....

এ সংখ্যার কবি : শামীম হোসেন

 





শামীম হোসেনের জন্ম ১৯৮৩ সালের ৭ আগস্ট পদ্মাপারের রাজশাহীতে। সদা আত্মমগ্ন থাকেন কবিতাধ্যানে। তার প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : বরেন্দ্র প্রান্তরে বসন্ত নামে (২০০৭), পাখি পাখি ভয় (২০১১), উপমাংসের শোভা (২০১২), শীতল সন্ধ্যা গীতল রাত্রি (২০১৩), ধানের ধাত্রী (২০১৫), ডুমুরের আয়ু (২০১৭)। ছড়াগ্রন্থ : এক তুড়ি ছয় বুড়ি (২০০৮), গাছভাই নাচভাই (২০১৭)। কবিতা লেখার পাশাপাশি সম্পাদনাতেও রয়েছে তার বিশেষ দক্ষতা। দীর্ঘদিন যাবৎ প্রকাশ করছেন শিল্প-সাহিত্যের কাগজ নদী। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার (২০১৫), রূপান্তর সাহিত্য পুরস্কার (২০১৩), রাজশাহী সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (২০১১), অধ্যয়ন শিশু ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৬), বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৭), আন্ওয়ার আহমদ স্মৃতি পুরস্কার (২০১৭)। বর্তমানে তিনি নিউজ পোর্টাল উত্তরকালে বার্তাপ্রধান হিসেবে কর্মরত।







ছায়া

আমি হাঁটলে আমার ছায়াও হাঁটে
আমি হাত তুললে সেও তোলে
বাহ দারুণ তো!
আমি দুঃখ পেলে বিমর্ষ হই
কিন্তু সে হয় না...
আমি কাঁদলে সেও কাঁদে
কিন্তু তার কান্নার কোনো শব্দ নেই।



পাতালঘরে

যেন আমি ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছি
একটা মায়াবী ঘন অরণ্যের ভেতর দিয়ে
আনমনে হেঁটে যাচ্ছি;
সামনে একটা লোহিত নদী আর ঘন কাশবন
তার ভেতর থেকে কী রকম একটা শব্দ টের পাচ্ছি
যেন নদীর ভেতর থেকে শব্দরা উঠে আসছে
যেন কাশবনের উপরে কবিতারা ভাসছে...
আর আমি উন্মাদের মতো ডেকে যাচ্ছি নিজস্ব স্বরে
মাটির নিচ দিয়ে যেন আমি চলে যাচ্ছি—
পাতালঘরে...



চড়ুই দুপুর

এতপথ হেঁটে হেঁটে
অন্ধকার পার হয়ে দূরে
কোনো নির্জন গোপনে
একটি পাখি ডেকে যায়
নিজস্ব সুরেৃ
পড়ন্ত যৌবনী রোদে
পিপাসার্ত ঠোঁট খোঁজে
ছায়া ছায়া শীতল শীতল
ঘুম ঘুম দুপুরে
এক ঘটি জল—
শান্ত দেহ—মনোবল।

ফাঁকা বাইপাস
লু হাওয়ায় নুয়ে গিয়ে
যান্ত্রিক কোলাহল নিয়ে
চলে এঁকেবেঁকে—
কত পথ, কত নির্জন অরণ্য
পিছে রেখে, ফেলে দীর্ঘশ্বাস।
শুধু একটি চড়ুই দুপুর
তোমার—আমার
ফিরে আসে না আর...



সূর্যটা

কাশফুলের মতো খুব হালকা কষ্ট পাওয়ায়
সাদা কাপড়ে বেঁধে ফেলেছি হাত
খরগোশের পশমের মতো মোলায়েম ভাবে
কেটে যায় রাত
জোসনা লেগে থাকে কুয়াশার গা’য়।

খেলাচ্ছলে অনেকেই বালুচরে লেখে নাম
নদীর ঢেউ এসে সেগুলোও ধুয়ে নিয়ে যায়
ক’জনই বলো
নামগুলো
জানতে পায়!

সূর্যমুখীর মতো লাল সূর্যটা
একদিনের জন্য হলেও আমার—
চাই-ই চাই...



সৈয়দপুরের পথে মনোট্রেন

মনোমাঝে শব্দ প্রবাহিত হয় নানাভাবে—নানাকল্পে—
নানা উপমায়; পু... ঝিক...ঝিক... শব্দের মতোন
হৃদয়ে ট্রেন আসে, যায়... দূরে...
শ্যামল চোখ নিয়ে এক বৃদ্ধ বলে—বাবা মনোট্রেন কী
সৈয়দপুর যায়!
আর আমি তখন নিজ আত্মার সাথে গোপন
পরামর্শ করি, আরে বলে কী বাবায়—
মনোট্রেন কী সৈয়দপুর যায়

দয়াল—
মনোট্রেন কী সৈয়দপুর যায়...



স্মৃতি, নদীপথে

শূন্যমিলনে ভেসে আসে মৎস্য
কিশোরীর স্বর...
আর মনোপথে গভীর অতল জলে
লাফ মারে চকচকে রুপালি ইলিশ
পদ্মাপারের ফর্সা মেয়েটি
হয়ে যায় গোপন গুইসাপ
সান্ধ্য কুয়াশায় ভেজানো পত্রগুলো
অদূরে ভেসে যায়
বিবর্ণতায়...



প্রস্তুতিপর্ব

আমরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে
ছাতার ব্যবহার শিখেছি
বাদামি ডাহুকীঘুমে রোপণ করেছি
আমাদের যাবতীয় স্বপ্নবীজ
আগুন ব্যবহারের অনেক আগে
আমরা রমণীদেহে আগুন জ্বালিয়েছি—
যখন মানুষেরা পরতো পাতার পোশাক।

আর আমরা ধীরে ধীরে আকাশি নীলে
জ্যোতির্ময় আলোয় জ্বলতে জ্বলতে
পৃথিবীতে এসেছি অনেক পরে।
তারপর বিবেচ্যভাবে ঘুরতে ঘুরতে
অন্তহীন লোহিত নদীতে পুড়তে পুড়তে
বৃষ্টিতে ভিজতে শিখেছি।



চিররহস্য

এতরাতে কে কাঁদো তুমি!
দূর থেকে তোমার কান্নার শব্দ শোনা যায়।

আর আমি তো নক্ষত্র আলোয় অপেক্ষারত
এতরাতে কেন কাঁদো তুমি
আমার চেয়েও বেশি কী তোমার ক্ষত!

এই রাতে আমি কেন কাঁচা হলুদের গন্ধ পাচ্ছি
দূরের মেয়ে—
তোমার কান্নার রঙ কী হলুদ!

এতরাতে কে কাঁদো তুমি!
কে!
কে!



ভয় ও নির্ভয়ের কবিতা

ভ্যাঁসাল দিয়ে মাছ ধরার মতো ছোটখাটো দুঃখগুলো
ছেঁকে আনি দূর-দূরান্ত থেকে মনের আয়নায়
কোথায় কখন কী ঘটেছিল সবকিছু—
ধীরে ধীরে মনে পড়ে যায়...

খুব ছোটবেলায় ঘুমের ঘোরে ছোট ছোট
কুণ্ডলী পাকানো কালো দৈত্যগুলো
বড় হতে হতে কখনো—
সরষের মতো ছোট হয়
আর মনের মধ্যে তখনই শুরু হতো—
জ্যাকেটভর্তি ভয়।

আর এখন যেকোনো যুবক
নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে রয়...





দোয়েল

আজ দুপুরে—
বিমর্ষ দোয়েল আটকে ছিল
আমাদের অফিসের কাচ জানালায়;
মা দোয়েল ওপাশ থেকে ডাকে—
বাবা আয়, আয়
আর বিমর্ষ দোয়েল আটকে থাকে
আমাদের অফিসের কাচ জানালায়।

যতবার আমি তাকে ঝুলঝাড়া
ঝাড়ু দিয়ে বের করতে চাই
ততবার সে ভয়ে ভয়ে—
আচানক থমকে যায়।
আর সে চোখে চোখে মাকে বলে—
আমি যে পড়েছি শিকারি খাঁচায়।

মাঝে মাঝে কাচের এপাশ থেকে
দোয়েল চেয়ে দেখে দূর আসমান
আমি তাকে ছেড়ে দিতেই সে বলে—
বেঁচে থাকো কবি
হও তুমি পৃথিবী সমান...



ফুল

মাটির দোতলায় ছড়ানো তোমার হৃদয়
শস্যদানার মতো ছড়িয়ে দাও আগুন—
ফুটুক এই ধানবাগানে আগুনফুল।

রক্তজবার কাছে রঙ নিয়ে এঁকে দাও—
জোনাকির বুকে লাল টিপসই কিংবা
তালপাতায় লিখে রাখো সময়কথন...

তবে ভুলে যেও না—
ফুল বনে নয়, মনেও ফোটে...



ভূতগ্রহণ

ওই তো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে
যারা ড্রাম বাজাতে বাজাতে আসছে
তাদের পেছনেই দেখা গেলো তাকে—
কী রকম চোরাগোপ্তা চুলের বাহারে...

আলিশান ঘোরলাগা মায়াসন্ধ্যায়
পাহাড়ের গুহামুখেও দেখা গেল তাকে
কী রকম মায়া মায়া চক্ষুচরক...
মনে হয় হলদে দাঁতের জাদুমন্ত্রে—
অভিজ্ঞ বংশীবাদক।

ওই তো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে
যারা ড্রাম বাজাতে বাজাতে আসছে
নাহ! তাদের পেছনে আজ দেখা গেল না তাকে...



প্রমূর্ত

কী রুদ্র শিবের জটার বিন্দুজল!

পানি টলমল—উত্তাল প্রমত্তা বাসর
হিম হৃদয়ে চিত্রিত ভাটির দেশে
মেঘের দিক থেকে ছড়িয়েছ চুল মাটির দিকে
যেন অবিনাশী প্রণয়শৃঙ্গার!

কী রুদ্র শিবের জটার বিন্দুজল!

আমি নিশ্চল—বোবা—বধির
কামহীন ততোধিক অধীর... দয়ার কাঙাল
প্রলয় শেষে একদা এই শান্ত সৌম্য নদীতীরেই
হাঁস হয়ে ভেসে উঠেছিলাম...



আধা মাদুলির মতো

নদীর কিনার থেকে বানে ভেসে আসা
আধা মাদুলি কুড়িয়ে পেয়ে
চকচক করে ওঠে জেলে যুবকের চোখ
আর তাকে অমূল্য ভেবে লুকিয়ে রাখে বুকের ভেতর।

তারপর বহুদিন পর
বাহুতে বেঁধে রাখে প্রণয় মাদুলি—
মাদুলি যতই নড়ে জেলেবউ রূপবতী হয়
আর একদিন রূপের হাওয়া যেয়ে লাগে পালের নৌকায়
জেলে শুধু চেয়ে থাকে আর কেঁদে-কুটে চক্ষু ভাসায়...

আর সে বড় বেশি উদাসীন হয়
বড় বেশি নদীহীন হয়
বানে ভেসে আসা আধা মাদুলির মতো
এখন সে নিজেকে লুকায়...



উপজেলা পায়ে সে শহরে ঢুকেছে

হু হু করে বিষণ্ন পাতাগুলো রোদ মেখে ফিরে গেছে সূর্যের বাড়ি; হাঁড়িতে আড়ি পেতে বসে আছে ফড়িঙবাবাজি আর ঘাসেরা হাইওয়ে ধরে হেঁটে হেঁটে চলে গেছে খড়খড়ি। আজ রোদমাখা কলাপাতা দিন—মনে হয় সবই রঙিন...

এবার বাজুক বাঁশি— রাধা তার কৃষ্ণ পেয়েছে।
উপজেলা পায়ে সে শহরে ঢুকেছে।



যদি একবার অরণ্যে যাই

যদি একবার অরণ্যে যাই—
চিতলের মতো চিৎ হয়ে শুনবো বৃক্ষের কান্না
আর সেই ভাষাহীন কান্না ছড়িয়ে দেবো আকাশময়
ধীরে ধীরে খুব ধীরে পাতার বিছানা মাড়িয়ে
চলে যাবো কোন প্রাচীন বৃক্ষের কাছে
এবং তোমাকে শেখাবো কী করে ফলবতী হতে হয়!

এসো মাটি হই—মাটির মানুষ
রোদে পুড়ে তামাটে সিঁথি থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম নিয়ে
ভিজিয়ে রাখি ঘাসের কার্পেট...
আর কিছু বৃক্ষের কাছে শুনে আসি প্রত্ন-ইতিহাস

চলো আরো গভীরে যাই...

তোমার পাঙাশ চোখ ফাঁকি দিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে
যদি অরণ্যে চলেই যাই; তবে—
কোমরের ডোর দিয়ে বাঁধবে কি আমার দুহাত
আর চোখের সার্কাসে নাচাবে আমায়!
যদি সবকিছু বেমালুম ভুলে
একবার অরণ্যে যাই—
সাধ্য কার
আমাকে ফেরায়!



নদীচরে মেষপালক

এইতো এসেছি চলে নদীগর্ভে
ও মেষপালক,
দেখো না কতদূর থেকে এসেছি
জলের চিহ্ন এখনো পায়ের পাতায়
চোখ এখনো লেগে আছে মহিষের শিঙে বসা—
শালিক ডানায়
দেখো না কতদূর থেকে এসেছি তোমার ডেরায়।

এইসব ভাসমান মেঘে এইসব ধানশিশু সবুজে
আলোড়িত বুঝি তোমার হৃদয়
আর এইসব চর-চরাচর বিস্তীর্ণ ভয়
কীভাবে উধাও করে ঘুমিয়ে থাকো—
নক্ষত্র বিছানায়!


আহা মেষপুরুষ আহা দুগ্ধবতী মেষ
নদীর জলের মতোই প্রবাহিত হও...



আমি আর র‌্যাঁবো শহরে আসছি

আয় র‌্যাঁবো একগ্লাস দুধের সাথে বীর্য মিশিয়ে—
দিয়ে আসি অহংবোধী অধ্যাপকের হাতে
সেই সাথে কানমলা দিয়ে আসি কিছু দাঁতাল ষাঁড়ের
আয় লিখি কিছু বোকা-সোকা অমার্জিত প্রেমের কবিতা।

আয় র‌্যাঁবো আয়
দেখ আমি শিশিরে লেপটে আছি—শুয়ে আছি ঘাসের ওপরে।

চল কিছু হদ্দজ্ঞানীর কানমলা দিয়ে আসি।



আগুন দিয়ে আগুন নেভাই

সে এক পাথর যুগ
পাথর দিয়ে পাথর ঘষে যখন
আগুন এলো পৃথিবীর ঘরে—
সেই থেকে আমরা আগুন জ্বালাতে শিখেছি
অথবা দেহের সাথে দেহ মিশিয়ে
পান করতে শিখেছি মেঘের জল;
আর বিজলীতে পুড়ে ভস্ম হয়েছি কতবার!
আরো কত রাত কেটেছে আমাদের—
পাথরের গুহায়।
কত রক্ত, ঘাম, বমি ও পুঁজের ভেতর আমরা
আগুন জ্বালিয়েছি শীতে; শীতের রাতে
আর মশালের আলোয় জ্বালিয়েছি কামনার আলো।

কী এক অদৃশ্য আগুনে পুড়ে পুড়ে নষ্ট করেছি
পাখিদের পালক ঝরানো ভোর—
আর রোদের আগুন মেখে আমাদের কৃষকবাহু
ধরেছে লাঙ্গল—ক্ষেতের শিশিরে
আর আমাদের সুস্তনী স্বাস্থ্যবতী যুবতীরা
পরেছে আগুন পোশাক।
তারপর যুবকেরা তাদের মনের ভেতর
জ্বেলেছে প্রেমের আগুন
আর ওতে নিজেরাই পুড়েছে এবং
চোখের নদীতে বয়ে গেছে ব্যর্থ ফাগুন।

বসন্তের বাউলা বাতাসে এখন
ধসে যাচ্ছে দেহ
আর লেলিহান অগ্নিস্রোতে
বের হয়ে আসছে অনাগত স্বপ্নসিরিজ...

কারো কারো চোখের ভাষায়
আগুন ছড়িয়ে যায়—দিকে দিকে নগরে নগরে
অতঃপর আগুনঘরে
কেউ কেউ পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়
তখন চোখে-মুখে, নাকে-কানে, হাতে-পায়ে
হৃদয়ে হৃদয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশের মতো
আগুন বেরোয়...
পাখিদের উড়োজাহাজে পাথর ছুঁড়ে
যারা ধরাতে চেয়েছিল আগুন
তারাও এখন হন্তদন্ত হয়ে আগুন নেভায়।
আর যারা তাদের রমণীরোদে
সাময়িক লৌহদণ্ডের দ্বারা ফেলেছিল সাড়া
তারাও টুটাফাটা মেঘের মতো খোঁড়াতে খোঁড়াতে
উষ্ণতা চাইছে আগুনের কাছে—
আর ঢালছে পানি
ছাই হওয়া গাছে; গাছের গোড়াতে।

আর যখন অথর্ব—নুলো, হেবা-কেবলার মতো লোকেরা
সমাজে-সমাজে, সঙ্ঘে-সঙ্ঘে
মানুষে-মানুষে আগুন ধরায়
আমি তাদের জন্য—
পাখির পালক খুলে রেখে
অগ্নিসাগর থেকে উঠে এসে
আগুন দিয়ে আগুন নেভাই।






শূন্যস্থান

পাক খেতে খেতে বাতাস ঘুরছে
ঘুরতে ঘুরতে ধূলি ও ঝড়—
শূন্যস্থান পূরণ করছে...
আর মহাশূন্যের দিকে ঢুকে যাচ্ছে
আমাদের ধূসর প্রকৃতি

বোধ ও বধির হাওয়ায় উড়ছে—
ফল ও ফসিল...
চাকার ঘর্ষণে অবিরাম বর্ষণে 
ধস ও ধ্বংসের দরজায়— 

বাতাস এসে শূন্যস্থান পূরণ করে যায়!  



নর্তন

আপনিই যদি মাথা হোন
আমি হবো পা
পা দিয়ে হেঁটে হেঁটে মাথার নিকটে যাবো—

মাথা খাবো
খুলি নিয়ে দরজায় ঝোলাবো।

মাথাহীন আপনি নাচবেন
পা দিয়ে আমিই নাচাবো।



পাখিদের স্নানঘরে

পাখিদের স্নানঘরে প্রবেশ নিষেধ
ভেতরে পাতার শব্দ—জলের ছলাৎ
নিষেধের ঢেঁকি তুলে গেয়ে যাচ্ছে গান
আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে—
দেহ ও পরান... 

কোকিলের কণ্ঠে জমেছে মেঘ 
অরণ্য ঢুকে গেছে ড্রয়িংরুমে 
মেহেদি পাতায় লাল হয় না এখন
নতুন বউয়ের হাত;
পাখিদের স্নানঘরে প্রতিদিন সন্ধ্যা আসে
প্রতিদিন ফিরে আসে রাত...



হাসপাতালে শাদাদিদি

ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায় শাদাদিদি
বেডে বেডে সৌরভ ছড়ায়—
লিখে দেয় বকুল ফুলের ঠিকানা।

আমিও নিকটে যাই—দিদির নিকটে
দেখি ঘাম জমে আছে শ্যামলা ঠোঁটে!

অসুখের কথা তাকে জানাই ইশারায়
হাসপাতালে দিদি দেখলেই—
অসুখ বেড়ে যায়...



তারা নেই, তারকাও নেই

কোথায় গিয়েছে তারা—
এত তর্জন-গর্জন, হম্বি-তম্বি
গিনিপিগ—ইঁদুর;
মরাডালে ঝুলন্ত বাদুড়—
ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশের প্রাণ!

শূন্যতার দড়ি বেঁধে ঝুলছে
তাদের ভাঁড়ার...

অথচ ফেরাও চোখ
দেখো সেই—
তারা নেই, তারকাও নেই!



ভিন্নপট

ফুর্তি জেগেছে মনে—
গাছের পাতা, পাখিরা কি জানে...?

আলোর মশাল জ্বেলে যে কৃষক বসেছিল মাঠে
তার কাছে শুনেছি অন্ধ ধীবরের কাহিনি
ততটুকু জেনেছি— যতটুকু জানার আগ্রহে ছিল
এর বেশি কিছুই জানিনি...

মোরগের লাল ঝুঁটি থেকে রঙ নিয়ে
খড়ের ক্যানভাস এঁকেছিল যে চিত্রকর—
সে গেছে বুধবারে—ভূগোলের বোঝাপড়ায়
আজো দেখো ফিরে আসেনি...

ফুর্তি জেগেছে মনে—
গাছের পাতা, পাখিরা কি জানে...?




মধু-বিষ

রোদের সেলুনে তুমি শুকিয়েছ চুল
হরিণের হাড়ের চিরুনীর কারুকাজে
বিনম্র মুখ আঁকে শিল্পী ক্যানভাসে
মেঘের দরজায় বৃষ্টির মেয়ে হাসে।

আর হাসির ঝিলিক লেগেছিল
বৃক্ষে—শাখে—কচুপাতায়
দূরের কোনো স্টেশনের সাইনব্যানারে
যে আঙুল ছুঁয়েছিলে আঙটির ভারে।

মাটির ঘর থেকে বহুদূরে জ্বলেছিল বাতি
ভেসে ছিল পদ্ম তখন সুঁই-সুতার আঙুলে—
আর বাঁকা হয়ে নেচেছিল চোখের কার্নিশ
যে হাতে মধু দিলে সে হাতেই তুলে দিলে বিষ!




নদীর দিকে ফিরবো

এমাজ ফকিরের ধ্যানের মতো সম্মোহিত
পাতার অভিধানে লিখে রাখবো কালের পঙ্ক্তি। 
এখন জোছনায় জোয়ার আর নদীতে ভাটা
অনতিক্রম্য পথের দাগ সমুখে আমার—
ট্রাফিকের মতো হাত নেড়ে দেখায় লাল সংকেত। 

কালো মেয়েটার বিবাহের বয়সের সমান নদীর কবিতা
এনে দেয় জলহীন ধুধুচরে জলের জোয়ার...
আমার ফেরা না ফেরার দ্বন্দ্বে—

আবার যদি ফিরি—নদীর দিকে ফিরবো। 




চাঁদের স্তন

যারা বৃষ্টির মতো কেঁদেছিল গতকাল
তাদের কান্নাই আজ পৃথিবীতে ঝরেছিল খুব
আর বিষণ্নমনা লোকটির প্রার্থনার মতো
ধীরে ধীরে ডুবেছিল চাঁদ—চাঁদের স্তন...

শুধু পড়েছিল চড়ুইয়ের পালক— ভয়!




বর্ষার ভোর

জামের রসের মতো হৃদয়ে দাগ লেগে থাকে
আর ভেজা ঠোঁটে ব্যাঙের ভঙ্গিমায় ফুটে উঠছে
বহুদূরের অতীত—
মাঝে মাঝে বুকের ভেতর ঘাই মেরে ডাকে।

কী করে সাজাই তবে বালির সংসার!
অহমের ধাতু ক্ষয়ে যে মাঝি ছেড়ে গেছে ঘাট
নৌকাও ভেসে গেছে তার বিপরীত স্রোতে...
ধুধু জল রেখে গেছে তালাবিহীন শূন্য কপাট
বুকের লকেটে শুধু ঝুলে আছে স্মৃতির ভাঁড়ার।

লেবুর সুগন্ধ ছিল বুঝি তার জিহ্বার টোপে
কবুতরের পাখনায় ধেয়ে আসে অসীম আঁধার
চাতক লুকায় দেখো মেঘের কাতারে—
মোকামে এখন বুঝি ব্যস্ত পারাপার...

কাঙালের ছড়ি ঘোরে দেখো এই চোখের ওপর
ভেতরে শ্রাবণ কাঁদে ভেসে যায় বর্ষার ভোর...




পারিবারিক

আমার মামার খুব ঘোড়া পোষার শখ ছিল
তাই ঘোড়া দেখলেই এগিয়ে যেতেন...

আর নানার ছিল মাছের—
এক বিরাট চিতলের কানে পরিয়ে ছিলেন দুল।

আর নানী আমার চুলে বিলি কেটে শোনাতেন—
পেঁপে গাছে বসা এক শাদা পরির গল্প।

আর খালারা ছিলেন পাঁচ বোন
               এখন পাঁচ জায়গায় থাকেন।

একথা সত্য যে, আমার মা খুব ভালো রান্না করেন!




ভূমির চাতাল

শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ান কবিগণ।

সব দরজা বন্ধ হলে খোলা আছে অবারিত প্রান্তর
এশিয়ার প্রাণবিশিষ্ট ভূমির চাতাল।
এবার ধরুন তবে মহুয়ার ডাল—রক্তজবার কালিতে
লেখা আছে ইলা মিত্রের নাম।

তেঁদড় ইঁদুরের যদি বাড়ে উৎপাত
প্রস্তুতি নিয়ে আছে কোঁচবিদ্ধ হাত!

এবার তবে সোজা হয়ে দাঁড়ান কবিগণ—
জোছনার আলোয় কেটে যাবে কবিতার রাত।






গ্রহণ

কত ডাক আসে ঘরে কত ডাক ফিরে যায়
চাঁদকে উল্টো করে হাতে ধরি রুপালি কয়েন
আমার ভেজার বাসনা আকাশের গায়ে যখন
লাগে দেখি মেঘের গ্রহণ—
খুব বেশি কচুপাতায় স্বপ্ন দেখি না।

যখন উঠেছে ফুটে দাদিমার নকশিকাঁথায়
এক নার্সের চোখের মতো বিড়ালের চোখ
কুয়াশার জ্যাকেটে মোড়া দাদার কবর;
তখন জেনেছি আমি—
কত ডাক আসে ঘরে কত ডাক ফিরে যায়
আকাশের গায়ে কেন লাগে না গ্রহণ!



এই কালো শরীর

ঘাসের লণ্ঠন জ্বেলে কে ডাকো সবুজ সবুজ!
পাতার উড়োজাহাজে ভেসে দেখে যাও—
বিরান প্রান্তরে জমিয়েছি শীতের শিশির
বুকের গোপনে সাজিয়ে রেখেছি আগামীর বীজ।

এখন তো অনেক কাজ মাঠে মাঠে
পাকা ধান কেটে কেটে অবশ দুহাত
লাহাড়ির অবসরে থরে থরে স্বপ্ন আর 
কানে গুঁজে রাখি কলমির ফুল...

আহা সেই স্বপ্নের ঘরে মহাজনী ইঁদুর
ফসলের ফসিল কেটে চালাকি ধামায়
ভরে ছিল গর্তের গোলাঘর আর তার 
লাল চোখের নিচে জমেছিল পাপের সিরিজ...

ঘাসের লণ্ঠন জ্বেলে কে ডাকো সবুজ সবুজ!
পাতার উড়োজাহাজে ভেসে দেখে যাও—

এই কালো শরীর ছাড়া আর কিছুই পাবে না।



প্রেমেতে মজিয়া মন 

প্রেমেতে মজিয়া মন—গেছে দেখো দূর কোনো বনে, আমারে রাখিও পুরে আগুনের খামে। ভেতরে পাতার অক্ষর সাজায়ে রাখিও বেণীর কাতারে। তখনো সোনালি মাঠ—ধান কাটা হয় নাই কাস্তের ধারে। আকাশে জমায়ে রাখো চোখের অশ্রু ওই মেঘ সরোবরে। 

পাহাড়ে সূর্য যখন ওঠে ওই জংলার ওপাশে, তখনো ঘুমায়ে থাকো মিহি মিহি তুলার ওপরে। যে আমারে রেখেছে মনে হৃদয়ের কুসুম বাগানে; তারেও বলেছি আমি চুল শুকাও রোদের ঝিলিকে... আমারে ছাড়িয়া তুমি যেয়ো নাকো কোকিলা পাখি—ময়না ও মুনিয়া বলে আমি শুধু তোমারে ডাকি।

ধান কাটা হয় নাই দেখো ওই সোনালি মাঠে—মাদুলি হারায়ে গেছে জলহীন প্রেমের ঘাটে। এত কেন খোঁজাখুঁজি? পাখি-টাখি নাই বুঝি আর; সে বুঝি উড়িয়া গেছে গারো ওই পাহাড়ের ওপার...    

 


আগামবার্তা

উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ, রোগ-শোক
সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবে—চোখ
মুখাবয়বজুড়ে ফুটে উঠবে অস্থির রেখা
আর নাভিতে জমবে ধুলো—মাকড়সার জাল
অস্ত্রোপচারের ছুরিতে পাওয়া যাবে মরচের দেখা।

জন্ম-মৃত্যু, হাহাকার-হতাশা, লোভ-লালসা
সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসবে অসংখ্য—ঠোঁট
আর সমস্ত প্রকৃতিজুড়ে ফুটে উঠবে বিভীষিকা
লাফ দেবে অণু-পরমাণু, মুনকির-নকির
পৃথিবীর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে আগুনের হলকা...



একটি লেবু

বাগানে লুকিয়ে আছে থোকা থোকা লেবু 
বাতাসে নড়ছে পাতা আর কাঁটায় বিঁধে আছে
তোমার লেবুগন্ধী সবুজ শেমিজ
যেন ভারে ভারে গাছগুলো মুষড়ে পড়েছে।

সোনামুখী সুঁই তুমি কি লেবুর নিকটে যাও?
বিড়াল পায়ে ঝড়ো ঝড়ো রাতে তাকে পাও
তোমার অধীনে; আর ঝরে যাবার আগে
লিখে ফেলো বাদামি দিনের জলজকাহিনি...

একটি লেবু—ভেবে দেখো
সমস্ত গাছের প্রতিনিধিত্ব করে।



ঘোষিকার টিপ

যা কিছু খোলা ছিল— ঢেকে ফেলা হলো
হরিণের মাংস দিয়ে তরা খেয়েছিল মদ
অরণ্য মাথায় তুলে—
সুন্দরবনে নেচেছিল বানরের দল...

ওরা খুব হেসেছিল—
যখন সংবাদ শিরোনামে
খসে পড়েছিল ঘোষিকার টিপ!



মাথা

মাথা ঘুরতে ঘুরতে মানুষ হয়ে যায়!

পাষাণ জলের ওপর ভাসমান হাঁড়ি—
ভেতরে কাটা মাথা—ধড়হীন, রক্তহীন
আবছায়া অন্ধকারে ঝোপঝাড় ঠেলে—
হাঁড়ি ঘুরতে ঘুরতে মানুষ হয়ে যায়!

ছোপ ছোপ কোনো রক্তের দাগ নেই
পাষাণ জলের ওপর ভাসমান—
কোথাও কোনো ধড় নেই; শুধু মাথা
ঘূর্ণায়মান জলে—ঘুরছে...

মাথা ঘুরছে শুধু মাথাই ঘুরছে...



বায়নাসূত্রে

বায়নাসূত্রে জমির মালিক তুমি হতে পারো 
বুনতে পারো বীজ—ফলাতে পারো ফসল
গুনিন দ্বারা বন্দক করতে পারো সীমানা প্রাচীর।
হয়তো তৈরি করতে পারো সুউচ্চ আলিশান বাড়ি 
ছিমছাম কারুকাজে থাকতে পারো আরাম আয়েশে।
বাড়ির চারপাশে লাগাতে পারো বিলাসী গাছ—
ফুলের সৌরভ নিয়ে জোছনা নামাতে পারো ঘরের ভেতর।
যেহেতু বায়নাসূত্রে জমির মালিক তুমি—
তাই যা কিছু ইচ্ছে করতে পারো...
মালিকানায় নিতে পারো সুদর্শন হরিণ
আপেল কেটে টুকরো করে সাজাতে পারো নাস্তার টেবিল 
প্রসাধনের ছোঁয়ায় ত্বক করে তুলতে পারো সজীব।

ভেবে দেখো বায়নার বিপরীতে তুমি
ধরে রাখতে পারো না নিজের শরীর...



ক্র্যাচের বেদনা 

দেখো রিকশায় হুড তুলে সবুজ যাচ্ছে
সবুজ মানে কিছু গাছ—লতাপাতাসহ
দেখো অটোতে লাল লাল আগুন যাচ্ছে
আগুন মানে লু হাওয়ার বলকানো ঝাঁঝ...

দেখো মাথার উপরে ছাদ—কংক্রিটের;
আর পায়ের নিচে চকচকে টাইলস
দেখো ফ্রিজভর্তি হিম হিম ঘুমের বাতাসা
স্পিরিট গন্ধে ছোট ছোট সাবু দানা...

দূরে কোথাও কৃত্রিম অরণ্যে পড়ে আছে
একজোড়া ক্র্যাচের বেদনা...



হনন

শিকার প্রস্তুত।

দৌড়াচ্ছে বাঘ...
জলে মাছ টেনে নিচ্ছে ছিপ।

চেয়ে চেয়ে দেখছে—
মহাশয় গোপাল প্রদীপ!

দিন হারানো মানুষ

দিন হারানো মানুষ
রাতকে কাছে পেয়ে 
ডাকিনির গোপন মন্ত্রে 
ডেকে আনে ভোরের কুসুম
আর বিভোর ও বিহ্বলভাবে
কুড়িয়ে নেয় আলোর জোনাকি—
দিন হারানো ভয় তাকে তাড়া দেয়
অন্ধকারের গোপন গুহায়
তার স্বপ্নগ্রস্ত চোখ দেখেনি
শিশিরে জমাটবাঁধা ঝরনা প্রপাত...

বহুপরে সেই দিন হারানো মানুষ
রাতকে কাছে পেয়ে
প্রগাঢ় আলিঙ্গন করে
আঁধার ও আলেয়ায়—
আর দুচোখ মেলে দেখে
অনতিদূরে সূর্যালোক
ঢেকে আছে কুয়াশায়!






পাথরের চোখ

পাথরের চোখ— অশ্রু পড়ে না, দুঃখ ঝরে না
গাবগাছের নিচে জালবোনা দিনে কুড়িয়ে আনি
কিছু নিমপাতা রঙের মনের ময়না!
পাথরের চোখ শুধু চেয়ে থাকে, পলক পড়ে না...

অনেক নিশুতিরাতে যখন হরিণশিশু লুকিয়ে থাকে
বনের ভেতর আর খাঁ খাঁ প্রান্তরজুড়ে শোনা যায় না
কোনো শুকনো পাতার মর্মর—
ডানা ঝেড়ে বিরহীঘুঘু ফেলে যায় ছোট্ট পালক
তখন অরণ্যময় জেগে ওঠে প্রাচীন বেদনা...

পাথরের চোখ শুধু চেয়ে থাকে, পলক পড়ে না

এদিকে মৎস্যশিশুর অভিমানী ঠোঁটে বাড়ছে ক্ষরণের ঢেউ
কালোরাতে জোছনার জাল পেতে বসে আছে চাঁদ
সমুদ্র নেচেছে তার উড়িয়ে শীতল বাতাস
মোহনায় এসে নদীরা ফেলছে দীর্ঘশ্বাস—
এত সুদূর বসন্তে কেন তবে কোকিল ডাকে না

পাথরের চোখ শুধু চেয়ে থাকে—
কেন তার অশ্রু পড়ে না, দুঃখ ঝরে না...




কৃষ্ণ বুকের চাতালে 

কুয়াশার শাড়ি পরে বসে আছে দূরের সবুজ
কে এসে খুলে নেবে ঘোমটার ভাঁজ
ভেতরে অঢেল জোনাকি স্রোতের ইশকুল
নামতার মতো ফোটে মহুয়ার ফুল।

হাতের রেখার মতো জেগে আছে ঘাসপত্র
আর রেখাচিত্র আঁকা দেখো পাথরের গুহায়
প্রযত্নে সবুজ রেখে বিলি করো পাতাঝরা দিন
কৃষ্ণ বুকের চাতালে জমছে প্রণয়ের বীজ...

কে তাকে পরাবে নিষেধের বেড়ি?
শেকলে বাঁধবে তার প্রাণের তাবিজ!

রোজ এসে ফিরে যায় পাখিডাকা বিকেলের রোদ
মরাবৃক্ষে লেগে থাকে সবুজের ওম—
দোয়েলের ঠোঁটে ভাসে অবিনাশী শিস
তাক করে আছে কোন শিকারির তীর?

কুয়াশার শাড়ি পরে বসে আছে দূরের সবুজ
কপালে দিয়েছে এক ছোট লাল টিপ।



প্রান্তের কোকিল

নিঝুম গ্রামের মতো কে তুমি হাতছানি দাও
নিশ্বাসের মতো যাওয়া-আসা এই বায়ু প্রবাহে
দেখো জমা করছে মনের ইথারে সহস্র বাসনা...
আর আমি মাটির ব্যাংকে জমিয়ে রাখছি স্বপ্নের কুসুম।

ওই পাহারাদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে এইমাত্র
যে ঘুঘুটি উড়ে গিয়ে বসলো দূরের ডালে
আর করুণ ও মধুর সুরে ডাকলো যে ডাক
যেন বুকের ছাতি ফেটে ঝরে পড়লো অঢেল বেদনা...

যদি কোনোদিন বর্ষার আগে গভীর নিশ্বাসে
সেই নিঝুম গ্রামের মতো কেউ হাতছানি দিতো
তবে অদৃশ্য খাঁচা ছেড়ে এক লহমায় উড়ে যেত
দূর প্রান্তের পোড়খাওয়া আহত কোকিল...



পাখি ও বিমান

পাখিদের রানওয়ে থেকে পালক ঝরছে
দুহাত পেতে কুড়িয়ে নিচ্ছি—
গুঁজে রাখছি কানের পাশে; বান্ধবীর খোঁপায়।

পেটভর্তি যাত্রী নিয়ে উড়ছে বিমান
বিমানের রানওয়েতে ঝরছে পালক
আর ঝরে ঝরে পড়ছে নিচের দিকে
সদ্য পেতে রাখা দুহাতের তালুতে...

কে জানতো পাখি ও বিমান—
একই রানওয়েতে উড়ছিল সেদিন!



নীল সাইকেল

মাটিপথ কাদাপানি মাড়িয়ে
আলো ঝলমল সিল্করোডে—
ভিড়-ভাট্টা, বাস-ট্রাক, রিকশার ফাঁক গলে
চলতেই থাকে—ঘুরতেই থাকে...

মাঝে মাঝে বিষণ্ন বাড়িফেরা রাতে 
কিংবা পাখিডাকা আলো ফোটা ভোরে
আমার ক্লান্তিহীন বন্ধু ঘূর্ণায়মান চাকা
ঘুরতেই থাকে—চলতেই থাকে...

গোলাপ-প্রিয় প্রেমিকার মতো—
আমি বন্ধু ভাবি তাকে।



লোককাহিনি

রাতকে বলি রাত্রি জেগে মেঘ নামিও না 
ওই মেঘগুলো এসে জমা হয় চোখের কার্নিশে!
দেখো না সমুদ্র কেমন গর্জন তুলে—
কাঁপিয়ে দেয় পাড়ের শরীর...

তুমি কোনোদিন অশরীরী হয়ো না।

লোককাহিনি থেকে উঠে এসে—
অযথাই ভয় দেখিও না।



চিতাকাঠ ছাই হয়
আমাকে পোড়াবে তুমি জলহীনা পতঙ্গহৃদয়
হাওয়ার ঘূর্ণিতে আমি পেতে রাখি ফাঁদ
আর কানে গুঁজে রাখি সমূহবিনাশ
শুধু শুধু পোড়াতে এসে নিজে হবে ছাই!

দহনে দাহ হয়ে কেঁপে ওঠে ঠোঁট
স্মৃতির রুমাল থেকে সুতা ছিঁড়ে—
এই অবারিত সবুজ প্রান্তরে কেন
সাজালে তুমি চন্দনের চিতাকাঠ?

মনে রেখো ও জলহীনা পতঙ্গহৃদয়
ফিনিক্স স্বভাবে আমি বারবার—
পোড়াতে থাকি নিজেরই হৃদয়
চিতাকাঠ ছাই হয়; পড়ে থাকে শুধু সংশয়।



চরকিপথ

চরকির মতো ঘুরে ঘুরে উপরে উঠছি
উপর মানে সিঁড়ি ঘোরানো চিলতে ছাদ—
উপরে তার জেগে আছে একাকিনী চাঁদ;
জোছনার বন্যায় কেটে গেছে প্লাবনের মেঘ।

বহুদূর সবুজ মাঠ—তারো দূর রেলগাড়ি পথ
সেই পথে পড়ে আছে ধুলোমাখা দিন...

চরকির মতো ঘুরে ঘুরে নিচে নামছি
নিচে মানে একাকিনী চাঁদ দেখে—
সিঁড়ি ঘোরানো পথে নামছে দু’পা
সঙ্গে তার পায়ের আওয়াজ...

খুব কাছে বিলবোর্ড—তারো কাছে বহুতল ছাদ
সেই ছাদে জেগে থাকে একাকিনী চাঁদ...



কন্যার প্রতি

নক্ষত্রের চামচ মুখে জন্মাও নি কন্যা আমার
এমনকি পিতলের চামচ মুখেও না!
বাজারের অতসব দামি জামার বদলে
দিয়েছি তোমাকে পাতার পোশাক!

আহা কন্যা আমার!
লিচুফুলের মধুটুকু ওর মুখে তুলে দাও এবার।

যখন তুমি খুলেছো চোখ পৃথিবীর মায়ায়
বাণিজ্যের বাতাস পাক খেতে খেতে
ছুঁয়েছে শহরের উঁচু মিনার—
আর অক্ষমতার দড়ি ঝুলিয়ে গলার ভেতর
মরাঘাসে দাঁড়িয়ে রয়েছি অপার!

আহা কন্যা আমার!
লিচুফুলের মধুটুকু ওর মুখে তুলে দাও এবার।

চাঁদের কুসুমিত পথে হেঁটে যাও তুমি—
বেড়ে ওঠো মাটি—ঘাস—তৃণের ভেতর
ঝরাফুল কুড়িয়ে বানাও গহনা তোমার
ঝলমলে ঐশ্বর্যগুলো চোখে মেখো না।

আহা কন্যা আমার! জেনে রেখো—
তোমার পিতা ছিল শুধু অক্ষরের দাস। 



খুব বেশি নিকটে এসে

খুব বেশি নদীর নিকটে যাই
খুব বেশি গাছের নিকটে যাই
নতজানু হতে হতে নক্ষত্র মেখে
খুব বেশি মানুষের নিকটে যাই...

যখন বৃষ্টিকাতর সন্ধ্যাগুলো
রাতের গভীরে যেতে যেতে
কুসুম হবার অপেক্ষায় থাকে—
আয়নায় নিজেকে দেখে দেখে
খুব বেশি তোমার নিকটে যাই!

দেখো এই হাতের তালুতে
কোনো ভাগ্যরেখা নেই—
কপালেও নেই কোনো 
জোছনামাখা ভাগ্যলিপিকা...

চাঁদকে সঙ্গে করে নিকটে এসে 
দেখি দূরত্বের অনাগত রেখা
ফণা তুলে ছড়িয়েছে বিষ—
তাই খুব বেশি নিকটে গেলে 
সমান দূরত্ব ধেয়ে আসে খুব...



জামা

তাকিয়ে থেকে নড়ছে-চড়ছে
হাত উঁচিয়ে ডাকার ভঙ্গিতে 
নানা কসরত চালিয়ে যাচ্ছে—
যেন শরীর সে; অশরীরী হয়ে
আমারই ঘরে ভয় দেখাচ্ছে!

আলো-আঁধারে সারাঘরে
হেঁটে হেঁটে চৌকাঠ ডিঙিয়ে
হঠাৎ ঢুকছে—হঠাৎ বেরুচ্ছে
মাথা ও শরীরবিহীন—
নড়ছে-চড়ছে ভৌতিক জামা...






মধুগ্রাম

পায়ে পায়ে মধু লেগে থাকে
রূপপুরের ঘাটে। এ গ্রামে রমণীরা
বাঁশফুল খোঁপায় গোঁজে আর
মাটি দিয়ে চুল ধুয়ে রাখে!
সেই এক প্রাচীন মহুয়াবাগানে
অন্নদাসুন্দরী একা একা হাঁটে।

প্রাসাদে পাহারা নেই। প্রজা সব
রাজা হয়ে বেচাকেনা করে।
দূর ওই মাঠে—আলিফ লাইলার
টি-শার্ট পরে কাকতাড়ুয়া হাসে।

এ গ্রামে মধু, ঠোঁটে নয়—
পায়ে লেগে থাকে!



গল্পাংশ

তোমার কোনো গল্পে যিশু হাঁটেন না।

আমি হাঁটি। আমার কৃষিগন্ধা হাত—
ছুঁয়ে আসে—তোমার মাটিমগ্ন মৌনতা।

হয়তো পাতার জাহাজ জলহীন স্রোতে
ফ্রেমে আটক ছবির মতো ধূসর—
বহু প্রাচীন কোনো জাদুর বাক্স
মেলে ধরছে কিছু বাজির খেলা... 

তুমি মৌন—নির্বিকার—স্থীর—
চোখের কোণে এক ফোঁটা জল
তাপ ও হাওয়ায়—রেখা হয়ে
ফুটে থাকে লতা ও পাতায়!

অনেকটা পথ হেঁটে এসে আমরা—
বসি। যিশু বসেন। মৃদু হাসেন।

তোমার ধ্যান ও ধারণায় আমি
নতুন কোনো গল্প হয়ে যাই...



বসন্তসূত্রে 

মেয়েটি এখন প্রজাপতি। দেয়ালজুড়ে
ছড়িয়েছে চোখ—মেঘদৃষ্টির রেখা
পাখি হবার বাসনা নিয়ে বসন্তসূত্রের
ধরেছে হাত। গভীর রাতে ফুল হয়ে
ফুটেছে কোনো শীতের বাগানে!

হাওয়ার সান্ধ্য-বিকেলে—নদীতীরে
সূর্যকে ধরে ঢুকিয়েছে ব্যাগের ভেতর 
আর নদীচিত্রে এঁকেছে ঢেউয়ের হাসি—
রঙে রঙে রাঙিয়েছে তার আকাশপথ;
মেয়েটি হেসেছে আর চোখ ভরেছে জলে।

কুণ্ডলী পাকানো কুয়াশায় ফুঁ দিয়ে—
মেয়েটি পাড়ি দিচ্ছে দীর্ঘ মিলনের পথ... 



অন্ধত্ব

অন্ধকার প্রতিমার সামনে দাঁড়াই।
চশমার ফ্রেম মুছে রাখি পাতার ওপর—
অনেক শুকনো পাতা; যায় বসন্তদিন।
পাথরে পাখির কণ্ঠে কথা ফোটানোর আগে
আলোবিনাশী প্রবণতা ছুঁয়ে যায়—
কাঠ-কয়লার তামাটে শরীর...

কে আমাকে আজ দাঁড় করিয়েছে—
শ্মশানের মতো নীরব এই ভিটের ওপর!
সামনে আঁধারপ্রতিমা—
আলোর বিপরীতে আত্মহননের পথ...

উপড়ানো চোখ হাতে নিয়ে—
কার সামনে দাঁড়াবো এখন!



দূতিকা

নগ্ন হওয়ার আগে পোশাক পরতে হয়!

কাঁকরপথে বিছিয়ে রেখে লাল মার্বেল
ইতিহাসে ভিজিয়ে রাখি হাতপাখা ঘুম...

দূরের বাঁকে জেগে আছে কচুপাতায়— 
শিশিরকণা—সাপের ফণা—লুডুর পাতা...

বায়োস্কোপের সকল ফুটো বন্ধ রেখে
দৃশ্য যদি ডেকে আনে দুধমাখা ভয়!

পোশাক পরার আগে নগ্ন হতে হয়!




অনুচিন্তা 

টেবিল-বাতির আলো জ্বালিয়ে রাখো
সারা রাত্রিময়—গোলাপ জলের গন্ধ
থেকে থেকে বুকের কাছে বয়—
হাওয়ার ভেতর তুমিই লুকিয়ে থাকো।

দূরের কোনো ভাঙাচোরা হাটের
পায়ে পায়ে ধুলোওড়া বিকেল
চুপি চুপি তোমার কাছে গেলে
হালকা করে কেন সরিয়ে রাখো!

মনে মনে বাগান করা ভালো
চারাগাছে ফুটুক কিছু ফুল
শীতের মতো তুমিও বুঝি ফের
ঘুরে-ফিরে এক ঋতুতে আসো।



ভ্রম

চুল দেখলেই চিরুনি এগিয়ে আসে 
যেমন তিল দেখলেই তাল ভেবে 
অনেকেই ছড়িয়ে দেন গুজবের হাট!
এক অন্ধ ধীবরের হাতে লেগেছিল
মৎস্যগন্ধা ভোরের নদীর জল—
সেই জল ও জালের ফাঁদে কাঁদে
বেহুলার নদীবাসী গোপন হৃদয়...

কাজল এঁকে দেয় চোখের নিচে
হারানো কোনো রাত্রির আঁধার
একা একা ঝিঁঝিডাকা বিন্দুর মতো
শুয়ে থাকে দূর অরণ্যের পথ...

তাল ভেবে তিল দেখে অনেকেই— 
কপালে লাগিয়ে দেন রূপের তিলক।



কৃষ্ণের জ্বর হলে 

লৌকিক রাধা এসে ঘুরে গেছেন পার্বতীপুর!

সে এক প্রাচীন বট—ঝুরি দিয়ে বিছিয়েছে পথ
চোখবন্ধ অন্ধকারে ধাওয়া করে মোহনীয় সুর...
অসংখ্য প্রাণকণা সাপের লকলকে জিহ্বার মতো
নিশ্বাসের বায়ুজুড়ে খেলা করে বুকের ভেতর।

পাথরের প্রেম গেছে—দেহভর্তি যমুনার জলে
দেখো—কার সুরে কে নাচে সুদূর মাধবনগরে!
শত বছরের প্রত্নরাত ঘুম পাড়ে শাড়ির আঁচলে
কী মায়া বয়ে যায় যোজন হৃদয়ে-হৃদয়ে...

কৃষ্ণের জ্বর হলে রাধা পোড়ে শীতের আগুনে!




বিন্দু-পাথর

ও প্রাচীন ট্রাক, তোমার চাকায় পিষ্ট করো আমার মস্তক...
গুণটানা দুপুরগুলো হারিয়ে যাবার আগে বলেছে এ কথা!

নদীতীরে জলতরঙ্গে যখন এসেছিল সূর্য গড়ানো রোদ
দেবীও প্রতিমা হয়ে বালুচরে ছড়িয়ে যায় মিলনের ডাক...

কৃষ্ণের রথের বিপরীতে দাঁড়িয়েছিল এ কালের বিন্দু-পাথর!



শীতকালে নদীকূলে

গভীর কুয়াশা আমি চোখে পুষে রাখি—
প্রজাপতির পাখায় লিখি যাপনের ভার
তোমাদের হরিৎবাগানে জেগে থাকে চাঁদ—
হাত নেড়ে ডেকে আনে পাথরের যুগ। 

বিলবোর্ড ভিজে গেলে বোকা বোকা লাগে—
শিশিরে লেপটে যায় মডেলের গাল; নাকউঁচু
ভবনের জানালার কাচজুড়ে ফুটে ওঠে টুকরো 
বিষাদ; দরোজায় আঁচড় কাটে হারানো বিড়াল!

দেখো গভীর কুয়াশা আমি চোখে পুষে রাখি—
শীতকালে নদীকূলে তাই কোনো ভণিতা করি না।



অন্ধ বিড়াল 

অন্ধ বিড়াল এসে প্রতিদিন দুধ খেয়ে যায়
এ-বাড়ি ও-বাড়ি হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত দুপুরে
ডুমুর গাছের নিচে চুপ করে বসে থাকে
অনুমানে গন্ধ শুঁকে শুঁকে মাথা নাড়ায়।

দিনের আলোয় ঝকমকে সূর্যের রোদে
অথবা রাতের বেলায় ঘুটঘুটে অন্ধকারে
ঝড়-বৃষ্টি প্রহারের ভয় ছাপিয়ে বিড়াল—
গৃহিণী রাখেন যে দুধ—সেখানে যায়।

শুনেছি বুড়ো এক লোক আমাদের পাড়ায়
রেখে গিয়েছিল শাদা এই জন্মান্ধ বিড়াল
কোনো কারণে দুধ কমে গেলে সকলে বলে—
অন্ধ বিড়াল এসে প্রতিদিন দুধ খেয়ে যায়!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।