....

পাণ্ডুলিপি থেকে : মায়ের কবরের মতো আমি একা / অরণ্য আপন

 



শুক্রবারের মেয়ে 

তাকে ভাবতে ভাবতে সে খোদা হয়ে গেছে
আমার কি দোষ মাবুদ 
তার সেজদায় পড়লে মাটির ঘ্রাণ বেড়ে যায়
সে মন থেকে মন্দির হয়ে গেছে 
সে হাসি দিয়ে আমার জীবনকে মদিনা করেছে 
সলতে তে তেল নেই
তারমধ্যে হাওয়ার বড় তেজ 
তার ওপরে নজর পড়লে মাবুদ
চোখ সরাতে পারি না 
আমি যে অত বড় ঈমানদার নই 

সে এক পাখি যেখানেই বসুক
চাই সেটা আকাশের ঢাল হোক অথবা গাছের ডাল হোক
মনে হয় আমার হৃদয়ে বসেছে

খামারকান্দি,  বগুড়া




ঠান্ডা রোদ

সারাজীবন নিজের ছায়ায় হেঁটে চলা মানুষ আমি
রাস্তায় যৎসামান্য যে রোদ কুড়ে পেয়েছি
তা সূর্য থেকে খসে পড়া ময়লা
এই রোদের ছায়া আমার
গাছের ছায়া আমি পাইনি 
সংসারেও থাকতে পারিনি, বনেও যেতে পারিনি 
জুতোর মধ্যে শুধু আমার পা থাকে না, আমার মাথাও থাকে
পায়েমাথায় জুতা পরা মানুষ আমি
আমি কিছু দেখতে চাইনে, শুনতে চাইনে 
শুধু চলতে চাই 
চলতে চলতে একদিন নিজের ছায়ায় পড়ে মরে যাব
আমি মরে গেলে আমার প্রেমিকা দেখতে আসবে
তাকে আমার গায়ে থাকা ঠান্ডা রোদ দিয়ে দিও
বেঁচে থাকতে তো তাকে কিছু দিতে পারিনি

খামারকান্দি, বগুড়া




পাশাপাশি 

পাশাপাশি থাকা দুটো গাছের চেয়ে পাশাপাশি থাকা দুটো রিকশা বেশি কথা বলে
তাদের চেয়েও বেশি কথা বলে পাশাপাশি থাকা দুটো বোবা কবর 
কে কাকে ছেড়ে এল
প্রতিদিন চলে সেই খবর 
পাশাপাশি থাকা দুটো দেশের সীমানা সব চেয়ে কম কথা বলে
একজন হাসে তো আরেকজন ভাসে জলে
তাদের চেয়েও কম কথা বলে পাশাপাশি থাকা দুটো মানুষ 
যাদের কেউ কারও ভালোবাসা হয়ে ওঠেনি 
যারা চোখ খুললে দেখে একজনকে
যারা মন খুললে দেখে অন্যজনকে 
পাশাপাশি থাকা দুটো গাছে আলাদা ফুল ধরতেই পারে আপন! 
পাশাপাশি থাকা দুটো মনে আলাদা মানুষ ধরতে পারে না, পারে না।

খামারকান্দি, বগুড়া 




গুনতে পারি না দেখে তুমি খোদা 

আমি বরাবরই অংকে কাঁচা ছিলাম 
কিছুই হাতে গুনে, আঙুলের রেখায় গুনে শেষ করতে পারিনি
স্কুলের রাস্তায় দাঁড়ান গাছ গুনে শেষ করতে পারিনি
বাড়ির পুকুরের জলবোনা হাঁস গুনে শেষ করতে পারিনি
গুনতে ধরলেই আমার খালি ভুল হয়ে যায়
গুনতে পারি না বলেই আমার কাছে খোদা একজন 
আর দেবতা তেত্রিশ কোটি 
আম্মা যে কতদিক থেকে আমাকে দেখতেন! 
আজও বলতে পারি না আম্মার চোখ কতগুলি ছিল 
রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ গুনতাম
মাঝেমধ্যে মানুষের মধ্যে কুকুর ঢুকে যেত আমি বুঝতেই পারতাম না 
আমাদের গ্রামে প্রথম ইটের বাড়ি ছিল আমাদের
ঘোড়ার গাড়িতে করে ইটে এসেছিল, আমি একদিনও দেয়ালের ইট গুনে শেষ করতে পারিনি 
গুনতে ধরলেই চোখ হারিয়ে বসতাম, দেয়াল জুড়ে চোখ খুঁজতে হত আমাকে 

আকাশে চাঁদ তারা গুনা সহজ
দিন মাস বছর গুনার মতোই সহজ
কিন্তু একাকিত্ব গুনা কি সহজ?
একাকিত্বে কত কি যে হারিয়েছি! গুনে শেষ করতে পারব না 
দুঃখ, সেও কি গুনা যায়? 

প্রজাপতির পেছনে দৌড়াতে  দৌড়াতে,  ফড়িং ধরতে ধরতে 
পায়ে পায়ে সন্ধ্যা বেরিয়ে পড়লে গুনতে হয়
আমাকে নিয়ে আব্বার স্বপ্ন, আম্মার স্বপ্ন, বোনের হাউস
বইয়ে রাখা স্বপ্ন 
ছেঁড়া পকেটে রাখা ওয়াদা
সাইকেলে রাখা চিঠি
রাস্তায় রাখা ছোটোবেলা গুনা কি সম্ভব? কতটুকু আর গুনা যায়!  

স্কুল ঘরের বেঞ্চ, মেডামের শাড়ির ফুল কোনোদিন আমি গুনে শেষ করতে পারিনি
কেন জানি গুনতে ধরলেই আমার খালি ভুল হয়ে যায় 
ভালোবাসা আর বন্ধুত্ব গুনতে যেও না, গুনতে গেলেই কমে যাবে 
কখনও চুমু বাদ পড়বে, কখনও চুমু বেশি পড়বে

এক সাহিত্য বিশারদ পুছ করেছিল, জুহিতার ফুল কয়টি? 
বললাম, দুইটি
খোঁপাও একটা ফুল, বাদ দিলে কেন? নাকের ফুলে তো তোমার বিশ্বাস নেই 
আমি এভাবেই গুনতে গুনতে ভুল করে বসি 
পেচ্ছাপের ফোঁটা কখনই গুনে শেষ করতে পারিনি 
নচ্ছার একটা 
গুনতে নিলেই টপটপ করে পড়তে শুরু করত 

ছোটোবেলায় বাড়িতে ভাইবোনদের মধ্যে আমের মুকুল গননার খেলা হত
আমি কখনই সে-ই খেলায় জিততে পারিনি 
এত হুলো হুলো পেঁপে তবু আমার গুনতে ভুল হত

আমার গুনাতে যত ভয়, আমার খারাপ লাগে না যে কেউ আমাকে গোনায় ধরে না 
গুনলেই মানুষ বিশ্রি একটা  সংখ্যা হয়ে যায় 
জুহিতা আমাকে গুনে গুনে শূন্য করেছে, সে এখন শূন্যের পাশে বসতে পারে না। 

খামারকান্দি, বগুড়া




ক্যাকটাস 

একটা মেয়ের ক্যাকটাস হওয়ার স্বপ্ন 
সে দেখতে চায় যে কে তাকে কাঁটার আঘাতের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আলিঙ্গন করে 
একদিন মেয়েটার স্বপ্ন সত্য হল
মেয়েটা ক্যাকটাস হয়ে গেল
তারপর থেকে সে একা 

খামারকান্দি,  বগুড়া




পঁচাত্তর 

বুদ্ধিজীবি খুনিরা খুব ভয়ংকর হয় 
তাদের বুদ্ধি বড় গুলি 
তাদের একটা দুর্বল দিকও আছে 
তারা বেছে বেছে এমন লোকের মাথার খুলিতে গুলি করে
যারা দেশ নিয়ে চিন্তা করে
যদি বুলেটের গর্ত থেকে তাদের চিন্তা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে 
তারা ভয় করে

খামারকান্দি,  বগুড়া 




আম্মা

জান্নাতের কথা বলো না, জান্নাত তো মায়ের পায়ের সমান
আমি তো খোদার কাছে পেয়েছি জান্নাতের চেয়ে বড় বাগান

খামারকান্দি, বগুড়া 




কাক

কিছু কথা গোপনেই সুবাস ছড়াক
কিছু স্বপ্ন চোখেই সেজে থাক
যখন কেউ মন দেখার কেউ থাকে না 
হাতটা একাই পড়ে থাক 
হৃদয় থেকে যখন মানুষ চলে যায়
চোখ থেকেও চলে যাক
জানালার পাশের গাছটা বন্ধ্যা কর না 
গোলাপটা গাছেই থাক 
কেউ যখন বাড়িতে নেই
কাকই ডেকে যাক

খামারকান্দি, বগুড়া




তসলিমার শাড়ি

একাকিত্বের শাড়ি খুলে পড়ে আছ সেজদার মতো
একাকিত্বের কাসার বাসনে খাবার নেই
জীবন কেঁদেকেটে ঘরের বাইরে গেছে
তুমি শাড়ির ভিতর নামাজ পড়ে যাচ্ছ
মানুষ ঘর তুলে একাকিত্ব ঢাকে
সংসারের থালায় বুকের কান্না রাখে

তোমার বুকের ওড়নাটা মিথ্যে, ওটা খুলে রেখ
তোমার ঘামের শরীর, গন্ধফুল
আমাকে ফুল কুড়াতে দিও
তোমার পায়ের আঙুলগুলি তোমার শরীরের চিঠি, পড়তে দিও
আমি ফুল কুড়ানো মানুষ, চিঠি খোলা মানুষ 
তোমার শাড়ি গন্ধের অভিমান
তোমার বাড়ি প্রেমিকের আসমান

তোমার শাড়ির লাল পাড়ের হসেন্ত পেরিয়ে যাব
কূয়োর উঠতি বয়সি ফেনা বাতাসে শ্বাস নেবে 
ঢেকি মাথা তুলবে, ঢেকি মাথা নামাবে রুকুর মতো 
তোমার বয়সের বর্ণমালা ধরে টান দেব, তুমি পেটিকোটের কষির মতো আলগা হয়ে যাবে 
কলাপাতার শাড়ি খুলে যাবে জলের বুননে
একাকিত্ব ক্লান্ত হয়ে উঠছে শাড়ির ভাঁজ গুনে গুনে 

আঙুলে আঙুলে আকাশ খুলে রেখেছি 
তুমি বয়সের ঝাপ খুলে 
বাঁশপাতার মতো দুলে 
ঝাপ দাও না! 

আমি তোমার শাড়ির কাছে ভিড় জমাব 
আমি তোমাকে তেলাওয়াত করব, মদ গুন্না, মাখরাজ খসাব 
তোমার বুকের ওড়নাটা মিথ্যে, ওটা খুলে রাখ 
আমার একাকিত্ব আর কোথাও জায়গা না পেয়ে 
তোমার শাড়িতে ঢুকে পড়ছে 
আমি তোমার শাড়ির কাছে ভিড় জমাব।

খামারকান্দি, বগুড়া




নির্মলেন্দু গুণের প্রেমিকা 

তুমি কি আমাকে ভালোবাস? 
হ্যাঁ 
অনেক?
হ্যাঁ, অনেক বেশি
আমি বলতে চাচ্ছি বেশি কত? 
সে দুই দিকে দুই হাত প্রসারিত করে দেখাল
তখন থেকেই জানতে পারলাম যে দশ অাঙুল দিয়ে মানুষ বিষ বানায় 

তুমি কি আমাকে ভালোবাস?
হ্যাঁ 
সত্য বলছ?
হ্যাঁ 
কয় সত্য? 
সে চোখ বন্ধ করে বলল তিন সত্য
তখন থেকেই জানতে পারলাম যে মিথ্যে বলার সময় মানুষ চোখ বন্ধ করে নয়তো মন বন্ধ করে

খামারকান্দি,  বগুড়া 




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

অস্বাভাবিক মন্তব্যের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়।