লানপ্রায় জীবনচিত্র নিয়েকতোদূর যেতে পারো তুমি?

নিশিডাকআকাশে বিছানো দেখো;
মেঘ হতে মেঘেউড়ছে জোনাক!

ডগার অহংকারেবিস্ময় তাকে শান্ত করেজলের বিস্মরণ থেকে জীবনকে উঁচিয়ে ধরে আছে মাছরাঙাআকাশমণি গাছ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে-

কোলাহলে থেকে গেছে মেঘের গাঁথুনি যতো;যেনো হাত পেতে দিয়ে বৃষ্টি জমানো হাতে;যেনো প্রতিবেশী ছাদ হতে রোদ এসেঝলসে দিচ্ছে মুখ;

মৃত্যুও দূরবীন নাকিদেখা দেয় আয়ুর মধ্যমা?
মুখে সংশয়হাসি প্রত্যয় ছেড়েবেনোজলে ভাসে

ঘূর্ণিকে বুকে নিয়ে বন্দর চৌচিরঅচেনা গানের মতোগুঞ্জনভিজে যাচ্ছে একাকীত্বেদৃশ্য থেকে মর্মকে পৃথক করে
দূরত্ববোধকৃর্তিকে প্রশ্নে কাতর করেউৎসের দিকে ফিরে আসে ঘন্টাধ্বনি!

মগজে আয়াত বাজে হেমন্ত উচ্চারণেমগজে মুর্দাফরাসতিরোহিতপ্রায়ত্রিদিক শূন্য করে মরুঝড় যেভাবে তাকায়-
লঘু হয় ধুলা পেয়েসাপের চলন মাঠে;
এদিকে বয়সভূগোলে যতিচিহ্নগুলি ম্যাড়মেড়ে হয়ে আছে
সবটাই মায়ার মলাটদুলছে ক্রমশঃ বুনো ফুলশ্যামলীপাতার ভারে!



লেখার টেবিল

রোদ পেয়ে ছন্দে পড়ে গেছে রাই সরিষার পাতাপাশে এক কাকতাড়ুয়ার হাসি
খুলে রাখে পাখালপ্রতিভাঅতদূর ভাবতে পারি না আজকালযতটা বেঁকেছে ধনুক
বুকে  বসন্তে!

যেনো এক মাথালের ভার
ইতে চেয়েছি একটা জীবনস্নায়বিক আঁচড় টেনে
আঁকতে চেয়েছি জননীর প্রসব ব্যাথাকেআমাকে চিহ্নিত করে
ভূগোলভর্তি রোদ প্রশ্নে কাতরথৈ পেয়ে প্রখর পুকুরে
ডুবে যাওয়া খেলছে শিশু আর শিশুর গ্রামারএখানে ফলন জুড়ে
ধানের সুরভী পাবে!

অতদূর যাচ্ছি না আরঅথবা চিত্রবোঝাই মড়কলাগা মাটিও
আমাকে বৃদ্ধ করেনিরুত্তাপ করেচূড়া  চড়ক গাছ
মুখ ঢেকে বেরিয়ে যাচ্ছেছেড়ে যাচ্ছে লেখার টেবিল!



টোল পড়া নক্ষত্র

চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছি একা-সড়কবাতির ঘাড় জড়ানো ওড়নার মতো নিয়ন আলোয়
আমাকে উচ্চারণ রে রে অটোরিকশারা বাজায় ভেঁপু!

এরকম সন্ধ্যাবৃত্তে এসে সবুজ রচিত নগরীও
একটানা রপ্ত করছে মৃদঙ্গভাবনিশ্চুপ দাঁড়িয়েছি কোনো আগন্তুকআর অনেক অনেক মেঘের ভিতর দিয়ে মানুষের বিষাদ লক্ষ্য করছে টোল পড়া নক্ষত্রকতগুলি ঢেউহীন মুখ এভাবে থামছে হঠাৎ!

মনে মনে অরণ্যপাঠ আমাকে প্লাবিত করে-যেনোএইদিকে চেয়ে পল্লবিত হলো নূহের ভ্রুকুটিআরো প্রতিধ্বনি নিয়ে স্নায়ুগত হয় পাখিদের নীড়চাঁদ হলো পিত্তথলি আর মহাবিশ্বে ধানের মতো মূর্ছনা দ্বিতীয়টি নেইক্ষীন ধারা নিয়ে সুবিল হাঁটছে বুকে!

এইটুকু বন্যতা নিয়ে
আছি এক শহর অধ্যায়েযেনো এক ঝর্নার সাথে
দেখা হয় প্রাতঃভ্রমণেএটুকু উড্ডয়নে
মুখিয়ে রয়েছে পিঞ্জরপাড়!



বৃত্ত

পিছুটানছুরির নিচে  কাকে রেখে এলে হে মনস্তাপ?
এর চেয়ে বাগানব্যাপীভীরু মানুষের ছায়া লক্ষ্য করো
আলো জ্বালো টর্চেএকটা বাদামী খোসার ফল বুকে ধরে
দৌঁড়াচ্ছে বাদুড় বাদুড়ীক্ষীণতোয়া ঘাসের সাথে
পাল্লা দিচ্ছেআরো বড় ঘাসমৃৎফুল;

এরচেয়ে জীবনব্যাপী অনুশোচনার রঙেআস্তর ঘঁষে মেজে
আলগা করো এই টর্চার সেল!

বৃত্তকে বলে দাও ব্যাস
মৃত্যুকে বলে দাও উর্মির ঠিকানা!

বাহিরে বেরিয়ে দেখো
মেঘ ঠেলে ঠেলে বিষম খাচ্ছে চাঁদ!



  
জিরাফ

মনে করি ভালোবেসে আছোডাঙা  দ্বিধায়-

একটি মূর্ছনা অভিমুখে ভেসে আসে তারস্বরমিঞ্জিরি ছায়ার নিবেশে 
মৃৎফুল কারুকাজআমাকে শান্ত রাখে একাকীত্বমনে করি ব্যথা  বিবিধ 
সব তুমি জানো!

আছি এক স্বীকারোক্তির মতোদৃশ্যতঅলীক মৃগয়া ডাকেচার পায়ে ডাকে 
রণসজ্জার দৌড়হয়তো জানালার দিকে এসেবকুলে পূর্ণ হচ্ছে বাতাস!

অতুল জিরাফ দূরে 
ঘাড় বেঁকে হেঁচকি লুকায়!





প্রায়শ্চিত্ত

আমাকে স্বপ্ন থেকে তুলেআছাড় মারছে
তোমার অট্টহাসি- আর মেঘের দিকে হাত
যেনো স্পর্শের কাতরতাতোমাকে বিহ্বল করে হে মাহুত!

গন্ডি পোষন করে হাঁপিয়ে উঠেছি ভীড়ে;
হাড় ভরা বেহুলা-কেতকী থাকেনৃত্যরত; অনেক শিফন রঙে
গড়িয়ে যাচ্ছেমনসা মঙ্গলদেবার্চনায় জাগছে লখাই!

নিশিডাকে সাড়া দিয়ে অনেক দোদুল ছায়াপ্রাণভয়ে মুচড়ে ধরে
সাঁওতালি টগরের সাপ!

আমাকে ডাল ছুঁড়ে দিয়ে একটি ঝড়
বকমুখে উড়ে গেলো বলেছিন্ন পাতার দিকে মৃন্ময়ে চেয়ে
নিচু হয় অশোক উদ্যান

প্রশ্নচিহ্ন জাগে প্রায়শ্চিত্তের মেঘেআর মুখে উদ্বেগ রেখে গেছে বলিদাগ
এইভাবে আয়ুর বাসনা জাগেঅস্তিত্ব ঘিরে থাকা যত প্রশ্নকে অনন্তযৌবনা মনে হয়!




রূপকথা

ঝিরি ফুল ফুটে আছে বৃত্তে
আর হাতছানি মেনে নিয়ে মেঘ
দুপুরভর্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে রূপকথাযেনো এক অন্ধের আয়ু
বাতাস থেকে লাফিয়ে হাঁটে মায়ার তরঙ্গে-

বৃষ্টিকে পল্লবিত লাগেপানি জমে কোথাও ডুব মেরে আছে ঘূর্ণি
আমন্ত্রণ ধ্বনিত হয়আরও আসে কূয়ার কল্লোল ভেসেকোথাও কান্নার লিপিকে
বানান করছে দ্বিধাএকটা অন্বেষণের শুরুসমস্ত কল্পনাকে তাড়া করছে গ্লানি!

এতোখানি উজানবাঁকে এসেমৃত্যুও পিপাসার্ত নাকি?
এতোখানি একাকীত্ব কারোমৃতদেহ ভারী করে তোলে?

মন থেকে শুরু এক উপকূল ঝাউবনে হেলান দিয়ে আছে-
এই পথে প্রবৃত্তিও আগাছায় পূর্ণআড়চোখে প্রশ্নচিহ্ন এসে
ভাঁজ করে রাখছে ললাটকরজোড়ে থাকিমিমাংসাকে প্রতিহত লাগে!

স্পর্শ নিজেও মিথযেমন স্তন্যপানের স্মৃতি;
তারপর নিমেষেইমেঘ থেকে বেরিয়ে আসতে পেরে
উড়ন্ত একটা ঘুড়িবাড়িঘরে ধাক্কা খেতে থাকে!





যাত্রাবাড়ী

তোরা যারা হেঁটে গিয়েছিলি পাহাড়েআমি নিচ থেকে সবাইকে
নাম ধরে ডেকে দেখেছিগোড়ালিতে জোর থাকাটা জরুরিনিজেকে উঁচু দেখাতে কাজে দেয়-

ভাবতেছিঅথৈ অবধি পা ফেলার আগে
একবার ঘুরে যাবো পুরাটা শহর;

তিনদিকে সিঁড়ি নিয়ে হাওয়া খায় ফ্লাইওভার
আর তাতে দাঁড়ালে নিচকার মানুষ  জীবিকা
কতোখানি তুচ্ছ দেখায়দেখবো;

তোমাদের সুনীল ছাতায় বৃষ্টিকে হাসিখুশি ঝরতে দেখে
চিনচিন ব্যাথাও বুকে চাপা পড়ে যায়আর সেই ব্যাথার ধারে এসে
সকালেই কোন যাত্রীযাবে বলে 'নছিমন-নছিমনডাকে!







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ