....

সীমা শামীমা’র একগুচ্ছ কবিতা


সরাইখানা 

সরাব ভর্তি জোনাকি রাত নিয়ে নেমে এলে বাতাবীর ঘ্রাণ
বাতাসে বুনে জোছনার ফুল সরাইখানা জেগে উঠে
আফিমের বনে তুলটমেঘ রজনীগন্ধা চোখে মেলে দেয় রাত।
ঘুঙুর ভাঙে সুর, সুরা হাতে সাকি, নীল নীল নক্ষত্রের মাঝে একা চাঁদ,

বোধ ও বিবিধ ভুলে মুসাফির।

সোনালি পাতাদের উল্লাসে ভেঙে যায় রাত
মুঠির সবটুকু লাল ছড়ায় উদয়ে।
ইতিহাসের নিস্তব্ধ বলয়ে জমা পড়ে আরো এক মহাকাল।

নির্ঘুম রাত্রিরা হেঁটে যায় আঁধারের খোসা ফেলে
কিছু ঘুুমচোখ উড়ে যায়
ভোর ডাকা পাখিদের মিছিল

২০/৩/২০১৮


প্রেম ও প্রতারণা

গাছের কাছে গেলে খুব সহজেই বুঝি ওদের ভাষা ;
পাতা ছুঁলেই বুঝা যায় ওদের শ্বাসকষ্ট নাকি প্রসূতিকাল!
মিনচোখে তাকালে বুঝে নিতে পারি মাছের ভাষা ও বসন্তকাল
শালিকের চোখে তাকালে পড়ে নিতে পারি ওদের বিরহ বা বাসা বাঁধার তাড়া!
দোয়েল ঘুঘু চিল এমনকি শকুনের ভাষাও পড়ে নিতে পারি ওদের চোখে তাকালেই!
একইভাবে কুকুর বিড়াল গরু সিংহ বাঘ, জগতের সমস্ত পশুর ভাষা লিখা থাকে চোখে, শরীরে ;
এমনকি সাপের ভাষাও সহজপাঠ্য! লিখা থাকে চোখে, জিভে!
শুধু বুঝিনা মানুষের ভাষা! কেন যেন মানুষগুলো অন্যরকম! বদলে যায় অকারণ!
যে চোখে ধরে প্রেম, সে চোখেই প্রতারণ!


বিস্মৃতি

কোথাও নড়েচড়ে ওঠে ছায়া দেবাক্ষ অভিমান,
হাওয়ার তুমুলে জাগে দেবালয়, পর্ণমোচী গানে কুয়াশার সেতার।
প্রবীন সন্ধ্যা, বাসন-ভাঙা চাঁদের মতো হেলে থাকে পুরানো চাতাল, কিশোরী চাঁদের আলোয় বাজে বিস্মৃত ঘুঙুর, নাচের মুদ্রায় বশীভূত অপ্সরী পা, ধূপছায়া শরীর, রুদ্র নৃত্যে জাগে পূর্বজন্মের শোক, আবছায় সহচর । স্মৃতি-বিস্মৃতির ধোঁয়ায় মূর্ত হয় বিমূর্ত কায়া, গতসঙ্গ প্রীতম , ঝড় হয়ে আসে সম্মোহিত পুরুষ, প্রাচীন বিগ্রহ ভেঙে, স্থির হয় ছায়ার বিপরীতে ! ধ্যান ভাঙে রাতের তমসা, জন্মান্তর প্রেমিকের ঘ্রাণে!


জড়তা ভাঙা নাগপঞ্চমী রাতে জাগে কামিনীগন্ধা প্রেম,নিভৃত আলাপন ; সন্তপর্ণে মেলে আঙুলের ভাঁজ, হাতের তালুতে আঁকা পূর্বজন্মের নাগ ! ললাট জুড়ে ঠিকরে পড়া আলোর বিচ্ছুরণ, দৃষ্টিতে লেখা নবজন্মের উপাখ্যান , বিগত প্রণয়ের।


সমীকরণ

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কলা'য় জন্ম নেয়া ক্ষোভ ও ঘৃণা বেড়ে যাচ্ছে
গাণিতিক হারে!
ক্রমান্বয়ে সরে যাওয়া পায়ের তলার মাটি
গড়েছে উইপোকার ঢিবি। শত সুরঙ্গ তবু ভিতরটা অন্ধকার, নিরবে
খেয়ে নেয় আয়ু। ঘুণে খাওয়া নড়বড়ে খুঁটিতে মজবুত বেড়া দিয়ে
পতন আটকে রাখার চেষ্টায় হেসে উঠে নিম্নচাপ। সমবেত সুরে
গাইছে ভাঙনের গান, ধ্বংসের দামামা বাজে দ্রিমিক দ্রিমিক দ্রাম দ্রাম!
অট্টহাসিতে ফেটে যায় স্বর!
রে পাতক! রে পামর!
এই বুঝি ছিঁড়ে গেল তার,
হাহাকার, হাহা কার সমীকরণ ৩ঃ৬।

ছলে, মিথ্যায়, অন্যায়ে,পাপে অর্জিত ক্ষমতা আর সম্পদের পাহাড়, পড়েই রইল
বারো ভূতে লুটেপুটে খাবে এবার!

২৫/৩/'১৯


সোঁদাগন্ধ

বৃষ্টি নামলেই জলরঙে ভেসে আসে মাটির সোঁদা গন্ধ!
চোখ বুজে তার স্বাদ নেই শুঁকে--
আমার এত ভাললাগে! এত ভাললাগে!
মনে হয় মিশে যাই তার বুকে!

হয়তো অদূর আগামীতে, আমার হাড়, মাংস,নখ, চুল, দেহ
হবে এ ঘ্রাণের দাবীদার।
যেদিন থাকবো না, থাকবো না, এ পৃথিবীর 'পরে আর।
আমায় মনে রাখবেনা, মনে রাখবেনা এ পৃথিবীর কেহ
সেদিন এ সোঁদা গন্ধের শ্বাসে, মিশে আমি হব একাকার!

২/২/১৮


মনখারাপের রাত

কোন কোন মনখারাপ খুব একা হয়
সিটকে পড়া ট্রেনের বগির মতো আনএটেন্ডেট,
অন্ধকার খসে পড়ে স্মৃতির আরশিতে---
দৃষ্টিহীন কুয়াশার মত বিছিয়ে থাকা এলোপাথাড়ি ভালবাসা ডিঙিয়ে যায় বেদনার ঘাসফুল,
না সময় না কোন পথভোলা নক্ষত্র,কেউ তাকে ছুঁয়ে দেখেনা।

১৮/৭/১৭


পানপাত্রে ডুবে যাওয়া রাত

পানপাত্রে ডুবে যায় রাত, ভেসে উঠে প্রিয়তমার প্রেমোময় মুখ
পৃথিবী হেসে উঠে এক নিষিদ্ধ গন্দমে ; তুচ্ছ হয় গত-বিগত সমস্ত বন্ধন।
চুমুকে পৌঁছে যায় স্বর্গের চূড়ান্ত শিখরে অত:পর
রাত ভোর হলে নেশা ছুটে যায়, শরীর বন্দী হয় এক মৃত বন্ধনে, সংসারে!
নিত্যই ঘটিবাটির টুংটাং,  ভালবাসার খতিয়ান, খসড়া উপস্থাপন!
এখন রঙিন বোতলে আর প্রেম আসেনা,ঝাঁজালো স্বাদে তেতে উঠে কণ্ঠনালী
একজন তরকারীতে লবন দিতে ভুলে গেলে অন্যজন খুলে নেয় খোঁপার গোলাপ ;
হায়!সেই ভালবাসা আজ কেবলই অভিশাপ!
এঁটো হয় পুরানো পানপাত্র, ভালবাসা খুঁজে নতুন জলাধার।
আলগা হয় ভালবাসার রঙ, ফুরায় প্রেম
ভুলে যায় কে ছিল কার আফ্রোদিতি, কে ছিল শ্যাম।

খাবার টেবিলে সাজানো ডিনার অপেক্ষায় থাকে কখনো ঝড়,কখনোবা ভালবাসা প্রহসনের।
সমুদ্রকে মনেহয় চোখের কোণে জমে উঠা একবিন্দু জল
পৃথিবী যেন এক অগ্নিকুণ্ড!

৭/১২/'১৭ 


একজন পতিতা যখন আমার মা

মা দৈনিক সাত রাক্ষসের সঙ্গম শেষে
ঘুমিয়ে পড়তেন স্লিপিং পিল বা ড্রাগসের ভিতর
আর কোন এক কালঘুমে আমি ঢুকে পড়ি মায়ের ভিতর।

বারোবনিতাদের মাতৃত্ব থাকতে নেই,
কিন্তু আমার মায়ের ছিল।
সমাজের সব আবর্জনা নিজের গায়ে মেখে,
মা আমায় রেখেছিলেন এক শুভ্রচাদরে।
তবু ওঁৎ পেতে থাকা শকুনের নখরে, শৈশবেই
ফালি ফালি হলো সে চাদর।
তখনো সে কষ্টের নাম জানিনি,তারও বহুপর
যখন জানলাম, তখন বুঝেছিলাম, মুখবুজে মা'কে প্রতিদিন
কতটা আগুন গিলতে হয়। শুধু সেই কষ্টেই কেঁদেছিলাম গোটাদিন।

তবু মায়ের পুণ্য বেঁচা কড়িতে আমি গুটি গুটি হেঁটে গেলাম আলোর জানালায়!
মা'র স্বপ্ন ছিল অনেক বড়, আয়ুটা ছিল নিতান্ত কম।
একটাই চাওয়া ছিল মা'র, তার মতো আমাকে যেন শরীরে আগুন পোষতে নাহয়!
আমি যেন হই সাহেববাড়ির বউ।

 মরে গিয়ে তুমি ভালই করেছ মা!সেই সুখ নিয়ে তুমি স্বর্গে থেকো।

পতিতার মেয়েকে কোন সাহেব বিয়ে করে না!

২৮/১০/১৭

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ