কবি
১.
কবি— এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বৃক্ষ,
বিস্তৃত এক বন সৃজন করে চলে, প্রাণের স্পন্দনে—!
বয়ে চলে, বয়ে চলে—
বাতাসে রেণু ছড়ায় প্রাণের বিপুল সম্ভাবনায়।
২.
কবি— ভালোবেসে কিংবা না বেসে
পাহাড়সম বেদনা—
জগতের সমান বয়সী ভালোবাসা
আর জীবনের সীমাহীন, সীমাহীন ভার—
নিয়ে হেঁটে চলে পৃথিবীর পথে পথে,
জীবনের বাঁকে বাঁকে।
৩.
কবি— ভাঙে, গড়ে
আবার ভাঙে, আবার গড়ে!
এক অনন্ত চক্রাবর্তে—
জীবনের সাথে খেলে যায়— আজীবন।
৪.
কবি— এক অভিশপ্ত নগরী!
খুঁজে ফেরে অন্তর্গত ঘৃণার এক জমিন—
খুঁড়ে তুলে নেয়— তার ভালোবাসার পবিত্র হেমলক!
পান করে যায় আজীবন—
হৃদয়ের, হৃদয়ের একান্ত তৃষ্ণায়।
জাতীয়তাবাদ
পাহাড়ে—
ছয় জন নিরীহ মাছ শিকারীকে—
ওরা গেঁথে দিলো ব্রাশফায়ারের জালে।
তিন জন মরে গেল
অন দ্য স্পটে
আর তিন জনকে আহত অবস্থায় নিয়ে গেল
জলপাই রঙের বুনো বাইসনগুলো।
আহত মাছ শিকারীদের, যেন শিকার করে নিয়ে যাচ্ছে—
বিকেলের স্ন্যাকস।
মনে হচ্ছে গেঁথে নিয়ে গেল আমাকেই—
রক্ত মাংসসমেত শিকারীর নির্মম উৎসাহে!
গন্তব্য বাঙালি জাতীয়তাবাদের টর্চার সেল।
সেখানে স্ন্যাকসের প্লেটে ওঠার আগে
কাঁটা চামচে কুঁচিয়ে নেওয়া হবে শরীরের মাংস,
চামড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা রক্তে মেরিনেট করে
রাখা হবে আমার শরীর।
কড়া বাঙালি জাতীয়তাবাদী আঁচে
আমাকে গ্রিল করার আগে শেখানো হবে—
কেন আমি বাঙালি নই!
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক—
স্লোগান দিতে দিতে বাইসনরা শিখিয়ে দেবে—
অধিকার চাওয়ার পরিণাম
কী নির্মম আর নিষ্ঠুর হতে পারে!
অথচ এই পাহাড়-জুম-দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতি আমাদের একান্ত আপনার।
পাহাড় আমার আত্মার আত্মীয়, আমার ঘর, ঠিকানা— আমার প্রাণ!
সে পাহাড়ে দাঁপিয়ে বেড়ায় জলপাইরাঙা বুনো বাইসন
প্রভুদের নির্দেশে যারা কেড়ে নেয় আমার অধিকার, সুচতুর কৌশলে।
আমার বুকে ছুরি
কেড়ে নেওয়া ভিটা
গলায় ঠেকানো অস্ত্র
বাইসনের স্ন্যাকসের প্লেটে সাজানো পাহাড়ি তরুণের কাটা মাথা—
কী অনন্য সম্প্রীতি পাহাড়ি-বাঙালিতে!
বাইসনরা বলে—
আমরা তোমাদের ভাই
গলাগলির নজির রেখেছি আমরা
আমরা হাসিমুখে পথ চলি কাঁধে কাঁধ রেখে
আর তা শুনে হাততালি দেয় বুদ্ধিবেশ্যারা। বলে—
বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
অথচ মাছ শিকার করবার কথা ছিল আমাদের— শান্ত সুশীতল বাতাসে আরামে!
তোমরা কেড়ে নিয়েছ আমার খাবার, আকর্ণ বিস্তৃত হাসি—
আমার ঘর-বাড়ি, সন্তান, প্রিয়তমা, বন্ধু, ভাই-বোন, এমনকি আমাকেও—
জীবন থেকে!
বস্তুত সারা পৃথিবীতেই আমি দখল হয়ে গেছি
জাতীয়তাবাদের বন্দুকের নলের মুখে।
আমি দখল হয়ে গেছি— কাশ্মীরে,
দখল হয়ে গেছি আমি— ফিলিস্তিনে,
নিজ ভূমে পরবাসী আমি— ইয়েমেন, রাখাইন, চীন, বেলুচিস্তান কিংবা আফ্রিকায়!
এমনকি, আমি দখল হয়ে গেছি গণতন্ত্রের দেবদূত আমেরিকাতেও!
আমাকে নিয়ে ফুটবল ফুটবল খেলা হচ্ছে দুনিয়াজোড়া।
কিন্তু ভুলে যেও না, আমাকে দখল করা যায় আপাত—
দখল হয়েছে হয়তো আমার পূর্বপুরুষেরাও,
কিন্তু থেমে থাকেনি, আমাদের বেঁচে থাকবার— অধিকারের লড়াই।
ভুলে যেও না—
মানুষ বানের জলের মতোন
যখন বইতে শুরু করবে, চারদিক প্লাবিত করে ভাসিয়ে নেবে
তোমাদের এই টর্চার সেল, কাঁটাতার, জাতীয়তাবাদ
ভাসিয়ে নেবে মানুষকে অবরুদ্ধ করতে ব্যবহৃত তোমাদের যত মেশিন
তোমাদের ভাসিয়ে নিয়ে মানবিক স্রোতে—
পৃথিবীটা মানুষেরই হবে একদিন— দেখে নিও!
সে পৃথিবী হবে মুক্ত ও স্বাধীন, মানুষ সেখানে হবে মুক্ত পাখি!
আমিও সেই পথেরই যাত্রী!
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
আপনাকে চাষাবাদ করতে হয় না।
চাষাবাদ করলে বুঝতেন—
প্রতি মণ ধানে দু’শ টাকা গচ্চা দেওয়ার পরও
মুখে হাসি ধরে রাখা কত কঠিন কাজ!
চাষাবাদ করলে বুঝতেন—
উৎপাদন খরচ উঠাতে না পেরে
কতটা অসহায় হলে রাজপথে ঢেলে দেওয়া যায়
শরীরের রক্ত পানি করে বড় করে তোলা আলু!
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
আপনি কৃষক নন, আপনাকে চাষাবাদ করতে হয় না!
চাষাবাদ করতে হলে বুঝতেন—
ধানক্ষেতে আগুন দিতে দিতে,
রাস্তায় আলু ঢালতে ঢালতে,
আপনিও আরও বুঝতেন—
জিডিপি, মাথাপিছু আয়, উন্নয়নের গান— খাতা-কলমের এইসব হিসাব—
সে বড়লোকের পকেট ভরার তত্ত্ব মাত্র।
অবশ্য আপনি কৃষক নন বলে—
ভাতের টেবিলে বসে, কৃষককে— গাঁইয়া, ক্ষ্যাত, অশিক্ষিত, আনকালচারড, ব্লাডি বলে গালি দিতে দিতে এখনো সংস্কৃতি চোদাতে পারছেন; মদের গ্লাস হাতে নিয়ে চিপস বা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই চাটতে চাটতে আলুর উপকারিতা নিয়ে লেকচার চোদাতে পারছেন; নেশার চোটে পশ্চাদ্দেশের কাপড় খুলে গেলেও তা সামনে উঁচু করে ধরে উন্নয়নের গানে গলা মেলাতে পারছেন।
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
কৃষক এখনো চাষাবাদ বন্ধ করে অস্ত্র তুলে নেয়নি হাতে
কৃষক হাতে অস্ত্র নিলে, রাষ্ট্রের দিকে বন্দুক তাক করলে
তখন আপনি বুঝতেন—
আপনার এই উন্নয়ন, নানা বস্তাপঁচা থিউরি, জাতীয়তাবাদ, মোরালিটির নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, শ্রেণিগত আগ্রাসন আর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নামে মানুষ বিভাজনের আত্মম্ভরিতা,
কিভাবে বুদবুদের মতোন হাওয়ায় কিংবা শূন্যে মিশে যায়!
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
আপাতত আপনাকে কৃষক হতে হয় নি বা কৃষক এখনো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি।
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন—
পোশাক শ্রমিকের মতো দাসের জীবন বেছে নিতে হয়নি আপনাকে,
কিংবা হতে হয়নি প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিক।
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন—
প্রয়োজনীয় কোনো পণ্য উৎপাদনের জন্যই আপনাকে শ্রমিক হতে হয়নি।
ফলে গরম, শীত, বসন্তে—
আপনি বেছে নিতে পারেন আপনার পছন্দমতো পোশাক
ঘরে লাগিয়ে নিতে পারেন আরামদায়ক এসি
এসির শীতল বাতাসে কিংবা ফ্যানের আরামদায়ক হাওয়ায়—
আয়েশে চোখ বুজে রবীন্দ্র, নজরুল, গজল কিংবা আধুনিক গান শুনতে শুনতে ভাবালুলতার ভেতর হারিয়ে যেতে পারেন;
কিংবা রক গান, মেটাল বা হেভি মেটাল শুনতে শুনতে উন্মত্ত মাদকতার ভেতর যেতে পারেন নিমেষেই বা ভিড়ের ভেতর স্তন চেপে দিয়ে বলতে পারেন— এটাই আধুনিকতা। অথবা বাড়িতে কাজের মেয়েটার সকল অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে তাকে বাধ্যতামূলক বন্দিত্বে রেখে আপনি মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন কিংবা সভা সেমিনারে বিশাল বিশাল বক্তৃতায় গাইতে পারেন নারী মুক্তির গান।
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
আপনি হননি হকার কিংবা পাটকল শ্রমিক,
যাদের সবসময় উচ্ছেদের ভয়ে থাকতে হয়, কিংবা মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে বউ বাচ্চা নিয়ে আধপেটা হয়ে থাকতে হয়। তাই গতর না খাটিয়েও তিন বেলা পেটপুরে খাইতে পারেন,
আর আস্তিক নাস্তিক বিতর্কে পেটের ভাত হজম করতে পারেন।
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
আপনি অটোমেশন শ্রমিক না।
তাই নির্দ্বিধায় কিবোর্ডে প্রতিবাদের ঝড় তুলতে পারেন বারংবার!
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
আপনাকে কোনো শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে হয়নি!
তাহলে বুঝতেন— কাজ করতে করতে কিভাবে পাছা ক্ষয়ে যায়!
কিংবা ওভারটাইম করতে করতেও যখন জীবনের হিসাব মেলে না, তখন কিভাবে মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয়ে যেতে থাকে— টের পেতেন!
আপনি টের পেতেন, আগুনে ভস্ম হয়ে কিংবা মাটির নিচে চাপা পড়ে মালিকের লোকসানের খাতায় কিভাবে লাভের হিসাব বাড়াতে হয় জীবনের হিসাব চুকিয়ে।
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
আপনাকে এর কোনোটাই করতে হচ্ছে না।
বরং পেটের দায়ে পাওনা মজুরি পেতে শ্রমিকরা যখন রাস্তায় নামছে—
আপনি তাদের উন্নয়ন বিরোধী, দেশদ্রোহী, উচ্ছৃঙ্খল বলে গালি দিতে পারছেন, টক শো চোদাতে পারছেন, কলাম চোদাতে পারছেন!
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
শ্রমিকরা এখনো আপনার টুটি চেপে ধরে বলেনি—
মাদারচোদ! আমার অধিকার আমি ছিনিয়ে নিবোই— আটকানোর তুই কে?
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
আপাতত শ্রমিকরা এর কোনোটাই করছে না!
তারা এখনো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি কিংবা রক্তের বদলে এখনো রক্ত চায়নি, বরং এখনো মৌন দাবি-দাওয়াতেই সীমাবদ্ধ তাদের আন্দোলন।
আপনি শুকরিয়া আদায় করুন যে—
আপনাকে কৃষক বা শ্রমিক কোনোটাই হতে হয়নি।
আর যদি শুকরিয়া আদায় করতে না পারেন,
তাহলে আপনার রক্তকণিকার কাছে জবাব চান—
শোষণের শৃঙ্খলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আপনার নিউরনের কাছে জবাব চান—
অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে মুখ বুজে অন্যায় সহ্য করার জন্য।
জবাব চান আপনার প্রিয়তম বা প্রিয়তমার কাছে—
দালালি করে এই অন্যায়কে দীর্ঘ মেয়াদে এগিয়ে দেওয়ার জন্য!
সাইকোডেলিক এ সকালে
সাইকোডেলিক এ সকালে—
ঠোঁট জোড়া কাছে আসে,
চুমুর কথা বলতে বলতে—
হঠাৎ চুপসে যায়!
মেলানকোলির সুর বাজে বাতাসে।
পরান টাটায় তার খাসলতে!
সাইকোডেলিক এ সকালে—
মনোলিথিক গাঁথুনি—
সেই ছাঁচে গড়ে ওঠা ব্যথা—
একটানা কামড়ায়।
কাছে-দূরে কোথাও
বিবশ হয়ে পড়ে থাকে সুন্দরীরা, তাদের হৃদয়ের ক্ষয়ে।
পরান টাটায় তার খাসলতে!
সাইকোডেলিক এ সকালে—
সারারাতের ক্লান্তিতে—
শিল্পরা পড়ে পড়ে গোঙায়—
তাদের একাকী দুঃখে!
শুধু মানুষ কাতরায়— তার হৃদয়ের একান্ত ব্যথায়!
ঠাঁই খুঁজে কোনো এক হৃদয়ের একান্ত নীড়ে।
পরান টাটায় তার খাসলতে!
সাইকোডেলিক এ সকালে—
প্রতিসারী আলো এসে— চোখ ঝলসে দ্যায় মুহূর্তেই!
নিউরন ছিঁড়ে ছিটকে বের হয়—
থোক থোক চিন্তার অনুলিপি!
কিলবিলিয়ে ওঠে মগজ।
পরান টাটায় তার খাসলতে!
সাইকোডেলিক এ সকালে—
সঙ্গমে ক্লান্ত চাঁদ,
আশ্রয় খোঁজে পৃথিবীর পাড়ে—
কিনে ফ্যালে, গিলে ফ্যালে তারে ধীরে ধীরে—
সাম্রাজ্যবাদী আকাশ—!
গোপনে বিক্রি হয়ে যায়, মানুষের শ্রম— তার একান্ত চাঁদের আলো।
তাই পরান টাটায় তার খাসলতে!
সাইকোডেলিক এ সকালে—
মানুষ মানুষরে গিলছে হরদম।
দরদামহীন বেচাকেনায়— মাংসের সাথে মিলছে মাংস
কেনার সাথে বেচার তফাতে!
মানুষ খাবার হয়ে চলে যায় মানুষের টেবিলে—!
পরান টাটায় তার খাসলতে!
সাইকোডেলিক এ সকালে—
মানুষ মানুষরে খেয়ে দ্যায় গোপনে
পরান টাটায় তার বাইনারি খাসলতে!
0 মন্তব্যসমূহ
অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।