....

রাশা নোয়েল এর কবিতা | দিব্যক




পরিত্যক্ত গাছগুলির উদ্দেশ্যে


কবিতার অলৌকিক ভাষা দেখি, কাব্যের গভীরে

নিজের কিছু স্বীকৃতি আছে কিনা- সেসবও এখন পাঠযোগ্য চিন্তা। এই স্মারকবেদী

ঘেরাও করে রাখি: 'চিরদিন তুমি যে আমার' শীর্ষক সিনেমার কথা মনে পড়ে। 

আহ্লাদী, এইরূপ প্রশ্ন করো, বলো

আমাদের যা কিছু চলে গেছে, সেকাল থেকে একালে ট্রান্সফার হয়ে আসা 

ব্যক্তিগত কীবোর্ড, 

ধীরগতির 

ইন্টারনেট

সংযোগ, 

প্রান্তিক কৃষকদের সহায়তায় ফলানো ধানের লে-আউট চোখে পড়ে? 


বিবিধ উপাদানে সমৃদ্ধ - এই কথা বারবার লেখা হয়ে গেছে। বহু পুরাতন 

আদিম ও প্রাগুক্ত তথ্যাদি বিচার-বিশ্লেষণসমেত একটি কালোত্তীর্ণ 

(কি যে লিখি- হিজিবিজি), পাঠ করে আনন্দ পাবার বদলে

আরো জঘন্য ঠেকে, ব্যাকগ্রাউন্ডে 

কারা যেনো বিমূর্ত ক্রিস্টাল থুয়ে রেখেছে। শালারা। 


তদা উপভোগ করি। লিখবার জন্যে উন্মুক্ত যেহেতু রাখা আছে সব,

(যদিও বিরক্তিকর) টেলিভিশন এবং ফিল্মের ফেক-ফালতু

ভেকধারী পড়াশোনা। কবিতার কাছে আসি 

জানাই প্রার্থনা, নামাজ, চড়-থাপ্পড়

প্রশ্ন করি, তোমাদের মতবিরোধ দিয়ে

আমার কিছু ছেঁড়া যায়? চাইলে দু'চারটি যৌন-বিকৃত শব্দ জুড়ে দেই-

সিগারেট খাওয়া থেকে বিরত রাখি ব্রাজিলিয়ান ঘোড়াদের। ফলত: 


নিজের ভাঁড়ারে অদ্ভুত সম্পাদনা হয় পঁয়ত্রিশ মিলিমিটার।

তাজ্জবমার্কা কাজকারবার দেখে বুদ্ধ সেজে থাকি। অথচ 

বাইরে বাড়তে থাকে পৃথিবীর তাপ

বিদ্যুৎ ছিনতাই হয়ে যায়, না খেয়ে থাকা

মুগ্ধ রেকুনের


আশ্চর্য জাদুকরী খিদে ধরা পড়ে জিভে-নখে। 




আমাদের জন্মসংক্রান্ত


এসো, এইরূপ প্ররোচনায় ক্রমশ লিপ্ত হই যে-

আমরা আমাদের দিকে এগোবো, আর 

চিন্তা করবো কীভাবে নিজেদের সাথে

নানাবিধ প্রেমের তৎপরতা চালানো যায়। 

ফলত: আমাদের বিড়ম্বনাসমূহ একটি 

ক্লান্তিকর অনুবর্তন লাভ করবে। 


এসো, আমরা নিজেদের ন্যারেটিভ নিয়ে বসি

দেখি- কোথাও কোনো খুঁত পাওয়া যায় কি না (যার দ্বারা স্টোরিটেলিংয়ে 

মল্লযুদ্ধ সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থেকে যায়)

দৃশ্যনির্মাণের বেলায় আমরা আড়ষ্ট না হয়ে স্বতঃস্ফূর্ত চিল্লাচিল্লি করবো।

আর্টিস্টদের বাধ্য করবো সালসা নাচতে। সংগীতায়োজনের বেলায় 

কর্তব্যরত চিকিৎসককে আমরা কিছু বেশি টাকা দিতে পারি, যেন- তিনি দু'দিন ঘুমোতে না পারেন। 

প্রণয়-নিবেদনের সময় আমরা মুখ চেপে ধরে হাসতেও পারি- এই ভেবে:

হিরো-হিরোইন চুমু খাওয়া শেখেনি। ঠোঁটের বিবিধ ম্যানার দেখে 

আমরা ওটাকে পুরোদস্তুর বেয়াদব বলে অভিহিত করতেও পারি। 

এসো, আমরা কারুকে ধরে বসিয়ে দিই সামনে

এবং বলি- তোমাদের এইসব সময়ের আবির্ভাব হওয়ার দরুন 

এখন প্রচুর সমতলভূমি গড়ে উঠছে। ধ্বংস হচ্ছে উঁচু আবাসস্থল। মানুষের 

বাসস্থানের পার্থক্য তৈরি হওয়ার অর্থ রুচি-আচারের

ডাইভার্সিফিকেশন। 


অর্থ উৎপাদন হওয়া ব্যতীত 

এবং

আলোচনার উপাদান কমে যাওয়ার কারণসমূহ তৈরি হবার কারণে 

সম্পর্কযুক্ত মানুষের পরস্পর প্রতিবিম্ব বিপরীতধর্মী। 




পরিণত সময়ের নামলিপি


ঘাসের দেশের সবুজ, দ্বীপ সে যখন দেখে দারুচিনি চোখের ভিতর 

অমনি বুনোলতা পৃথিবীর নদী-নালা-খাল

আস্বাদিত হয়ে হয়ে হতে পারে বড় সরোবর 

তেমনি মানুষ চিনি, জ্যামিতির বহুকৌণিক জ্ঞান

অর্জিত হয়ে আছে, এ বিশদ আলাপকালে 

তথ্যের পুনর্ব্যবহার আমাদের নানাবিধ কাজে

ধীরে ধীরে পরিণত নাকি? 


হাড়ের-রক্তের গলি চেনা থাকে যদি

সহজেই ঢুকে পড়া- পড়া- পড়াশোনা হতে পারে, হয়ে দেখি যায়-

বিবিধ উপাদান বয়ে টেনে নিয়ে যাবে এই ভরসায়

শরীরের তাপমাত্রা আচমকা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। 

এ কেমন অনল? ঘুম-স্বপ্নে গ্রাস করে তনু

এরূপ আগেকার কথা লিপিবদ্ধ থাকে

শতবর্ষে পদার্পণ কখনো করেনি জীবানু? 


নিখুঁত শব্দোচ্চারণ এই: সুস্পষ্ট ইঙ্গিতসহযোগে 

কাব্যের কাহিনিবিস্তার ঘটমান বর্তমানে বর্ণনা করবার জন্য কতিপয় গাছপালা প্রয়োজন

অনুরূপে নিজেদের ভাবনা মূলত দেখি- 

করে আছে তারা আয়োজন

 

অস্থির প্রমাদহীন স্নিগ্ধ করপুটে। 


আমাদের ভেতর-নদের শুষ্ক আবাসন 

নির্মাণপ্রকল্পের অধীন ভেকতুল্য ত্বকে

লুপ্তপ্রায় সভ্যতার বিচলিত ভাবনার মেদ

যুক্ত-বিযুক্ত এক দীর্ঘকায় গোঁজামিল ছকে


সহজেই বিষম দাঁড়ায়। 


এরচেয়ে ভালো, বিপরীত দ্বীপে চলে যাই

ক্লান্তপ্রাণ সে এক, জগতের ধূসর অশোক-রোগ

দেহে দেখা দিক, এরচেয়ে ভালো

কোনো মাছের সাথে হোক যোগাযোগ


তথ্যের পুনর্বণ্টন পরিণত হোক, শুভ হোক। 




জেনিটাল


সকল ফুলের ভেতর এইরূপ ঘ্রাণ

গভীরে মুকুর থাকে, পুকুরের পাড়

ঘেঁষে চ'লে গেছে আজকের মাছ

তাকে যদি দেখো তবে লিখে দিও এই পরিমাণ


মজুদ রাখতে হবে আসন্ন সময়ে:


সময়ের কাঁধে দেখি ঝুলে আছে ভূত

নাপাক বস্ত্র পরে বেজে থাকে দেহ 

সতত প্রচেষ্টা খুব, চালানোও যায় 

পেস্টের নাম করে নিষিদ্ধ তুঁত 


নিষিদ্ধ তুঁত শুধু মাছেদের চোখে

থলির মধ্যে থাকে বিপন্ন জাল 

ভাতের ডালের সাথে তাহাদের দেখা 

কদাচিৎ মেলে-মেশে কামুক বেড়াল




কাব্যরূপ


ভাষার একপ্রকার কোষে 

দীর্ঘদেহী কতিপয় নালিকার তৎপরতা দেখা যায়। 

আমাদের বৃহত্তম সৃষ্টির মাধ্যম এই: 

অপরিপক্ক ফলফলাদি খায়টায় কেউ, 

কেউ যায় পাহাড়ি রাস্তায়, ভীষণ 

গ্রীষ্মওয়ালা কোনো শীতকাল দেখে

কেউ কেউ বসন্তের প্রথম ভোরের নিয়তে

নামাজ-পূজা ইত্যাদি করে। 

তবু আমাদের বৃহত্তম সৃষ্টির মাধ্যম একই থাকে। তিল পরিমাণ কমেডি ধাঁচের 

এইরূপ পড়াশোনা সেইম। 


ভাষার একপ্রকার কোষে 

দীর্ঘদেহী কতিপয় নালিকার তৎপরতা শুরু হলে

মানুষ জানতে পারে পৃথিবীর সন্দেহজনক কাব্যরূপ। 




গ্রুনফেল্ড


সামাজিক মেলামেশা এই: সর্বৈব

মানুষকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়ে গেছে

অসংখ্য, অগুনতি কবি। রাফ বৈচিত্র্যময়,

কলমের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভে

কবিতার সুচতুর দাবাড়ু হবার আগে

একজন কবি-র শব্দের পর শব্দের গ্রুনফেল্ড ডিফেন্স

বিস্মিত করে নিতান্ত পৃথিবীকে৷ চৌষট্টি ঘর সাজিয়ে

পরখ করে দেখা যেতে পারে তার মানবীয় নমুনা৷

এদের মধ্যে প্রকৃতি ব্যতীত আর কোনো ব্যতিক্রমী কিছু চিন্তার সন্নিবেশ নেই।

একজন মানুষ নেক থাকতে থাকতে শয়তান হয়ে উঠতে পারে

একজন কবি, শয়তান বেল্লিক থেকে দ্রুত হয়ে যায় কবিতার সুচতুর দাবাড়ু।

এই আমূল পরিবর্তন শোভা বর্ধন করে প্রকৃতির।

শেষতক সামাজিক মেলামেশার অভ্যাসটা আমৃত্যু সরব রাখে মস্তিষ্কের আয়োজন।




বিক্ষোভের মত, প্রিয়


পার্টির বিপক্ষে যারা গেছে, তাদের চেনা হয়ে গেছে কমরেড। এরা পরিচিত মুখ, তবুও

তুমি অভিযোগ করতে পারো- এদের বিরুদ্ধে কোনোপ্রকার 

মল্লযুদ্ধে যাওয়া হয়নি কেন, তা নিয়ে। 

তোমার প্রশ্ন থাকতে পারে- 

নানাবিধ 

অভিমান থাকতে পারে- কেন এরা (বিশেষত এইসব দুর্যোগের সময়ে) হুট করে

ভিড়ে গেল ভিন্ন দলে

কেন ভিন্ন গোত্রে ভাগ হয়ে গিয়ে এরা শুরু করলো আদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই- 


আদর্শ কি? তোমার কাছে 

আমি চাইলেই প্রশ্ন রাখতে পারি এবং তোমাকে উন্মুক্ত মঞ্চে 

ডেকে এনে হারিয়ে দিতে পারি কথার তেজস্ক্রিয়ায় 

তুমি অত দ্রুত ক্ষেপে যেওনা কমরেড, আদর্শের প্রশ্নে 

আমাদের অনেকেই পাশ করতে পারেনি, 

কেউ কেউ উৎরে গেছে হয়তো, 

অথবা

কেউ কেউ টুকিটাকি মারণাস্ত্রের জোরে 

হেঁটে চলে যেতে পেরেছে নরম গদির দিকে


তুমি ইতিহাসের দিকে তাকাও কমরেড, সময় কারুকে ছাড় দেয় না। 

আমাদের প্রচন্ড ব্যক্তিগত সময়েও

আমরা সারারাত জেগে

পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে 

মল চত্বর

হাকিম চত্বর 

অমর একুশে 

টিএসসি 

এবং এমনকি

ভিসির বাড়ির সামনেও গ্রাফিতি করে এসেছি 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে 

পাশাপাশি বসে ক্লাস করা আমাদের বন্ধুরা আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসেছে

আমাদের ঘৃণা করেছে

আমাদের প্রেমিকাদের শরীর নিয়ে করেছে বীভৎস ফ্যান্টাসি। 

তারা আমাদের দিকে থুথুও ছুঁড়েছে, বলেছে- আমরা বখে যাওয়া, রাত জেগে নেশা করা এবং 

রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্ত অন্ধের দল। 


ওরা আমাদের ওপর হামলাও করেছে, আমাদের অনশনে ওরা ঢিল ছুঁড়েছে, 

আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে খাবার খেয়েছে। তবু, 


আমরা ক্ষুধা চেপে রেখেও আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিলাম। 

আমরা রাত জেগে নেশা করিনি কমরেড, 

বরং 

আমরা একে অপরকে তিলাওয়াত করে শুনিয়েছিলাম হো চি মিন, লেনিন, মলয়

নেরুদা এবং সুনীল

আমরা গলা ছেড়ে গান গেয়েছিলাম, 

তখন বৃষ্টি পড়ছিলো, আমরা ভিজে যাচ্ছিলাম

রোদ সূর্যের কাছে ফিরে গেলে:

আমরা বিকেল দেখতে বের হয়েছিলাম একসাথে

একসাথে আমরা চাঁদের আলোও পান করেছিলাম, রুদ্র পড়তে পড়তে

আমরা মাঝেমাঝে চেঁচিয়ে উঠতাম 'ভালো আছি, ভালো থেকো' বলে

হেমন্তের সকালে আমাদের সহযোদ্ধাদের কয়েকজন মরে যায়, আমরা কাঁদিনি 

শ্লোকের মত কবিতা আউড়াতে আউড়াতে আমরা তাদেরকে দাফন করতে গিয়েছিলাম হাসিমুখে।


শীতকাল এলে আমরা একই চাদর ভাগাভাগি করে নিজেদের দিয়েছি উষ্ণতা 

একই সিগারেট আমরা পাঁচজনে মিলে টেনেছি

একই বালিশ পালাক্রমে গিয়েছে বিভিন্ন মাথার নিচে

আমাদের মেয়ে বন্ধুদের আমরা গল্প শুনিয়েছি, তাদের বলেছি নিশ্চিন্ত থাকবার জন্যে


মীরা পছন্দ করতো বিষ্ণু দে, মাঝেমাঝে নিকোলাই গোগোলও 

তাকে বলেছি- অনন্ত নক্ষত্রদের জন্মপ্রক্রিয়া, ধ্বসে যাওয়া, অস্তগামী সূর্যের কাছে ঋণী একটি চাঁদের কথা- 

বলেছি সুদিনের কথা, ভালোবাসার কথা, প্রেমের কথা কিংবা আন্দোলন পরবর্তী সংসারের কথা- 

আমরা তো শেষ হয়ে যাইনি এখনো কমরেড 

আমাদের শরীরে স্যালাইনের বিকট হুংকার আমাদের করেছে সংকীর্ণ 

আমাদের পাকস্থলী ছোট হয়ে গেলেও 

আমরা জোরালো কণ্ঠে বলতে পারবো: আমাদের সাহস এখনও শুকিয়ে যায়নি

কারো হুমকিতে আমরা তখুনি পালিয়ে যাইনি, কারো বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজে

আমরা দলছুট হবার বদলে আরো জড়ো হয়ে একে অপরের বুকের সাথে মিশে গিয়েছিলাম


আমরা মূলত একটি সাবলীল ডাকসু চেয়েছিলাম।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ