[ কবি আহমেদ মওদুদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮১ খিস্টাব্দে। মহিন্দ্রাফতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আফানউল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে মাহিগঞ্জ কলেজ ও কারমাইকেল কলেজে একাডেমিক পাঠের সমাপ্তি ঘটে। পেশাঃ শিক্ষকতা। কাজ করছেন লিটলম্যাগ বিন্দুর সাথে।
প্রধানত কবিতা, গদ্য, কিশোর উপন্যাস লিখেন। বাংলাদেশে লিটলম্যাগের অন্যতম এই যোদ্ধার একটি সাক্ষাৎকার নেবার উদ্দেশ্যে আমরা তাঁকে ই-মেইলে প্রশ্নগুচ্ছ পাঠিয়েছিলাম। ২৮ আগস্ট ২০১৯ তারিখে তিনি যে উত্তরমালা পাঠিয়েছে, তা হুবহু প্রকাশ করা হলো। আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। -সম্পাদক। ]
সা ক্ষা ৎ কা র
❑❑
প্রশ্ন
ছোট বেলায় কী হতে চাইতেন? মানে ‘এইম ইন লাইফ, রচনায় কী লিখেছেন, তা নয়; বরং মনের ভেতরে সুপ্ত বাসনা ছিলো কি কোন কিছু হবার জন্য?
আহমেদ মওদুদ
আমার ছোট বেলা মূলত বিস্তীর্ণ ধানের মাঠে ছুটোছু্িট করে, গম ক্ষেতের পাখি তাড়িয়ে, শিমুলের ফুল কুড়িয়ে আর দাদার পুরনো জঙ্গলবাড়ির পাখ-পাখালি দেখেই কেটে গেছে। যেমন কাটে আমার পাঁচ বছরের ছেলের এখন। ছোট বেলায় নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিলো না। আর ছোটদের মধ্য দিয়ে বড়রাই মূলত তাদের স্বপ্নগুলো প্রতিফলিত করার চেষ্টা করে। যারা বড়েেদর কাছে বশ মানে তারা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বা আমলা-টামলা হয়ে যায়। আর যারা মানে না তারা কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী নয়তো রাজনীতিবিদ হয়ে যায়। অথবা অন্যকোন স্বাধীন পেশায় চলে যায়। তবে ছোট বেলায় সম্ভবত আইসক্রিমওয়ালা বা হাওয়াইমিঠাইওয়ালা হতে চাইতাম।
প্রশ্ন
একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষসত্তা কে কী ভাবে ব্যাখ্যা করেন?
আহমেদ মওদুদ
লেখকের কথা না হয় বাদই দিলাম, একজন মানুষকে আমরা সাধারনত কীভাবে দেখতে চাই বা একজন মানুষের কাছে সোসাইটি কী প্রত্যাশা করে? প্রত্যাশা করে মনুষত্ব এবং মানবিকতা। অর্থাৎ যার দ্বারা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, দ্বিধাবিভক্ত হবে না। সোসাইটি একজন লেখককে সমাজের আর দশজন মানুষের চেয়ে উচু স্তরের ভেবে থাকে। তো সোসাইটির এই ভাবনা বা প্রত্যাশাকে পূরনের দায় কিন্ত লেখকের থেকেই যায়। তবে যে লেখক সমকালে যে ধরনের রোল প্লে করবে ইতিহাস তাকে সেভাবেই মূল্যায়ন করবে। উদাহরন স্বরুপ বঙ্কিম চন্দ্র এবং বিদ্যাসাগরের কথা বলা যায়। দুজনই লেখক অথচ ইতিহাস প্রথম জনকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং দ্বিতীয় জনকে প্রগতিশীল হিসেবে চিহ্নিত করে।
আহমেদ মওদুদের কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ। |
প্রশ্ন
জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানের জীবন সম্পর্কে আপনার অনুভুতি কী?
আহমেদ মওদুদ
জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানের জীবনটা মূলত বেহালার সুরের মতো। যা কীনা অন্যকে আনন্দ দানের জন্য বেজে চলে অথচ সুরের অন্তর্গত ভাবটা হলো বেদানার।
প্রশ্ন
লেখার ক্ষেত্রে আপনার কোনও প্রেরণার জায়গা আছে কি?
আহমেদ মওদুদ
প্রেরনার জায়গাটা একেক সময় একেক রকম ছিল। এখন যেমন লিটলম্যাগাজিন আর ওয়েবজিন। অর্থাৎ এই যে কিছু লিটলম্যাগ আর ওয়েবজিন আমার কবিতা ছাপছে, সাক্ষাৎকার ছাপছে, এটাই মূলত প্রেরণার জায়গা। এই যেমন, একজন সম্পাদক কয়েকদিন আগে কবিতা চাইলেন। তখন মনে হলো তাহলে তো নতুন কবিতা লেখা দরকার।
প্রশ্ন
বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের অলোচনা-সমালোচনা চর্চা কতটা গঠনমূলক হচ্ছে?
আহমেদ মওদুদ
তরুণদের মধ্যে কেউ কেউ সমালোচনা- সাহিত্যের চর্চার একটা ক্ষেত্র তৈরি করার চেষ্টা করছে। সম্ভবত আমাদেরকে আরো অপেক্ষা করতে হবে সাহিত্যের গঠনমুলক আলোচনা-সমালোচনার চর্চার জন্য।
প্রশ্ন
‘কবিতায় ছন্দ, প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?
আহমেদ মওদুদ
ছন্দের ব্যকরণ মেনে কবিতা লেখার বিষয়টা ধীরে ধীরে লোপ পেতে শুরু করেছে । আসলে কবিতার প্রয়োজনেই ছন্দ, ছন্দের প্রোয়োজনে কবিতা না। ভাষা যখন গতিশীল তখন ছন্দ তার গতানুগতিক চরিত্র নিয়ে কবিতার ভাব আর ভাষার সাথে তাল মেলাতে অপারগ হয়ে পড়ছে। তবে হৃদয়গ্রাহ্য প্রতিটি কবিতারই অর্ন্তগত সুর আর ছন্দ রয়েছে। এই সুর আর ছন্দ হয়েতো ব্যাকরণ মেনে চলছে না তবে কবিতার ভাব আর ভাষাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সৃষ্টি করে চলছে।
প্রশ্ন
ছোট বেলায় কি লেখালিখি করতেন?
আহমেদ মওদুদ
সপ্তম শ্রেনীতে পড়ার সময় টুকটাক লিখতে শুরু করি। ওসবের কিছু কিছু স্থানীয় দৈনিকের শিশুদের পাতায় প্রকাশ পায় তখন। সময়েই মূলত আমার লেখালেখির হাতেখড়ি।
প্রশ্ন
লিখতে কেমন লাগে?
আহমেদ মওদুদ
লিখতে তো ভালোই লাগে যদি লেখার পরিবেশ পাই। তবে বৃটিশ-বঙ্গে লেখার পরিবেশ দলিল লেখক আর দালাল লেখকদের জন্য যতটা অনুকূল, সৃজনশীল লেখকদের জন্য ততটাই প্রতিকূল।
প্রশ্ন
আপনি কী ধরনের বই পড়তে পছন্দ করেন?
আহমেদ মওদুদ
বই, সেটা যে ধরনেরই হোক না কেন, পড়তে ভালো লাগে। তবে বই পড়ার আগে লেখকের জীবনী বা লেখক পরিচিতি পড়াটা আমার পুরনো অভ্যাস। এক্ষেত্রে বই আর আগাছার পার্থক্যটা দ্রুত করা যায়।
প্রশ্ন
এখন কোন বইটা পড়ছেন?
আহমেদ মওদুদ
গোলাম মুরশিদ সম্পাদিত প্রবন্ধের বই ‘বিদ্যাসাগর’ পড়ছি এখন।
প্রশ্ন
আপনি বারবার পড়েন, এমন কবির নাম জানতে চাই।
আহমেদ মওদুদ
আমি বারবার মূলত আহমেদ মওদুদের কবিতাই পড়ি। কারণ অন্য কোনও কবির কবিতা পড়ার পর আমি সেগুলো সংশোধনের অধিকার রাখি না বা সে সুযোগ আমাকে দেওয়া হয় না। অতএব আমার বহুল পঠিত কবির নাম আহমেদ মওদুদ।
প্রশ্ন
বর্তমান সময়ের কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলেন। কবির কি পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিত?
আহমেদ মওদুদ
কবিতার বিরুদ্ধে বরাবরই এই অভিযোগ ছিল। কিন্তু অ-কবিতার বিরুদ্ধে কখেনোই এই অভিযোগ ছিল না। যারা এ ধরনের অভিযোগ করে থাকে তাদেরকে আমি ছড়া পড়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। কারণ ছড়ার ভাষা সহজ সরল আর সুপাঠ্য। আর শিশুকালে আমরা ছাড়কেও কবিতা বলেই জানতাম। পাঠক থাকলে পাঠকের রুচির বিষয়টিও থাকে। কিন্তু যেখানে পাঠকই নেই সেখানে রুচির প্রশ্নটি আবান্তর। যে দেশ ঘুষখোর, সুদখোর, ধর্ষক আর দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্য, সে দেশ কবির না। পাঠক তো আরো পরের বিষয়। তবে গল্প উপন্যাসের কিছু পাঠক এখনো রয়েছে আর উপন্যাসিক তার পাঠকের রুচি বা বাজারের কথা মাথায় রেখে যতটা সম্ভব আপোষ করার কথা ভাবতে পারেন। কিন্তু কবি মাত্রই আপোষহীন। কী কবিতা, কী জীবন, কোথাও তিনি আপোষ করতে পারেন না। আর কবি কখনও কখনও আপোষ করলেও কবিতার কিন্তু আপোষকামীতা পছন্দ না। ফলে যশপ্রার্থী কেউ কেউ কবি উপাধিটা বয়ে বেড়ালেও আপোষকামিতার কারণে কবিতা কিন্তু তাদেরকে ছেড়ে চলে যায় এবং এদের দেহাবসানের পাশাপাশি কবি উপাধিটারও অবসান ঘটে। এছাড়া কবি যদি তার নিজের চোখ দিয়ে না দেখে পাঠকের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন তবে সেই কবির সৃষ্টি নিম্নমানের হতে বাধ্য। কারন পাঠক যতোই সচেতন বা দূরদর্শী হোক না কেন কবির দূরর্শনের কাছে তা নিতান্তই শিশু পদবাচ্য। অর্থ্যাৎ এখানে পাঠককে যদি আমরা ভোক্তা শ্রেণির মধ্যে ফেলে থাকি তাহলে ভোক্তার রুচির বিষয়টি বিবেচনার দায়িত্ব পড়ে ব্যবসায়ীর। কিন্তু কবি তো ব্যবসায়ী না।
প্রশ্ন
লেখা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে অন্তর্জালকে কীভাবে দেখছেন?
আহমেদ মওদুদ
লেখা প্রকাশের জন্য অর্ন্তজাল অনেক বড় একটি মাধ্যম। আমার কাছে এটাকে পজিটিভ মনে হয় এবং আমাদের উচিৎ এর সুবিধাটা গ্রহণ করা।
প্রশ্ন
আপনার কি বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে?
আহমেদ মওদুদ
আমি মার্কসের দর্শনে বিশ্বসী এবং মনে করি, মানুষের প্রকৃত মুক্তির দিশা এই দর্শনেই রয়েছে। যারা মার্কসবাদী রাজনীতির সাথে যুক্ত তাদের প্রতি আমার পুরোপুরো সমর্থন রয়েছে।
প্রশ্ন
আপনি কি এক বসায় কবিতা লেখেন, না কি বারবার সংশোধন করেন?
আহমেদ মওদুদ
এক বসায় কবিতা লিখলেও কয়েক বসায় তা সংশোধন করে থাকি। আবার এমনও হয়েছে একটি কবিতা পুরোপুরি লিখতেই এক সপ্তাহ কেটে গেছে। অর্থাৎ একদিন দু’লাইন লিখে রেখে দিয়েছি আবার পরের দিন লিখছি পরের দু’লাইন।
প্রশ্ন
আপনার প্রেমের কবিতাগুলো কি কল্পনাসৃষ্ট না কি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ?
আহমেদ মওদুদ
ইনিয়ে বিনিয়ে আপনি মূলত আমার প্রেমের খোঁজ খবরই নিতে চাচ্ছেন। মূলত গত দশ বছরে একটাও গতানুগতিক প্রেমের কবিতা লেখা হয়নি। তার আগে লেখা প্রেমের কবিতাগুলো অবশ্য অভিজ্ঞতালব্ধ।
প্রশ্ন
লিটল ম্যাগাজিনগুলি সাহিত্য বিকাশে কী গুরুত্ব বহন করে?
আহমেদ মওদুদ
সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। যে কোন কিছুর বিকাশের জন্য নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দেয়। লিটলম্যাগাজিনেও চলে সাহিত্যের নানান নিরীক্ষা। এগুলোকে সাহিত্যের গবেষণাগারও বলা যেতে পারে। কারন এখানে নতুন লেখক যেমন তার স্পর্ধার স্ফুরণ ঘটানোর সুযোগ পায় তেমনি নিরীক্ষাপ্রবণ লেখকের নিরীক্ষাধর্মী লেখাটিও ধারন করে লিটলম্যাগাজিন। ফলে সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে লিটলম্যাগাজিনের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন
আপনি দিনের কোন সময়টাতে লিখতে পছন্দ করেন? কোনো রুটিন আছে কি এ ব্যাপারে?
আহমেদ মওদুদ
এ ব্যাপারে কোন রুটিন নেই। অবসর পেলে দিনের যে কোন সময়েই লিখে থাকি। তবে এখন অবসর পাওয়াটাই মুশকিল। কারণ আনন্দপাঠ নামে শিশুদের একটা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকার কারনে প্রচুর পরিশ্রম এবং গবেষণা করতে হয়। এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে আমরা মূলত শিশুদের শৈশব ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যাই হোক লেখালেখির বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও রুটিন নেই।
দিব্যককে ধন্যবাদ সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য।
প্রকাশিত বই:
(কবিতা)
দেহের আড়ালে থাকে প্রকৃত স্বজন (ফেব্রুয়ারী ২০০৯ মাটিয়াল)
দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানের খন্ডচিত্র (মার্চ ২০০২, বাঙ্ময়)
দুঃস্বপ্নের চিরস্থায়ী বাগানে (জানুয়ারী ২০১৮, বাঙ্ময়)
(কিশোর উপন্যাস)
কিশোর (ফেব্রুয়ারী ২০০৭, নিসর্গ)
কবি (ফেব্রুয়ারী ২০১৭, বাঙ্ময়)
(গবেষনা)
রংপুরের লোক লোকছড়া (এপ্রিল ২০১৭, বাঙ্ময়)
প্রকাশিতব্য :
(জীবনী গ্রন্থ) ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
নোট: আহমেদ মওদুদদের বক্তব্য সম্বলিত ছবিগুলো তানজিন তামান্না সম্পাদিত অনলাইন লিটলম্যাগ ওয়াকিং ডিসট্যান্স এর সৌজন্যে।
6 মন্তব্যসমূহ
মওদুদ ভাই ভালোবাসা।
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা,সোয়েব ভাই।
মুছুনবন্ধুবর আহমেদ মওদুদ-এর সাক্ষাৎকার পড়ে অনেকদিন পর ওর সাক্ষাৎ পেলাম।
উত্তরমুছুনতার আনন্দ পাঠ-এর আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হোক।
দীর্ঘস্থায়ী হোক।
মুছুন"হৃদয়গ্রাহ্য প্রতিটি কবিতারই অর্ন্তগত সুর আর ছন্দ রয়েছে। "
উত্তরমুছুনবেশ লাগলো সাক্ষাৎকারটা।
"হৃদয়গ্রাহ্য প্রতিটি কবিতারই অর্ন্তগত সুর আর ছন্দ রয়েছে। "
উত্তরমুছুনবেশ লাগলো সাক্ষাৎকারটা।
অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।