১৯৯৩ সালে প্রথম ‘সরমা ও পরমা’ নামে এক নন্দনতাত্ত্বিক প্রবন্ধের বই পড়ে আমি কবি অমিতাভ গুপ্তের ভক্ত পাঠক হয়ে যাই। তবে তাঁর খুব বেশি লেখা আমার হাতে এসে পৌঁছেনি দীর্ঘদিন। উত্তর আধুনিক চেতনার ভূমিকা নামক বইটি আমি পডেছি। তবে, বাংলা সাহিত্যে ‘উত্তরআধুনিকতা’ অভিধাটি প্রথম উচ্চারণ যাঁর লেখায়, তাঁর প্রবন্ধ, কবিতা এবং সম্পাদিত বই হাতে এলেও এবং তাঁর লেখা ১৯৯৩ সাল থেকে পাঠ করলেও, তাঁর সাথে চাক্ষুষ পরিচয় ঘটে ২০১৭তে। তবে হৃদয়ের মহানুভবতায় তিনি আমাকে এতটা কাছে টেনে নেন, যেন আমাদের হাজার বছরের পরিচয়, যেন আমরা পরমাত্মীয়।
কবি অমিতাভ গুপ্তের জন্ম হুগলীতে ১৯৪৭ সালে, দেশভাগের পরে। পিতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সুলেখক বীরেন্দ্রকুমার গুপ্ত এবং মাতা মাধুরী গুপ্ত। কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতক এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উপাধি অর্জন করে তিনি ইংরেজির অধ্যাপনা শুরু করেন।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে ১৯৬৫ সালে ‘আলো’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে তিনি কাব্যামোদী মহলে বেশ প্রশংসিত হন। মার্কসীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ চিন্তাশীল এই কবি-প্রাবন্ধিক একজন সর্বক্ষণের সাহিত্যকর্মী হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তাঁর কণ্ঠে সেই বামচিন্তার স্ফুরণে উচ্চারিত হয়—
মোরগের গলা মুচড়ে একটা টকটকে লাল সকাল বেরিয়ে এল৷
কিংবা
ওদের শিরস্ত্রাণে ভারি ধাতুর অস্বস্তি,পোষাকে, কোমরের বেল্টে ঘাম আর ক্লান্তির অস্বস্তি৷
তিনি সেই স্বপ্নচারী লোক, যিনি বলেন—
ভাঙা মানুষের ফাটা মানুষেরঝরা মানুষের গানেএকদিন এই পৃথিবী মুখর হবে......আজ তারা শুধু কীর্তিনাশার অকুলের মাঝখানে.......যারা চলে যায়, সকলে ফেরে নাতবু সহস্র ফেরেতারা বেঁচে ওঠে, তারা বেঁচে থাকে,গান বোনে ধান বোনে৷
বাংলা সাহিত্যের ইউরোকেন্দ্রিক অবক্ষয়ী আধুনিকতার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা 'উত্তর আধুনিক চেতনা' ভাবধারাটির অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। দেশজ ভূমিলগ্ন সংস্কৃতির গভীরে তাঁর চেতনাটি নিহিত। সমকালীন ছিন্নমস্তা সময় তাঁকে ব্যথিত করলেও 'সূর্য অনুসারী' এই তাপসের অগ্নিপূত হৃদয় মানবতার সাধনায় ধ্যানমগ্ন। তাই তো উচ্চারিত হয়—
পালকিবেহারার ছেলে দুষ্যন্ত কাহার, তাকে শাহউলমুলক আকবরেরনবরত্ন সভায় ডেকে আনা হল। ঘরের দেওয়াল জুড়ে ছবি আঁকা, আজরাজকবিদের পুঁথি আঁকাজোঁকা করা তার দায়ভাগ। বসাওন কিংবা কেশুদাশতাব্রিজের সয়ীদ আলীর মতো রাজার চাকর হয়ে বেঁচে থাকা? কোনোঅমোঘ ঝড়ের রাতে দুষ্যন্ত কাহার হেসে উঠলেন।চোরাকুঠুরির ছায়ায় দড়ির ফাঁস একবার দুলে উঠল।
আবার কখনো—
যেকোনো পোস্টার নিয়ে অশ্বমেধযজ্ঞে যাওয়া যায়পরমান্ন রাঁধা হয় হিংস্র ভ্রুণের আঁচে৷
মনে পড়ছে ‘বুলন্দ দরওয়াজা’ নামের অসাধারণ সুদীর্ঘ কবিতাটি। যার ছত্রে ছত্রে জনমানুষের হাহাকারের বর্ণনার সাথে ফুটে উঠেছে ক্ষমতার দম্ভের আস্ফালনের নশ্বরতা। মনে পড়ছে ‘শাপলা ও রাজহাঁস’ নামের আরেকটি চমৎকার দীর্ঘ কবিতা, যার উপজীব্য চরিত্রগুলো শেক্সপিয়রের নায়ক নায়িকারা। কবি তাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন ভারতবর্ষে ইংরাজ ঔপনিবেশিকতার ঘটনাপন্জী এবং তার প্রেক্ষিতে এতদন্চলে সংঘটিত দুর্ভোগ। ইতিহাসচেতনা তাঁর কবিতার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ—
হেঁটেছি কতবার গুহার পথ ছেড়ে বনের পথ ছেড়েশুঙ্গ কুষাণের মগধ মৌর্যের শৌর্যে লোভে হাহাকারেঘোরী বা তৈমুরলঙের ছায়া পড়ে : শুনেছি দিল্লীর আকাশে একটিওওড়ে না পাখি আর। দৃপ্ত মুঠি দিয়ে লাঙল ধরি তবু কীভাবে একদিনধানের পাঁজরেই ক্ষয়কীট ও জমিদার পূঁজ ও বিষ ঢালে৷
এভাবেই মানুষের অগ্রযাত্রা—আমাদের অগ্রযাত্রা।
১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার বই 'আলো'; এবং ২০১৮ সালে প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিকতম কবিতার বই 'কালো হরিণ'সহ মোট ২৮টি কাব্যগ্রন্থ এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কবিতায় একটিই স্বর—সে স্বর যৌথের, জনমানুষের, বঞ্চিতের প্রতিরোধের প্রতিবাদের স্বর।
এই ২৮টি বই থেকে কবির নির্বাচিত কবিতা নিয়ে গাঁথা হয়েছে নির্বাচিত কাব্যসংগ্রহ 'আধেকমুক্ত রজনীগন্ধা'। মূলত ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর অসংখ্য কবিতার ভাণ্ডার থেকে চয়ন করা এই প্রবহমানতা এপার বাংলার কাব্যপ্রেমীদের জন্যে খড়িমাটি উপহার দিয়েছে ২০১৮ সালে, যা কবি যৌথভাব উৎসর্গ করেছিলেন অচ্যুত ভট্টাচার্য এবং আমাকে ।
0 মন্তব্যসমূহ
অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।